বাঘের বাড়ি
মার্জিয়া লিপি
~ সুন্দরবনের আরো ছবি - মহম্মদ রাশেদুজ্জামান ~
বছর কয়েক আগের দেখা সুন্দরবন।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, নানা রঙের পাখি, গাছ আর জলের কুমির নিয়ে সুন্দরবন। বনবিভাগে থেকে ইকোটুরিজ্যম গবেষণায় সুন্দরবনের দুর্গম গহীনে যেয়ে দেখেছি দর্শনীয় অনেক কিছুই। সেবার ট্যুরে এসেছিলাম সাতক্ষীরা রেঞ্জ দিয়ে - কারণ একটাই, সমগ্র সুন্দরবনের মধ্যে এই সাতক্ষীরা রেঞ্জেই সবচেয়ে বেশি দেখা হয়ে যায় বাঘের সাথে।
ইউনেস্কো, ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ‘বিশ্বের ঐতিহ্য’ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যে জালের মতো জড়িয়ে আছে সামুদ্রিক জলধারা। রয়েছে বাদাবন আর ছোট ছোট দ্বীপ। নতুন চরে জেগে উঠে ধানসী, পরে কেওড়া, গরান, বাইন, পশুর, ধুন্দল, সবশেষে সুন্দরী গাছ। অনেকের মতে সুন্দরী গাছের নামে এ বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুন্দরবন, যেখানে সময়ের সঙ্গে সৌন্দর্যের রঙ বদলায়। নির্জন দুপুরের রূপ অচেনা, ভোরগুলো আবার অন্যরকম স্নিগ্ধ।
সুন্দরবন অভিযান টিমে ছিলাম ছ’জন সহকর্মী ছাড়াও বন বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী, বিদেশি পরামর্শক, জাহানারা নূরী, গাইড, কেবিন ক্র, ক্যামেরাম্যান ও দুজন ফরেস্ট গার্ডসহ মোট বাইশজন। খুব সকালে আমরা ঘাটে এসে পৌঁছলেও জাহাজের কিছু যান্ত্রিক সমস্যার কারণে যাত্রা শুরু করি মাথার উপর সূর্যকে রেখে। জাহাজ চলার আধ ঘন্টার মধ্যেই দ্য গাইড ট্যুরের মুগলী ভাইয়ের হঠাৎ চিৎকারে চোখ পড়লো একটা শুশুক পরিবারের উপরে। ঝুপ করে এক ডুব দিয়ে একটু পরেই আবার পানিতে ভেসে উঠছে ছোট বড় শুশুকগুলো, ভাসছে আর ডুবছে।
বুড়িগোয়ালিনির কাছাকাছি কলাগাছি বনটহল ফাঁড়িতে নেমে অ্যাডভেঞ্চার শুরু। কলাগাছি ফরেস্ট ক্যাম্পের ঠিক পেছনে রয়েছে বনের ভিতর দিয়ে একটা হাঁটা পথ। এ পথে শুধু মানুষ নয়, বাঘও হাঁটাহাঁটি করে। শেষ বিকেলে বনের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে তার প্রমাণও পেলাম।
একটু দুঃসাহসী হয়ে কলাগাছি থেকে সন্ধ্যায় জাহাজে উঠে যাত্রা শুরু করি মান্দারবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার পর গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা নদীর বুকে। বাতাসে লোনা পানির গন্ধ, নিশাচর জন্তু-জানোয়ারের পদচারণে রহস্যময় রাত। নির্জনতার রূপ যেন অচেনা, অন্যরকম। ঘোর নিস্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করে শুধু ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। চার্জ লাইটের আলোয় রাতের অরণ্যের রহস্যময় দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে যখন দল বেঁধে কয়েকটা নৌকা আমাদের জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে তখন মনে মনে ভাবছিলাম রূপকথার জলদস্যুদের কথা। অবশেষে মাঝরাতে জাহাজ নোঙ্গর করলো মান্দারবাড়িয়ার সমুদ্র সৈকতে।
হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর তীরে মান্দারবাড়িয়ায় বন আর বেলাভূমির যুগল মিলন। আমার দেখা এক অন্য রকম অপার্থিব দৃশ্য। অনুভবে দেখছিলাম প্রকৃতির অতলে সৃষ্টির বিচিত্রতার বিস্ময়! ভোরের আলোতে কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি এক পাশে বিশাল সমুদ্র আর অন্য পাশে ঘন বন। বৃক্ষ আচ্ছাদিত রহস্যময় অরণ্য, মনের রহস্যকে আনমনা করে দেয়, মনোজগতে তৈরি হয় এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার টান।
প্রায় আট কিলোমিটার লম্বা এই সমুদ্র সৈকত যেন ছবির মত। অসম্ভব ভালোলাগার আচ্ছন্নতায় মুগ্ধ আমি। কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, ইনানী, সেন্টমার্টিনসহ বঙ্গোপসাগরের অনেকগুলো সৈকত বেশ কয়েকবার দেখেছি। সুন্দরবনে এসে এত বড় একটি সৈকতের দেখা পাব ভাবতেও পারিনি। কিন্তু মান্দারবাড়িয়া সৈকতের সাথে অন্যকোন সৈকতের একটুও মিল নেই। অপূর্ব সৌন্দর্য ঘেরা এক জায়গা। পিছনে সবুজ রহস্যে ঘেরা বনে বাঘের ভয় আর সামনে অসম্ভব ভালোলাগার হাতছানি দেওয়া সমুদ্র, বিস্তীর্ণ সৈকত। নির্জন সৈকতে নিজেকে নষ্টালজিয়ার লাল-নীল-সবুজ লতাপাতার জালে জড়িয়ে খুঁজতে থাকি অন্যরকম এক অনুভূতি।
সকালে সী-বিচে ঘুরতে ঘুরতে পেলাম সামুদ্রিক কচ্ছপ, রানি কাকড়ার দেখা, হরিণ আর বাঘের পায়ের ছাপ। তার মানে বিচে কিছুক্ষণ আগেই হরিণ আর বাঘেরা হাঁটাহাঁটি করেছে। মান্দারবাড়িয়ায় ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করে শুনলাম, ভোর বেলায় বাঘ এসেছিল। বাঘের পায়ের ছাপ দেখার পর থেকে আবারও বাঘ দেখার নেশা আরেকটু জাঁকিয়ে বসলো। পায়ের ছাপের পিছুপিছু কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম জাহাজে। এর দক্ষিণে তালপট্টি। সুন্দরবনে এমন অনেকগুলো ছোট-বড় সমুদ্র সৈকত আছে। কচিখালি থেলে কটকা এরকমই নির্জন সুন্দর ৭কি.মি. দীর্ঘ আরেকটি সমুদ্র সৈকত।
উদ্দেশ্য এবার হিরণ পয়েন্ট। দুপুরের মধ্যে পুষ্পকাঠির হিরণ পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম আমরা। দলের মধ্যে থেকে তিনজন হিরণ পয়েন্টের পিছনের হাঁটা পথ ধরে পায়ে পায়ে চলতে শুরু করলাম ক্যামেরা অন করে। এবারও আমাদের সাথে ফরেস্ট গার্ডেরা রয়েছেন। বনের ভিতর কোষ্টগার্ডের দপ্তর থেকে প্রায় আধা মাইল খানেক আসার পর দেখি বিশাল শন বন। এ পথের শুরুতে কয়েকজনের সাথে দেখা হলেও এখানে এসে আর কাউকেই পেলাম না। শন বনের আবহাওয়াটা কেমন যেন একটু গুমোট। স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। নীরব, নিস্তব্ধ এলাকা। হাওয়ায় শন গাছগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। একটু শব্দ হলেই গা ছমছম করে উঠছে। এই বুঝি বাঘ এলো। বাঘের ছবি তোলার নেশায় আবার সাহস জোগাচ্ছি একে অপরকে। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছি না। হঠাৎ শন বনের মাঝে আবিষ্কার করলাম হেলিপ্যাড। প্রায় পুরো জায়গাটাই শনে ঢেকে আছে। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই যে এখানে হেলিকপ্টার নামে। সেখান থেকে আরও একটু এগিয়ে গেলাম ঘন বনের দিকে। জানি না কোথাও বসে বাঘ বিশ্রাম নিচ্ছে, নাকি শিকারের আশায় চুপচাপ ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় আছে? বাঘের পায়ের ছাপ দেখতেই ভয়টা সবাইকে আরও বেশি ঘিরে ধরল। স্পষ্ট বুঝতে পারছি আশেপাশে কোথাও বাঘ আছে।
তখন বিকেল নেমে আসছে সুন্দরবনে... ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের পাল দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দ্রুত ছুটছে আর ছুটছে…
~ তথ্য - সুন্দরবন ~ সুন্দরবনের আরো ছবি - মহম্মদ রাশেদুজ্জামান ~
লেখিকা ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া সরকারি কাজের সূত্রে এবং ভালবাসার টানে ঘুরে বেড়ান বাংলাদেশের আনাচেকানাচে। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ নিয়ে সেই অনুভূতির ছোঁয়াই ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। প্রকাশিত বই ‘আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন’।