ইতিহাসের শহরে

মহুয়া ব্যানার্জি

~ তথ্য - ফতেপুর সিক্রি ~ ফতেপুর সিক্রির আরো ছবি - রত্নদীপ দাশগুপ্ত ~

শ্বেত শুভ্র মার্বেল পাথরে তৈরি সেলিম চিস্তির দরগার সামনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে এক ফকির। মনে পড়ছিল সেই বহু জনশ্রুত গল্পটির কথা। সম্রাট আকবর ও তাঁর স্ত্রী যোধাবাঈ বহুদিন অপুত্রক ছিলেন। পুত্রসন্তান লাভের মনষ্কামনা নিয়ে সম্রাট আকবর সস্ত্রীক আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রিতে পায়ে হেঁটে এসেছিলেন সেলিম চিস্তির দরগায় দুয়া চাইতে। আকবর ও যোধাবাঈ-এর মনোবাঞ্ছা পূরণ করে তাঁদের কোলে জন্ম নেন জাহাঙ্গীঁর। সেলিম চিস্তির দরগায় তাঁদের মনষ্কামনা পূর্ণ হওয়ায় তাঁরা শিশু জাহাঙ্গীরের নাম রাখেন “সেলিম”।
আগ্রা থেকে ৩৭কিমি দূরে অবস্থিত এই শহরটিতে প্রথমে কেবল সুফি সন্ন্যাসী সেলিম চিস্তির দরগাই ছিল। সুফি ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস যে এই দরগায় এসে প্রার্থনা করলে মনষ্কামনা পূরণ হয়। সেলিম চিস্তির দরগা, আজমের শরিফের দরগার মতই সুবিখ্যাত। পুত্রলাভের পর ১৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবর এই স্থানটিকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে ছোট্ট একটি শহরে পরিণত করেন। ১৫৭২ সালে আকবর ফতেপুর সিক্রি থেকে গুজরাট সফরে যান এবং যুদ্ধে জয়লাভ করেন। যুদ্ধ জয়ের পর এই শহর নাম হয় “ফতেহাবাদ” বা “জয়ের শহর”। আগ্রা থেকে মুঘল রাজধানী সরে আসে ফতেপুর সিক্রিতে।
সম্রাট আকবর ছিলেন উদার মনের মানুষ। তাঁর সৃষ্ট “দিন-ই-ইলাহী” সকল ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বাসনায় গঠিত। ফতেপুরসিক্রির আভ্যন্তরীণ কারুকার্যে রয়েছে পার্শী প্রভাব। নানা জায়গায় রয়েছে মুসলীম শৈলীতে জালির কাজ। লাল পাথরের দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা কারুকাজে হিন্দুরীতিতে লতাপাতা ও দেবদেবীর চিহ্ন। আবার বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টীয় স্থাপত্যের প্রেরণাও আছে কোথাও কোথাও।

সেলিম চিস্তির দরগাটি একতলা। চৌকাকৃতি ইমারতটি সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি। দরগার ভেতরে শায়িত আছে সুফি সন্ন্যাসীর মরদেহ। এখনও বহু মানুষ দরগায় সুতো বেঁধে দিয়ে যান - ইচ্ছা পূরণের আশায়। সেলিম চিস্তির আখ্যানের মধ্যে কখন তলিয়ে গিয়েছিলাম, চমক ভাঙল ছেলের ডাকে, তাকিয়ে দেখি সে আঙুল দেখাচ্ছে মস্ত বড় এক দরজার দিকে। ও বাবাঃ সে যে কি প্রকাণ্ড এক দরজা - শিশুমনতো আশ্চর্য হবেই দরজাটির বিশালত্ব দেখে, আমরাই অবাক হয়ে যাচ্ছি। গাইড বললেন, এ হচ্ছে সেই ইতিহাস বিখ্যাত “বুলন্দ দরওয়াজা”। মেহগনি রঙের দরজাটি দৈর্ঘ্যে যেমন তেমনই প্রশস্তও বটে। গাইডের কাছ থেকে জানতে পারি এটি ৫৪ মিটার লম্বা। দুটি ভারী পাল্লা প্রচুর কারুকার্যময়। চওড়া দরজার গায়ে কাঠ খোদাই করে ছোট ছোট ফুল ও আরও বিচিত্র সব কারুকাজ খুব যত্ন সহকারে করা হয়েছে। “বুলন্দ দরওয়াজা” শব্দের অর্থ হল “বৃহৎ দরজা”। সত্যি,এই দরজার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে একটা হাতি ঢুকে যেতে পারবে। এই বুলন্দ দরওয়াজাই হল ফতেপুর সিক্রি শহরটিতে প্রবেশ করার অন্যতম দ্বার। “বুলন্দ দরওয়াজা”র সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি শিল্পীর সৃষ্টিকে। দরজার ওপাশে বিস্তৃত নীল আকাশ। আর দূরে পুরো শহরটির এক ঝলক। আকবরের আমলে প্রায় কুড়ি পঁচিশজন সৈন্য মিলে দরজার একটি পাল্লা খুলতে সক্ষম হত।
এগিয়ে গেলাম জামা মসজিদের দিকে। লাল পাথরের গায়ে মাঝে মধ্যে শ্বেতপাথর বসিয়ে বিচিত্র সূক্ষ্ম কারুকার্য। কিছু জায়গায় ছত্রী ও জালির কাজ। মসজিদের মাথায় একটা বড় সাদা গম্বুজ। সম্রাট আকবরের আমলের অনেক আগে থেকেই এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন হয়। অতীতের মতো আজও প্রতি শুক্রবার নামাজের ধ্বনিতে মুখরিত হয় এখানকার আকাশ।
ইতিহাসের গল্পকথা শুনতে শুনতে যেন ইতিহাসের পথ ধরেই পৌঁছে গেলাম “নহবৎ খানা”-য়। “হাতিপোল গেট” বা “এলিফ্যান্ট গেটে”র ঠিক পাশে অবস্থিত ‘নহবৎ খানা’ প্রকৃতপক্ষে একটা স্টেজের মতো। এক সময়ে এখানে নহবৎ-এর আসর বসত। রাজা এলে ঢাকঢোল সানাই ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মহারাজকে সম্বর্ধনা জানানো হত। কালচক্রের আবর্তনের ফেরে একদা মুখর সে নহবৎখানা আজ শূন্য। জৌলুসহীন ও মূক হয়ে পড়ে আছে। রয়ে গেছে শুধু তার কঙ্কালসার কাঠামোটাই।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম “কিংস্‌ গেট”- কবরখানা। এখানে মুঘল পরিবারের মৃত পুরুষদের কবর দেওয়া হত। মহিলাদের সমাধিস্থ করার স্থান আলাদা- একটু ভিতরে। মোগল সাম্রাজ্যের মহিলারা পর্দানসীন ছিলেন - তাঁদের কবরও একটু অন্তরালে সাজানো, নীরবে নিভৃতে তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন। কোন কোন কবরের ওপর সাজানো রয়েছে ফুল-মালা। ধূপের গন্ধে জায়গাটা ভরে উঠেছে। এরই মাঝে একটা গুপ্ত দরজা দেখিয়ে গাইড জানালেন যে এর তলায় নাকি সুড়ঙ্গ পথ আছে যা আগ্রা পর্যন্ত গিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি না জানি কত গোপন রাজকাহিনি জমা হয়ে আছে এখানকার ইঁট বালির পরতে পরতে। গা টা একটু ছমছম করে উঠল।
“অনুপ তালাও” একটি ছোট্ট জলাশয়। তানসেন নাকি এই সরোবরের মাঝে বাঁধানো জায়গায় বসে গান গাইতেন! জলাশয় ঘিরে বসতেন সৌভাগ্যবান শ্রোতারা – এক প্রান্তে সম্রাট আকবর – পাশে প্রাসাদের ঝরোখার আড়ালে থাকতেন যোধাবাঈ ও অন্যান্য মহিলারা।  সরোবরের স্ফটিক-স্বচ্ছ জল এখন শ্যাওলায় গাঢ় সবুজ। পাঁচতলা হাওয়া মহল পেরিয়ে চত্ত্বরের অন্য পাশে “দিওয়ান-ই-খাস”। মহারাজা ও মন্ত্রীদের “খাস” বা গুপ্ত বৈঠক হত এখানে – বৈঠক অর্থাৎ ছেলেবেলায় ইতিহাস বই-এ পড়া আকবরের ‘নবরত্ন সভা’! সত্যিই বীরবল, টোডরমল, আবুল ফজল সবারই বাড়ি আজো আছে ফতেপুর সিক্রিতে।

“দিওয়ান-ই-আম”- সাধারণ মানুষের জন্য রাজ দরবার - একপাশে মুঘলসম্রাট ও তাঁর মন্ত্রীদের বসার জায়গা। কালো স্লেট পাথর দিয়ে বাঁধানো। সামনে জনগণের বসার জন্য সুবিশাল চত্বরের ওপর দিনান্তের ছায়া নেমে আসছে ধীরে ধীরে। আকাশে পায়রার ওড়াউড়ি। নির্জন নহবৎখানায় আর খালি ইমারতগুলির ঘুলঘুলিতে ওদের বসবাস।
ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি দেখি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওপরেই - ও এই শহরেই থেকে যেতে চায় - ওই সুন্দর কারুকাজ করা লাল পাথরের বাড়িগুলিতে। অনেক বোঝানোর পর শেষপর্যন্ত অতীতের শহর থেকে বর্তমানে ফিরে আসতে রাজি হল। ততক্ষণে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে গেছে – অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে জনশূন্য শহরটিকে...।

~ তথ্য - ফতেপুর সিক্রি ~ ফতেপুর সিক্রির আরো ছবি - রত্নদীপ দাশগুপ্ত ~


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মহুয়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন দেশে-বিদেশে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher