জগদলপুরের জলপ্রপাতে
অদিতি ভট্টাচার্য
~ তথ্য- জগদলপুর || জলপ্রপাতের আরো ছবি ~
বিশাখাপত্তনম থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম জগদলপুরের দিকে, উদ্দেশ্য ভরা বর্ষার শেষে তীরথগড় আর চিত্রকোট – ছত্তিশগড়ের এই দুই বিখ্যাত জলপ্রপাত চাক্ষুষ দেখা। বিশাখাপত্তনম থেকে জগদলপুরের দূরত্ব তিনশ পাঁচ কিলোমিটার। রাস্তায় পড়ে সবুজ গালিচায় মোড়া বেশ কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ভ্যালি। এই সব দেখতে দেখতে অন্ধ্রপ্রদেশ পেরিয়ে, ওড়িষা পেরিয়ে, ছত্তিশগড়ে ঢুকে জগদলপুর পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল।
পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম তীরথগড়ের উদ্দেশ্যে। তীরথগড় জলপ্রপাত জগদলপুর থেকে বত্রিশ কিলোমিটার দূরে কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে। এই অরণ্যে ঢোকার মুখে পড়ছি সংগ্রহ করতে হয়। বিদেশী পর্যটকদের ক্ষেত্রে টাকাটা বেশি লাগে। কী অজ্ঞাত কারনে জানি না, যিনি পড়ছি দিচ্ছিলেন তিনি আমাদের বিদেশী পর্যটক ভেবে বসলেন। অবশেষে আইডেন্টিটি প্রুফ দেখিয়ে, বিশুদ্ধ হিন্দিতে বার্তালাপ চালিয়ে তাঁকে বোঝানো গেল যে আমরা নিখাদ ভারতীয়, পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। আমাদের সঙ্গে এক দল অল্পবয়েসী ছেলে মেয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিল, বোধহয় কোনো কলেজ থেকে এসেছিল। তাদের হাসিঠাট্টায়, ব্যঙ্গবিদ্রুপে পড়ছি বাবুর অবস্থা তখন বেশ কাহিল। যাই হোক পড়ছি নিয়ে যাত্রা শুরু হল। দুপাশে ঘন জঙ্গল, অনেক জায়গাতেই রোদ্দুরের প্রবেশ নিষেধ। কানে আসছিল নাম না জানা কত পাখির ডাক। কত রকম চেনা অচেনা গাছ, বুনো ফুল, রঙ বেরঙের প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখতে দেখতে গা শিরশিরে হাওয়ায় এই যাত্রা সত্যিই এতো ভালো লেগেছিল যে বলার নয়।
বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর জলের গর্জন কানে এল। বুঝলাম কাছাকাছি এসে গেছি। গাড়ি এসে থামল অপেক্ষাকৃত একটা ফাঁকা জায়গায় যেখানে জলের আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। এতসুন্দর পরিবেশে বড় দৃষ্টিকটুভাবে লাগছিল চা, বিস্কুট, চিপস্, ঠাণ্ডা পানীয়র ছোট বড় একের পর এক দোকানগুলো। গাড়ি থেকে নেমে সেসব পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম রেলিং ঘেরা একটা ছোট ঝুলন্ত বারান্দার মত জায়গায়। আমাদের চোখের সামনে তখন নীল আকাশ আর সবুজ গাছপালার ব্যাকগ্রাউণ্ডে মুগাবাহার নদী ওপর থেকে নীচে সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল পাহাড়ের গা দিয়ে ধবধবে সাদা চওড়া চওড়া ফিতে ঝোলানো রয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে নীচে নামতে শুরু করলাম যেখানে জলপ্রপাত মাটি স্পর্শ করেছে। শ' দুয়েক মত সিঁড়ি ভেঙে একদম নীচে পৌঁছনো যায়। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে জলে পা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়াতে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয় কারণ পাথর অত্যন্ত পিচ্ছিল। বর্ষার ঠিক পরে হওয়ায় জলও খুব বেশি ছিল। পাহাড়ের একদম মাথায় শিব পার্বতীর প্রাচীন একটি মন্দির আছে। স্থানীয় মানুষকে সেখানে পুজো দিতে যেতে দেখলাম। আসতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু তাও কিছুক্ষণ পরে রওনা দিতে হল পরবর্তী গন্তব্য চিত্রকোট জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে।
চিত্রকোট জলপ্রপাত জগদলপুরের আটচল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত, তীরথগড়ের অপরদিকে। পৌঁছতে তাই বেশ সময় লেগেছিল। দুটো জলপ্রপাত সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তীরথগড় জলপ্রপাত অনেক উঁচু থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গর্জনও বেশী। কিন্তু চিত্রকোট অত উঁচু নয়। ইন্দ্রাবতী নদী ঊনত্রিশ মিটার উচ্চতা থেকে নীচে নেমে এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে কিন্তু তার ব্যপ্তি অনেক বেশী। যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল। ইন্দ্রাবতী নদী তার বিশাল বিস্তার নিয়ে এখানে প্রবাহিত। জলপ্রপাতের সামনেই একটা রিসর্ট আছে কিন্তু তাছাড়া আর কোনো দোকান বা বাড়িঘর নেই। জলপ্রপাতের বাকী তিন দিক জঙ্গলে ঘেরা। যতদূর চোখ যায় শুধু গাছপালা আর জল। এখানেও কিছু কিছু জায়গায় পাথরের ওপর দিয়ে জলে পা ডুবিয়ে ঘোরা যায়।
যেখানে ইন্দ্রাবতী নদী সবচেয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেখান থেকে জলকণা ধোঁয়ার মতো ওপর দিকে উঠেছে। শুনেছিলাম এখানে সূর্যের আলো পড়লে রামধনু দেখা যায়। কিন্তু সূর্য তখন মেঘের আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। একটু মনখারাপ নিয়েই ফিরে আসছিলাম। হঠাৎই সূর্য বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে, দুপুরের চড়া রোদ্দুরে ঝলমল করে উঠল চারদিক। পেছনে তাকিয়ে দেখি জলপ্রপাতের গায়ে রামধনু। আকাশে রামধনু অনেকবার দেখেছি, বৃষ্টির পরে রোদ উঠলে, কিন্তু এত নীচে জলের ওপর রামধনু! কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর হুঁশ হতেই তাড়াতাড়ি এই অসাধারণ দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করা হল। ফেরার পথে জগদলপুরের ডোকরা শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে স্থানীয় বাজারে গেলাম। কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে আবার হোটেলে ফেরা। মনের মধ্যে রয়ে গেল দুই জলপ্রপাতের অপরূপ ছবি।
~ তথ্য- জগদলপুর || জলপ্রপাতের আরো ছবি ~
সংখ্যাতত্ত্ববিদ অদিতির কাছে বই আর অক্সিজেন সমতুল্য। কর্মসূত্রে বছর খানেক আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি ভালোবাসেন বিভিন্ন জায়গায় বেড়িয়ে এসে ভ্রমণকাহিনি লিখতে।