উত্তরাখণ্ডে ট্রেক

মৃণাল মণ্ডল


~ কেদারনাথ যাত্রার আরও ছবি ~

~ পূর্বপ্রকাশিতের পর ~

যতকাণ্ড কেদারনাথে...

গৌরীকুণ্ডের পথে

গাড়িতে অসীমার বরাবরের সমস্যা। পিছনের দিকে বসলে গা গোলায়। জানলা না খোলা থাকলে সমস্যা হয়। এইসব। তাই ও সবসময় গাড়ির সামনের সিটে বা মাঝখানের সিটে জানালার ধারটায় বসতে চায়। আর গাড়িতে ওঠার আধঘণ্টা আগে অ্যাভোমিন চাই-ই-চাই। ট্রেকের সময় যে মেয়ে ঘোড়ার মতো ছোটে, গাড়িতে উঠলেই সে জব্দ হয়ে যায়।
আমারও গাড়িতে একটা সমস্যা আছে। কোনোকিছু খেয়ে গাড়িতে উঠলেই (বিশেষ করে চকোলেট, চিপস্, কোল্ডড্রিংকস বা ভারী কোনো খাবার) খুব তাড়াতাড়ি অ্যাসিডিটি হয়ে যায়। আর বমি করে ফেলি। তাই গাড়িতে বড়ো কোনো দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার আগে সাধারণত কিছুই খাই না। দরকার হলে গাড়িতে বসে শুধু মুড়ি আর জল। ব্যস। বাকি খাবার নামার পর। তাতে আমার আবার বিশেষ কোনও অসুবিধা হয় না।
যাই হোক, আমাদের এবারের দলের সবার সঙ্গে সবার মেলবন্ধন খুবই ভালো। সবাই সবার সুবিধা বা অসুবিধা খেয়াল রেখে গাড়িতে চড়েছিলাম। তাই বড় একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। আমাদের সকলের প্রিয় সন্দীপদার একটা ভালো অভ্যেসের কথায় এবারে আসি। দাদা প্রত্যেক অভিযানের শুরুর থেকে সবরকমভাবে প্রস্তুতি নেয়। যখন পরিকল্পনা চলে দাদা তখন চারপাঁচটা পেনড্রাইভ জোগাড় করে ফেলে। আর তাতে ভরে ফেলে বিভিন্ন দশকের, বিভিন্ন ভাষার ও বিভিন্ন মুডের গান। যা সমস্ত অভিযান জুড়ে গাড়িতে চলার সময় বাজতে থাকে আবার বিভিন্ন মুডের সঙ্গে সঙ্গে গানের ধরণও পরিবর্তিত হতে থাকে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক সময়, অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য্যর প্রয়োজন। যা দাদা হাসিমুখে একার দায়িত্বে আয়োজন করে। তার জন্য আমার মতো অভিযাত্রীদের সবাই-ই দাদাকে বাহবা দেয়। কারণ ট্রেকের ক্লান্তি কিছুটা দূর করতে এ এক দারুণ ঔষধ।

এই যাত্রাতেও তার অন্যথা হল না। গানের তালে তালে দুলে দুলে চলতে শুরু করলাম। আর গাড়ি তরতরিয়ে এগিয়ে চলল কেদারের পথে। কিন্তু গানেরও একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে ক্লান্তি উপশমের। তার ওপর আবার অনেকেরই হাঁটার অভ্যেস তেমন নেই। আর প্রথম ট্রেকেই ৩৮ কিমি হাঁটতে হয়েছে (যারা পাণ্ডবগুহা গিয়েছিলাম তারা আবার ৬ কিমি আরও বেশি )। তাই সবাই-ই নিজের আসনে বসে থেকেই যে যার মতো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। ড্রাইভারের পাশে বসে অসীমাই কেবল ঠিকভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারছিল না। দীর্ঘপথ যাত্রায় গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে যে বসে তার ঘুমালে চলে না। কারণ ঘুম অতি ছোঁয়াচে রোগ আর ড্রাইভারের তন্দ্রাভাব এলে সবার বিপদ।

গাড়ি এগিয়ে চলল নিজের ছন্দে। আমাদের ড্রাইভার মোমিন ক্রমাগত পানমশলা চিবাতে চিবাতে গাড়ি চালাতে লাগলেন। পিচঢালা কুড়িফুটের ফাঁকা রাস্তা। পাহাড় কেটে তৈরি করা। রাস্তার মাথার ওপর পাহাড়ের কাটা অংশ ঝুলছে বিপজ্জনক ভাবে। রাস্তার বামদিক থেকে গা ঘেঁষে যেন ঝুলে আছে। আর ডানদিকে নীচে খাদের মধ্যে দিয়ে গর্জন করতে করতে বয়ে চলেছেন মা গঙ্গা। কে বলবে যে এই ইনিই গোমুখের গুহায় যেখানে জন্মেছেন সেখানে দুগ্ধপোষ্য শিশু (নালার মতো)।
যাইহোক গাড়ির গতি কখনই তিরিশ-চল্লিশের বেশি উঠছিল না। মাঝে মাঝে রেগে যাচ্ছিলাম মনে মনে। কারণ যা পরিকল্পনা করে এসেছি এই গতিতে চললে তার হেরফের হয়ে যাবে। বারংবার গতি একটু বাড়াতে বলা সত্ত্বেও মোমিন যেন কানেই নিচ্ছিলেন না। তাই বিরক্ত হয়ে একসময় বলা বন্ধ করে দিলাম। ৪৭ কিমি চলার পর দাবরানি এবং আরও ৬ কিমি চলার পর গঙ্গানী এলো। আর গঙ্গানী থেকে গাড়িতে বসেই দূরে ঋষিকুণ্ড মন্দিরের এক ঝলক দেখতে পেলাম। গাড়ি কিন্তু থামল না। এগিয়েই চলল। আরও ৪৪ কিলোমিটার চলার পর উত্তরকাশিতে পৌঁছলাম। উত্তরকাশি বেশ বড়ো একটা শহর। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, খেলার মাঠ, বড় বাজার, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, এটিএম সব রয়েছে এখানে। জমজমাট শহর বলা চলে। আর একেবারে সমতলে - গঙ্গার কোলে। গাড়ি থামালাম। চা আর হালকা স্ন্যাক্স খাওয়া হল। কেউ কেউ এটিএম থেকে টাকা তুলে নিল। তারপর বেশি সময় নষ্ট না করে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। উত্তরকাশি থেকে ওল্ড তেহরি পর্যন্ত ৭০ কিমি পথের দুপাশ বেশ জমাটিই রইল। প্রচুর দোকান, হোটেল, বাজার, জনবসতি। আসলে চিন্নলিশ্বরের ২ কিমি পর থেকে ওল্ড তেহরি পার করে গাড়োলিয়ার ২-৩ কিমি আগে পর্যন্ত বিস্তৃত বিখ্যাত তেহরি জলাধার রয়েছে - রাস্তার সঙ্গে সমান্তরালে বামদিক ঘেঁষে। তাই এই জমাটি ব্যাপারস্যাপার। গাড়োলিয়ার পর শ্রীনগরের পথে না গিয়ে একটু শর্টকাট নিলাম। অন্য পাহাড়ের অন্য রাস্তা ধরে। তাই মুহূর্তে জমাটি ভাবটা উবে গেল।

গাড়োলিয়ার পর ১৬ কিমি গিয়ে ঘানশালি থেকে গাড়ি ডানদিকে বাঁক নিল। তারপর আরও ৫৭ কিলোমিটার চলে সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ তিলওয়াড়া পৌঁছে গেলাম। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় আর এগোনো সম্ভব ছিল না। তাই একটা হোটেল খুঁজে নিলাম। হোটেলের পিছনের দিকের তিনটে ঘর নিলাম আমরা। আমি, অতনু, অসীমা আর রাখি একটা ঘরে। সন্দীপদা আর অনসূয়া একটায়। সোমাঞ্জন, অভিজিৎদা একটাতে। ব্যবস্থা হল। ড্রাইভারের আলাদা ব্যবস্থা করে দিল হোটেল কর্তৃপক্ষ। সবাই ফ্রেশ হয়ে একপ্রস্থ চা খেলাম। তারপর হোটেল সংলগ্ন দোকান থেকে আমরা কিছু সব্জি কিনলাম। সন্দীপদা ভেন্ডি খেতে চাইল। তাই ভেন্ডি নেওয়া হল। হোটেল থেকে সেই ভেন্ডি রান্না করে দিল। আমরা রুটি, ভাত, ওমলেট, ভেন্ডির তরকারি সব মিলিয়ে রাতের আহার সেরে ঘরে ঢুকলাম। অনেকটা পথ গাড়ির ধকল, সবার এক ঘরে না থাকা, পরের দিনের কেদারের ট্রেক মাথায় রেখে এখানে নৈশ আড্ডা বসল না। খাওয়ার ঘরে একটু আলোচনা করে, সকালে যে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে সে কথা বলে, ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। পরের দিনের গোছগাছ মোটামুটি সেরে নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়েও পড়লাম। আলো নেভানোর পর ঘুম আসতে দেরি হল না বেশি।
পরের দিন সকালে প্রাতঃরাশ সাঙ্গ করে হোটেলের বিল মিটিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। প্রথম গন্তব্য সোনপ্রয়াগ। তিলওয়াড়া থেকে গুপ্তকাশি হয়ে সোনপ্রয়াগ। মোট ৬২ কিলোমিটার পথ। গুপ্তকাশির কাছে রাস্তা মন্দাকিনীর গা ঘেঁষে। একই সমতলে। এখানে মন্দাকিনীর আল রাস্তার মাঝখানে হেলিপ্যাড - কেদার যাওয়ার। জায়গাটা ভীষণই সুন্দর। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা। গাড়ি থেকে নামলাম একটু ঘুরে দেখতে। একপাল ভেড়া এসে জুটল কোথা থেকে। তারা রাস্তা পার হয়ে পাহাড় বেয়ে পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উঠে গেল আপন ছন্দে।

গাড়ির রাস্তা আবার খাড়াই হতে শুরু করল। বাকি পথ একইরকম থাকল। অর্থাৎ রাস্তার একদিকে খাড়া পাহাড়। অপর দিকে গিরিখাত। তার অপরপাশে অন্য পাহাড় উঠে গেছে ওপরের দিকে। গিরিখাতে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী নদী, স্বমহিমায়। এই মন্দাকিনী গোটা রাস্তাকে যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে গেছে সেই রূদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত। তারপর অলকানন্দার হাতে এই গুরুদায়িত্ব সঁপে দিয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কলেবরে অলকানন্দার ক্রোড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তারপর অবশ্য অলকানন্দাও দেবপ্রয়াগে গিয়ে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। আর ভাগীরথীর সাথে মিশে গঙ্গার বক্ষে বিলীন হয়েছে। সে এক ইতিহাস। আর পৌরাণিক মাহাত্ম্য ও মহাকাব্যিক তাৎপর্যও তার বিরাট। সে গল্প না হয় সময় পেলে বৈঠকি ঢঙে বলা যাবে আরেকদিন। বরং এবারের অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে চলি। কারণ কেদার পৌঁছনোর তাড়া আছে !
যাই হোক সোনপ্রয়াগের পর এ গাড়ি এগোবে না। কারণ সোনপ্রয়াগের ব্রিজের ওপাশে এপাশের গাড়ির অনুমতি নেই। তাই আমরা প্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ ব্যাগ নিয়ে ব্রিজ পেরোলাম। এই গাড়িটা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাদের ফিরে না আসা পর্যন্ত। মোমিনকে খাওয়ার জন্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে এগোলাম। ব্রিজের উল্টোদিকে দুই ধরণের গাড়ি পাওয়া যায়। দশ আসনবিশিষ্ট টেম্পো ট্রাভেলার ও সাধারণ সাত আসন বিশিষ্ট সুমো। ট্রাভেলারে চড়ে বসলাম। জনপ্রতি পনেরো টাকা করে ভাড়া। দশজন যাত্রী দেখতে দেখতে হয়ে গেল আর আমাদের গাড়ি রওনা দিল গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। এখানে বলে রাখি ট্রেক ছাড়াও কেদার যাওয়ার অন্য উপায় আছে। হেলিকপ্টারে যাওয়া যায়। উত্তরাঞ্চল ট্যুরিজম এর হেলিকপ্টার পবন-হানস্ ছাড়ে অগস্ত্য মুনি, রুদ্রপ্রয়াগ থেকে। কেদারনাথ হেলিকপ্টার সার্ভিসেসের হেলিকপ্টার ছাড়ে তিন জায়গা থেকে। সিরসি, ফাটা ও গুপ্তকাশী হেলিপ্যাড থেকে। এই সার্ভিসে যুক্ত কোম্পানিগুলি হল আরিয়ান, থাম্বি অ্যাভিয়েশান প্রাইভেট লিমিটেড, পবন হানস, উতাইর ইণ্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, ইন্দো কপ্টার প্রাইভেট লিমিটেড ও হিমালয়ান হেলি। এদের সবারই কেদার পৌঁছাতে দশ পনেরো মিনিটের বেশি লাগে না। ভাড়া একমুখী যাত্রায় পঁচিশশো-এর কাছাকাছি। আর দ্বিমুখী যাত্রায় সাতচল্লিশশো থেকে হাজার পাঁচেকের মধ্যে। প্রসঙ্গত দেরাদুন থেকেও হেলি পরিষেবা আছে।
সোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ডের রাস্তা আরও সংকীর্ণ। পাশাপাশি দুটো গাড়ি চলাচল করে বটে কিন্তু বিপজ্জনকভাবে। পাহাড় কেটে এ রাস্তা তৈরি। তাই অত্যন্ত ধ্বসপ্রবণ। রাস্তার ধার ঘেঁষে নেমে যাওয়া ঢাল আরও খাড়াই। আর ধারের দিকের পাথর অধিকাংশ জায়গায় বেশ আলগা। খাদের মন্দাকিনী আরও খরস্রোতা।

হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। এ রাস্তায় বৃষ্টি খুবই বিপজ্জনক। ধ্বসপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয় বহুলাংশে। পিচের রাস্তাও পিচ্ছিল। আর রাস্তা সাপের মত একে বেঁকে চলেছে যার বাঁকগুলো হৃদকম্প ধরানোর জন্য যথেষ্ট। একচুল এদিক ওদিক হলেই নিচের খাদে। আর ঘটনাও তাইই ঘটেছে দেখলাম। একটা বাঁক নিয়ে সামনে এগোতেই জোরে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে পুরো বাঁক জুড়ে গাড়ির লাইন। আর বাঁকটা বেশ অনেকখানি। পুরো একটা ইউ-প্যাটার্নের। তাই উল্টোদিকের বাঁকও চোখের সামনে উন্মুক্ত। সেই বাঁকের ঠিক আগেই রাস্তার উপর একটা ছোট্ট জটলা। ওখান থেকে একটা বাস পড়ে গেছে খাদে - মন্দাকিনী বক্ষে। হতাহতের সঠিক হিসেব কেউ বলতে পারল না। আধঘন্টা আগে হয়েছে এই ঘটনা। ডিজাস্টারের টিম এল বলে। এখানে খবর দিলে উদ্ধারকারী দল চলে আসে খুবই দ্রুত। দল এসে আগে দড়ি দিয়ে বেঁধে কয়েকজন সহ ড্রাফটিং বোট নামিয়ে দেওয়া হল। সেই সঙ্গে শুরু হল রাস্তা ফাঁকা করার কাজ। পনেরো মিনিটের মধ্যে জটলা ফাঁকা করা হল আর দাঁড়িয়ে পড়া গাড়িও চলতে শুরু করল। আমাদের গাড়িও এগিয়ে চলল গন্তব্যে, বিপজ্জনক এই স্মৃতিকে পিছনে ফেলে রেখে। দেখতে দেখতে ৫ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম গৌরীকুণ্ড। যেখান থেকে শুরু হবে আমাদের পায়ে হাঁটার সফর। যা গাইডবুকের হিসাবে ১৮ কিলোমিটার। স্থানীয় হিসাবে বাইশ-তেইশ। আর এক প্রৌঢ় তথা স্থানীয় বাসিন্দার মতে কম-সে-কম ২৬ কিলোমিটার। কারণ প্রকৃত দূরত্ব বলে দিলে নাকি অভিযাত্রীদের মনোবল নষ্ট হয়!

~ ক্রমশঃ ~


~ কেদারনাথ যাত্রার আরও ছবি ~

হাওড়া জেলার অঙ্কুরহাটি কিবরিয়া গাজি ঊচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মৃণাল মণ্ডলের নেশা ভ্রমণ, খেলাধূলা ও সাহিত্য চর্চা।

 

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

Cannot connect to the Host