নৈসর্গিক নায়াগ্রা
পায়েল চক্রবর্ত্তী
~ তথ্য- নায়াগ্রা জলপ্রপাত || - নায়াগ্রার আরো ছবি ~
সময়টা জুলাই মাস। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে চার দিনের টানা ছুটিটা কাটানোর জন্য উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নায়াগ্রাতে আগে থেকেই আমরা রির্সট বুক করে রেখেছিলাম।
বাস ধরার জন্য ভোর ছ’টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে প্রথমে গেলাম এডিসন-এ। বাসে উঠে জানলার ধারে বসেই দীর্ঘ ন’ঘন্টার পথ কতক্ষণে শেষ হবে তা একবার ঘড়ি দেখে হিসেব করে নিলাম। মাঝে ক্যাফেতে একটু থেমে বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা।
স্বামী-র কর্মসূত্রে আমরা নিউ জার্সি-র বাসিন্দা। যখন ছোটবেলায় ভূগোলের বই তে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ছবি দেখেছিলাম, বিশদ বিবরণ পড়েছিলাম তখন কখনও ভাবিনি যে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাতকে চাক্ষুষ দেখারও সুযোগ পাব! নায়াগ্রা আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে এবং কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত।
একটা ব্রিজ পেরোনোর সময় গাইড ভিকি জানালেন যে আমরা নায়াগ্রা নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছি,আর কিছুক্ষনের মধ্যেই জলপ্রপাতের সামনে পৌঁছে যাব। বাসশুদ্ধু সবাইতো দারুণ উত্তেজিত। বাস থেকে নেমে নায়াগ্রা ফলস্ স্টেট পার্কের মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম নায়াগ্রা নদীর জলও কুলুকুলু শব্দে বেগে এগিয়ে চলেছে, তারপর যেন হঠাৎই আমাদের মুগ্দ্ধ করে ১৬৭ ফুট গভীর খাদে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। চারপাশে প্রচুর মানুষের ভিড়। নায়াগ্রাতে এই সময় প্রায় কুড়ি লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। রেলিং-এর ধার ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জলপ্রপাতের একদম সামনে। ঝোড়ো হাওয়াতে জলের ছিটে এসে লাগছে চোখেমুখে। না! এ তো আর বই এর পাতার ভিতরের ছবি নয়,এ যে পুরো সামনে দাঁড়িয়ে! স্পর্শ পাচ্ছি শরীরে!
আমরা সামনে যে জলপ্রপাতটিকে দেখছিলাম তার নাম আমেরিকান ফলস্। আসলে চারটি হ্রদের জলের ধারা মিলিতভাবে তিনটি জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে - আমেরিকান ফলস্, ব্রাইডাল ফলস্ এবং হর্সস্যু ফলস্ বা কানাডিয়ান ফলস্। এই তিনটি জলপ্রপাতকে একসাথে নায়াগ্রা ফলস্ বলা হয়। গাইডকে অনুসরণ করে রওনা হলাম এরপর মেইড্ অফ্ দ্য মিস্ট -এ যাওয়ার জন্য।
লিফটে নামলাম পাঁচতলা থেকে একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সেখানে রেনবো ব্রীজের কাছে ফেরিঘাট থেকে একটা ফেরিতে উঠে জলপ্রপাতের একদম মাঝখানে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু হল আমাদের। একটা নীল রেনকোট দেওয়া হল। বাঁদিকে আমেরিকান ফলস্ এবং ব্রাইডাল ফলস্-কে ফেলে এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে – আশপাশ ঢেকে আছে ধোঁয়ার মত সূক্ষ্ম জলকণায়। যত এগোচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল যেন কুয়াশার চাদর কেটে কোন আজব দেশে চলেছি!
অনেক উঁচু থেকে প্রচণ্ড বেগে জলের ধারা যেখানে আছড়ে পড়ছে তার থেকে মাত্র হাত কয়েক আগে বোটটা দাঁড়িয়ে পড়ল। চারপাশে জলপ্রপাতের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য যেন বাকি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া! প্রায় ২২০১ ফুট চওড়া জলপ্রপাতটি যেন দুহাত মেলে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে তার গর্জনের সুরে। চোখের সামনে যে নৈসর্গিক রূপ আমরা দেখছিলাম, সৃষ্টিকে সত্যি তার জন্য ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। ঘোড়ার ক্ষুরের মত আকারের এই জলপ্রপাতের নাম হর্সস্যু ফলস্। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। বোটের বাঁদিকে চেয়ে দেখি কাছ ঘেঁষে একটা রামধনু যেন আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ফন্দি আঁটছে। ওপর থেকে সূর্যও যেন যোগ দিয়েছে সেই খেলায়। তারই মাঝে মাঝে সীগাল পাখিগুলি জলপ্রপাতের কাছ ঘেঁষে খেলার ছলে তাদের স্নান সেরে নিচ্ছে, সঙ্গে চলছে মাছ শিকার। বাতাসে ভেসে বেড়ানো জলকণা পবনদেবের দৌরাত্মে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শরীর-মন।
এত বিভোর হয়ে ছিলাম যে হঠাৎ সামনের একটি ঘটনায় সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম জলপ্রবাহের সামনে একটা গোল বড় রাবার বল ওপর থেকে পড়ল আর তৎক্ষনাৎ দুটি পুলিশ হেলিকপ্টার আবির্ভূত হয়ে আমাদের বোটের সামনের দিকে চক্কর খেতে থাকল বলটি উদ্ধার করার জন্য। আমাদের বোটের ডানদিকে অন্য একটি বোটে মানুষের হর্ষধ্বনি, উড়ন্ত নিশানা দেখে বুঝলাম ওটি কানাডার বোট। ফেরিঘাটে ফেরার সময় গাইডকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এটা সম্ভবতঃ কোনও কীর্তিমানের বাহাদুরিতার নিদর্শন -এই ইভেন্টের নাম ‘নায়াগ্রা ডেয়ার ডেভিল’। রাবারবলের ভিতর বসে কোনও অতি সাহসী ভদ্রলোক জলপ্রপাতের ওপর থেকে প্রায় ২০০ ফুট নিচে ঝাঁপ দিয়ে হয়তো জয় করলেন ভয়ঙ্কর সুন্দর এই নায়াগ্রাকে। এরূপ চেষ্টা আগেও বহুবার হয়েছে। জীবিত থাকলে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, আর অসফল হলে সুইসাইড রের্কড!
ফেরি ছাড়াও পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনে থেকে নায়াগ্রাকে দেখার আর এক উপায় আছে যার নাম ‘কেভ অফ দ্য উইন্ডস্’। ব্রাইডাল ফলস্ এর পিছনের দিকের গুহা কেটে তার উপর দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে ফলস্-এর সামনে দিকে এনে একটা ডেক এর মত জায়গার উপর দাঁড়িয়ে ফলসটাকে সামনের থেকে দেখার আর তার সাথে কালবৈশাখী ঝড়ের মত জলপ্রপাত এর দমকা বাতাস অনুভব করা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু কিছু মেরামতির কাজ চলছিল বলে সেই সৌভাগ্য আমাদের হল না।
সূর্য ঢলে পড়ছিল পশ্চিমে - দুই দেশের সীমান্ত থেকে পড়া নানা বর্ণের আলোর ছটায় নায়াগ্রাকে যেন আরও মোহময়ী লাগছিল। ক্রমশঃ রাত নেমে এল। পূর্ণিমার দু’দিন আগের পূর্ণ চাঁদের মায়ায় বর্ণময় জলপ্রপাতের ঝঙ্কারে আমার মন যেন কোন অপার্থিব দুনিয়ায় পৌঁছে দিল।
~ তথ্য- নায়াগ্রা জলপ্রপাত || - নায়াগ্রার আরো ছবি ~
হাওড়ার মেয়ে পায়েল স্বামীর কর্মসূত্রে আমেরিকা প্রবাসী। ভালোবাসেন গান শুনতে, নানারকম রান্না করতে আর নানান নতুন জায়গায় বেড়িয়ে এসে সেইসব অভিজ্ঞতার কথা লিখতে।