জঙ্গলে-জঙ্গলে সাইকেলে
মহম্মদ শরীফুল ইসলাম
~ সিলেটে সাইকেল অভিযানের আরো ছবি - মহম্মদ শরীফুল ইসলাম - আশফাক হাসান ~
কমলাপুর স্টেশন, ঘড়িতে সাড়ে সাতটার মতো বাজে। আমরা ছ’জন উপস্থিত, অপেক্ষা করছি বাকি ছয় জনের জন্য। পৃথিবী দিবস (Earth Day) উপলক্ষে সেইফ এর আয়োজনে আমরা বারোজন মিলে সাইকেল চালানোর জন্য শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। আমরা অর্থাৎ আমি, নূর ভাই, রাহাত ভাই, ফুয়াদ ভাই আশফাক ভাই, ফয়সাল ভাই, পার্থ ভাই, রাহিন ভাই, সজিব ভাই, নিবির ভাই, শাওন ভাই আর আরাফত ভাই। এছাড়াও এই যাত্রায় সঙ্গে রয়েছে আমাদের সহকারী মাসুম ভাই, গাড়ির ড্রাইভার সোহাগ ভাই ও তার সহকারী। বাকি ছ’জন আসলেই সাইকেলগুলো তুলে দেব পিকআপে। এই ভাবতে ভাবতেই দেখি সাইকেলের সামনে বাতি জ্বালিয়ে সবাই উপস্থিত।
ইতিমধ্যে আমাদের ম্যাকগাইভার নূর ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাইকেলের প্যাডেল খোলা আর হ্যান্ডেল বাঁকা করার জন্য। আমাদের দলে অবশ্য আরেকজন ম্যাকগাইভার ইমরান ভাই ছিলেন, কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। তাতে অবশ্য দেখছি একটু সুবিধাই হয়েছে। দুইজন ম্যাকগাইভার এক সঙ্গে হলে দেখা যেত তাঁরা সাইকেল খুলে বিমান অথবা হেলিকপ্টার জাতীয় কিছু একটা বানিয়ে ফেলেছেন! সবাই সাঙ্গ-পাঙ্গ হিসাবে নূর ভাইকে সাহায্য করে গেলাম। আমরা যে ছোট পিকআপ নিয়েছি সেটাতে সব কয়টা সাইকেল নিতে হলে প্যাডেল খোলা আর হ্যান্ডেল বাঁকা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। পিকআপে সাইকেল তুলে সবকিছু বেঁধে শেষ করতে করতে রাত ন'টা বেজে গেল। এই কাজে আমাদের বিদায় দিতে আসা মহিউদ্দিন ভাই ও শামীম ভাইও সহযোগিতা করলো।
ট্রেন ছাড়ার কথা রাত দশটায়, এই তথ্য শুধু আমি আর রাহাত ভাই জানি, আর কেউ না। সবাই যদি জানতো রাত দশটায় ট্রেন তা হলে কেউ সাড়ে ন’টার আগে কমলাপুরে উপস্থিত হতো না। এর আগে আশফাক ভাইয়ের লঞ্চ মিস করার অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা আছে। সে গল্পটা অবশ্য রাহাত ভাইয়ের কাছেই শুনতে হবে।
ট্রেন চলতে শুরু করলো তখন ঘড়িতে দশটা বেজে পনেরো কী কুড়ি। সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে এক সময় পৌঁছে গেলাম শায়েস্তাগঞ্জ। স্টেশনের ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। পুরোপুরি অন্ধকার স্টেশন, বিদ্যুৎ নেই। একটা হোটেলে ঢুকে জানতে পারলাম বিদ্যুৎ নেই রাত দশটা থেকেই, কখন আসবে তারও কোন ঠিকঠিকানা নেই। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম সকালের আলোর জন্য। প্লাটফর্মে সবাই বসে পড়লাম, কেউ কেউ শুয়েও পড়লো, আর নূর ভাই কয়েকজনকে নিয়ে আকাশের তারা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সকালের আলো ফুটতেই রওনা দিলাম সাতছড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সাতছড়ি বনের গেটে। সেখানে সাইকেলগুলো নামিয়ে ঠিকঠাক করে রওনা দিলাম রেমার দিকে। পথে চুনারুঘাটে সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে করে আবার রওনা দিলাম। প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার যাওয়ার পর পথে ছোট একটা নদী পড়ল। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের আমাদের ছোট নদী কবিতার মতোই। কবিতার নদীর মতো এখানেও অল্প পানি। আমাদের হাঁটু পানির চেয়ে একটু বেশিই তবে ফুয়াদ ভাইয়ের মনে হয় হাঁটু পানিই হবে কারণ তিনি আমাদের সবার চাইতে লম্বা। এই নদীতে গরুর গাড়ি না চললেও আমরা সবাই সাইকেল নিয়ে ঠিকই পার হয়ে গেলাম। তবে সাইকেলে চেপে না, সাইকেল আমাদের কাঁধের উপর চেপে পার হলো।
পার হওয়ার সময় আশফাক ভাইকে বললাম, যে গরম এখানে গোসল করে নিতে পারলে ভালো হতো। নদী পার হয়ে পিছন ফিরে দেখি তিনি এরমধ্যেই হাফ প্যান্ট পড়ে নদীতে শুয়ে পড়েছেন। অল্প সময় বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম। এতক্ষণ আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে চালাচ্ছিলাম, এখান থেকেই মাটির রাস্তা শুরু হলো। চা বাগানের ভিতরে ঊঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করলাম। আঁকা-বাঁকা রাস্তা পার হয়ে একটা জায়গায় এসে থামলাম পানি নেওয়ার জন্য। একটি প্রাইমারী স্কুল চোখে পড়লো - "রেমা চা বাগান কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়"। স্থানীয় একজন লোকের সহযোগিতায় সবার পানির বোতল ভরে নিলাম। কয়েকটা বিস্কিট আর পানি খেয়ে রওনা দিলাম, ঘড়িতে তখন সকাল ১১ টা।
মোটামুটি এক ঘণ্টা চালানোর পর হঠাৎ ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। ফয়সাল ভাইয়ের সাইকেলের পেছনের চেনের দিকে একটা প্রমাণ সাইজের ডাল ঢুকে গেল। রাহাত ভাই অনেক দোয়া-দূরুদ পড়ে সেই ডালটি বের করতে সক্ষম হলেন। দোয়া-দূরুদ পড়ার কারণ ডালটা এমনভাবে ঢুকেছিল যে বেশি টানাটানি করলে ডিরুইলারটাই ভেঙ্গে যেতে পারত।
আরো প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার আসার পর দেখি ফুয়াদ ভাই আর পার্থ দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? দেখলাম আগের বার বেঁচে গেলেও এবার অঘটনটা পুরোপুরিই ঘটেছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের একটা ডালের বাড়ি খেয়ে ভেঙ্গে গেছে ফুয়াদ ভাইয়ের সাইকেলের ডিরুইলার। আমার ৪/৫ বছর সাইক্লিং জীবনে এটা দ্বিতীয় ডিরুইলার ভাঙ্গার ঘটনা। নূর ভাই আর আমি কোনরকমে চেইন কেটে ছোট করে ফিক্সড করে দিলাম। যেকোনভাবে এই জঙ্গল পার হতে পারলে শান্তি।
সাইকেল চালাচ্ছি তো চালাচ্ছি... আশে-পাশে কোন জনবসতি নেই। প্রচণ্ড গরম, অনেকের বোতলের পানি শেষ, আশফাক ভাই এরই মধ্যে ছড়া থেকে পানি নিয়ে খেয়ে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ পর পরই টিলা উঠা-নামা করতে হচ্ছে। পথে গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে, শুকনা ডাল দেখে খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল ঠেলে উঠতে হচ্ছে। দুপুর ২ টার দিকে পৌঁছে গেলাম রেমা বিট অফিস।
এখান থেকে শ্রীমঙ্গল দুই আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। সবাই আরাম করে অফিসের টিউবয়েল থেকে পানি নিয়ে নিল। কেউ কেউ কলের নিচে বসে গোসলও করে নিল। হালকা খাওয়া-দাওয়া করে অনেক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমার রওনা দিলাম। ঘণ্টা খানেক চালানোর পর রাস্তার দেখা পেলাম। ফোনে গাড়ির ড্রাইভারকে চলে আসতে বলে দিলাম। গাড়ি আসার পর ফুয়াদ ভাইয়ের সাইকেল তুলে দেওয়া হলো। আশফাক ভাই, রাহাত ভাই, ফয়সাল ভাই, রাহিন ভাইসহ কয়েকজন গাড়িতে করেই শ্রীমঙ্গলের পথে রওনা দিল। আর আমরা হার না মানা কয়েকজন সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। বিকালেই পৌঁছে গেলাম শ্রীমঙ্গল শহরে। কুটুমবাড়ি নামে এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম সবাই। খাওয়ার পর রাতে থাকার জন্য রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত বি.টি.আর.আই. টি.-রিসর্টে। রিসর্টে পৌঁছে কোনরকমে ব্যাগ রেখে সুইমিং পুলে লাফ দিলাম। অনেক্ষণ দাপাদাপি করে রুমে ফিরে এসে ঘুম। সকালে উঠতে উঠতে ৮ টা। কয়েকজনতো ৯ টার দিকে উঠলো। ঘুম থেকে উঠেই আবার সুইমিং পুলে দাপা-দাপি শুরু করলো সবাই। সকালের নাস্তা খেয়ে রওনা দিলাম লাউয়াছড়া বনের দিকে।
বনের গেটে এসে ডাব, আনারস, তরমুজ খেয়ে বনের ভেতরে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ ট্যুরিস্টদের ফেলে আসা ময়লা পরিষ্কার করে আবার সাইকেল চালানো শুরু করলাম। আমাদের কাছ থেকে থেকেই বিদায় নিলেন সজিব ভাই আর নিবির ভাই। তাঁদের পরের দিন অফিস আছে তাই ঢাকায় ফিরতে হবে। লাউয়াছড়ার জঙ্গলে ঢুকে আমার আর শাওন ভাইকে জোঁকের কামড় খেতে হলো। আমাদের জোঁকের কামড় খাওয়া দেখে সবাই যে যার হাত-পা দেখে নিলেন। জঙ্গল থেকে ভুল রাস্তা ধরে বের হয়ে এক চা বাগানে এসে থামলাম। যাই হোক লোকজনদের জিজ্ঞেস করে আমরা এক গ্যাসফিল্ডের পাস দিয়ে শহরে যাওয়ার রাস্তা পেলাম।
রাস্তা অবশ্য পুরোপুরি পাকা না, কিছুটা মাটির। পার্থ ভাই মুখ গোমড়া করে সবার সামনে চালান আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন। প্রথমে কারণটা বুঝতে পারছিলামনা, তারপর ফুয়াদভাই বুঝিয়ে দিলেন যে আমরাতো একটু আস্তে সাইকেল চালাচ্ছি তাই পার্থভাইয়ের মন খারাপ। কারণ তিনি সব সময় জোরে সাইকেল চালিয়ে থাকেন। ইদানীং আইরন ম্যান হওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছেন তাই তাঁকে কিছুক্ষণ পর পর খুঁজে পাওয়া যায় না!
একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে রওনা দেওয়া হলো। ৪ টার দিকে আমরা আবার শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি সজিব ভাই আর নিবির ভাই এখনো ঢাকায় যাননি। তাঁদের ট্রেন ছাড়ার সময় পিছিয়েছে। এবং তাঁরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্তও নিয়েছেন যে আমাদের একা একা আনন্দ করতে দিবেন না এবং তাঁরা ঢাকা যাবেন না। তবে আশফাক ভাই ঘোষণা করলেন তিনি চলে যাবেন। হোটেলে উঠে সবাই ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসলাম বাইরে ঘোরাঘুরি ও রাতের খাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলের পাশেই একটি সিনেমা হল চোখে পড়লো। সেখানে যে ছবি চলছে সেই ছবির পোষ্টার দেখে কয়েকজনের বেশ ভালই আগ্রহ তৈরি হয়ে গেলো। ছবির নাম 'শিকারি'। আমাদের সেই কুটুমবাড়িতে রাতের খাওয়া শেষ করে ফেরার সময় ফুয়াদ ভাই ঘোষণা করলেন তাঁর ছোট বেলার, "ঐ দেখা যায় তাল গাছ/ ঐ আমাদের গাঁ" এই কবিতাটি হঠাৎ মনে পরে গেছে। হঠাৎ এই কবিতা মনে পরার রহস্যটা একটু ইন্টারেস্টিং। তবে সেটা আপাতত রহস্যই থাক।
সকালে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে বের হয়ে লাউয়াছড়া রাস্তার দিকে রওনা হয়েছি, এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। লাউয়াছড়ার গেটের আগে ডানদিকে একটি রাস্তা চলে গেছে মাধবপুর লেকের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ করে আমার সামনে সজিব ভাই সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ে গেলেন। কারণ তিনি রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সেখানে বালু ছিলো, সেই বালুতে স্লিপ করে পড়ে গেছেন। হাত কনুইয়ের দিকে ছিলে গেছে এবং আঙ্গুলে বেশ ভালই ব্যথা পেয়েছেন। দুর্ঘটনার কারণে সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে থাকা আমাদের পিকআপের ড্রাইভার সোহাগ ভাইকে ফোন করলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। এর মধ্যে নূর ভাই সজিব ভাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দিয়েছেন। সজিব ভাইকে গাড়িতে তুলে আমরা রওনা দিলাম মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে। প্রায় ৪০ মিনিট সাইকেল চালানোর পরেই পৌঁছে গেলাম লেকে। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম শহীদ বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান সমাধিস্থল দেখতে। শহীদ বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জনাব অক্কাশ আলী একজন দরিদ্র কৃষক এবং মাতা গৃহিনী কায়সুননেসা। তিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ধলই সীমান্ত চৌকিতে যুদ্ধে নিহত হন। সেখানে কিছু ছবি তুলে আমরা রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পাশ দিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম শহরে। সাইকেল গাড়িতে তুলে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম ট্রেন আসার জন্য।
সময়ের অভাবে আমাদের “শিকারী’ ছবিটা আর দেখা হলো না!
~ সিলেটে সাইকেল অভিযানের আরো ছবি - মহম্মদ শরীফুল ইসলাম - আশফাক হাসান ~
বিপদেআপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই 'সেইফ' (Safety Assistance For Emergencies) -এর প্রধান কাজ। এর বাইরেও সেইফের নিয়মিত কর্মী শরিফুলের জীবনের আরেক নাম ভ্রমণ। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, নৌকায় এযাবত নানান অভিযানে অংশ নিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে সাইকেলে বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলা ভ্রমণ, পায়ে হেঁটে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ, সাইকেলে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সময় পেলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ভ্রমণের পাতায় লেখেন সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।