কুয়াশাঘেরা হ্রদ-পাহাড়ের উপকথা

বিপ্লব রহমান

বগালেকের তথ্য

দুর্গম পাহাড়ে ডিসেম্বরের ভোরে হিম বাতাসের কামড় ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করা কুয়াশা নয়, নারকেল দুধের মতো ঘন সাদাটে ধোঁয়াশা। শীতলতায় হাত-পা অবশ হয়ে আসতে চায়, ঘোলাটে চশমার কাঁচ বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে আসে, তখন হাত তিনেক দূরের দৃষ্টিও বুঝি অসাড়। কুয়াশা জমে জমে বৃষ্টির মতো টুপটাপ ঝরে পড়ে জলকণা অরণ্য সবুজের মগডাল থেকে। ভিজিয়ে দেয় পোষাক-আশাক,ব্যাগ-ব্যাগেজ,সর্বস্ব। দূরে রাতজাগা কোনো পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে বলে, হুঁশিয়ার!
এরই মধ্যে রেস্ট হাউজ নামক বাঁশের তৈরি মাচাং ঘর থেকে গুটি গুটি পায়ে একাই বেরিয়ে পড়া। হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ, গেরিলা কায়দায় 'রেকি' করা চারপাশ, ক্ষীণ আশা - সকালের আলোয় বগালেকের অপার বিস্ময় যদি খানিকটা ধরা পড়ে! কিন্তু টর্চের আলো ফ্যাকাশে বলে ভ্রম হয়, তখনো সকালের আলো ফোটেনি। চারপাশের চাপ চাপ ধোঁয়াশার বিস্তার দেয়ালসম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চামড়ার পুরনো জ্যাকেট, আর কোমড় তাঁতে বোনা চাকমা সুতি মাফলারে শীত তাড়ানোর অবিরাম কসরতের অংশ হিসেবে একটি সিগারেট ধরানো। তাতে ধোঁয়াশা আরেকটু বাড়ে বৈকি, শীতের দাপটে রক্ত জমে আসতে চায়। আবারো ফিরে আসা এক কামরার মাচাং ঘরের ওমের ভেতর।
সহ-সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা তখনো মাচাং ঘরের দ্বিতীয় সিঙ্গেল খাটে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের ঘোরেই অস্ফুট স্বরে নির্দেশ পাওয়া যায় শুয়ে পড়ার। আরেক সিঙ্গেল খাটে বম কম্বলে প্যাকেটজাত ও আধ শোয়া হয়ে খাটের নীচ থেকে টেনে নেওয়া ছোট্ট পানীয়ের বোতল, কড়া স্বাদের মারমা লিকারটির নাম - প্রাইং। শীত ও ক্লান্তি নিবারণে বিন্নি ভাতের এই চোলাইটির কার্যকারিতা বিস্ময়কর। কয়েক চুমুক পান করার পর বুদ্ধ তার খাট থেকেই হাত বাড়ায় বোতলটির দিকে, দু-এক টানেই শূন্য করে ফেলে। টর্চের লালচে আলোয় ক্রেওকাডং শিখর জয়ের পরিকল্পনা করা হয়। তার আগে বগালেক তো অবশ্যই…
লোকালয় বিচ্ছিন্ন বান্দরবানের রুমার দূর বগালেকের পাড়ের রেস্ট হাউজ কাম মাচাং ঘরটি প্রাচীন কোনো গুহা বলে ভ্রম হয়। যেন পথহারা দুই পর্বত অভিযাত্রী অবিরাম পরিকল্পনা করে চলেছে উদ্ধারের আশায়। বন মোরগের ঝাঁক প্রাতরাশ সারতে বেরিয়ে তীব্র চিৎকারে ডাকে বার বার। দ্বিপাক্ষীয় আলোচনা দ্রব্যগুণের প্রলাপে ছেদ পড়ে।
এমনি করে সকাল খানিকটা চড়লে নয়টা নাগাদ দেখা মেলে সুর্যদেবের। আউট অব ফোকাস থেকে আস্তে আস্তে দৃষ্টি গোচর হতে থাকে লেকপাড়ের বম পাড়া। আড়মোড়া ভেঙে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়া। জগের পানিতে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে মাইনস-সিক্স-বাইফোকাল চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে আর বাক্য সরে না। সামনে হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন নীলাভ রঙা সুবিশাল এক প্রাকৃতিক জলাশয়– বগালেক! অশেষ অপার বিস্ময়ের বগালেক!
এই লেক, লেক ঘেরা সবুজ পাহাড়ের দেয়াল, বম পাড়া – সবই বুদ্ধর খুব চেনা। তবু একান্ত মুগ্ধতাটুকু ওকেও স্পর্শ করে আরেকবার।
অলিম্পাস অটো-জুম ক্যামেরার শাটার টিপে ঝটপট তোলা হয় একের পর এক ছবি। তখনো কুয়াশায় মোড়া হ্রদের দূর পাড়ে যেন সাদা রহস্য-ঝাঁক উড়ে যায়। বুদ্ধ বলে, ওগুলো নিছক কুয়াশা নয়, বিশাল এক সাদা বকের দল। লেকে মাছ শিকারে নেমেছে।
এরপর লেকপাড়ের বড় বড় পাথরের বোল্ডারের একটি দখল করে বসা।পায়ের নীচে বরফ শীতল স্বচ্ছ পানিতে ভাসতে থাকে থোকা থোকা লাল শাপলা-শালুক। সেখানে ঘাই মারে ট্যাংরা-পুঁটির ঝাঁক। বুদ্ধ কোথা থেকে একটি বাঁশের কঞ্চি নিয়ে শাপলা-শালুক লতা টেনে নেয়। বলে,আমরা আজ সকালে খানিকটা সিঁদোল শুটকি দিয়ে এই লতার ঝোলের সঙ্গে গরম ভাত খাবো। সঙ্গে থাকবে কচি লেবুর পাতা। তারপর বম গ্রাম প্রধান সাংলিয়ান কারবারিকে গাইড বানিয়ে উঠে যাবো ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায়।
আরো পরে সকালের আহার শেষে ক্রেওক্রাডং-এর দীর্ঘ পথযাত্রায় একের পর এক চড়াই-উতরাই, গিরিখাদ, ঝরনা ও ঝিরি পেরোতে পেরোতে সাংলিয়ান দা'র কাছে শোনা হবে বগালেক নিয়ে প্রাচীন এক বম উপকথা।
যাত্রা বিরতি হয়, নাম বিস্মৃত একটি ছরার পাশে। শীতলতর অবাক জলপানের পর ভূপতিত মৃত গাছের গুঁড়ির ওপর বসলে কারবারি দা' খুলে বসবেন মালাকাইটের ঝাঁপি। ...
বম ভাষায় বগা লেক হচ্ছে-- বগা রেলি। 'বগা' মানে অজগর, আর 'রেলি' হচ্ছে লেক। লেকের উত্তরে বাস ছিলো এক ম্রো পাড়ার। সেটি ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা।
একবার ম্রো' শিকারিরা পর্বতের গুহা থেকে বিশাল এক অজগর সাপ জ্যান্ত ধরে ফেলে। পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো লোকটি অনুরোধ জানান, সাপটিকে যেন অবিলম্বে আবার বনে ছেড়ে দেওয়া হয়; কারণ এটি কোনো সাধারণ অজগর নয়, এটি হচ্ছে পাহাড় দেবতা। বুড়োর কথায় কেউ কান দেয় না।
ওই রাতে সবাই মিলে গ্রামের উঠোনে জ্বালে বড়সড় এক অগ্নিকুণ্ড। তারা সাপটিকে আগুনে ঝলসে মহা আনন্দে মদ দিয়ে খায়। সুস্বাদু সাপের মাংসর ভাগ পায় গ্রামের সকলেই। কেবল সেই বুড়ো লোকটি সাপের মাংস ছুঁয়েও দেখেন না। সেদিনই ভোর রাতে বিরাট এক পাহাড়ি ঢল নেমে আসে ম্রো গ্রাম জুড়ে। পানির তোড়ে ভেসে যায় পুরো গ্রামটি, অজগর-পাহাড় দেবতার অভিশাপে মারা পড়ে সবাই। কিন্তু অলৌকিক আশীর্বাদে বেঁচে যান একমাত্র সেই বুড়ো লোকটি। অজগর-অভিশপ্ত ওই পানির ঢল থেকেই বগালেকটির সৃষ্টি। এখনো নাকি সেই ম্রো বুড়োর ভিটে আর অজগরটির গুহা অবিকল টিকে আছে…।

বগালেকের তথ্য

বিপ্লব পেশায় সাংবাদিক আর নেশায় ব্লগার। বাংলাদেশের আদিবাসী জনজীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে লেখালেখি করছেন।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher