বসন্ত উৎসব, ভারতবর্ষ ও একটি ভূতের গল্প

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

~ তথ্য- শান্তিনিকেতন ~

তুমি ডাক দিয়েছ
না, সকালে নয়, বিশু পাগলের ডাকটা এল একেবারে মাঝরাতেই। মন দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য জায়গার বেড়ানোর একটা লেখা পড়ছিলাম। বইটা হঠাৎ বন্ধ করে ঘুমন্ত দীপকে ডেকে বললাম, শুনছ, আমি এই দোলে শান্তিনিকেতন যাব। পাশবালিশটা আরেকটু ভালো করে টেনে নিয়ে নির্বিকার ঘুমন্ত গলায় জবাব এল, “যাও”। বললাম, যাও মানে? – “যাও মানে যাও...”।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে আবার মনে পড়ল। বললাম, আমি কিন্তু সত্যিই দোলে শান্তিনিকেতন যাব, সিরিয়াসলি বলছি। দীপ বলল, “যাও না, কে বারণ করছে? আমিও সিরিয়াসলিই বলছি।” কিন্তু থাকব কোথায়? – আমি জানতে চাই, আরতো এক সপ্তাহই দেরি। -“সময় থাকতে বললে তো টুরিস্ট লজেই চেষ্টা করে দেখা যেত, এখন দেখি কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।” আমি কিন্তু বেশি টাকা-পয়সা খরচ করে যাব না – সোজা জানিয়ে দিই। যাবতো রবীন্দ্রনাথের কাছে, এই তো কত আর দূর শান্তিনিকেতন!
আমার বন্ধুস্থানীয় দুজনের কাছে খোঁজ নিই যাদের রুটিরুজি এই ভ্রমণকে ঘিরেই - সস্তায় কোথাও ঘর পাওয়া যাবে কীনা? একজনের সোজা উত্তর, নো ম্যাডাম। আরেকজন বলল, দেখছি। কিন্তু কয়েকদিনের চেষ্টায় সে যা খোঁজ দিল তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। বললাম, থাক যাব না। দীপও টুকটাক যা খোঁজ নিল তার কোনটাই আশাপ্রদ নয়। তারপর বলল, ওদের ফোটোগ্রাফির গ্রুপটার কয়েকজনও দোলে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, ওরা যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে।
বুধবার সাতাশ তারিখ দোল। সোমবার রাতে প্রবীরদার ফোন এল – একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে, মাটির ঘর - ওতেই মেয়েরা মানে আমি আর আমার কন্যা থেকে যাব, বাকি সবাই বাইরের দাওয়ায় শোবে। দীপ বলল, কী করবে? বললাম, চলতো। তেঁতুল পাতা যখন জুটেই গেছে ওতেই সকলের হয়ে যাবে – ওই ঘরেই এদিক-ওদিক করে সবাই ধরে যাব, শোওয়ার জায়গা না হলে আড্ডা দিয়েই রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে...।

জনতা জনার্দন
বেলা আড়াইটের সময় মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে নিতেই দৌড় দৌড় দৌড় – ট্রেন বিকেল চারটে চল্লিশ। প্রবীরদারা তিনটে পঞ্চাশের ট্রেনেই রওনা দিয়েছে – ফোনে জানিয়েছে টিকিটের লম্বা লাইন পড়ছে। বড়বাজারের জ্যামে হোঁচট খেতে খেতে প্রায় পৌনে চারটে নাগাদ হাওড়া পৌঁছে দেখি জনসমুদ্র, আর তার একটা বড় অংশেরই গন্তব্য বোলপুর। বিশু পাগলের আক্কেলটা সত্যি কী, এতো প্রায় বাঁক কাঁধে নিয়ে ভোলেবাবার দর্শনার্থীর ভিড়! শুধু শিব ঠাকুরের বদলে রবি ঠাকুর। টিকিট কেটে আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ঢুকছে আর দরজাগুলো লক্ষ করে ছুটছে মানুষ। আমিও ছুটি মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে, বলি খবরদার হাত ছাড়াসনি যেন। চোদ্দ বছরের মেয়ে বলে, ওকে ওকে, আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ। সত্যিই তাই, প্রচণ্ড ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে আমার হাত আলগা হতেই দেখি বাবার ক্যামেরা কাঁধে ও উঠে পড়েছে। দীপতো আগেই বড় ব্যাগটা শুদ্ধু ঢুকে গেছে। আমার সামনে ওড়না, পিছনে সাইড ব্যাগ – কোনটা সামলানো সম্ভব ভাবতে ভাবতেই দেখি জনতা জনার্দনের প্রবল চাপে আমি ট্রেনের কামরার ভেতরে। একমুহূর্ত মাথাটা কেমন ধাঁধাঁ হয়ে গেল - তাকিয়ে মেয়ে-বাবা কাউকেই দেখতে পাই না, শুধু অজস্র মানুষ। মেয়ের ডাকে খেয়াল পড়ে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দীপের ব্যাগ দিয়ে রাখা জায়গায় ধপাস করে বসে পড়ি। লোকে দেখি সশরীরে কামরায় ঢোকার আগে জানলা দিয়ে রুমাল ছুঁড়ে জায়গা রাখছে, বোঝ! তো সেইসব অশরীরী রুমালটুমাল সরিয়েই দীপ জায়গা করে নিয়েছে। আমরা মা আর মেয়ে তিনজনের সিটে তৃতীয় আর চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে বসি, দীপ দাঁড়িয়ে থাকে। কামরার চতুর্দিকে জায়গা রাখা নিয়ে নানান গোলমাল-ঝগড়াঝাঁটি চলছে... ট্রেনও চলতে শুরু করে।

হোলি হ্যায়
শান্তিনিকেতন একবারই গেছি, তাও অনেকদিন আগে, কী একটা পরীক্ষা দিতে। সেবারে ঘোরা হয়নি। তাই ভাল করে তেমন মনেও নেই। কিন্তু শান্তিনিকেতন নামটা শুনলেই কেমন একটা রোমান্টিক চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। বোলপুর স্টেশন থেকে বেরোতেই লোকজন-রিক্সার ডাকাডাকি সব ছাপিয়ে কানে এল মাইকের প্রবল নিনাদ - হিন্দি গানের সুর – হোলি হ্যায় – হায় রবীন্দ্রনাথ!

আজ জ্যোৎস্না রাতে
দুটো রিক্সাকে আড়াইশো থেকে একশো ষাটে নামিয়ে আমরা রওনা দিলাম ত্রিশুলাপট্টির দিকে। স্টেশনের কোলাহল পেরিয়ে পথ ক্রমশ শান্ত হয়ে এল। আকাশে প্রায় গোল থালার মতো চাঁদ – কাল দোলপূর্ণিমা। মনে পড়ছিল অনেকদিন আগে হোস্টেলে থাকতে হঠাৎ করে মৌসুমীদির সঙ্গে এক সন্ধ্যায় ওদের বাড়ি মুড়াগাছায় যাওয়ার কথা। সেদিনও ট্রেন থেকে নেমে এরকমই এক জ্যোৎস্নারাতে রিক্সায় চড়ে দু'জনে যাচ্ছিলাম। সময়ের দূরত্বে কে কোথায় পৌঁছেছি কে জানে, শুধু মৌসুমীদির দেওয়া ডাইরির পাতার লাইনগুলো আজও বলে – পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী...ভাবতে ভাবতে কখন দেখি পৌঁছে গেছি ত্রিশুলাপট্টি দুর্গামন্দির চত্ত্বরে। প্রবীরদা অপেক্ষা করছিল। আমরা পৌঁছতে দীপের রিক্সায় উঠে পড়ে পথনির্দেশ করে।

এই যে কালো মাটির বাসা
উলগা বা উলগানাথনকে আমি বা দীপ কেউই চিনতাম না, প্রবীরদা আর শিবাজির পরিচিত। উলগাদের দেশ একসময় ছিল বিহার, এখন বহুদিনই শান্তিনিকেতন। উলগার বাবা খুব ফুটবল খেলতে ভালবাসতেন। তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন উলগানাথন। রাইস মিলের বড় পিলারটা পেরিয়ে উলগার দাদা-বৌদির টালির চাল দেওয়া মাটির বাড়ি। একটাই ঘর আর আরেকটা রান্নাঘর। বাড়ির সবাই যারপরনাই কুন্ঠিত, আপনাদের খুব কষ্ট হবে... আমরাও বিব্রত হই। মাথা ঝুঁকিয়ে টালির চালের নীচু অংশ সাবধানে এড়িয়ে ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসি। দুটো-তিনটে ইঁট দিয়ে উঁচু করা চৌকির নীচে সংসারের হাঁড়ি-কুড়ি, বাক্স-প্যাঁটরা। দড়িতে কয়েকটা জামা-কাপড় ঝুলছে। মাথার ওপর টালির ছাদ মাঝে মাঝেই ভেঙ্গে গেছে। দেওয়ালে একপাশে ঠাকুরদেবতার ক্যালেন্ডার কাটা ছবি আটকানো। আরেকদিকে বলিউডের অভিনেত্রী দিব্যার বড় সাইজের একটা ছবি। দাদা-বৌদি আর ওদের ছোট মেয়ে বছর বারোর পূজার সঙ্গে পরিচয় হয়। পূজার সঙ্গে অল্পসময়েই আমার মেয়ের ভাব হয়ে যায়। ছোটদের সখ্যের মজা এটাই যে ওরা অনেক সহজভাবে মিশতে পারে। আর সে কেবল বড় হয়নি বলেই।
রান্নাঘরে মোড়া পেতে বসে স্টিলের কাপে অনেকটা চিনি দেওয়া গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বৌদির সঙ্গে আলাপ জমাই। পাম্প করা স্টোভের ওপর বড় হাঁড়িতে ভাত বসেছে। ভাতের হাঁড়ির ওপর ডালের হাঁড়ি। বৌদি আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে দুঃখ করেন - আমাদের পাকা ঘরে থাকতে দিতে না পারার দুঃখ, সংসারের বোঝা বওয়ার দুঃখ, একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়া না শেখাতে পারার দুঃখ...। কথায় কথায় জানতে পারি চালের মিলে কাজ করার সময় অ্যাক্সিডেন্টে দাদার দুটো পা-ই ভেঙ্গে গিয়েছিল। অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে এখন হাঁটতে চলতে পারেন কিন্তু কাজটা আর নেই। ওই মিলেই এখন বৌদি একটা কাজ করেন। খুব ইচ্ছা ছিল ছেলেকে মাধ্যমিক অবধি পড়ানোর। ক্লাস নাইনে উঠেছিল, তারপরে বাবার এই অবস্থা। ছেলেও একটা মিলে চাকরি পেয়েছিল কিন্তু এতদিন সেই মিল বন্ধ ছিল, সবে সাতদিন হল ফের চালু হয়েছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটজন ক্লাস সিক্সে পড়ে। দাদা এসে বৌদিকে বকেন, কী সব বলছ দিদিকে – ওনারা কতদূর থেকে এসেছেন তাড়াতাড়ি রান্না কর। ভাতটা দেখ যেন গলিয়ে ফেল না। এই চালে করনাতো। ডালটায় টমেটো দিয়ে ভালো করে ফোটাবে। ডিমের ঝোলের পেঁয়াজগুলো ভালো করে কষবে। শশা এনে রেখেছি একটু স্যালাড করে দেবে। বৌদি বলেন, টমেটোতো আনোনি, যাও এখনি সাইকেল নিয়ে। দাদা যাচ্ছি বলে এবার গল্প জুড়ে দেন, এখানকার জমিজমার দাম আগুন হয়ে গেছে, বাইরে থেকে লোকজন এসে জমি কিনে নিচ্ছে, নানারকম রাজনীতির খেলা চলছে...কড়াতে ডিমের ঝোল ফুটতে থাকে।

যাঁ, এঁইবাঁরের মঁতো তোঁকে ছেঁড়ে দিঁলাম...
পাড়াটার একেবারে শুরুতে উলগার এই দাদা-বৌদির বাড়ি আর মাঝের পুকুরটা পেরিয়ে একেবারে শেষের দিকে বড় দিদি-জামাইবাবুর পাকা ঘর। ওদেরই ছাদে তোষক-চাদর বিছিয়ে প্রবীরদারা তিনজন আর দীপের শোওয়ার ব্যবস্থা হয়। ছাদে কিছুক্ষণ আমরা মা-মেয়েও আড্ডা জমাই। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গোটা ছাদ, পিছনের মাঠ-বাড়িঘর। প্রবীরদা বেড়ানোর চমৎকার সব গল্প বলেন। শিবাজি গান গাইতে একটুও রাজি না হয়ে বলে তোমরা কেউ ভূত দেখেছ? প্রবীরদা বলেন, কেন তুই দেখেছিস নাকি? হ্যাঁ দেখেছি মানে অনুভব করেছি, শিবাজি উত্তর দেয়। এর পরেরবার আমাকে একটু দেখাসতো, আমি সঙ্গে একটা শিশি নিয়ে যাব, ভূতকে নিংড়ে খানিকটা তেল বের করে নিয়ে আসব। শিবাজির মুখটা ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যায় – ওইরকম পরিস্থিতিতে যদি পড়তে, সেই শ্মশানে...। আমাকে শ্মশান দেখাস না তো, কত শ্মশানে ঘুরেছি, কোথাও আধখানা ভূতেরও দেখা পাইনি। আমি আসলে ভূতে বিশ্বাসই করি না। আমি মনে মনে ফিলোসফারের মত ভাবি, আসলে মানুষ ভয়তো পায় ভয়টাকেই, আর অন্ধকারকে, অজানাকে, একাকীত্বকে। এই সবগুলোই একসঙ্গে জড়ো হয়ে যেটা হয় তার নাম ভূত। অবশ্য আমি নিজেও তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে ফিলসফি বা লজিকের ধার ধারবনা তা বিলক্ষণ জানি। শিবাজির মুখটা ক্রমশ আলুর দমের মত হয়ে আসছিল। এমন সুন্দর জ্যোৎস্না রাতে ভূতের গল্প দিব্যি জমবে – আমরা উৎসাহ দিই, বলো বলো। শিবাজি গল্প শুরু করে। তখন আমি বেশ ছোট, বছর দশ-বারো হবে। পুজোর সময়। গ্রামের একপ্রান্তে আমার মামার বাড়ি ছিল। একটা মাঠের ধারে ছিল শ্মশানটা। আমি একদিন ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে পথ ভুল করে শ্মশানের দিকে এসে পড়েছি আর রাস্তা চিনতে পারছি না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গা টা কেমন ছম ছম করছে। হঠাৎ মনে হল আমি হাঁটছি আর আমার ঠিক পেছনে একটা খসখস করে শব্দ হচ্ছে। আমি থামছি, শব্দটাও থেমে যাচ্ছে। প্রবীরদা ফুট কাটেন, কুকুরের বাচ্চা। শিবাজি ভুরু কোঁচকায়, আবার গল্প শুরু করে। আমিতো ভয়ে আর পেছনের দিকে তাকাচ্ছিনা, শুধু ছুটছি। আমার পেছনের আওয়াজটাও ছুটছে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ চোখে পড়ল চেনা গাছের সারি – এর ওপারেই মামার বাড়ি। গাছের সারিটা পেরোতেই কেউ একটা পিছন থেকে বলে উঠল - যাঁ, এঁইবাঁরের মঁতো তোঁকে ছেঁড়ে দিঁলাম... বলো, কুকুরে কখনও এটা বলতে পারে?

লাগল যে দোল
অচেনা পরিবেশে রাতে ঘুম খুব একটা গাঢ় হয়নি, সকালে অ্যালার্ম বাজার আগেই উঠে পড়ে দীপকে ফোন করি। ওরা যে বাড়িটায় আছে সেখানেই যেতে হবে বাথরুমে, তাই রাত সাড়ে চারটের সময় সঙ্গীর প্রয়োজন। সবাই মিলে তৈরি হয়ে বেরতে ছটা বেজে গেল। উলগা আর দাদার দেখানো পথে শর্টকাটে মাঠ-ছোট পাঁচিল ডিঙিয়ে পৌষ মেলার মাঠের দিকে জনতার স্রোতের সঙ্গে হাঁটা দিই। শিবাজি আর প্রবীরদার ক্যামেরার ফ্রেমে মানুষ, একা রেললাইন, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ঠাকুরের ভাঙ্গা কাঠামো। দীপও ক্যামেরা বের করে।
এবারই প্রথম বসন্ত উৎসবের স্থান বদল হয়েছে আশ্রম মাঠের থেকে পৌষ মেলার মাঠে। পৌঁছে দেখি এও সত্য এক মেলা, মানুষের মেলা...। পায়ে হেঁটে, স্কুটার-মটোরসাইকেল, সাইকেলে চেপে লোকজন আসছে। মাঠের শুরুতে সুলভ শৌচাগারের পাশে বেশ কয়েকটা অমুক ট্রাভেলস, তমুক ট্রাভেলস লেখা বড় বড় ভলভো বাস দাঁড়িয়ে। বাসের পিছনে চলছে রান্নার আয়োজন। নানা রঙের ভিড়ে বাসন্তী রঙটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে। মহিলাদের কারোর কারোর মাথায় ফুল, পলাশের মালা। কেউ কেউ আবির মাখতে আর মাখাতেও শুরু করে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে একটা জমজমাট মেলার মেজাজ। বেলা বাড়ছে, রোদও চড়ছে একটু একটু করে। মাইকে মাঝে মাঝে নানারকম অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। তারপরে একসময় ভেসে আসে – ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল।
দূরে স্টেজ দেখা যায় কী যায় না, সামনে জনসমুদ্র। দীপ বলে যা ভিড়, এখান থেকে কিছুইতো দেখতে পাবেনা, বুইয়ের দিকে কিন্তু খেয়াল রেখো। মনে মনে ভাবি বিশু পাগল যদি শেষমেষ এতদুর টেনেই এনেছে তখন বাকীটাও সেই দেখবে, আমার আর চিন্তা কী। মুখে বলি দেখিই না চেষ্টা করে, মেয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরি। সে বলে, ডোন্ট ওরি মম, আই উইল নট গেট লস্ট, আই প্রমিস। জনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। দীপ হারিয়ে যায়।

চক্রব্যূহে অভিমন্যু
যত না বসন্তের ডাক কানে আসে তার থেকেও বেশি কানে বাজে, ও দাদা একটু বসুন না, সামনের লোক না বসলে আমরা দেখব কীকরে। মাঝে মাঝে এমন ঠেলা আসে যে ভাবি এই বুঝি ধপাস করে পড়ে গেলাম। সত্যি পড়ে গেলেনও একজন। বেশ বয়স্ক এক মহিলা। যে বয়সে কোন তীর্থের ভিড়ে উনি পড়ে গেলে আশ্চর্য হতাম না সেই বয়সে বসন্ত উৎসবে ওঁকে পড়ে যেতে দেখে অবাক হই, ভাবি কীসের আশায় উনি এখানে এই ভিড়ের মাঝে এসেছেন? কে জানে হয়তো বিশু পাগল ওঁকেও ডাক পাঠিয়েছিল। তবে ভিড় তাকে মাড়িয়ে যায় না বরং সহানুভূতির অনেকগুলো হাত টেনে তোলে। বাচ্চা কোলে মা ভিড়ের মধ্যে ঠেলে ঠেলে চলে। যে অনুষ্ঠান টিভি খুললেই দেখতে পাওয়া যায় তা দেখার জন্য কত দূর থেকে কতরকম মানুষ এসেছেন। ভিড়ের মাঝেই যেন একেকবার এক ঝলক বিশু পাগলকে দেখতে পাই। আবার অসহিষ্ণু মানুষের মাঝে হারিয়ে যায় সে। ঠেলাঠেলি, ঝগড়া কোথাও কোথাও মৃদু হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছায়। আবার আশপাশের মানুষজনই তাঁদের শান্ত করেন। জনতা জনার্দনের ঠেলায় কখন দেখি প্রায় বাঁশের বেড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ভিড়ের মাঝেই উলগার উদ্বিগ্ন মুখ উঁকি দেয় – বৌদি দেখতে পাচ্ছেন কিছু? আমি বলি পাব পাব, তুমি চিন্তা কোর না। সারাক্ষণই ও ফটো তোলা ছেড়ে আমাদের দিকে চোখ রেখেছে। মেয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিই, আরেকটু দেখি, নইলে বেরিয়ে যাব। যদিও পিছন ফিরে বুঝি সামনে এগোনো যত কঠিন এখন পেছনো তার চেয়েও বেশি। আমরা একেবারে চক্রব্যূহে প্রবেশ করেছি।

সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে
'ওরে গৃহবাসী' গানের সঙ্গে লাঠিতে তাল দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচের যে দলটা দুটো বাঁশের বেড়ার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল তাদের প্রায় দেখিনি, রঙিন লাঠিগুলো মাঝে মাঝে একঝলক চোখে পড়েছে। গান শেষে নাচের দল চলে যেতেই লোকজন বেড়া টপকাতে শুরু করল। প্রথমে বেড়ার ওপর দিয়ে। আমরা যখন বেড়ার কাছে পৌঁছালাম তখন ওপারের লোকজন তারের জালি টেনে তুলছে আর এপারের লোকেরা নীচ দিয়ে গা-মাথা গলিয়ে দিচ্ছে। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ছেলেগুলো অসহায়ের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওপারের দলে উলগাও রয়েছে। আমরা মা-মেয়ে পার হই। পরের বাঁশও ডিঙিয়ে সামিয়ানার তলায় পৌঁছে মাঝামাঝি জায়গায় এসে একপাশে বসে পড়ি। এখান থেকে অনেকটাই পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বসে বসে গান শুনি – রঙ লাগালে বনে বনে...। কখনও নৃত্য-গীত দুইই দেখি-শুনি। লাল-সবুজ পাড়ের বাসন্তী রঙের, লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে, ফুলের মালা গলায়, মাথায় দিয়ে আশ্রমের ছাত্রীরা আর সাদা পাঞ্জাবি রঙিন উত্তরীয়য় ছাত্রের দল মঞ্চে একের পর এক গানের সঙ্গে নেচে যায়। গানের মাঝে কবিতা পাঠ হয়। এরমধ্যেই পাশের বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে খানিক আলাপ জমিয়েছি। উনি স্থানীয় মানুষ। আমরা প্রথমবার এলাম শুনে আফশোস করছিলেন যে আসল বসন্ত উৎসবই আর দেখতে পেলেন না। তারপরে বলেন, ওই যে মঞ্চে বাঁদিকে যিনি বসে আছেন উনিই উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত। হঠাৎ খেয়াল হয় দীপকে একটা খবর দিই, আমরা দুজনে হারিয়ে গেলাম ভেবে যদি চিন্তা করে। আসলে আমরা দুজনে বেড়াতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যাই কীনা। আসার আগে পাখি পড়ানোর মত করে ত্রিশুলাপট্টি, দুর্গামন্দির বার বার করে বলে দিয়েছে। আমার আবার ছোট-খাটো কথা একদম মনে থাকে না। ফোন করতে গিয়ে দেখি মোবাইলে টাওয়ার নেই। এবার একটু ইতস্তত করে ওনাকেই বলি দাদা, আমার মোবাইলে টাওয়ার নেই, আমার হাজব্যান্ড চিন্তা করবেন, আমরা দুজনে ঢুকে এসেছি এতটা ভিতরে, যদি আপনার ফোন থেকে একটা ফোন করতে দেন। উনি নিশ্চয় নিশ্চয় বলে পকেট থেকে মোবাইলটা এগিয়ে দেন। আমি অনেকবার চেষ্টা করে লাইন না পেয়ে ফোনটা ফেরত দিতে যাই। উনি বলেন আরেকটু দেখুননা চেষ্টা করতে করতে ঠিক পেয়ে যাবেন। আমি তাও পাইনা। কী আর করি ফোনটা ফেরত দিয়ে গানই শুনি-দেখি – আজই দখিন- দুয়ার খোলা...। ত্রিশুলাপট্টি-দুর্গামন্দির, এইতো দিব্যি মনে আছে। ওদিকে খেয়াল করে দেখি আমার নবলব্ধ দাদাটি প্রাণপনে আমার ডায়াল করা নম্বরটায় চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অবশেষে একটু বাদে হাসিহাসি মুখে ফোনটা এগিয়ে দেন আমার দিকে, নিন কথা বলুন – লাইনের ওপারে দীপের গলা ভেসে আসে। গানে-আওয়াজে প্রায় কিচ্ছু শোনা যায় না। তাও শেষপর্যন্ত বুঝি আর বোঝাই সেই সুলভ কমপ্লেক্স, বেলা সাড়ে নটা।
পৌনে নটা নাগাদ উঠে পড়ি। 'বসন্ত তোর শেষ করে দে রঙ্গ' – অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে আসছে। শুরু হয়ে গেছে আবির খেলার পালা। আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীরা, চেনা-অচেনা মানুষ সবাই রঙের উৎসবে মাতোয়ারা। লাল-সবুজ-হলুদ বেগুনি আবির উড়ছে বাতাসে। রঙ লেগেছে সবার চোখে-মুখে, মনের পর্দায়। ফেরার পথে ভিড় বেশ হালকা হয়ে গেছে। বাঁশের তলা গলে একই পথে বেরিয়ে এসে আবিরে রাঙানো মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকি। অচেনা মানুষ হাসি মুখে এগিয়ে আসেন, অনুরোধ জানান আবির মাখানোর। আমরাও আবির মাখতে মাখতে মাখাতে মাখাতে এগিয়ে চলি। কখন যেন বিশু পাগল আবার সঙ্গী হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে খানিক অপেক্ষা করতেই দীপকে দেখতে পাই। সবাই মিলে সরবত খাওয়া, আবির খেলা হয়। ওরই মাঝে আরও আরও অচেনা মানুষজন এগিয়ে আসেন আবির নিয়ে। কোন জোর নেই তাই কেউ এগিয়ে এলে নিজের থেকেই এগিয়ে যাই তার দিকে। আজ যে সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।

বন্ধুদের সঙ্গে রঙ খেলবি চল
আমাদের ফিরতে দেখে সবচেয়ে খুশি পূজা। বুইয়ের হাত ধরে টানে, চল, আমার বন্ধুদের সঙ্গে রঙ খেলবি চল। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপী, বেগুনি – এতগুলো রঙের আবির একসাথে কখনও খেলেনি পূজা। বন্ধুদের আবির মাখায় যত ইচ্ছা। ওকে দেওয়া চকলেটগুলো নিজে একটুও না খেয়ে টুকরো টুকরো করে বিলিয়ে দেয় বন্ধুদের মধ্যে। হয়ত অনেকদিন ও বন্ধুদের দেওয়ার মত কিছু পাইনি। আজ সামান্য এইটুকু আবিরই ওর অনেকটা খুশি হয়ে বাতাসে ঝরতে থাকে। আমার মেয়েও খুব খুশি। ও কুকুর ভীষণ ভালবাসে। বাড়িতে পুষতে দিইনা বলে পাড়ার কুকুরদেরই আদর করে। কালকে রাতে এসেই ছাগলের বাচ্চা আর কুকুরের বাচ্চা কোলে নিয়েছে। এখনতো পারলে রাস্তায় আর পুকুর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছোট ছো্ট হাঁস-মুরগীর ছানাগুলোর সঙ্গেও ভাব করে। আর ও-ওতো কখনও একসঙ্গে এত বন্ধুর সঙ্গে রঙ খেলেনি। কেউ ওর বয়সী, কেউবা একটু বড় বা ছোট। কারোর বিয়েই হয়ে গেছে, কোলে ছোট বাচ্চা। ভারী খুশি হয়ে আমায় এসে বলে আমি আজ এখানকার সব বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছি মা।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও
রোদের তেজ মরে আসছে। ব্যাগ গুছিয়ে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়ি। বাকীরা কাল ফিরবে। সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৌদিকে ডেকে তুলে বিদায় জানাই। মিস্টির প্যাকেট হাতে দিই, আর কী বা দিতে পারি? গতকাল প্রবীরদারা চাল-ডাল-ডিম সব কিনে এনেছিল বলে দাদা খুব রাগ করছিলেন। বলছিলেন, আমাদের বাড়িতে এসে আপনারা নিজেদের আনা খাবারই খাচ্ছেন, আমার মান-সম্মান আর কিচ্ছু রইল না।
বৌদিকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথে এগোই। হাঁটতে হাঁটতে মেয়ের বলা একটা কথা খুব সত্যি বলে মনে হয়। ওকে বলছিলাম, দেখছিসতো কত মানুষ কত কষ্ট করে বেঁচে থাকে। এটাই সত্যিকারের ভারতবর্ষ। ও বলল, মা, ওরা কিন্তু খুব আনন্দেই আছে। এই আনন্দ অন্য আনন্দ যা শত দুঃখের মধ্যেও কোথাও একটা দাদা-বৌদি-পূজার মুখে দেখেছি। এটাই হয়ত ওঁদের বাঁচার রসদ। যে আনন্দের একটু ছোঁয়া হয়ত আমার বুকেও লেগেছে আর অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে আমার মেয়ের মুখের আলোতে।
এগিয়ে চলি – আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে...।

~ তথ্য- শান্তিনিকেতন ~

‘আমাদের ছুটি’-র সম্পাদক দময়ন্তী কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন দৈনিক ‘কালান্তর’, ‘স্বর্ণাক্ষর’ ও ‘আজকাল’ প্রকাশনার সঙ্গে। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে মুক্ত সাংবাদিকতা করছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher