বকখালি ভ্রমণ ও একটি রচনা লেখার গল্প
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ তথ্য- বকখালি || বকখালির আরো ছবি - শিবাজী কুণ্ডু ~
গোপালের ভ্যানরিক্সায় সওয়ারি আমরা তিনজন। এখনো রোদ ওঠেনি তেমন... অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। বকখালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে ইঁটের রাস্তা ধরে লাফাতে লাফাতে ভ্যানটা চলেছে। রাস্তার দু’পাশে মাটির বাড়ি – বনতুলসীর বেড়া দেওয়া। নিকোনো উঠোনে বিছানো রয়েছে মাছধরার জাল। উঠোনের ধারে লাল জবা আর কল্কে গাছে সাদা-হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে। আর ওদের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে নারকেল গাছগুলো। রাস্তা কোথাও কোথাও এতটাই ভেঙ্গে গেছে যে নেমে পড়তে হচ্ছে ভ্যানরিক্সা থেকে।আরও কিছুটা এগোতেই পথের পাশে একের পর এক মাছের ভেড়ি চোখে পড়ছিল। চেনাগাছগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে অচেনা ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে। গোপালের কাছে বনের পাঠ নিই – চিনতে চিনতে চলি হেঁতাল, গরান, বানি, গেঁও, গামা, বের বাবলাদের। গরান আর হেঁতালের ঝোপের পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বের বাবলা। এর চেহারা অনেকটা সুন্দরীর মতো। হেঁতালের স্থানীয় নাম ‘বকরা’ – যার থেকে উৎপত্তি বকখালি নামের। ছোট্ট ছোট্ট ফলেভরা বো-এর কুলগাছ। পথের ধারে লাল ভ্যারেন্ডা আর মনসার ঝোপ।ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ফাঁকে কোথাওবা উঁকি মারছে চেনা নিম আর খেজুর গাছ। ইঁটের পথ শেষ হয়ে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোয় ভ্যান। এইপথেই আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে কিরণ সৈকত, আমরা অবশ্য অতটা যাবনা। ভ্যান থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই জলের ধারে।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের একটা বড় অংশ হেনরি আইল্যান্ড। নামকরণ হয়েছিল এক ব্রিটিশ সার্ভেয়ারের নামে। সুন্দরবনের পশ্চিমপ্রান্তে সমুদ্রের তীরে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছাওয়া এই এলাকায় অনেকদিন আগে নাকি বাঘের দেখাও পাওয়া যেত। নদী আর তাদের শাখানদীরা জলের জাল বুনেছে এই ভূমিতে। ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য দপ্তর সমুদ্র লাগোয়া এই অঞ্চলটিকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে গড়ে তোলে। ভ্যানরিক্সায় আসতে আসতেই ফিসারিজ-এর ট্যুরিস্ট বাংলো চোখে পড়েছিল।
জল-জঙ্গলের কোলের কাছে দাঁড়িয়ে গোপালের অথবা গোপালদের গল্প শুনি। ওই যে মাটির বাড়িগুলো পথে দেখতে দেখতে এলাম ওরকমই কোন মাটির দাওয়ায় হয়তো এখন মাছ ধরার জাল শুকাচ্ছে গোপালের বউ আর তার বুড়ি মা, উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে গোপালের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আরেকটু বড় হলে মেয়ে হাত লাগাবে মায়ের সঙ্গে আর ছেলে জাল নিয়ে বাপের মতোই নেমে পড়বে সমুদ্রে অথবা শিখে নেবে ভ্যান চালানোর কাজ।
কী যেন ভাবছিলাম...মনটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ গোপালের ডাকে সম্বিত ফিরে দেখি কখন জঙ্গলে ঢুকে ভেঙ্গে এনেছে ঝলমলে হলুদ ফুলে ভরা একটা ল্যাটা গাছের ডাল, বনঝাউয়ের ডালের টুকরো আর গরানের ফলের ঝাড়। গাছগুলো ভাঙ্গার কথা বারণ করতে গিয়েও থেমে গেলাম...ফুলগুলোর মতোই ঝলমল করছে ওর হাসিভরা দু’চোখ। এই প্রকৃতির ও অনেক কাছের মানুষ। হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করি প্রকৃতির উপহার। এবার ফিরতে হবে।
এটা প্রায় বছর ছয়েক আগের গল্প। মেয়ে তখন অনেকটাই ছোট। গরমের ছুটিতে ওর হোমওয়ার্ক ছিল গ্রামে বেড়াতে গিয়ে সেই বর্ণনা লিখে ফেলা। ওকে নিয়ে এটাই মুশকিল যে রচনা জিনিসটা যে বানিয়ে লিখতে হয় সেটা কিছুতেই মানবেনা। স্কুল থেকে ফিরেই বলল, আমাকে হয় কোন গ্রামে বেড়াতে নিয়ে চল, নইলে আমি ওই রচনা লিখছিনা। কী ঝামেলারে বাবা...কে যাবে এই ঘোর গরমে বাংলার গ্রামে! সমাধান করল দীপ। একটা রবিবার ভোরে ভূতল নিগমের বাসে উঠে পড়ি তিনজনে। গন্তব্য কাকদ্বীপ, নামখানা পেরিয়ে বকখালি। পথে কলকাতায় জন্ম ইস্তক বড় হওয়া আমাদের সাতবছরের মেয়েকে দেখাতে দেখাতে চলি খড়, টিন, টালিতে ছাওয়া মাটির বাড়ি, উঠোনে খেলে বেড়ানো মুরগীর বাচ্চা, কলাগাছ, পুকুর, ধানক্ষেত, মফস্বলের বাজার...।
গাড়ি পৌঁছালো নামখানা। এখানেই বার্জে চড়ে পেরোতে হবে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী। শুধু আমরাই নই, আস্ত বাসটাই অন্য আরও গাড়ির সঙ্গে উঠে যাবে লঞ্চে! প্রথমবার এই অভিজ্ঞতায় কে বেশি উত্তেজিত আমি না আমার মেয়ে তা বলা বেশ কঠিন। পরে আন্দামান বেড়াতে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা একাধিকবার হয়েছিল কিন্তু প্রথমবারের মতো অমন উত্তেজনা আর কখনো হয়নি।
সরকারি ট্যুরিস্ট লজটা সমুদ্রের বেশ কাছে। তবে প্রায় ঢোকার পরপরই বিপত্তি - কোথা থেকে একটা গোদা বাঁদর এসে টেবিল থেকে আমার সাইড ব্যাগটাই তুলে নিচ্ছিল। অনেক কষ্টে তার হাত থেকে ওটা উদ্ধার করা হল। সে আরেক গল্প।
বকখালির সমুদ্র একটু ভেতরে। স্নানের জন্য বেশ ভালো। প্রশস্ত সৈকতে হাঁটতে বা বসে থাকতেও বেশ ভালোলাগে। সমুদ্রের ধারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা টানা বসার জায়গাও রয়েছে। তবে সেইসময় রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে সমুদ্রের তীরে যা জঞ্জালের স্তুপ দেখেছিলাম সেটা খুব বিশ্রী লেগেছিল। স্নান করে উঠে সবচেয়ে ভালোলাগে সমুদ্রের ধারের ঝুপড়ি হোটেলগুলোর ডালভাত, মাছতরকারির স্বাদ – খিদের মুখে একেবারে অমৃত। বিকেলবেলায় সৈকতের কাছের ঝুপড়ি চায়ের দোকানগুলোয় বসে সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া আর গরম চা দুটোই দারুণ। মেঘ সরলে রাতের সমুদ্র জ্যোৎস্নায় ভাসে... হু হু হাওয়া উড়িয়ে দেয় চুল।
সোমবার সকালে হেনরী আইল্যান্ড আর বনবিভাগের কুমির প্রকল্প ঘুরে আসার পর দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের গন্তব্য ফ্রেজারগঞ্জ আর বেনফিসের ফিসিং হারবার। দূর থেকেই বড় বড় উইন্ডমিলগুলো স্বাগত জানায়। সমুদ্রতটের ঠিক আগেই আগাছা আর জঙ্গলে ঘেরা সাহেবী আমলের বাংলো টাইপের কয়েকটা ভাঙ্গা বাড়ি। এরই আশেপাশে কোথাও বাংলার একসময়ের লেফটেন্যান্ট গভর্ণর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের বাংলোবাড়িটি ছিল, কালের অতলে যা হারিয়ে গেছে সমুদ্রগর্ভে। ফ্রেজার সাহেবের নাম থেকেই এই জায়গার নাম হয়েছিল ফ্রেজারগঞ্জ। সন্ধ্যের মুখে যখন ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রতটে পৌঁছালাম তখন নির্জন সৈকতে শুধু হু হু করে হাওয়া বইছে আর একাকী দাঁড়িয়ে আছে মাছধরার একটা নৌকো। অন্ধকার নামার আগেই পৌঁছাতে হবে বেনফিসের হারবারে, আবার ভ্যানে উঠে বসি।
জলের মধ্যে সারসার দাঁড়িয়ে আছে মাছধরার নৌকা। কেউবা ফিরে এসেছে একটু আগেই, কারোরবা চলছে কাল সকালে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি। আঁশটে গন্ধে হারবারের বাতাসটা ভারি হয়ে আছে। এখান থেকে ছোট নৌকো ভাড়া নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে জম্বু দ্বীপ থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়। হারবারের দুপাশে বানিগাছের জঙ্গল। মাটির মধ্যে থেকে উঁকি মারছে ম্যানগ্রোভের অজস্র শ্বাসমূল। হারবারের নীচে সিমেন্টের থামের গায়ে মরা সামুদ্রিক পোকা জমে তৈরী হয়েছে প্রকৃতির কারুকার্য। ভ্যানচালক বললেন এইগুলো ভেঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয় চুন। সত্যি কতরকম জীবিকায় বেঁচে থাকার লড়াই করে মানুষ, আর কতরকমভাবেইনা হাত বাড়িয়ে দেয় প্রকৃতি।
পরদিন ফেরার পথে বাসে বসে টুকরো টুকরো ভ্রমণস্মৃতি ফিরে ফিরে আসছিল। মনে হল আপাতদৃষ্টিতে পরিষ্কার রাস্তাঘাট আর ঝাঁ চকচকে হোটেলের সারির মাঝে কোথাও যেন লেগে আছে একটা অবহেলার সুর। নোংরা জমে থাকা বেলাভূমিতে, হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়ার ভাঙ্গা রাস্তায়, ঝুপড়ি দোকান আর নীচু নীচু মাটির বাড়িতে কিম্বা ফ্রেজারগঞ্জের আগাছা ঢাকা ভাঙ্গা বাংলোবাড়িগুলো আর গোপাল দাসদের কন্ঠস্বরে পাওয়া যায় সেই বেদনার আভাস।
~ তথ্য- বকখালি || বকখালির আরো ছবি - শিবাজী কুণ্ডু ~
‘আমাদের ছুটি’-র সম্পাদক দময়ন্তী কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন দৈনিক ‘কালান্তর’, ‘স্বর্ণাক্ষর’ ও ‘আজকাল’ প্রকাশনার সঙ্গে। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে মুক্ত সাংবাদিকতা করছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ভালোবাসেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, বই পড়তে, ভ্রমণকাহিনি ও ছোটগল্প লিখতে, বেড়াতে আর ‘আমাদের ছুটি’ কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে।