২০০০ সালের ১ নভেম্বর ছত্তিশগড় রাজ্যের জন্ম। ছত্তিশগড়কে মোটামুটি দুটো সার্কিটে ভেঙে দেখে নেওয়া যায়। একদিকে রাজধানী শহর রায়পুরকে কেন্দ্র করে কাছেপিঠের সিরপুর, রাজিম, বর্ণপাড়া অভয়ারণ্য, ভোরামদেও প্রভৃতি আর অন্যদিকে জগদলপুর থেকে দন্তেশ্বরী মন্দির, কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, কুটুমসর গুহা, চিত্রকোট ও তিরথগড় জলপ্রপাত।
রায়পুর (Raipur) – ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর অতীতে কালচুরি বংশের রাজাদেরও রাজধানী ছিল। রায়পুর থেকে শহর ঘুরে দেখে নেওয়া যায় মহামায়া মন্দির, দুধধারী মন্দির, বোধা তালাও, গুরু ঘাসিদাস মিউজিয়াম প্রভৃতি। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে রায়পুরের প্রতিষ্ঠাতা কালচুরি রাজা রামচন্দ্রের আমলে দুধধারী মন্দিরটি নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে রাজা রঘুরাওজী ভোঁসলের আমলে রায়পুরে অনেকগুলি মন্দিরের তৈরি হয়। তিনি নিজে বিষ্ণুভক্ত ও মহান্ত স্বামী বলভদ্রদাসজীর অনুগামী ছিলেন। বলভদ্রদাসজীকে নিয়েও নানান গল্প ছড়িয়ে আছে দুধধারী, বালাজী, সঙ্কটমোচন, বৃন্দাবন প্রভৃতি মন্দিরগুলি ঘিরে। শহর থেকে ২০ কিমি দূরে ছত্তিশগড়ের আদিবাসী লোকশিল্পকলার অসাধারণ সংগ্রহশালা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র পুরখাউতি মুক্তাঙ্গন। রায়পুর থেকে ৮৬ কিমি দূরে মহানদীর ওপর গাংরেল ড্যাম (Gangrel Dam)।
রাজিম (Rajim) – মহানদী, পৈরি ও সন্দুর নদীর সঙ্গমে ছত্তিশগড়ের প্রয়াগ রাজিম। রায়পুর থেকে দূরত্ব ৪৯ কিমি। অষ্টম-নবম শতাব্দীর রাজীবলোচন মন্দির এখানকার মূল আকর্ষণ। এর আশপাশেই রয়েছে নরসিংহ, বামন, বদ্রীনাথ, জগন্নাথ ও মহাদেবের মন্দির।
সিরপুর (Sirpur) – রায়পুর থেকে ৮৫ কিমি দূরে মহানদীর তীরে প্রাচীন সর্বপুরীয় রাজাদের রাজধানী সিরপুর। সপ্তম শতাব্দীতে এখানে এসেছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ। সিরপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে পাশাপাশি একই সময়ের শৈব, বৈষ্ণব, জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এরমধ্যে লক্ষণ মন্দিরটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উপাস্য দেবতা বিষ্ণু।
বর্ণপাড়া অভয়ারণ্য(Barnapara Sanctuary) – রায়পুর থেকে ১২৫ কিমি দূরে ২৪৫ বর্গকিমি ব্যপী বর্ণপাড়া অভয়ারণ্য। শাল, সেগুন, শিশু, শিমুল, মহুয়া, তেন্দু গাছে ছাওয়া সবুজ এই অরণ্যে দেখা মিলবে বাঘ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, অ্যান্টিলোপ, চিঙ্কারা হরিণ, বাইসন, নীল গাই ও আরও নানান জীবজন্তুর। পাখিদের কলকাকলীতে ভরে থাকে অরণ্যভূমি। ১ জুলাই থেকে ৩১ অক্টোবর জঙ্গল বন্ধ থাকে।
ভোরামদেও (Bhoramdeo) – রায়পুর থেকে ১১৬ কিমি দূরে শঙ্করী নদীর তীরে ভোরামদেও মন্দির – ছত্তিশগড়ের খাজুরাহো। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এই মন্দিরটি নাগরাজ রামের আমলে তৈরি। মূল মন্দিরের তিনটি অংশ – মণ্ডপ, অন্তরাল ও গর্ভগৃহ। ভোরামদেও মন্দিরের কাছেই মান্দোয়া মহল ও মদনমঞ্জরী। ভোরামদেও অভয়ারণ্যের ভিতরে বানজারি মাতার মন্দির।
যাওয়া : নিকটতম বিমানবন্দর রায়পুর। ট্রেনও যাচ্ছে রায়পুর। রায়পুর থেকে সিরপুর ও বর্ণপাড়া অভয়ারণ্য বেড়ানোর জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হবে। রায়পুর থেকে কাওয়ারধা হয়ে ভোরামদেও যাওয়া যায়।
থাকা : ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের রায়পুরে হোটেল ছত্তিশগড়,গাংরেল ও ভোরামদেও-এ ট্যুরিস্ট রেস্টহাউস, বর্ণপাড়া রিসর্ট আছে। বর্ণপাড়ায় ট্যুরিজমের রিসর্ট ও বনবিভাগের লজ রয়েছে।
উৎসব-শ্রাবণমাসে হারেলী ও পোলা উৎসব হয়। রাজিমে কুম্ভস্নান ও শিবরাত্রিকে কেন্দ্র করে ভক্তসমাগম ঘটে।
জগদলপুর (Jagdalpur) – বাস্তার জেলার প্রধান শহর জগদলপুর। বাস্তারের আদিবাসী জনজীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে যেতে হবে অ্যানথ্রপলজিকাল মিউজিয়াম।এছাড়াও রয়েছে বাস্তার প্যালেস, বালাজি মন্দির, কালেক্টরেট ভবন,শহিদ পার্ক,গঙ্গামুন্ডা লেক,রামকৃষ্ণ মন্দির, পরিযায়ী পাখিদের ঠিকানা দলপত সাগর লেক প্রভৃতি।
দন্তেওয়ারা (Dantewara) – জগদলপুর থেকে ৮৫ কিমি দূরে শঙ্খানী ও দঙ্খানী নদীর তীরে দন্তেশ্বরী মন্দির। শক্তি রাজাদের আমলে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মহিষাসুরমর্দিনী দেবী এখানে দন্তেশ্বরী নামে আরাধ্য। পাথরের মন্দিরটিতে শিব, গণেশ, নন্দী ও বিষ্ণুর মূর্তি রয়েছে।
তিরথগড় জলপ্রপাত (Tirathgarh Falls) – কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার মুখেই কাঙ্গের নদীর বুকে তিরথগড় জলপ্রপাত। জগদলপুর থেকে দূরত্ব ৩৯ কিমি। ১০০ ফুট ওপর থেকে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে নেমে এসেছে দুধসাদা জলপ্রপাত। অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছনো যায় জলপ্রপাতের পায়ের কাছে।
কুটুমসর গুহা (Kutumsar Cave) – তিরথগড় থেকে ১ কিমি এগিয়ে আদিম অরণ্যের বুকে প্রাচীন গুহা কুটুমসর। মাটির গভীরে প্রায় ৩৫ কিমি নীচে ২৫০মি দীর্ঘ গুহাটিতে সংকীর্ণ ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। পাহাড় চুঁইয়ে জল পড়ে পড়ে গুহার দেওয়ালে তৈরি হয়েছে স্ট্যালাগমাইট-স্ট্যালাগটাইটের অপরূপ সব কারুকার্য। গুহার ভেতরে দিনের বেলাতেও জমাট অন্ধকার. গাইডের সৌরলন্ঠনই ভরসা। সঙ্গে টর্চ রাখলে সুবিধা হবে।
কুটুমসর গুহায় প্রবেশের জন্য জগদলপুরে পর্যটনের অফিস থেকে টিকিট কাটতে হবে। গুহামুখ থেকে ১০ কিমি আগে চেকপোস্ট। এখানে রসিদ জমা দিয়ে গাইড ও লাইট নিয়ে নিন। ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন গুহা খোলা থাকে।
কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক (Kanger Valley National Park) – বাস্তার জেলার প্রাণভূমিতে একটুকরো নিষ্পাপ অরণ্যের ঠিকানা কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। ২০০ বর্গ কিমি তরাই বনভূমি ছেয়ে আছে শাল, সেগুন, টিক, অর্জুন, মহুয়া, কেন্দু, খয়ের – চেনা অচেনা নানান গাছপালা। রয়েছে নানা ওষধি গাছও। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলেছে কাঙ্গের নদী। ভেজা ভেজা আদিম অরণ্যে পাথরের গায়ে জমে উঠেছে কালচে সবুজ শ্যাওলা আর ছত্রাক. পাথর জড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফার্ণের দল। আদিবাসী মানুষ আর পশুপাখি – জঙ্গলের সব আদিম বাসিন্দাই এখানে মিলেমিশে বাস করে। নানান প্রজাতির হরিণ, শম্বর, শেয়াল, বনবেড়াল, বুনোশুয়োর, চিতা, কাঠবিড়ালি, হায়না, নানা জাতের সাপ, এমনকী বাঘের দেখাও মিলতে পারে এই ঘন অরণ্যে. গাছের পাতার শব্দে মিশে যায় ঈগল, কাঠঠোকরা, পেঁচা, ময়ূর, মাছরাঙা, বুনো পায়রার বিচিত্র আওয়াজ। দেখা মিলতে পারে বাস্তারের বিখ্যাত পাহাড়ি ময়নার, গান গাইতে ভারি ওস্তাদ এরা। ১ জুলাই থেকে ৩১ অক্টোবর কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক বন্ধ থাকে।
চিত্রকোট জলপ্রপাত (Chitrokot Falls) – জগদলপুরের পশ্চিমে ৩৮ কিমি দূরে বিন্ধ্য পর্বতমালার বুকে অশ্বখুরাকৃতি চিত্রকোট জলপ্রপাত, ভারতের নায়গ্রা। কাবেরীর উপনদী ইন্দ্রাবতী সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রায় ১০০ ফুট নিচে। জলকণার সাদা ধোঁয়ায় ঝিকমিক করে সূর্যের মায়াবী সাতরঙ। ভরা বর্ষায় আরও রূপসী হয়ে ওঠে এই জলধারা। প্রপাতের নিচে ডাইনে বাঁক নিয়ে জলস্রোত মিলিয়ে গেছে গোদাবরীর বুকে।
যাওয়া : নিকটতম বিমানবন্দর রায়পুরে। ট্রেনে বা বিমানে রায়পুর পৌঁছে জগদলপুর যাওয়াই সুবিধাজনক। যাঁরা একযাত্রায় জগদলপুরের সঙ্গে ভাইজাগ-আরাকু ঘুরতে চান তাঁরা বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকু হয়ে কিরনডুল এক্সপ্রেসে জগদলপুর পৌঁছান। রায়পুর থেকে জগদলপুর যাওয়ার বাস রয়েছে সারাদিনই।
থাকা : ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের জগদলপুরে আসানা ট্যুরিস্ট রেস্টহাউস ও চিত্রকোটে রিসর্ট আছে।
উৎসব – দশেরায় গোটা বাস্তার মেতে ওঠে উৎসবে। ধুমধামে পুজো হয় দন্তেশ্বরী মাঈয়ের।
বাস্তারে বড় আকর্ষণ গ্রামীন হাটগুলি। জগদলপুরে হাট বসে প্রতি রবিবার। জগদলপুর থেকে ১৬ কিমি দূরে বস্তার হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার। চিত্রকোট জলপ্রপাত যাওয়ার পথে প্রতি শুক্রবার বসে লোহান্ডিগুড়া হাট। জগদলপুর থেকে ৯ কিমি দূরে পামেলা হাট বসে প্রতি রবিবার।
কেনাকাটা – জগদলপুর ও নারায়ণপুরে রয়েছে হ্যান্ডিক্র্যাফটস শপিং সেন্টার. বাস্তারের আদিবাসী শিল্পীদের হাতে তৈরি টেরাকোটা, রট আয়রন, বেল মেটাল, বাঁশ ও কাঠের অপরূপ সব ভাস্কর্য মিলবে এখানে। খ্যাতি রয়েছে সুতি আর কোসা সিল্কের ফেব্রিকেরও। কেমন করে তৈরি হয় এইসব অপরূপ শিল্পকাজ, তা প্রত্যক্ষ করতে যেতে হবে শিল্পগ্রাম কোন্ডাগাঁও।