একটুকরো ব্রাসেলস
মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
~ তথ্য - ব্রাসেলস || ব্রাসেলসের আরো ছবি ~
অনেকদিন আগের কথা। এক ধনী ব্যবসায়ীর আড়াই বছরের ছোট্ট ছেলেটি হারিয়ে গিয়েছিল ব্রাসেলস শহরে। আনাচে কানাচে খুঁজতে খুঁজতে শেষপর্যন্ত যখন তাকে পাওয়া গেল তখন সে শহরের এক প্রান্তে ফোয়ারার জলের মধ্যে নিশ্চিন্তমনে প্রস্রাব করছিল। তার বাবা তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দেই সেই জায়গায় বানিয়ে ফেললেন ব্রোঞ্জের আস্ত একটা মূর্তিই ঠিক যেমনটি তাকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তারপর বেশ কয়েক শতাব্দী কেটে গেছে। প্রচলিত কথা বলে, যুদ্ধের সময়ে দেবদূতের মতো সেই নগ্ন শিশুমূর্তি বাঁচিয়ে ছিল এই শহরের মানুষজনকে। ১৬১৯ সালে শিল্পী হিয়েরোনিমাস নির্মিত এই মূর্তিটি চুরি গিয়েছেও বেশ কয়েকবার এমনই এর জনপ্রিয়তা। প্রতিবারই নতুন করে বানানো হয়েছে মূর্তিটি। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস শহরে এই স্ট্যাচুটিকে ঘিরে সারা বছর ধরেই চলে নানা উৎসবের পালা। উৎসবের দিনে নানা পোষাকে সেজে ওঠে এই কিংবদন্তী শিশু। গ্র্যান্ড প্লেসের সিটি মিউজিয়ামে গেলেই দেখা যায় এই ছোট্ট মূর্তিটির অজস্র পোষাকের সম্ভার।
এখানে আসার আগেই অনেকবারই শুনেছিলাম এই আশ্চর্য শিশু মূর্তিটির কথা। ব্রাসেলসে পৌঁছেই তাই কৌতুহল মেটাতে প্রথমেই চলে এসেছিলাম “রু দে লেতুভ” আর “রু দে গ্র্যান্ড কারস”-এর সংযোগস্থলে অবস্থিত ‘ম্যানিকেন পিস’ নামক ৬১ মিটার দীর্ঘ সেই শিশু মূর্তিটি দেখতে। এখন সেখানে দাঁড়িয়েই নানা গল্পকথা শুনছি গাইডের মুখে আর মূর্তিটিকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা দেখতে দেখতে মনে পড়ছে ভারতবর্ষের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা হাজারো সত্যিকারের নগ্ন শিশুদের কথা, যাদের দিকে ফিরেও তাকায় না মানুষ।
গল্প শুনতে শুনতে কোথা দিয়ে দেখি অনেকটা সময় কেটে গেছে। 'ম্যানিকেন পিস'-এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আশপাশের দোকানগুলোয় সাজানো বটল ওপেনার, ফ্রিজ ম্যাগনেট, চাবির রিং, আরও হরেক রকমের ম্যানিকেন পিসের সাজানো সম্ভার দেখতে দেখতে এবারে এগোই গ্র্যান্ড প্লেস বা গ্রেট মার্কেটের দিকে।
ব্রাসেলসও ইতিহাসের শহর। কিন্তু এই ইতিহাস মূক নয়, বরং আধুনিকতার রঙমিশেলে অতীত বড় জীবন্ত এই শহরে। ব্রাসেলস শব্দের ডাচ অর্থ "জলা জায়গার ওপর বাড়ি"। সত্যি একসময় এটি নীচু জমির ওপর ছোট্ট একটি শহর ছিল। সেটা প্রায় দশম শতাব্দীর আশেপাশে এক সময়ের কথা। কালক্রমে শহর বাড়তে বাড়তে আজকের এই সাজানো গোছানো ঝকঝকে বৃহৎ শহরে পরিণত হয়েছে। একদিনে পুরো শহর ঘুরে ফেলা একেবারেই সম্ভব নয়।
ব্রাসেলস শহরের প্রাণকেন্দ্র সেন্ট্রাল স্কোয়ার বা গ্র্যান্ড প্লেস। গিল্ড হাউস, সিটি টাউন হল আর ব্রেডহাউস দিয়ে ঘেরা এই গোলাকৃতি জায়গাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত। প্রাচীনত্বের দিক থেকে তো বটেই এমনিতেও স্থানটির আভিজাত্যই আলাদা। প্রত্যেক দু’বছর অন্তর “ফ্লাওয়ার কার্পেট” দিয়ে সাজানো হয় সুবিশাল এই চত্ত্বর। আমাদের অবশ্য ফ্লাওয়ার কার্পেট দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে গোটা জায়গাটা তখন ছোট ছোট বেগুনি ফুলের রঙবাহারি টব দিয়ে সাজানো ছিল। সুন্দর এই চত্ত্বরটা ঘিরে দোকানের সারি – চিজ, চকোলেট, কফিশপ, খাবারের দোকান, বিয়ার শপ আরও কত কী।
টাউন হলের গথিক স্থাপত্যের টাওয়ারটি দেখে ভুল করে ভাবছিলাম বোধহয় কোন প্রাচীন চার্চ বা কাসেল। আসলে সেটাই টাউন হল। ১৬৯৫ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত টাউন হলটির যেদিকেই তাকাই অতীত যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। মাঝখানের উন্মুক্ত জায়গাটি ঘিরে রয়েছে বিশালাকৃতি হলগুলি। পাথরের তৈরি বড় বড় ইঁট জুড়ে তৈরি মেঝের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে। পুরোনো হলগুলোর নীচের তলায় এখন নানারকম দোকান, রেস্তোঁরা আর ছোট ছোট কাফে আর ঠাণ্ডা পানীয়ের দোকান। দেখলাম বেশ কয়েকটা বেলজিয়ান চকোলেটের দোকান রয়েছে। একটা কাফের রঙিন ছাতার তলায় বসে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আশপাশে তাকিয়ে দেখছি প্রাচীন আর আধুনিক বিচিত্র এই শহরকে – নানান দেশের পর্যটকদের ভিড় থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন ভাষায় চেনা-অচেনা শব্দ-বাক্য, দোকানগুলিতে তাল মিলিয়ে চলছে বেচাকেনার পালা, ওরই মাঝে এক শিল্পী তার ক্যানভাসে আপন মনে বোলাচ্ছেন তুলি, ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে মার্কেট প্লেসের রঙ-ছবি।
হাতে সময় খুব কম। এক ঝলক ঘুরে নিলাম অ্যাটোমিয়াম থেকে। ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলস-এর মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ফেয়ার। সেই সময় অ্যাটোমিয়াম নামক একটি স্ট্রাকচার গড়ে তলা হয়। এটি দেখতে একটি অণুর মত। আশ্চর্য কারিগরি দেখে বেশ অবাক হলাম।
ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল। একেবারেই দেখা হল না দুটি বিখ্যাত মিউজিয়াম – রয়্যাল মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস আর বিখ্যাত কমিক চরিত্র টিনটিনকে নিয়ে করা কমিক মিউজিয়াম। বেশ আফশোষই লাগছিল। রয়্যাল প্যালেসের এক অংশ এখন হোটেল। সেখানে লাঞ্চ সেরে ফেরার পথ ধরলাম।
~ তথ্য - ব্রাসেলস || ব্রাসেলসের আরো ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মহুয়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন।