বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com

 

কোণার্কের সূর্যমন্দিরে

হুমায়ূন কবীর ঢালী

চব্বিশ এপ্রিল আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে জানিয়ে আগেই মেল করেছিল সরোজিনী সাহু। সরোজিনী ভারতের অন্যতম নারীবাদী লেখক। ওড়িশায় বাস। যার সহযোগিতায় আমার বইটি ওড়িশা থেকে প্রকাশের সুযোগ ঘটেছে। যাহোক, চব্বিশ তারিখের কথা শুনে ভারতীয় ভিসা পেতে তৎপর হয়ে উঠলাম। কিন্তু ভারতীয় ভিসা পেতেও আজকাল বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। সে প্রসঙ্গে আর নাইবা গেলাম। বেশ কয়েকবার (কয়েকদিন বলাই সমীচীন হবে) চেষ্টার পর ইন্টারনেটে ফর্ম পূরণ করে জমা দেওয়ার তারিখ এবং যথাসময়ে ভিসাও মিলল।
বিশ এপ্রিল কলকাতা, এবং বাইশ এপ্রিল ওড়িশার রাজধানী ভূবনেশ্বর গেলাম। ভারতের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি রাজ্য ওড়িশা। ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ওড়িশা একেক সময় একেক নামে পরিচিত ছিল – কলিঙ্গ, উৎকল, কোঙ্গদ, উড্রদেশ ও উড়িষ্যা । অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ওড়িশা রাজ্য। নীল সাগর ও বেলাভূমি, পাহাড়ি নির্ঝর, সবুজ বনানী, ডলফিনের বাস চিলিকা হ্রদ ও জলপ্রপাত। এসবের পাশাপাশি এখানকার প্রাচীন কারুকার্যময় মন্দিরগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বিশেষ করে কোণার্ক-এর সূর্যমন্দির, ভূবনেশ্বরের রাজারানি মন্দির, লিঙ্গরাজ মন্দির, পুরীর জগন্নাথ মন্দির খুবই বিখ্যাত।
কলকাতা থেকে ভূবনেশ্বর ট্রেনে ছয় ঘন্টার পথ। যদিও জনশতাব্দীতে লেগেছিল প্রায় সাত ঘন্টা। ভূবনেশ্বর সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম রাত সোয়া নয়টায়। পন্ডিত আচার্য এসেছেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। সাথে তার কয়েকজন বন্ধু ও সহযোগী। ফুল আর উত্তরীয় পরিয়ে তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বাংলাদেশের একজন লেখকের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা দেখে খুব ভালো লাগল। পন্ডিত আচার্যর গাড়িবহর আমাকে গ্রিডকো গেস্ট হাউজে নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কেননা, তখনো সরোজিনী এসে পৌঁছায়নি। তার পৌঁছাতে পৌঁছাতে আগামীকাল সকাল। রাতে উড়িষ্যার বেশ কয়েকজন লেখক এলেন। উড়িষ্যা আর বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডা-আলাপে রাত প্রায় বারটা বাজল।
ভোর সাতটায় দরজার কড়া নড়ল। দরজা খুলে দেখি সরোজিনী সাহু দাঁড়িয়ে আছেন।
"গুড মর্ণিং। রাতে ঘুম কেমন হলো?" - বাংলা আর ওড়িয়ার মিশেলে সরোজিনী জানতে চাইলেন।
"খুব ভালো হলো।"
"আমাদের রাত কেটেছে গাড়িতে। ভোর ছয়টায় এসে ভূবনেশ্বর পৌঁছলাম। আমরা আপনার পাশের রুমে আছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। আমরা বেরোবো। পুরীতে যাব।"

সিডিউল আগেই দেওয়া ছিল। তৈরি হয়ে পুরীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ভূবনেশ্বর থেকে দক্ষিণে পুরীর দূরত্ব ষাট কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পুরীর অবস্থান। তার আগে কোণার্ক শহর। সেখানে অবস্থিত সূর্যমন্দির। সমুদ্র থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে। পুরী থেকে ছত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গাড়িতে ওঠার পর জগদীশদা (জগদীশ মোহান্তি, ভারতের বিখ্যাত লেখক, সরোজিনীর স্বামী) জানালেন, পুরীতে যাওয়ার আগে আমরা সূর্যমন্দির পরিদর্শনে যাব। রাজধানী পেরিয়ে কোণার্কের সড়কটা খুব চওড়া না হলেও যানজটমুক্ত থাকায় সমান গতিতে গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল। সড়কের দুপাশে সমতল ফসলি জমি। নানারকম সবজি আর সোনালী ধানের শীষে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এসব দেখতে দেখতে কখন কোণার্ক চলে এসেছি খেয়াল নেই। সরোজিনী যখন বলল, "ঢালী, কোণার্ক চলে এসেছি। নামতে হবে।" – আমার ঘোর কাটল।
প্রধান সড়ক থেকে সূর্যমন্দির পায়ে হাঁটার পথ। তিনশ গজ হবে। মন্দিরের গেটে গিয়ে থামতে হলো। টিকিট কাটতে হবে। জগদীশদা টিকিট কাটলেন। মন্দিরে ঢুকতে চওড়া সড়ক। সড়কের দুপাশে সবুজ পরিপাটি বাগান। এরপর মন্দিরে ঢোকার প্রধান গেট। সূর্যমন্দির। একসময় মন্দিরটি সমুদ্রের পারে অবস্থিত ছিল। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব এখানে সূর্য উপাসনা করে কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। মন্দিরটি আন্তর্জাতিক বিশ্ব ঐতিহ্য প্রকল্প কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ও ইউনেস্কো নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের (১০৭৮-১৪৩৪) রাজা প্রথম নরসিংহদেব (১২৩৮-১২৬৪) দ্বা্রা নির্মিত। বারশ শিল্পী বার বছরে এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মূল মন্দিরটি বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আমরা যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি মুল মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমন্ডপ অংশ। পুরো মন্দিরটি পাথরের খাঁজ কেটে তৈরি করা হয়েছে। কারুশিল্পের চমৎকার নিদর্শন এই মন্দির। মন্দিরটির উচ্চতা ২২৮ ফুট। মন্দিরটির ডিজাইন সম্বন্ধে উড়িষ্যার সরকারি ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়া আছে, The entire temple was designed in the shape of a colossal chariot with seven horses and twenty four wheels, carrying the sun God, Surya, across the heavens. Surya has been a popular deity in India since the Vedic period.
উপাস্য সূর্যমূর্তিটি সম্রাট মুকুন্দদেব পুরীর মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। মন্দিরের কারুকার্যে তিন রকমের সূর্যদেবতা রয়েছে। দক্ষিণ পাশের সূর্যদেবতাকে 'উদিতসূর্য', যার উচ্চতা ৮.৩ ফুট, পশ্চিমদিকের সূর্যদেবতাকে 'মধ্যাহ্ন সূর্য', যার উচ্চতা ৯.৬ ফুট এবং উত্তর দিকের সূর্যদেবকে 'অস্ত সূর্য', যার উচ্চতা ১১.৫ ফুট, আখ্যায়িত করা হয়েছে। পুরো সূর্যমন্দিরটি একটি রথের মতো। মন্দিরে আছে ২৪ টি চাকা। প্রতি চাকায় আটটি স্পোক। একেকটির ব্যাস ৯.৯ ফুট। মন্দিরের দক্ষিণদিকে কারুকার্যে খচিত রয়েছে দুটি যোদ্ধা ঘোড়া। প্রতিটি দৈর্ঘে ১০ ফুট ও প্রস্থে ৭ ফুট। পূর্ব দিকে মন্দিরে প্রবেশের মুখে দুপাশে দুটি ঐশ্বর্যপূর্ণ সিংহ দুটি হাতির ওপর চেপে আছে। প্রত্যেকটি সিংহ ও হাতির মূর্তি একটি পাথরে তৈরি। এটি দৈর্ঘে ৮.৪ ফুট, প্রস্থে ৪.৯ এবং উচ্চতায় ৯.২ ফুট। প্রতিটি সিংহ ও হাতির ওজন ২৭.৪৮ টন। এটি মন্দিরের প্রধান গেট। এছাড়া মন্দিরের গায়ে অসংখ্য দেবদেবী, জীবজন্তু, নর-নারীর কারুকার্য শোভিত। তবে অধিকাংশ মূর্তিরই ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব। আগের সেই দেহবল্লরী যেমন শোভা পাচ্ছে না, তেমনি মন্দিরটিও প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের ক্ষয়িষ্ণু নির্মাণ দর্শন করছে পর্যটকরা।
মন্দির পরিদর্শন শেষেও বেরিয়ে আসতে ইচ্ছা করে না। ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছা করে। মন্দিরের শিল্পকর্ম নিয়ে যেকোনো শিল্পপ্রেমী মন ভাবনার অতলে ডুবে যাবে বারবার।

~ কোণার্কের তথ্য || কোণার্কের আরো ছবি ~

পেশায় সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক হুমায়ুনের অবাধ ও সাবলিল বিচরণ শিশুসাহিত্য, কথাসাহিত্য ও কাব্যসাহিত্যে। লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। বর্তমানে শাপলা দোয়েল ফাউণ্ডেশনের ট্রাষ্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য হুমায়ুন বাংলাদেশ কালচারাল রিপোটার্স এসোসিয়েসনসহ অনেক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাংলাপ্রকাশের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বেও নিয়োজিত আছেন। এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে চল্লিশটিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

প্রকৃতির কাছাকাছি

রফিকুল ইসলাম সাগর

রাতের অন্ধকার ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলেছে সিলেটের উদ্দেশে। শ্রীমঙ্গল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এই রেল পথ অসম্ভব সুন্দর, আশপাশে শুধুই চা-বাগান। যদিও এখন সবই অন্ধকার, শুধু রেলপথের ওপর ট্রেনের আলো আর মাঝে মাঝে আলো-অন্ধকারে একেকটা স্টেশন যেন ভেসে উঠছে আঁধার সমুদ্রে।

সাতটায় সিলেট পৌঁছে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। মাজার জিয়ারতের কাছেই একটি হোটেল ভাড়া করলাম থাকার জন্য। সেখান থেকে মাধবকুণ্ড প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায় মাধবকুণ্ড। এর আগে কখনও আমার যাওয়া হয়নি। শুনেছি মাধবকুণ্ডের ঝরনা খুব সুন্দর। মাধবকুণ্ড যাব বলতেই ফিরোজা খালা হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন,এই বৃষ্টি-বাদলার দিন না যাওয়াই ভাল। আমি, ইভা, ফাহিম ও বাঁধন ছাড়লাম না। বললাম, গিয়ে দেখোই না, বর্ষাতেই তো মাধবকুণ্ডের ঝরনা পেখম মেলে। একটা সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাড়া করে সোজা চলে গেলাম মাধবকুণ্ড। যাওয়ার পথে একটি ফেরিতে করে পার হতে হয়েছে। বর্ষায় অনেক জায়গায় পথ ছুঁই ছুঁই পানি। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল অটোরিকশায় থাকতেই। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ১০ টাকার টিকিট কেটে মাধবকুণ্ড পর্যটন কেন্দ্রে ঢুকলাম। বড় বড় গাছ, ভেজা পাখি, পাহাড় সব মিলিয়ে দারুণ ভাল লাগছিল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও কিসের শব্দ যেন কানে আসছিল। বাঁয়ে ঘুরতেই ঝরনা দেখতে পেলাম। বেশ বড় কলেবর নিয়ে পূর্ণ তেজে নীচে গড়িয়ে পড়ছে। এই শব্দই পাচ্ছিলাম এতক্ষণ! এরপর তো আর দেরি চলে না। দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ছোঁয়াছুঁয়ি খেললাম, ডুবে থাকলাম, ভেসে তো থাকলামই। উঠতেই চাইছিলাম না। কিন্তু ফিরোজা খালা ছাড়ল না। ঘণ্টা তিনেক পর তো প্রায় কান ধরেই উঠাল। বিকেল হয়ে গিয়েছে। বাইরে আমাদের জন্য অটোরিকশা চালক উজ্জ্বল মিঁয়া অপেক্ষা করছিলেন। হোটেলে খেয়ে অটোরিকশায় উঠে বসলাম।

পরদিন সকালে বের হলাম জাফলং ও তামাবিল যাওয়ার জন্যে। উজ্জ্বল মিঁয়াকে ফোন করে বলে দিলাম অটোরিকশা নিয়ে আসার জন্য। ততক্ষণে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। জাফলং যাওয়ার পথে চোখে পড়ল বিশাল উঁচু উঁচু পাহাড় আর অনেকগুলো ঝরনা। পাহাড়গুলো এত উঁচু যেন মেঘ ছুঁয়ে আছে। ঝরনাগুলো ভারতের সীমান্তের ভেতরে থাকায় কাছে গিয়ে দেখার সুযোগ নেই। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষে জাফলং অবস্থিত। জাফলং যাওয়ার পথেই তামাবিল চেক পোস্ট। যাকে বলা হয় তামাবিল জিরো কিলোমিটার সেখান থেকে বিএসএফ ক্যাম্প খুব কাছে। দেখলাম ভারতীয় ট্রাক মাল নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কিছুক্ষণ সেখানে থেকে মনের আনন্দে ছবি তুললাম। তারপর সোজা জাফলং। জাফলং-এ আছে পাহাড়, ঝরনা, কমলা বাগান, চা বাগান ও ডাওকি নদী। ডাওকি নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। এই এলাকার মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছে পাথর উত্তোলনে। জাফলং যাওয়ার পর চোখে পড়ল নদী থেকে পাথর তোলার পরিচিত দৃশ্য। জাফলং-এ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দুচোখ ভরে উপভোগ করে কেটে গেল সারাদিন।


~ মাধবকুণ্ডের তথ্য ~

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন কোর্সে পাঠরত রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বেড়ানো আর ভ্রমণ সাংবাদিকতা তার পছন্দের বিষয়।

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher