বনে-পাহাড়ে
শুভেন্দু রায়, দেবাশিস মন্ডল, দীপক ভৌমিক
~ বড়ন্তি-পঞ্চকোটের তথ্য ~ বড়ন্তির আরো ছবি - সিন্টু ভট্টাচার্য ~
বড়ন্তি পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় বেলা বারটা বাজল। এখানে আমাদের আগামী দিন তিনেকের ঠিকানা বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচার স্টাডি হাট। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে আড়াইটে নাগাদ আমরা ঘুরতে বেরোলাম। বড়ন্তি পাহাড়ের একদিক দিয়ে উঠে বড়ন্তি গ্রামের পিছন দিকে শাল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে এলাম। পাহাড়ের ওপর থেকে জলাধার ও চারিদিকের ধানখেত যেন পটে আঁকা ছবি।
জীবনপুর হয়ে ড্যামের শেষ প্রান্তে একটা ব্রীজ আছে, সেটা পেরিয়ে তালবেড়িয়া গ্রাম। যাওয়ার পথে জীবনপুরে ঢুকে এই গ্রামটি না দেখলে দারিদ্র্যের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা কাকে বলে তা বোঝা যেত না। গ্রামটির সমস্ত মানুষই সাঁওতাল। তালবেড়িয়া গ্রাম পেরিয়ে রাস্তাটি সুভাষ রোডে পড়েছে। বরাকর পুরুলিয়া রোড থেকে এই অঞ্চলের গ্রামগুলির মূল সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তা এই সুভাষ রোড। রাস্তাটি শেষ হয়েছে বাঁকুড়া- পুরুলিয়া পথে সাঁতুড়িতে। ১৯২৪ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু স্থানীয় রামচন্দ্রপুর আশ্রমে স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে সভা করতে এসেছিলেন এই পথ ধরেই। সেদিনের মাটির পথ আজ আধুনিক পথ হয়ে তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় তালবেড়িয়া পেরিয়ে গ্রামের শেষে এসে দাঁড়িয়েছি। তালবেড়িয়ার এই জায়গাটি থেকে ছোট ছোট পাহাড়, টিলাগুলি খুব সুন্দর দেখায়। সামনের পাহাড়ের কোলে বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকাতে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এই পথ ধরে ব্লক অফিসের পাশ দিয়ে রাস্তাটি পোরোলি পাহাড়ের নীচ দিয়ে পোরোলি নামে একটি সাঁওতাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে মুরাডি গ্রামে পড়েছে। এই পথ ধরে আমরা মুরাডি পাহাড়ের নীচ দিয়ে বড়ন্তি ড্যামে পৌঁছলাম।
বড়ন্তি ড্যাম থেকে সূর্যাস্তের সময় আকাশে হাজারো রঙের অপরূপ শোভা চিরদিন মনে থাকবে। প্রায় ৬-৭ কি.মি. হাঁটার পর সবাই মিলে ড্যামের ধারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে এলো। ফেরার পথে দূর থেকে বাজনার আওয়াজ কানে ভেসে এল। অন্ধকারের মধ্যেই লক্ষ্য করে দেখি একজন স্থানীয় মানুষ বিরাট একটি কালো রঙের টিউব কাঁধে ও হাতে জাল নিয়ে ড্যামে মাছ ধরতে নামছেন। সারা রাত ধরে মাছ ধরবেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম দূরে কোথাও সাঁওতাল বা ছৌ নাচের মহড়া চলছে।
পরদিন সকালে ঠিক সাতটার সময় দুটি টাটা সুমো এসে হাজির হল। গাড়ি আমাদের নিয়ে বড়ন্তি ড্যামের উপর দিয়ে রামচন্দ্রপুর-কিনাইডি-কোটালডি হয়ে সুভাষ রোডের শেষে বরাকর পুরুলিয়া রোডে পড়লো। সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে রঘুনাথপুর দিকে কিছুটা যাবার পর গোবাগের মোড়। গোবাগ মোড় থেকে পাকা রাস্তা ধরে পাঞ্চেৎ জলাধার দিকের যাবার পথে ৩ কি.মি. দূরে রাস্তার দক্ষিণে ও পঞ্চকোট পাহাড়ের পশ্চিম দিকে পাহাড় থেকে একটি জলধারা পড়ছে যার স্থানীয় নাম “হদহদি”। হদহদির ১০০ মিটার দূরে মূল রাস্তা থেকে একটি পথ পাহাড়ের ভিতর প্রবেশ করেছে। বহু কাল আগে তৈ্রি হওয়া পঞ্চকোট পাহাড়ের একটি চূড়াতে যাবার রাস্তাকে কিছু বছর আগে বন দপ্তর সংস্কার ও পুর্ননির্মাণ করেছিল। গাড়ি চলাচলের অনুপযুক্ত হলেও ট্রেকিং এর পক্ষে রাস্তাটি ভাল। পাহাড়ের চড়াই উতরাই পেরিয়ে একদিকে গভীর খাদ নিয়ে পঞ্চকোটের বৈচিত্র্যময় শাল, মহুয়া, কেন্দুর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তাটি ৭ কি.মি. দূরে শেষ হয়েছে। গাড়ি থেকে হদহদির কাছে নেমে সেই পথে আমাদের হাঁটা শুরু হল। আমরা যাব ৭ কি.মি. ট্রেক করে ২১০০ফুট উচ্চতায়। মূল রাস্তা থেকে বেশ কটি পায়ে চলা সুঁড়ি পথ পাহাড়ের এদিক ওদিক চলে গেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে রাস্তাটি বেশ চড়াই। চারদিকের জঙ্গলও পাতলা। রাস্তা যত এগোচ্ছে জঙ্গলের পরিবর্তনও চোখে পড়তে লাগল। সারি সারি শাল, বেল, হরিতকি, আমলকি, বহড়া, কেন্দু ও কত রকমের নাম না জানা গাছ। পাহাড়ের ঝোপ ঝাড়ে নানা ধরনের ফুল, বাতাসে তাদের বিচিত্র গন্ধ। একদিকে চড়াই পথ অপরদিকে গভীর খাদ। ২ কি.মি. যাবার পর উপর থেকে সমস্ত কিছু পরিস্কার দেখা যেতে লাগলো। গ্রামগুলো ছোট ছোট দেশলাই বাক্সের মত। তার মাঝে মাঝে রাস্তাগুলো সাপের মত এঁকে বেঁকে চলেছে। দূরে ঐতিহাসিক শেরগড়ের জঙ্গল আজকের আধুনিক আসানসোল ও বার্ণপুর শহর। কারখানাগুলিতে নানা রকমের ধোঁয়া উঠছে। অপরদিকে জৈন যুগের বিক্রমাদিত্যের প্রিয় জায়গা তেলকুপি দখল করে নেওয়া পাঞ্চেৎ জলাধারের জলরাশি। সবই যেন কোন শিল্পীর তুলির টানে আঁকা জীবন্ত এক পট। ভাবলাম মনের মধ্যেকার ইতিহাসের জুম দিয়ে যে ছবি দুচোখ ভরে দেখছি সে ছবি ক্যামেরা বন্দি করব কেমন করে? কখন যে ৬ কি.মি. পথ পেরিয়ে এসেছি তা বুঝতেই পারিনি। তাকিয়ে দেখি পূর্ব-দক্ষিণ কোন বরাবর ২২০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পঞ্চকোটের চূড়া দেখা যাচ্ছে। মূল রাস্তা থেকে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে উঠে দেড়শো ফুট হেঁটে যাবার পর দেখা গেলো তিনশো স্কোয়ার ফুট বিশিষ্ট একটি প্রায় সমতল হয়ে যাওয়া জায়গা যেটির চারদিক পাড় দিয়ে বাঁধানো। এটি অতীতের নপকরা বা নপুকুর। জনশ্রুতি এই পুকুরে আগে নীল পদ্ম জন্মাতো। পুকুরের দক্ষিণ দিকের সমতল জমিতে দুষ্প্রাপ্য ভেষজ চাষ করা হত। পঞ্চকোট রাজারা আয়ুর্বেদের উন্নয়নে এখানে বহু পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছেন। সারা দেশ থেকে এই চর্চার জন্য বৈদ্যদের আনা হয়েছিল। আজও বহু দুস্প্রাপ্য ভেষজ এই পাহাড়ে পাওয়া যায়। সেইসময় পুকুরটিতে সারা বছর জল থাকতো। এখন পাঁকে মজে গেছে। উত্তর দিকের পুকুর পাড়ে এক নাম না জানা সাধু প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে ডেরা বেঁধেছিলেন। সাধনপীঠের ছাইভষ্ম এখনও সেখানে পড়ে আছে। জায়গাটিকে সাধুর ডেরা বলা হয়। পাহাড়ের এই অঞ্চলটিতে বছরে বেশ কিছু সময় মেঘ জমে থাকে। ফলে এখানকার জলবায়ু পাহাড়ের অন্য স্থানের থেকে একটু অন্যরকম। মাঝে মাঝে দার্জিলিং এর ম্যালের মত মেঘ উড়ে যাচ্ছে। তবে মেঘের এই খেলা বর্ষা কালেই বেশী দেখা যায়। দেখতে দেখতে আমরা রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম।
এখানে পর্যটকদের বসার জন্য বন দপ্তরের তৈরি একটি গোল চালা দেওয়া কংক্রিটের চারদিক খোলা ঘর রয়েছে। এখান থেকে চারদিক ঠিক যেন ছবির মত। ইতিহাস ঢাকা পড়েছে বর্তমানের চাদরে। পুরনো দিনের শেরগড়ের জঙ্গল আর নেই যেখান থেকে শেরসাহ বঙ্গ বিজয় শুরু করেছিলেন। ভয়াল ভয়ঙ্কর দামোদর, বরাকর বাঁধা পড়েছে পাঞ্চেৎ মাইথনে। পাহাড়ের নীচে, মাটির ওপর আর তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে ৮১০ বছর ধরে গড়ে ওঠা পঞ্চকোট রাজ্যের রাজধানী। এক সময় হাতি শালে হাতি ছিল, ঘোড়া শালে ছিল ঘোড়া। মন্দিরগুলিতে সন্ধ্যার আরতি হত। মল্লিকবাজার গমগম করতো প্রজাদের আনাগোনায়। গড় থেকে সৈন্য বাহিনী ছুটে যেত শত্রু মোকাবিলায়। আজ সে রাজধানী জঙ্গলে ভরা তেপান্তরের মাঠ। তবু আধুনিকতা চেষ্টা করেও এখনও ধ্বংস করতে পারেনি পঞ্চকোট পাহাড়কে। জঙ্গলে গাছেরা আছে, পশুরা ঘুরে বেড়ায়, ডালে ডালে পাখিরা গান গেয়ে বেড়ায়। মরশুমে পাতা ঝরে আবার নতুন পাতা হয়-ফুলে ফলে ভরে থাকে চারিদিক। এই খরাপ্রবণ জেলায় মানুষের দারিদ্র্য কিম্বা অপরিকল্পিত ভাবে পাহাড়ের তলায় তৈরি হওয়া স্পঞ্জ আয়রণ কারখানার কালো ধোঁয়া ও হাজারো দূষণ এখনও পারেনি এই পাহাড়কে শেষ করতে। আমরা যখন বাঁধানো জায়গাটাতে খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে নানা কথা বলছি ও ভাবছি সেই সময় হঠাৎ তলায় মেঘ জমে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আমরা মেঘের ওপর থেকে মেঘনাদ হয়ে সে দৃশ্য দেখলাম।
প্রায় দেড়শো বছর আগে হয়তো এখানে বসেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পঞ্চকোট পাহাড়ের মেঘের খেলা দেখে তাঁর “পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী” কবিতায় লিখেছিলেন,
‘হেরিনু রমারে আমি নিশার স্বপনে,
হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে-
পদ্মাসন উজলিত শতরত্ন-করে,
দুই মেঘরাশি-মাঝে, শোভিছে অম্বরে,
রবির পরিধি যেন। রূপের কিরণে-
আলো করি দশ দিশ, হেরিনু নয়নে,
সে কমলাসন-মাঝে ভুলাতে শঙ্করে
রাজরাজেশ্বরী, যেন কৈলাস-সদনে।....’
~ বড়ন্তি-পঞ্চকোটের তথ্য ~ বড়ন্তির আরো ছবি - সিন্টু ভট্টাচার্য ~