বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com

 

ঈশ্বর-প্রকৃতি-ভ্রমণ

অদিতি ভট্টাচার্য

কৌশানি পৌঁছেই ঠিক করেছিলাম পরের দিন চৌকরি যাবার আগে বৈজনাথ আর বাগেশ্বর দেখে যাব। কৌশানি থেকে বৈজনাথের দূরত্ব ষোলো কিলোমিটারের মত। বৈজনাথ উত্তরাখণ্ডের বাগেশ্বর জেলার একটা ছোট শহর - গোমতী নদীর তীরে, গরুড় উপত্যকায়, মোটামুটি এগারোশ মিটার উচ্চতায়। শহরটার নামই হয়েছে বৈজনাথ মন্দিরের নাম থেকে। বৈজনাথ আসলে ভগবান শিব বা বৈদ্যনাথের মন্দির যা থেকে অপভ্রংশে বৈজনাথ হয়েছে।
মূল রাস্তা থেকে অনেকগুলো পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গোমতী নদীর ধার দিয়ে বৈজনাথ মন্দিরে পৌঁছতে হয়। যাবার রাস্তাটা খুব সুন্দর। গোমতীর ধারে ফুলে সাজানো সুন্দর বাগান। বাগান আর নদীর ধার দিয়ে কিছুদূর গিয়ে মন্দির। বৈজনাথ মন্দিরকে শুধু মন্দির বললে ভুল বলা হবে। আসলে এটা অনেকগুলি মন্দিরের সমাবেশ - বৈজনাথ গ্রুপ অব টেম্পলস।
প্রস্তর নির্মিত বৈজনাথ মন্দির তৈরি হয়েছিল দশম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে। নির্মাণ করেছিলেন কত্যুরী বংশের রাজারা। বৈজনাথ শহর ছিল কত্যুরী রাজাদের রাজধানী যার তৎকালীন নাম কার্তিকেয়পুরা আর এই উপত্যকার নাম ছিল কত্যুর। মন্দিরে যাওয়ার জন্যে যে সিঁড়িগুলো দিয়ে নামতে হয় সেগুলোও কোনো এক কত্যুরী রানীর আদেশেই তৈরি। কথিত আছে এখানে গোমতী আর গরুড়গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। পুরাণের গল্পকথা বাদ দিলেও এখানে এলে যা মুগ্ধ করে তা হল বৈজনাথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শান্ত, নির্জন পরিবেশ আর অসাধারণ দৃশ্যপটের ব্যাকগ্রাউণ্ডে এই মন্দিরগুলো বছরের পর বছর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোহিত বা পাণ্ডার জোরজুলুম নেই, পুজো দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। নিজের ইচ্ছে মতো মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণভরে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করা যায়। নৈঃশব্দের মাঝে কানে আসে শুধু গোমতী নদীর কলকল বয়ে যাওয়া। মন্দিরের ভেতরে শিব, পার্বতী, গণেশ ইত্যাদি দেব দেবীর মূর্তি ছাড়াও বাইরের গাত্রে পাথরের কারুকাজের মাঝে কালো পাথরের পার্বতী মূর্তি। দুটো একই রকম মন্দির আছে যা টুইন টেম্পলস নামে পরিচিত।
গোমতী নদীতে প্রচুর মাছ। এখানে মাছ ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই স্বচ্ছ জলের মধ্যে তাদের নির্ভয় ঘোরাফেরা স্বচ্ছন্দে ক্যামেরাবন্দি করা যায়। আর জলের ওপর মাছের খাবার ছড়ালেতো কথাই নেই। মুর্হূতের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভিড় করে আসে।
পরের গন্তব্য বাগেশ্বর। বাগেশ্বর নাম এসেছে ব্যাঘ্রেশ্বর থেকে। বাগেশ্বর শহর অবস্থিত সরযূ আর গোমতী নদীর সঙ্গমস্থলে। সরযূ নদী - শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই কোন ছোটবেলায় পড়া রামায়ণের গল্প যার শুরুই ছিল সরযূ নদীর তীরে অযোধ্যা নগরী। দুই নদীর সঙ্গমের একদম কাছেই বাগেশ্বরের অতি প্রাচীন বাঘনাথ মন্দির। যদিও মন্দিরে পৌঁছতে হয় অনেকটা হেঁটে বাজার দোকানের মাঝখান দিয়ে। এই মন্দির গড়ে উঠেছিল চাঁদ রাজবংশের রাজত্বের সময়ে। কথিত আছে ভগবান শিব এখানে বাঘের রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই এটি বাঘনাথ মন্দির। শিবরাত্রিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। মন্দিরের পাশে সরযূ নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে বেশ ভালো লাগে। সরযূ গোমতীর সঙ্গে মিলেমিশে বেশ বিশালকায়। আশেপাশে আরও কয়েকটা মন্দির আছে। গোমতী আর সরযূর সঙ্গমস্থলে শ্মশান রয়েছে। সরযূ নদীর ধারে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে রওনা দিলাম চৌকরির উদ্দেশে।

 

সংখ্যাতত্ত্ববিদ অদিতির কাছে বই আর অক্সিজেন সমতুল্য। কর্মসূত্রে বছর খানেক আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি ভালোবাসেন নানা জায়গায় বেড়াতে আর বেড়ানোর কাহিনি লিখতে।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

জল আর পাখিদের দেশে

বনশ্রী চক্রবর্তী

||ভেম্বানাদ লেকের ছবি ||

যতদূর চোখ যায় শুধু নীল আর সবুজ...। প্রকৃতি যেন উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে তার সব সৌন্দর্য। কেরালার ভেম্বানাদ লেকের ধারে বসে চা খেতে খেতে খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম নিজের শহুরে জীবনটাকে।
ভারতের সব চেয়ে লম্বা লেক এটাই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সকালের জলখাবার খেয়ে স্পিডবোটে ঘোরার, সেইমত বেরিয়ে পড়লাম। প্রচন্ড বেগে জল কেটে ছুটে চলা বোটে বসে জলের ছিটেয় ভিজে যাচ্ছিলাম সবাই। বেশ মজা লাগছিল। কোনমতে জলের ছিটে থেকে ক্যামেরা বাঁচিয়ে ছবি তোলা। দাঁড়ানোও যাচ্ছেনা ঠিকমত। লেকের টলটলে নীল জলের নীচে চোখে পড়ছে মাছেদের খেলা আর ওপরে নানান পাখির ভেসে যাওয়া।
বিকেল চারটে নাগাদ আবার বেরোনো সান-সেট ক্রুইজে। খোলা আকাশের নীচে লঞ্চে বসে বাঁশি আর মৃদঙ্গের সুর শুনতে শুনতে ভেসে চলেছি। আকাশের মুখ ভার – আমাদেরও মনটা একটু খারাপ খারাপ – সূর্যাস্ত দেখা যাবেতো? পাখিরা সব বাসায় ফিরছিল, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কখনোবা একঝলক বিকেলের আলো – মনে হচ্ছিল এইতো স্বর্গ...। জেটিতে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি নামল – ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমরা ভিজছি আর মাথার ওপর মেঘ ও রৌদ্রের খেলা! পরদিন ঠিক সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে পড়া – গন্তব্য কুমারাকোম বার্ড স্যাংচুয়ারি। চেনা-অচেনা গাছপালার একটা বড় অংশ রবার গাছ। গাইডকে সঙ্গী করে স্যাংচুয়ারির অরণ্যের গভীরে ঢুকতেই কানে এল নানান পাখির ডাক। আমরা যে সময়টায় গিয়েছিলাম তখন ছিল পাখিদের নেস্টলিং সিজন। ডিম ফুটে সবে ছোট্ট ছোট্ট পাখির বাচ্চারা মাথা বার করছে। একজায়গায় এসে গাইড বললেন জঙ্গলে একটু ঢুকলেই বাদুড়ের কলোনী দেখা যাবে। সেখানে পৌঁছে দেখি ওরে বাবা গাছে গাছে তা বোধহয় প্রায় হাজার দশেক বাদুড় ঝুলে আছেতো হবেই। এত বাদুড় আমি কখনো একসাথে দেখিনি। আর কিছুটা এগোলেই ওয়াচটাওয়ার, ওখান থেকে খুব ভালো পাখি দেখা যাবে – গাইডের এই আশা আর আশ্বাসের ঠেলাতেই ক্লান্ত শরীরে আমরা পৌঁছে যাই অভীষ্টে। যত এগোচ্ছি ততই বাড়ছে পাখির কিচিরমিচির। অবশেষে ওয়াচটাওয়ারে ওঠার পর মনে হল এতটা পথ হাঁটা সত্যিই সার্থক – একেবারে যেন সেই ক্রৌঞ্চ দ্বীপে পাখিদের রাজ্যেই পৌঁছে গেছি। নানান প্রজাতির অন্তত হাজারদশেক পাখি রয়েছে - কেউ উড়ছে, কেউ বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে, কেউবা বসেছে ডিমে তা দিতে, কেউবা বাচ্চাকে দিচ্ছে প্রথম ওড়ার পাঠ। তারমধ্যেই চলছে যেন ঝগড়াঝাটি-মানঅভিমানের পালাও। ছবি তুলব না শুধু ওদেরই দেখব ঠিক করে উঠতে পারছি না। গাইড চেনান হেরণ, স্টর্ক, পিন টেল ডাক, কর্মোরেন্ট, ইগ্রেট, টিল, ডার্টার, পেঁচা, কোকিল আরও হরেক জানাঅজানা পাখিদের। মনে হচ্ছিল অমলের ঠাকুরদাদার মতোই বলি আহা এখানেই যদি থেকে যাওয়া যেত, কেবল ডানা নেই এই যা – ফিরে যেতে যেতে মনের ডানায় ভর করে আবার আসব কথা দিলাম।

পেশায় শিক্ষিকা বনশ্রী ভালবাসেন বেড়াতে এবং প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণির ছবি তুলতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

একদিন সারাদিন কুমিল্লায়

রফিকুল ইসলাম সাগর

বৃহত্তর কুমিল্লার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস - শত শত বছরের পুরনো রাজা-প্রজাদের বাড়ি-ঘর, রানিদের জন্য নির্মিত দিঘি ও পুকুর ঘাট, ব্রিটিশদের কবরস্থান, আরও নানান পুরাকীর্তি।
ইতিহাসের সেই স্পর্শ নিতে একদিন হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা ক'জন। সকাল ছটায় মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে রওনা। মাত্র দেড় ঘণ্টাতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। কুমিল্লায় নূরজাহান হোটেলের সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ওখানকারই আরও দুই বন্ধু। সবাই মিলে হোটেলেই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম।
প্রথমে গেলাম 'কুমিল্লা বার্ড' ঘুরে দেখতে। ভেতরে সবকিছু বেশ সাজানো-গোছানো - উঁচু-নিচু পথ, নানারকমের গাছ-গাছালি, সবকিছুতেই যত্নের ছোঁয়া। এর পরের গন্তব্য কোর্টবাড়ি। কোর্টবাড়ি রুব্বান মুড়ায় আছে পুরাকীর্তির সম্ভার। পুরোনো বাড়িগুলির অধিকাংশই এখন মাটির নীচে। এখান থেকে সংগ্রহ করা কিছু মূর্তি ও জিনিসপত্র বর্তমানে জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এত বড় চত্ত্বরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলাম।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই পৌঁছালাম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কবরস্থান ওয়ার সিমেটারিতে। মেঘলা দিনে ব্রিটিশদের সেই সাজানোগোছানো নির্জন সুন্দর কবরস্থানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমরা যেন বিদেশে আছি। কুমিল্লা মূল শহরের কাছাকাছি ইপিজেড এলাকা। সেখানে সরকারি হাসপাতালের পাশে কুমিল্লা বিমান বন্দর। বিমান বন্দরটি অনেক পুরানো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এখানে মিত্র বাহিনির বিমান ও সামরিক ঘাঁটি ছিল। এখান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক অপারেশন চালানো হয়েছে - প্রধানত বার্মা ও চিনে। আহত সৈন্যদের চিকিৎসা হত কুমিল্লা সামরিক হাসপাতালে। যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের অনেকেই শায়িত রয়েছেন ওয়ার সিমেটারিতে।
রেল স্টেশনের কাছে দুপুরের খাবার খেলাম। কুমিল্লা থেকে ভারতের সীমান্ত খুব কাছে। সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো। বড়জ্বালা সীমান্ত ফাঁড়ি পার করে ভিতরের দিকে গেলাম। সেখানের বাসিন্দারা নাকি প্রায়শঃ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। গ্রামের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করতে পারব কিনা। সে বললো না, আপনারা যেহেতু এখানে অপরিচিত তাই ভিতরে প্রবেশ করা যাবেনা। শুধু মাত্র পাসপোর্ট ভিসা থাকলে প্রবেশ করা যায়, নাহলে বিপজ্জনক। অবৈধ প্রবেশ হিসেবে গণ্য হবে। যেকোনো রকমের বিপদ হতে পারে। ভারতের সীমান্তর কাছাকাছি পৌঁছানোর পর লক্ষ্য করলাম সাইনবোর্ডে লেখা আছে সামনে ভারতের সীমান্ত রেখা, অতিক্রম নিষেধ।
এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে রাতের খাওয়া সেরে ঢাকার বাসায় ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত হয়ে গেল।

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন কোর্সে পাঠরত রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বেড়ানো আর ভ্রমণ সাংবাদিকতা তাঁর পছন্দের বিষয়।

 

 

"ছুটির আড্ডা" - পরের পাতা

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher