--> :: Amader Chhuti :: সান্দাকফু – চেনা পথে ফিরে আসার গল্প

সান্দাকফু – চেনা পথে ফিরে আসার গল্প

মাহমুদ ফারুক

সান্দাকফু-ফালুট ট্রেক রুট ম্যাপ || সান্দাকফুর তথ্য
ট্রেকের ছবি - মাহমুদ ফারুক ~ ট্রেকের আরো ছবি

সান্দাকফু নামটি সর্বপ্রথম শুনেছিলাম আমার ট্রেকিং গুরু আনোয়ার ভাই-এর মুখে। উনার কাছ থেকে শুনে শুনে আর অবসর সময়ে গুগলে ম্যাপ দেখে কিছু কিছু জায়গার নামও প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে টার্গেট করে রেখেছিলাম ২০১২তেই সান্দাকফু ভ্রমণ করব। শেষপর্যন্ত তা সত্যিই করতে পারলাম – একবার নয়, একবছরের মধ্যেই দু-দুবার ঘুরে এলাম সান্দাকফু থেকে!
সান্দাকফু-র ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় যে আবেগ কাজ করেছিল তা হল জীবনে প্রথম ১২০০০ ফিট উচ্চতায় আরোহণ এবং নিজের চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং এভারেস্টের চূড়া দেখা। প্রথমবারে সঙ্গী ছিল আমার এক ট্রেকিং বন্ধু মাহবুব রুবেল। কিন্তু সেবারে কুয়াশা আর খারাপ আবহাওয়ার জন্য অনেক কিছুই দেখতে পাইনি। প্রথমবার সান্দাকফু ভ্রমণ শেষ করেই রুবেল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবছরের শেষে আমরা আবার সান্দাকফু যাব। শেষপর্যন্ত ২৮শে অক্টোবর রাতে আমরা রওনা দিলাম। তবে রুবেলভাই যেতে না পারায় মনটা বেশ খারাপ।
দিলীপদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রথমবারে শিলিগুড়ি পৌঁছে। মানেভঞ্জন যাওয়ার জন্য ২৭০০ টাকায় একটা গাড়ি রিজার্ভ করে দিয়েছিলেন উনি।এবারেও শিলিগুড়ি পৌঁছে সোজা দিলীপদাকেই খুঁজলাম মানেভঞ্জন যাবার গাড়ি রিজার্ভেশানের জন্য। আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। এবার উনি ২৫০০ টাকায় একটি টাটা সুমোর ব্যবস্থা করে দিলেন আমাদের।
গতবারে আমরা যেদিন মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে রওনা দিই,সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ। শিলিগুড়ির রাস্তা ধরে কিছুদুর যাবার পরে মিরিক, শুকিয়াপোখারি হয়ে মানেভঞ্জন। আমরা একটু একটু করে উচ্চতায় আরোহণ করছি। পাহাড়ি বাঁকগুলো ঘোরার সময় একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল।
এবারে সেই চেনা রাস্তা আর চেনা স্মৃতি দিয়ে আবার যেতে যেতে আমার যে কী পরিমাণ আনন্দ হচ্ছিল তা বলে বোঝাবার নয়। সেই ক্যান্টমেন্টের ভিতর দিয়ে রাস্তা, সেই পরিচিত পাথুরে নদী। যাবার সময় একটা বিড়ালকে রাস্তা পার হতে দেখে আমাদের ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে একটুক্ষণ বসে রইল। এবারের ড্রাইভার নিখাদ বাঙালি আর আগের ড্রাইভার ছিলেন নেপালি, বাংলা বলতে আর বুঝতে একটু আটকে যেতেন। যাই হোক বিড়ালকে গার্ড অফ অনার দিয়ে আমরা পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠা শুরু করলাম। চা বাগানের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলছে সঙ্গে নস্টালজিক গান – আহ্‌ এই অনুভূতি বলে বোঝাবার নয়। সবাই মিলে কোরাস গাইতে গাইতে ঘন পাইন বন আর চা বাগানের ভিতর দিয়ে মিরিক পৌঁছে গেলাম।
গতবার আমরা মিরিকে মিনিট পনের-কুড়ি থেমেছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল মিরিকে আর একবার আসতেই হবে, জায়গাটা খুবই সুন্দর। মিরিকে একটি খুব সুন্দর লেক আছে তার ওপারে বনভূমি। কিন্তু এবারে মিরিক এসে পুরাই হতবাক হলাম – মিরিক লেকের মাঠটায় বোধয় কোন অনুষ্ঠান হয়েছিল – চেয়ার প্যান্ডেল আর ধুলা বালুতে সব একাকার আর খালি ট্যুরিস্ট আর ট্যুরিস্ট - পুরো এলাকা গিজ গিজ করছে। চা খেয়ে,  মুড়ি ভর্তা নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম।
মানেভঞ্জন
এখান থেকে আমরা ধীরে ধীরে আরো ওপরে উঠে চা বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে সন্ধের মধ্যেই মানেভঞ্জন পৌঁছেছিলাম। মানেভঞ্জনের উচ্চতা ২১৫০ মিটার বা ৭০৫৪ ফিট আর শিলিগুড়ির উচ্চতা ছিল ১২২ মিটার/৪০০ ফিট - অর্থাৎ প্রথম দফাতেই আমরা প্রায় ২০২৮ মিটার বা ৬৬৫৪ ফিট উঠে এসেছিলাম। এর আগে আমি কখনও এত উচ্চতায় উঠিনি। আমরা মানেভঞ্জনের ‘জীবন চিত্রে’-র হোটেল এক্সোটিকা খুঁজে ওখানে গিয়ে উঠেছিলাম। সান্দাকফু ট্রেকিং-এর আগে ইন্টারনেট সার্চ করে যত ব্লগ আর ফোরাম দেখেছিলাম সবাই এর কাছেই যাবারই পরামর্শ দিয়েছে। কারণটা একটু পরেই বুঝতে পেরেছিলাম।একে উচ্চতার জন্য শারীরিক কষ্ট তায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। জীবনদাদার আন্তরিকতায় সবকিছু ভুলে গেলাম। জীবনদাদা ও তার সহধর্মিনী আমাদের এমন আতিথেয়তা দিলেন যেন মনে হল আমার কোন খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি।
এবারের গল্পটা কিন্তু বেশ আতঙ্কেরই। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আবছায়া আর চাঁদের সোডিয়াম আলোতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন অনন্ত পথ ধরে চলছি। গান শুনতে শুনতে অন্যদের মতো আমিও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই কিন্তু সুকিয়াপোখরিতে এসে ড্রাইভার যখন আশে পাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করা শুরু করল মানেভঞ্জনের রাস্তা কোনদিকে তখন বুঝলাম এই বান্দা কখনও মানেভঞ্জন আসেনি, ঘুম উবে গেল। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না, গাড়ি গাড়ির মত চলছে ত চলছেই, মাঝে মাঝে দেখি ড্রাইভার লাইট দিয়ে তেলের লেভেল দেখছে। একসময় সে পুরোপুরি সন্দিহান হয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করল যে এটাই  মানেভঞ্জনের রাস্তা কি না, আমি বললাম সুকিয়া থেকে বামে এই একটাই রাস্তা আর সেটা সোজা মানেভঞ্জন দিয়েই গিয়েছে – কিন্ত রাস্তার অবস্থা এত খারাপ কিছু কিছু জায়গায় যে আমি নিজেই সন্দিহান হয়ে উঠছিলাম ঠিক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি কিনা। অন্ধকারে যা হয় – হাল্কা আতঙ্ক এসে ভর করে এবং তখন নিজের ডাইনিংরুমও ক্যাসেল ট্রান্সসিলভেনিয়া হয়ে যায়!
সন্দেহ – আতঙ্ক আর তেলের লেভেল দেখতে দেখতে দুশ্চিন্তার প্রায় চরম পর্যায়ে এসে আমরা শেষপর্যন্ত মানেভঞ্জন পৌঁছুলাম। আহ্ আবার সেই হোটেল এক্সোটিকা – দৌড়ে ওপরে উঠলাম জীবনদার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
জীবনদা-ও আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন এবং সাথে সাথেই বললেন যে আমাদের ‘দিদি’ গিয়েছেন শিলিগুড়ি বেড়াতে। এর একটাই অর্থ যে রাতে ডিনার বাইরে করতে হবে। এখানকার লোকাল রেস্টুরেন্টগুলো সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায় সেখানে পৌনে আটটাতো গভীর  রাত। নীচের দোকান থেকে চকলেট আর বাদাম কিনলাম। রুমে এসে বললাম আজ এগুলো দিয়েই আমাদের ডিনার সারতে হবে। হঠাৎ দেখি হুড়মুড়িয়ে চেনা একটা দল এসে ঢুকল হোটেলে – নয়ন ভাই-এর গ্রুপ।
বাংলাদেশেই নয়ন ভাই-এর সাথে পরিচয়। উনি বলেছিলেন যে উনারা যাবেন ১৮ তারিখে। আমাদেরও যেতে বলেছিলেন ওঁদের সঙ্গে। আমি বাংলাদেশ থেকেই জীবনদার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আমরা যদি ৩১ তারিখে সান্দাকফু উঠি তাহলে সমস্যা হবে না। প্রতি বছর এই সময় একটি ট্রাভেল গ্রুপ দৌড়ে সান্দাকফু উঠা আর নামার একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট করে। এর জন্য ওরা পথের সব লজ অগ্রিম বুকিং করে ফেলে। ফলে সাধারণ ট্যুরিস্টদের থাকার চরম সমস্যা হয়। নয়ন ভাইকেও ব্যাপারটা জীবনদা বলেছিলেন কিন্ত নয়নভাইয়ের কিছু করার ছিল না, ছুটি নিয়ে নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তাই ‘যা আছে কপালে’ টাইপের অবস্থা মাথায় নিয়েই গিয়েছিলেন। উনাদের কাছে শুনলাম ট্রেকিং করে উনারা সান্দাকফু উঠে কোন  কটেজে থাকার যায়গা পাননি – কোনমতে অভিশাপ দিতে দিতে  আর প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে নাকি রাত পার করেছেন এবং পরেরদিন গাড়ি নিয়ে সোজা এখানে।
রাতের খাবারের একটা ক্ষীণ আশায় আবার জীবনদার কাছে গিয়ে দেখি উনি আমাদের জন্য আলু ভর্তা, ভাত আর ডিম ভাজি করছেন। আহ্, সাথে সাথে সব্বাইকে ডেকে জীবনদার ডাইনিং-এ জম্পেশ করে ভাত-ডাল-আলুভর্তা-ঘি দিয়ে ডিনার শেষ  করলাম।Mayali Pass Trek
গতবারে আমাদের জন্য জীবনদা যে গাইড ঠিক করেছিলেন তার নাম ছিল 'নিমাহ’, বছর বিয়াল্লিশ বয়স, বেশ কয়েকবার সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা রয়েছে। বেরোনোর দিন সকালে জীবনদাদার ম্যাজিক দেখেছিলাম,উনি হাতে হাতে একটি ম্যাপ এঁকে দিয়েছিলেন - প্রতিটি শর্টকাটের চিহ্নিত করা এবং সঠিক দূরত্ব পরিমাপ করে দেওয়া। সেই ম্যাপ এবারেও আমাদের সঙ্গে রয়েছে। উনি সেবারে আমাদের মেঘমা থেকে জৌবাড়ি হয়ে তুমলিং যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এবারে খুব ভোরে উঠে তৈরি হয়ে আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টা দিকের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি, আলুর দম আর ডিম দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। দ্বিতীয়বার ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা থেকে পাঠককে বলছি যে অবশ্যই মানেভঞ্জন থেকে ভরপেট নাস্তা করে যাবেন। এরপরে আর কোথাও রেডিমেড নাস্তা পাবেন না। আর কিছু খেতে গেলে রান্না করার সময় পর্যন্ত আপনাকে বসে থাকতে হবে যা স্রেফ সময়ের অপচয়!
খেয়ে দেয়ে চিত্রের দিকে হাটা শুরু করলাম, চিত্রের দিকে যে রাস্তাটা উঠে গিয়েছে সেখানে একটি তিন রাস্তার মোড় রয়েছে, অনেকটা Y জংশান টাইপের – একটি মানেভঞ্জনের দিকে, একটি চিত্রের দিকে আর একটি রাম্মাম থেকে গুরদুম হয়ে মানেভঞ্জনের সঙ্গে মিশেছে। এই মোড়েই রয়েছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের চেকপোস্ট। এখান থেকেই টিকেট কিনে নিতে হয়।
আমাদের আগের বারের গাইড 'নিমাহ' এবার অন্য গ্রুপের সঙ্গে ট্যুর করছে। গাইড অ্যাসোসিয়েশান আমাদের একটি অল্পবয়সী গাইড দিল, বয়স খুব বেশি হলে ১৪-১৬, সাথে কোন মোবাইল নেই, ঘড়িও নেই। আমি অবশ্য এতে ঘাবড়াইনি - রাস্তা যেহেতু চিনিই তাই নিয়ম রক্ষার জন্য এই গাইড নেওয়া। বাকি সব গাইড নাকি সেই ম্যারাথন প্রতিযোগিতার সঙ্গে রয়েছে।
চিত্রে
সান্দাকফু ট্যুরের সবচেয়ে নয়নাভিরাম পথ হচ্ছে মানেভঞ্জন থেকে চিত্রে যাবার রাস্তা। ২৫০০ মিটার/৮২০২ ফিট - মানেভঞ্জন থেকে প্রায় ৪০০মিটার/ ১৩১২ ফিট ওপরে - মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমি যেন হলিউডের কোন মুভির সেটের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। জায়গাটা এত বেশি সুন্দর যে ভাষা অথবা ছবি কিছু দিয়েই এর বর্ণনা করা যাবে না। ঘন পাইন বনের ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে পিচে ঢালা পথ। উপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ ইরাজ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন উত্তরে পিছনে যেই বরফওয়ালা পর্বতটা দেখা যাচ্ছে সেটিই কাঞ্চনজঙ্ঘা কিনা? আমি তাকিয়ে একেবারে হতবাক! মার্চের ট্যুরে একমাত্র সান্দাকফু থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলাম তাই বিস্ময়ে স্রেফ বোবা হয়ে গেলাম। সত্যি আমি রাস্তার সেই কোণায় স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে দেখছি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে! বাকিরা দেখি আমাকে রেখে অনেক ওপরে উঠে গিয়েছে। চিত্রে পর্যন্ত যাওয়া তো দূরে থাক, চিত্রে উঠার রাস্তা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে এটা তাদের মোটেই বিচলিত করছে না, যেহেতু এরা প্রথম এলো তাই হয়ত মনে করছে এইটাই স্বাভাবিক! আর আমি চিন্তা করছি মার্চে আমি আর রুবেল ভাই রাস্তায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতো দূরের কথা দশফিট দূরের কিছুই দেখতে পারছিলাম না কুয়াশার জন্য।
গতবারে চিত্রে পৌঁছেই যেটা সবার আগে চোখে পড়েছিল যে এখানে একটি বিরাট বৌদ্ধ মনাস্ট্রি রয়েছে। মনাস্ট্রির ভিতর দিয়ে গিয়ে আমরা একটা ট্রেকার্স লজে গিয়ে উঠেছিলাম। এখানকার ট্রেকার্স লজগুলো একাধারে রেস্ট হাউজ, ট্রেকার্স লজ এবং রেস্টুরেন্ট। এখানকার মজার বিষয়টা হচ্ছে আমরা যখন খাবার অর্ডার দিব ঠিক তখনই রান্না শুরু হবে আর একদম ফ্রেশ খাবার পাওয়া যাবে। সেবারে দোলমা দিদির লজে আমরা কফি খেয়েছিলাম। এখানেই পরিচয় হয়েছিল দুই জার্মান ভদ্রলোকের সাথে, দুজনের বয়স আনুমানিক আমি ধরেছিলাম সত্তরের কাছাকাছি - পরবর্তীতে 'মেঘমা'তে গিয়ে পাসপোর্ট দেখানোর সময় একজন বলল তার জন্ম ১৯৩৩ সালে - শুনে এস.এস.বি-র দায়িত্বরত কর্মকর্তারও চোখ কপালে উঠেছিল।
এবারে চিত্রে পৌঁছে পুরা মনাস্ট্রি চক্কর দিয়ে সেই দোলমা দিদির লজে গিয়েই উঠলাম। মজার বিষয় হচ্ছে এই লজে আমাদের যাদের সাথে দেখা হয় তাদের সাথেই ট্যুর শেষ হয় ... গতবার তাই হয়েছিল, কে জানত যে এবারও তাই হবে!
লামেধুরা
গতবারে চিত্রে থেকে আমি আর রুবেল ভাই আর সেই দুই জার্মান মিলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লামেধুরার দিকে একসঙ্গেই বেরিয়েছিলাম। যাবার পথে সেবারে আমরা একটা শর্টকাট নিলাম। এখানেই আমার একটু কষ্ট হয়েছিল। ২৬০০ মিটারের বেশি ওপরে বাতাসের অক্সিজেন পরিমাণ হয়ত কম - বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি কিন্ত ফুসফুস ভরছেনা, একটু বমিবমি আর দুর্বলও লাগছিল - একদম পার্ফেক্ট অলটিচিউড সিকনেস-এর লক্ষণ। মন দিয়ে শরীরের উপরে জোর খাটিয়েছিলাম, প্রিয় গানগুলো মোবাইলে লাউড স্পিকারে চালিয়ে আস্তে আস্তে একটু একটু করে উঠছিলাম। লামেধুরার একটু আগে গিয়ে রুবেলভাই আর জার্মানদের দেখা পেয়েছিলাম,ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।এরপর অবশ্য সিকনেসটা চলে গিয়েছিল এবং সাবলীলভাবেই ট্রেকিং করেছিলাম।
এবারে নিজে ভুক্তভোগী না হলেও অসুস্থ সঙ্গীকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেও আবারও এযাত্রায় পিছিয়ে পড়লাম।
মেঘমা
২৬০০ মিটার/৮৫৩০ ফিট। মেঘমা যাবার রাস্তায় অনেকগুলো শর্টকাট আছে, এই শর্টকাটগুলো প্রধান গাড়ি চলার রাস্তাকে ঘিরেই। মেঘমা নাম দেওয়ার কারণটা গতবার সেখানে পৌঁছেই বুঝেছিলাম, একেবারে মেঘের ভিতরে আমরা ট্রেকিং করছি এবং ১০ ফিট দূরত্বের বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না।
এবারে প্রায় কোন ঝামেলা ছাড়াই আমারা লামেধুরা থেকে মেঘমা পৌঁছুলাম। গত মার্চে এখানে কুয়াশার জন্য ১০ ফিট দুরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু এখন তংলুর মাথার ওপরে নীল আকাশ।
মেঘমা থেকে তুমলিং যাবার দুটো রাস্তা আছে, একটা তংলু হয়ে তুমলিং আর একটা জৌবাড়ি হয়ে তুমলিং - তংলুর উচ্চতা ৩০৭০ মিটার এবং কেউ কেউ বলেন এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট সান্দাকফুর চাইতেও নাকি ভালো দেখা যায়। মনে হচ্ছিল তংলুর রাস্তা দিয়ে ওপরে উঠে যাই, কিন্ত দলের দুজনের পায়ের অবস্থা চিন্তা করে মনের ইচ্ছে মনেই রেখে দিলাম। তংলুর রাস্তাটা খুব সুন্দর - এঁকে বেঁকে ওপরের দিকে উঠে যাওয়া।
তুমলিং
২৯৭০ মিটার/৯৭৪৪ ফিট। গতবারে মেঘমা থেকে জৌবাড়ি যাবার পথে মেঘ এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে লেন্সে ফাংগাস পড়ে যাবার ভয়ে আর ক্যামেরা বের করা যায়নি। সেবারে আগে থেকে এটাও প্ল্যান করেছিলাম যে এখানেই আমরা রাত কাটাব। অর্থাৎ ২৬শে মার্চ মানেভঞ্জন, ২৭শে মার্চ তুমলিং। কিন্তু পৌঁছে দিনের আলো দেখে ২৬২১ মিটারে অবস্থিত গাইরিবাস-এ নেমে গিয়েছিলাম।
এবারেও মেঘমা থেকে নির্বিঘ্নে তুমলিং পর্যন্ত এলাম, এখানে শিখর লজের বাইরে পাতা একটি বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার গাইরিবাসের দিকে যাত্রা।
গাইরিবাস
তুমলিং ছেড়ে কিছুদূর যাবার পর আবার সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে হেঁটে যাওয়া। বিকালের রোদটা খুবই মিষ্টি লাগছিল কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছিল দিনের আলো থাকতে থাকতে হয়ত গাইরিবাস পৌঁছাতে পারব না। গাইরিবাসের ঠিক আগে একটি টাওয়ারওলা সেটেলমেন্ট আছে – নামটা ঠিক মনে নেই। এখানে মার্চে যখন এসেছিলাম তখন ছিল ঘন কুয়াশা, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না আর এবার পুরো উপত্যকাটাই ভাল করে দেখতে পেলাম। এখানে একটু জিরিয়ে নিতেই দেখি সূর্য ডুবে গিয়ে লালিমা ছড়াচ্ছে।
সন্ধ্যায় গাইরিবাস নামাটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল – এক অন্ধকার, যদিও টর্চ ছিল আর দুই এই রাস্তার পাথরগুলো সব ছড়ানো ছিটানো এবং পাড়া দিলেই গড়াগড়ি খায় যেটা পা মচকে যাবার জন্য যথেষ্ট। আমি মনে করেছিলাম ভরা পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে ট্রেকিং করব। কিন্তু প্ল্যানে একটু ভুল ছিল - চাঁদ উঠে পুব দিক থেকে আর আমরা যাচ্ছি পশ্চিমে এবং একটি পর্বতের ঢাল বেয়ে পর্বতটাকে ডান দিকে রেখে। যার কারণে একটু পরে দেখলাম জোছনায় পুরা উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে কিন্ত আমরাই একমাত্র অন্ধকারে - আমরা আছি পর্বতের চূড়ার ঢালে, ছায়াতে!
গতবারে গাইরিবাসে পরদিন সকালে কতগুলো পাহাড়ি কুকুরের সাথে ভাব হয়েছিল - দেখতে পুরা ভয়ঙ্কর সাইবেরিয়ান নেকড়ের মত কিন্তু আন্তরিকতায় একদম ট্যুরিস্ট ভক্ত। আপনার সাথে সাথে হাঁটবে, খেতে দিলে খাবে, মনে হবে যেন কতদিনের পরিচয়। এবারেও ওদের সঙ্গে দেখা হল।
কাইয়াকাঠা
গাইরিবাস ২৬২১ মিটার থেকে খাড়া ৪০০ মিটার উঠে কাইয়াকাঠা। এই উঠার পথেই প্রথম দেখি রডোডেন্ড্রনের প্রাকৃতিক বাগান, ঝাঁকে ঝাঁকে রডোডেন্ড্রন ফুল।
কালাপোখারি
৩১৮৬ মিটার/ ১০৪৫২ ফিট। কাইয়াকাঠা থেকে কালাপোখারির রাস্তাটাই বোধহয় গোটা ট্যুরে সবচাইতে ভাল রাস্তা। পুরোটাই সমতল এবং উঠানামা খুবই সামান্য।সেবারে কালাপোখারি পৌঁছে আমরা প্রথমে এস এস বি ক্যাম্পে চেক ইন করে নিয়েছিলাম। এখানেও বেশ কিছু ট্রেকারস লজ আছে। গাইডের পছন্দের একটি ট্রেকার্স লজে উঠে রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছি, এস.এস.বি. থেকে একজন এসে আমাদের সাথে আলাপ করলেন। তিনি এস.এস.বি.-তে জয়েন করার আগে পরে ২৪ পরগনা থেকে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে যাত্রা পুজো ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখতে চলে আসার কাহিনি শোনালেন। এশিয়া কাপে ওঁরা নাকি বাংলাদেশকে সাপোর্ট করেছিলেন এবং আমাদের সাথে খেলার শেষে ওঁরাও নাকি কেঁদেছিলেন – ঠিক একই কথা অবশ্য বলেছিলেন মানেভঞ্জনের এস.এস.বি.-তে যিনি প্রথম আমাদের নাম এন্ট্রি করেন। এঁরা সবাই খুব আন্তরিক। এখানকার থাকার ব্যবস্থা অসাধারণ এবং সেই আবার প্ল্যান করেছিলাম যে পরবর্তীতে গাইরিবাস না থেকে এখানেই চলে আসব। কিন্তু এবারেও কালাপোখরিতে থাকা হল না, স্রেফ একটু চা খেয়ে বিকেভঞ্জনের দিকে রওনা দিলাম।
বিকেভঞ্জন
৩৩৫০ মিটার/১০৯৯১ ফিট। বিকেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর তিনটি রাস্তা রয়েছে - একটি নেপাল হয়ে,একটি গাড়ির রাস্তা আর একটি হচ্ছে গাড়ির রাস্তার মাঝে কৌণিক দূরত্বের শর্টকাট। আমরা গাড়ির রাস্তা দিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। এই রাস্তাটা অনেকটা জায়গায় খাড়া উঠে গেলেও চওড়া অর্থাৎ গাড়ি চলার মত প্রশস্ত হওয়ায় মনস্তাত্ত্বিক ভাবে একটু নিরাপদ।
সান্দাকফু
৩৬৩৬ মিটার/১১৯২৯ ফিট। গতবারে বিকেভঞ্জন থেকে খাড়া উঠতে উঠতে আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম আর ক্ষণে ক্ষণে দেখছিলাম সান্দাকফু দেখা যায় কি না। শেষপর্যন্ত যখন সান্দাকফুর ট্রেকার্স লজের মাথাটা চোখে পড়ল তখন নিমাহকে ডেকে বললাম এর জন্যই এত কষ্ট করে আসা।
এই সেই স্বপ্নের সান্দাকফু!! ...সান্দাকফু উঠেই আমার প্রথমবার অনুভূতি ছিল এটাই।
আমি যেন ডিপ-ফ্রিজের দরজা খুললাম এবং ১৮০ কিমি বেগে সেই ফ্রিজের ঠাণ্ডা বাতাস আমার উপরে বয়ে যাচ্ছিল! কিন্ত কী আশ্চর্য সব কিছু অগ্রাহ্য করে সান্দাকফুর চূড়ায় উঠা শুরু করেছিলাম। দুচোখ দিয়ে খুঁজেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট। কিন্তু সেবারে আবহাওয়া এতটাই খারাপ ছিল যে তিরিশ সেকেন্ড পর পর মেঘ আর কুয়াশা এসে দৃষ্টিসীমা ঢেকে দিচ্ছিল।
এবারে সান্দাকফুর চূড়ায় পৌঁছে দেখলাম মার্চে যেই লজে উঠেছিলাম সরকারি সি ক্যাটাগরির ঠিক সেই লজটিতেই গাইড নিয়ে গেল। চেনা কিচেনে ঢুকে কেয়ারটেকারকে হিন্দি-ইংরেজিতে বলতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বলল হ্যাঁ, আপনি নিমার সাথে এসেছিলেন। আর তার বউ বলল আপনি না আমাদের ছবি তুলেছিলেন সেই ছবি কৈ? যাঃ...আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম ... ছবি তো আনা হয়নি! লজ্জায় পরে এই-ওই বলে কাটিয়ে তাদের সাথে মোমো খেতে খেতে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলাম।
একটুপরে বাইরে বেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্টের লালিমার ছবি তুলতে শুরু করলাম। এখানে একটি মজার বিষয় না বললেই নয়, যে ফরাসী মহিলাকে চিত্রেতে দেখেছিলাম পরে লামেধুরাতে তাকে আমরা পেয়েছি। মেঘমাতে খানিক আলাপও হয়েছিল। এর পরে তাকে আমরা আমাদের ক্রস করতে দেখিনি কিন্তু সান্দাকফুতে সূর্যাস্তের ছবি তোলার সময় দেখি সে এসে হাজির। ট্রেকিং-এ পরিচয়ে কুশল বিনিময়ের এক অদ্ভুত আনন্দ আছে সেটা যারা গিয়েছেন তারা জানেন। ইজরায়েলি একটি দলের সাথে সে এসেছে। সান্দাকফুতে পা দিয়েই রমাকান্তদার সঙ্গে পরিচয় হল। সুন্দর বিকেলটা কাটালাম রমাকান্তদার টিম আর বিদেশি আরও কিছু ট্রেকারদের সাথে। মজার বিষয় হচ্ছে মার্চে ঠাণ্ডার চোটে যেখানে দাঁড়িয়েই থাকতে পারছিলাম না সেখানে এখন ছবি তুলছি খালি হাতে আর সানন্দে আড্ডাও দিচ্ছি। সূর্য ডুবে যাওয়ায় পুরো আকাশটা লাল হয়ে কী এক অদ্ভুত অনুভূতি এনে দিচ্ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
হঠাৎ শুভ ভাই এসে বললেন যে, যে কারণে ট্রাইপডটা ক্যারি করেছি সেটার সদ্‌ব্যবহার করতে, অর্থাৎ রাতে সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলতে। ট্রাইপড আর ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। যেখান থেকে ছবি তোলার প্ল্যান করছি ঠিক সেখানেই দেখি রমাকান্তদারা দাঁড়িয়ে আছেন। ট্রাইপড সেই মার্চেও নিয়ে এসেছিলাম কিন্ত তখন বিকেলেই যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি সেখানে রাতে দেখা অবান্তর। প্ল্যান করেছিলাম এবারও সুযোগ নিব এবং সৌভাগ্য যে চিত্রে থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছিল আর সান্দাকফুতেতো রাতেও খালি চোখে দেখা যাচ্ছে কারণ আকাশ ভরা জোছনা। জায়গা মত ট্রাইপড সেট করে ম্যানুয়াল ফোকাস অ্যাডজাস্ট শুরু করলাম কিন্ত ঠাণ্ডায় সব কিছু জমে যাচ্ছিল – গ্লাভস থেকে হাতই বের করা যাচ্ছিল না, কয়েকটা স্ন্যাপ নেবার পরে ঠাণ্ডায় হাল ছেড়ে দিচ্ছি এমন সময় রমাকন্তদা আসলেন। আমাকে ইন্সপায়ার করলেন আর সাথে কেউ থাকলে সাহস একটু বেড়ে যায় বইকি। আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। যেহেতু ম্যানুয়াল ফোকাস তাই পুরা আন্দাজের ওপরে ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে ফোকাস করছি। আন্দাজের উপরে প্রিভিউ দেখতে দেখতে তেইশ নাম্বার ছবিটাতে শার্পনেস পেলাম। ততক্ষণে আমাদের হাত পা সব বরফ হয়ে গিয়েছে। যদিও ছবিটা আমার ক্যামেরায় তোলা কিন্তু সেই ছবিটার আনন্দ সেখানে সবাই মিলে দারুণ উপভোগ করলাম।
খুব ভোরে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্টের চূড়ায় সূর্যোদয়ের লাল কমলা রঙ লাগার অপরূপ ছবি তুলে নিলাম। মনে পড়ছিল প্রথমবারের অভিজ্ঞতার সেই অসাধারণ স্মৃতি। সেবারে পরদিন সকালে গাইড এসে ডেকে দেওয়ার পর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখি এতটাই ঠাণ্ডা যে গ্লাভস থেকে হাত বের করা খুব কষ্টকর,বেশিক্ষণ খোলা হাত বাইরে রাখলে হাত একটু পরেই অবশ হয়ে যাচ্ছে, কিন্ত ক্যামেরাটা ভালভাবে অপারেট করতে হলে হাত খোলা ছাড়া বিকল্পও নেই। ধীরে ধীরে একটা হলুদ-কমলা-লাল ঝলকানি দিয়ে সূর্য উঠা শুরু করল। চারিদিকে শুধু শাটারের শব্দ। সে এক বর্ণনাতীত মুহূর্ত – সত্যি সত্যি যদি আপনার কোন স্বপ্ন আপনার চোখের সামনে সত্যি হয়ে যায় তার অনুভূতিটাই অন্যরকম,সুবহানআল্লাহ সুবহানআল্লাহ।
বর্ষাকালে একবার বান্দারবনের থাঞ্চি যাবার সময় আনোয়ার ভাই পথের ক্লান্তি দূর করার জন্য একটা সমতল পথে হাত বাড়িয়ে বলে উঠেছিলেন 'ওয়েলকাম টু থাঞ্চি' যদিও তখনও আরও দুটো খাড়া খাড়া মান্দার গাছের রেলিং ছাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠা বাকি ছিল, কিন্তু স্রেফ সাহস জাগানোর আর আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য তিনি এই কাজটা করেছিলেন। আমিও সেদিন সান্দাকফুর চূড়ায় উঠে আসা পাশের সব ট্যুরিস্টকে 'ওয়েলকাম টু থাঞ্চি উপস্‌ সান্দাকফু' বলে হ্যান্ডশেক করা শুরু করলাম, এবং কাজটা করতে গিয়ে বুঝলাম তারাও আমার মতই আবেগাপ্লুত।
সাবারগ্রাম
আমাদের পরবর্তী প্ল্যান ফালুট যাওয়া। সান্দাকফু থেকে ফালুটের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার আর ফালুটের উচ্চতা প্রায় ৩০০০ মিটার। ফালুট ট্রেকের বিশেষত্ব হচ্ছে এই ট্রেইলের কোথাও পানি নেই। শুধু ১৪ কিলোমিটার দূরে সাবারগ্রাম নামে একটা জায়গা যেখানে ছোট্ট একটা এস.এস.বি. ক্যাম্প আছে। এখানে ট্যুরিস্টদের জন্য খাবার-পানি আর বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। এখান থেকে একটা পথ নিচে 'মলে' নামক একটা জায়গায় নেমে গিয়েছে সেটা দিয়ে গুরদুম হয়ে শ্রীখোলা যাওয়া যায়।
সান্দাকফু থেকে সব গুছিয়ে রওনা দিতে দিতে আমাদের সাড়ে দশটা বেজে গেল। যাবার সময় বার বার চেয়ে থাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্টের দিকে, ক্ষণে ক্ষণে ফিরে ফিরে চাই। যতই এগোচ্ছি ততই কাঞ্চনজঙ্ঘা বড় হয়ে উঠছে। সান্দাকফু থেকে সাবারগ্রাম যাবার ট্রেইলটা এত সুন্দর আর মোহময় যে কেউ না গেলে তাকে বোঝানো যাবে না। অনন্ত অসীম দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট, মেঘের খেলা, ছায়া আর রোদের লুকোচুরি ... স্বপ্নের মত । ফালুট ট্রেইলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুধু ফসলের গমের গাছগুলোকে ঘাস ভেবে নিলেই আমেরিকার প্রেইরি-র স্বাদ আপনি এখানে নিতে পারবেন।এই পর্বতে কোন জীবিত গাছ দেখতে পাওয়া বিরল, যদিও পুরোটা পর্বতই সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা। কখনোসখনো এক-আধটা গাছের পোড়া কঙ্কাল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই এলাকায় প্রচুর বজ্রপাত হয়, বাতাসের বেগও এখানে অসম্ভব বেশি।
হাঁটতে হাঁটতে গতবারের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। কিছুদূর যাবার পর সেই জার্মানদের দেখা পেয়েছিলাম। দেখি একটা উঁচু ঢালের উপরে বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা, আমরাও বসে পড়েছিলাম। আমি চকলেট খেয়ে অভ্যাসবশত র‍্যাপারটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। ফেলামাত্রই দেখি জার্মানদের গাইড দৌড়ে র‍্যাপারগুলো তুলে নিজের পকেটে ভরে রাখল। এটা দেখে এতটাই লজ্জা পেয়েছিলাম যে বাকি পুরো ট্রেইলে কোথাও চকোলেটের খোসা ফেলিনি। আর ফালুট ট্রেইলে কোন কোন জায়গাতে দেখা যায় একটা বড় টিনের কন্টেনার কেটে ডাস্টবিন বানিয়ে বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর থেকে একদম সুবোধ বালকের মত পকেটে জমিয়ে রাখা সেই খোসাগুলো এই ডাস্টবিন খুঁজে খুঁজে তাতে ফেলেছি।
সেবারে সাবারগ্রামের শেষে উঠার সময় খুব কষ্ট হয়েছিল, এমনকী ব্যাথার পা নিয়ে রুবেল ভাইও আমাকে অতিক্রম করে চলে গিয়েছিল, মাথার উপরে ছিল গনগনে সূর্য, একটুতেই হাঁপিয়ে উঠছিলাম আর থেমে থেমে পানি খাচ্ছিলাম। দুপুরবেলায় সাবারগ্রাম পৌঁছেছিলাম।
এবারে সাবারগ্রামে এসে একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমরা ন্যুডলস খেতে চেয়েছিলাম, কেয়ারটেকার বলেই দিলেন স্যুপ হবে না। ভাবলাম নিজেরাই রান্না করব। ন্যুডলস-এ পানি দিলাম ফোটানোর জন্য কিন্ত এই গনগনে আগুনের তাপেও পানি আর গরমও হয় না, ফুটেও না। দুজনে চিন্তায় পরে গেলাম ঘটনাটা কী এত এত জাল দিচ্ছি কিন্ত পানি গরম হয় না কেন! পরে বুঝলাম এই ৩৬০০ মিটার উচ্চতায় জল গরম হতে একটু সময় নেবে বইকি। পিয়াজ টমেটো কাঁচামরিচ কেটে কড়াই-এ ডিম ভেজে তেল দিয়ে আমরা রেডি কিন্তু ন্যুডলস আর সিদ্ধই হয়না! শেষে কুড়ি মিনিটের রান্না এক ঘন্টায় সেরে খেয়ে দেয়ে ফালুটের দিকে রওনা দিলাম।
ফালুট
গতবারে সাবারগ্রাম ক্যাম্পে একটা কালো-বাদামি রোমশ কুকুর দেখেছিলাম,আমরা রওনা দেবার সাথে সাথেই সেও আমাদের সঙ্গী হয়েছিল।
ফালুটের ট্রেইলে গাড়ি চলার মাটির পথ এবং কোথাওবা পাথরের খাঁজ করা। মজার বিষয় হচ্ছে এই ট্রেইলটা যে কেন ভাল লেগেছে তার কোন যৌক্তিক কারণ আমি বলতে পারব না – হয়ত পথের ওপরে বিকেলের সূর্যের আলোর খেলা, হয়ত সেই কুকুরটার সাথে আমাদের ভাব নিয়ে চলা – হয়ত বিকেলের স্বাভাবিক নস্টালজিয়া - মেঘের আসা-যাওয়া...কে জানে!
কুকুরের কাহিনিটাই বলি – সে নিশ্চুপভাবে আমাদের পিছনে পিছনে আসছিল। মাঝে মাঝে আমি থেমে যাই ছবি তুলতে, তখন রুবেল ভাই আর নিমাহ অনেক সামনে চলে যায়। কিছু দূর হাঁটার পর দেখি কুকুরটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি প্রথমে বুঝিনি, মনে করেছিলাম বুঝি ফিরে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছে। ওমা, আমি কাছে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার সামনে হাঁটা দিল এবং একজন প্রশিক্ষিত গাইড যেভাবে কিছুক্ষণ পর পর ট্রেইলের পিছনে দেখে, সেও কিছুক্ষণ পর পর পিছনে ফিরে দেখে নিচ্ছিল আমি তাকে ফলো করছি কিনা!
ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য আমি ইচ্ছা করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ছবি তুললাম। হেঁটে একটা বাঁক ঘুরেই দেখি সে হলিউডের ছবির নেকড়েদের মত মাথা উঁচু করে বসে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাওয়া মাত্রই সে আবার আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। কিছু কিছু জায়গায় নিমাহ আমাদের শর্টকাট দিয়ে নিয়ে গেল, কিন্তু আমি দেখলাম সেই কুকুরটা রেগুলার ট্রেইলেই দৌড়ে আগে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আগে কোথাও একা হয়ে গেলে নিমাহর লাল জ্যাকেট খুঁজতাম দৃষ্টি সীমানায়,এরপর থেকে খুঁজেছি সেই চার পেয়ে গাইডকেই। এমনকী একবার কুকুরটাকে দেখতে না পেয়ে আমিই উল্টে নিমাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কই? নিমাহ হেসে হেসে বলল আছে, সামনেই আছে, জায়গা মত কোন এক বাঁকের মাথায়, এবং ঠিক তাই!
ফালুটের আগে একটা যায়গায় দেখলাম গলায় ঘন্টা বাঁধা ইয়াক, দেখেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল, যাক হয়ত আর বেশি দূর না। কিন্ত না,ফালুট আর আসে না। একটা একটা করে পর্বতের ঢাল পার হই আর মনে হয় এটাই ফালুটের পর্বত, কিন্তু না মাঝে আর একটা – আর একটা পার হলে আবারও একটা...।
এভাবে ফালুট পৌঁছাবার ঠিক আগে একদল ঠাণ্ডা ঝড়ো গতির মেঘ এসে আমাদের ঢেকে দিল, ফালুটের লজে আসার পর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে ঘরের ভিতরে না ঢুকে বাইরেই দেয়ালে ঠেশ দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। পরে ঢুকে দেখি পুরো ট্যুরিস্ট লজে আমরা আর একটা সুইডিশ কাপল।
রাতে সেবারে রীতিমত শিলাবৃষ্টি নেমেছিল, টিনের চালে ঠাশ ঠাশ আওয়াজে মন চলে গিয়েছিল আমাদের ময়মনসিং-এর বাসায় যেখানে টিনের চালের সেই বৃষ্টি-শিলার আওয়াজে কাঁথামুড়ি দিয়ে জেঁকে ঘুমাতাম। জানালাগুলোতে কাচের শার্শি কাঁপিয়ে একটু পর পর সাইরেনের মত শব্দ করে ঝোড়ো বাতাসের এক একটা ঢেউ এসে রুমের ভিতরেও ঠাণ্ডার একটা হিমেল স্রোত বইয়ে দিচ্ছিল।
এবারেও ফালুটে থাকার জায়গা মিলল। গতবারের মতো ঝড়-ঝঞ্ঝা নেই, বেশ নিরুপদ্রবেই ঘুম হল। ভোরে উঠেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলতে উপরে উঠে গেলাম। গতবারের মত এবারও সাথে পানি নিতে ভুলে গিয়েছি। দেখি ঘাসের ওপর শিশির জমে বরফ হয়ে আছে। গতবারতো এই বরফ মুখে দিয়েই তেষ্টা মিটিয়ে ছিলাম। পুরো পর্বতের চূড়াই ঘাসের সবুজের সাথে সাদা জমে যাওয়া শিশির বরফে একাকার। কিছু ওপরেই একটা সীমানা পিলার যার একপাশে নেপাল – কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে, ডান পাশে সিকিম আর পিছনে-বামে পশ্চিমবঙ্গ। এর কাছেই একটা ছোট্ট বৌদ্ধ মন্দির – আলগা পাথর দিয়ে ছোট্ট একটা তাঁবুর মত করে বানানো।
কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট আর দিগন্তের নৈসর্গিক ছবি তুলতে তুলতে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম হঠাৎ পিছনে চেয়ে দেখি রমাকান্তদাদের তিনটি বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে ... এভাবে একা একা একটি বিরাট পর্বতের চূড়ায়...। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করলাম প্রকৃতির কাছে আমরা কতটাই ক্ষুদ্র।
গোরখে
সিঙ্গালিলা পার্ক ধরে গোরখের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাটা অসাধারণ। ঘন, গহিন পাইন বনের ভিতরে কোথাও মাটিকাটা, কোথাওবা পাথর সাজিয়ে ৬-৮ ফিট প্রশস্ত রাস্তা। গোরখে নামার ঠিক আগে একটা খাড়া জিক-স ZzZ কৌণিক রাস্তা নেমে গিয়েছে। গতবারে মিরিকের মত এই জায়গাটাতেও আমি পূরো একদিন থাকার ভবিষ্যৎ প্ল্যান করে ফেলেছিলাম যদিও এবারেও সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা রাম্মাম পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যার এক-দেড় ঘণ্টা আগে, রাম্মাম ট্রেকিং লজের ভিতরে যাওয়া মাত্রই শুরু হল বৃষ্টি,অঝোর ধারায়। অন্ধকার হবার পর জানলা দিয়ে দেখলাম পাহাড়ের এক কোনায় অনেক অনেক আলো ছড়িয়ে আছে,নিমাহ কে জিজ্ঞাস করলাম এটা কোথায়? বলল এই আলো দার্জিলিং-এর, আমরা তো তাজ্জব, দার্জিলিং-এর এত কাছে আছি আমরা!
এবারেও সকাল সকাল রওনা দিলাম গোরখের উদ্দেশ্যে ... সেই পরিচিত ট্রেইল সেই পরিচিত রাস্তা, শর্টকাট হেঁটে যাবার সময় কী যে ভাল লাগছিল তা যে দ্বিতীয়বার গিয়েছে, সেই জানে। সন্ধ্যার কিছু আগে রাম্মাম পৌঁছুলাম।
রিম্বিক
রিম্বিক যাবার পথে কয়েকটা ছোট ছোট গ্রাম পেরোতে হয়। যে পাহাড়টা ধরে নেমে যাচ্ছি তার পাশের পাহাড়টাই সিকিম। অনেক লোকালয়,মোবাইলের টাওয়ার, পাহাড়ি ঘর-বাড়ি দেখে দেখে নেমে যাচ্ছি শ্রীখোলা ঝরনার দিকে, এই ঝরনার ওপর দিয়ে একটা কাঠের টানা ব্রিজ আছে যেখান থেকে পুরো ঝরনাটা আর উপত্যকাটার একটা বর্ণনাতীত ছবি পাওয়া যায়।
শ্রীখোলা থেকে কিছুটা ওপরে উঠলেই সিপ্পি নামে একটা জায়গা। সেখান থেকে একটা গাড়ির রাস্তা সোজা রিম্বিকের দিকে গিয়েছে। ট্রেকিং শেষ... এবার ঘরে ফেরার পালা। রিম্বিকে নেমে এসে ফেরার গাড়ি ধরলাম।

সান্দাকফু-ফালুট ট্রেক রুট ম্যাপ || সান্দাকফুর তথ্য
ট্রেকের ছবি - মাহমুদ ফারুক ~ ট্রেকের আরো ছবি

পেশায় ওয়েব ডিজাইনার এবং ডেভেলাপার ফারুকের জীবনের আরেক নাম ভ্রমণ। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে ট্রেকিং-এ।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher