--> :: Amader Chhuti :: ঈশ্বরের আপন দেশে

ঈশ্বরের আপন দেশে

ঝুমা মুখার্জি

হর-কি-দুনের তথ্য || ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি

গরমের ছুটিতে মানুষের ভিড় পাহাড়ে, কটাদিন অন্তত দাবদাহ থেকে মুক্তি। গরম জামাকাপড়ে বাক্স ভর্তি করে সপরিবারে মুসৌরি-নৈনিতাল রওনা দেন ভ্রমনবিলাসীর দল।
আবার ছমাস বন্ধ থাকার পর গাড়োয়ালের মন্দিরগুলিও দর্শনের জন্য খোলে এখন। অসংখ্য তীর্থযাত্রী তাই এই পথে পা বাড়ান।
আডভেঞ্চারপ্রেমী পর্বতারোহীর দল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অজানা পথে পাড়ি দেন এই সময়েই।
আবার আমার মত কেউ আছেন যারা ছকে বাঁধা আটপৌরে জীবনে একটু রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে পাহাড়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন। সবাই একমত হবেন কিনা জানি না, তবে সকলের জন্যই গাড়োয়াল হিমালয় আদর্শ। বিধাতা এখানে প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন। অজস্র নদী, ঝরনা, সবুজ বনানী, বুগিয়াল, ফুল আর পাখিতে সুসজ্জিতা প্রকৃতি। আর এখানকার প্রতিটি স্থানকে ঘিরে আছে পৌরাণিক গল্প আর মানুষগুলো ও বড়ই সরল-সাদাসিধে। প্রতি বছর এখানে ট্রেক করতে গিয়ে গাড়োয়ালিদের সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনে আমরাও কটাদিন অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এবারে আমরা মানে আমি ও অনিন্দ্য যাচ্ছি 'হর কি দুন'। শিবের উপত্যকা বা ভ্যালি অব গডস নামে পরিচিত এজায়গা।
৩১ মে, দিল্লি থেকে দেরাদুনগামী একটি ট্রেনের জেনারেল শ্রেণীর কামরায় উঠে বসলাম, কোনরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছি। প্রচণ্ড গরমে ভীড়ের চাপে নাজেহাল অবস্থা আমাদের। হরিদ্বার পৌঁছতেই ট্রেন প্রায় খালি, আগামীকাল দশহরা উপলক্ষে গঙ্গাস্নানে চলেছে হাজার হাজার পুণ্যার্থী। বাকি রাস্তা ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম ।
রাত সাড়ে আটটায় দেরাদুন স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম। রাতটা কাটিয়ে পরদিন, ১ লা জুন সকাল সকাল বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলাম।। পুরোলাগামী বাসে উঠে বসলাম। বাস ছাড়তে ছাড়তে ৭টা বাজল। বাস তো ভরে গেল, তিল ধারণেরও জায়গা নেই। স্থানীয় মানুষেরই ভিড়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাস ছুটে চলেছে। এই রাস্তা দিয়ে আগেও গেছি মুসৌরি বেড়ানোর সময়। আবারও ছবির মত সুন্দর রাস্তা দিয়ে যেতে ভাল লাগছিল। মিষ্টি শীতল হাওয়ায় মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। ৩৫ কিমি দূরে মুসৌরি পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগল,রাস্তায় পড়ল কেম্পটি ফলস, বাস থেকেই দেখে নিলাম। এখনও চেনা পথেই চলেছি। কিছুক্ষণ পর অচেনা অদেখা পথে যাত্রা,যার জন্যইতো বেরিয়ে পড়া। যে জায়গায় যাব বলে মনস্থির করেছি,তার সম্পর্কে বই আর ইন্টারনেট ঘেঁটে যা তথ্য পেয়েছি তাই সম্বল করে দুই প্রকৃতিপ্রেমিকের বেরিয়ে পড়া। না করেছি কোথাও বুকিং, না নিয়েছি গাড়ি,না আছে বড় দল। বেড়িয়ে পড়েছি দুগ্গা দুগ্গা বলে। আর এইভাবে বেরিয়ে পড়ি বলেই হয়তো প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করতে পারি। কদিনের জন্য খোলা আকশের নীচে দাঁড়িয়ে বুকভরে তাজা শ্বাস নিতে পারি। নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই। এই পাওনা যে কতখানি অমূল্য তা আমিই জানি। হিমালয়ের অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারি না, তাই বারবার ছুটে আসতে হয়।
বাস পুরোলা পৌঁছল দুপুর বারটা নাগাদ। এখান থেকে আরও ৬০ কিমি যেতে হবে। এখানে জি.এম.ভি.এন-এর গেস্ট হাউস আছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান-বাজার আছে। ট্রেকাররা এখান থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই রুটে এটাই শেষ শহর, এরপর মোবাইল পরিষেবা, বিদ্যুত বা অন্য কোন আধুনিক পরিষেবা এসব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে কদিন। তবে আজকাল সোলার প্যানেল ডিশ টিভি লাগাচ্ছে কেউ কেউ। এখানে মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেলে আধুনিকতার পরশ ইকোসিস্টেমের ওপর তার এফেক্ট ফেলবে, বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে তার প্রভাব পড়বে।

আমাদের এই বাস সাঁকরি অব্দি যাবে। কিন্তু পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে। আমরা ভেবেছিলাম এখান থেকে শেয়ার জীপে বাকি রাস্তা যাব। কোনো জীপ পাওয়া গেল না তাই বাসেই আবার উঠতে হল। বাস যত এগোচ্ছে প্রকৃতিকে তত সুন্দরী লাগছে। জানলায় চোখ আটকে আছে। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে জলধারা নেমে আসছে কখনও সে চঞ্চলা কিশোরী, কখনও শান্ত পূর্ণযুবতী। বাস থামছে। স্থানীয় মানুষ নামছে উঠছে। বেশিরভাগই মহিলা। এদের পোশাক ও গয়নায় রঙের বাহার আর অমলিন হাসি নজর কাড়বে। ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছে গেলাম মোরি। অসাধারণ জায়গা। পাহাড়, নদী, সবুজ বনানী সব মিলিয়ে যেন অপূর্ব এক চিত্রপট। থাকার জন্য ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। দুদিন নিরালায় ছুটি কাটানোর এক দারুন স্পট। এরপর বাস থামল ২১ কিমি দূরে নেটওয়াড়ে, গোবিন্দ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির প্রবেশদ্বার। এখান থেকে প্রবেশ মুল্য দিয়ে অনুমতি নিয়ে তবেই প্রবেশ করা যায়। আমরাও তাই করলাম। এই বনাঞ্চল আকারে ৯৫৭.৯৬৯ বর্গ কিমি। ১৯৫৫-র ১ মার্চ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির পশুপক্ষী ও জীবনদায়ী উদ্ভিদের জন্য সংরক্ষিত। স্নো লেপার্ড, ব্ল্যাক বিয়ার, ব্রাউন বিয়ার, মাস্ক ডিয়ার, গোল্ডেন ঈগল এই অঞ্চলে বাস করে। নেটওয়ারে রুপিন ও সুপিন নদী মিলিত হয়েছে,এরপর টন্স নাম হয়েছে। আর ১২ কিমি যেতে হবে। এক কমবয়েসি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল বাসে, পড়াশুনা করছে, নাম চমন। ছুটিতে গাইড- পোর্টারের কাজ করে। ঠিক হল আমাদের সঙ্গে ছ'দিন থাকবে চমন। বিকাল ৫টায় সাঁকরি এসে পৌছলাম। জি.এম.ভি.এন.-এ উঠলাম। গেস্টহাউসের অবস্থান পাহাড়ের মাথায়। ভীষণ ঠাণ্ডা, সঙ্গে কনকনে হাওয়া। মুখহাত ধুয়ে একটা ছোট দোকানে চাউমিন আর চা খেলাম। তারপর আধ কিমি নীচে সর্ গ্রাম ঘুরে এলাম। এখানে চমনের বাড়িতে কিছুক্ষণ কাটালাম। আমাদের ক্যামেরার ব্যাটারি আরেকবার চার্জ করে নিলাম।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে, দূরে পাহাড়ে রঙের ছটা। আঁধার নামবে। তার আগেই ফিরে এলাম গেস্টহাউসে। ঠাণ্ডা আরও জমিয়ে পড়ছে। এখানে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে কিন্তু তার দেখা আমরা পেলাম না। ঘরে মোমবাতি জ্বেলে বসে না থেকে চেয়ার নিয়ে বাইরে বসলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে,দু' এক দিন পরই পূর্ণিমা। মনে হচ্ছিল সব ছেড়ে এখানে এসে থাকলেই তো পারি। কেয়ারটেকার নানাজি আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। ওনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন, কালকের ট্রেক প্রসঙ্গেও নানা খুঁটিনাটি বলে দিলেন। ন'টায় ভাত, রাজমা, রুটি আর অরগানিক সব্জি খেয়ে সোজা লেপের তলায়। কাল ২ জুন আমাদের যাত্রা শুরু।
খুব ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি সূর্য উঠে যায়। বিছানা ছেড়ে বাইরে এলাম । কিছুক্ষণ পর আমরা গাড়ি নিয়ে তালুকার দিকে যাত্রা করলাম। এই রাস্তায় সবসময় গাড়ি যায় না। ল্যান্ডস্লাইড হলেই বন্ধ হয়ে যায়। আমরা ভেবেছিলাম হেঁটে যেতে হবে, গাড়ি যাচ্ছে তাই আমাদের একটা দিন বেঁচে গেল। রাস্তা অবশ্য সেইরকমই, কতবার যে আমার মাথা ঠুকল! কোমর, পেট ব্যথা হয়ে গেল। কিছুটা রাস্তা ভাল, বাকিটা বোল্ডার বিছানো। দু’এক বার গাড়ি বন্ধ হল আবার চলল, প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগল তালুকা আসতে।
এখানে পৌঁছেই পেলাম বরফঢাকা সাদা হিমালয়ের দেখা। আকাশ আয়নার মত তকতক করছে আর ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে, সুন্দরী প্রকৃতি যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। এমনিতে জায়গাটা ভীষণ অপরিচছন্ন। ঘোড়া আর খচ্চর নোংরা করে রেখেছে। জি.এম.ভি.এন-এর গেস্টহাউস আছে,কিন্তু তার অবস্থা শোচনীয়। সবাই সীমা গিয়েই রাত্রিবাস করে। সোজা রাস্তা সুপিন নদীর পাশ দিয়ে গেছে, যেন মনে হচ্ছে আমরা নদীর তীর ধরে সোজা উৎসের দিকে এগিয়ে চলেছি। আজ দীর্ঘ ১৪ কি.মি. ট্রেক করতে হবে। তাই প্রথম থেকেই পা চালানোর নির্দেশ এল। কিন্তু এ পথ হেঁটে শেষ করার জন্যই কি আসা? গন্তব্যে পৌঁছনোই কি উদ্দেশ্য? আমার মতে তা নয়,প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখব,তার রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করব,কখনও যেন পথচলা ক্লান্তিকর না হয়। আমাদের পোর্টার এগিয়ে অনেকদূর চলে গেছে, আমার সঙ্গীটিও দ্রুত হাঁটছে। আমি পিছিয়ে পড়ছি। তাড়াহুড়ো না করে নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম,দেখি পাহাড়ের গা বেয়ে জলধারা নেমে আসছে,হাত দিয়ে দেখলাম ভীষণ ঠাণ্ডা জল। জুতো না ভিজিয়ে পার হলাম। এরকম জলধারা পথে অনেক পড়ল। একঘন্টা পর রাস্তা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বোল্ডার বিছানো রাস্তা পেরিয়ে কাঠের পুল পার হলাম,যার নীচ দিয়ে খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে। তারপর অনেকটা খাড়া চড়াই পেরিয়ে সমতলে এলাম।
এক বিদেশি দম্পতির সঙ্গে আলাপ হল, অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন হিমালয়ের টানে। ওনারা হর কি দুন থেকে ফিরছেন। বল্লেন, ইন্ডিয়া এত ভাল লাগে যে বারবার আসতে ইচ্ছা করে, আগে চারবার এসেছেন। শুনে বেশ ভাল লাগল। প্রথমদিন আর অনভ্যাস তাই বেশ কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে ভিডিও ক্যামেরা চালালাম, পাখির কলতান, ঝরনার-নদীর পথ চলা, নাম না জানা ফুলের বাতাসের সঙ্গে সংলাপ, রঙ্গিন প্রজাপতি ক্যামেরাবন্দি করলাম। আখরোট, পাইন, ওক, চীর, দেওদার, ভূর্জগাছ প্রচুর আছে। তাছাড়া বিরল প্রজাতির হার্বস - ভেষজ উদ্ভিদের জন্যই এ অরণ্য সংরক্ষিত। সাদা বুনো গোলাপের ঝাড় তো অনেক - আর তার গন্ধও খুব মিস্টি। এখানে পথে একটাই গ্রাম পড়ে তাছাড়া কোনও চা খাবারও জায়গা নেই। তার জন্য এখনও ৩ কি.মি. যেতে হবে। তাই মুখে লজেন্স, চুইংগাম রাখছিলাম। পথে ছোট বাচ্চারা মিঠাই চাইছিল, মানে টফি। আমাদের সঙ্গে যা ছিল ওদের দিলাম, ওদের হাসিমুখের ফটো তুললাম। এদের দেখে ভীষণ কষ্ট হল, পরনে ধুলিধুসরিত জামা, না পায় সঠিক শিক্ষা, না পায় পেট পুরে খেতে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও কত কিছু থেকে বঞ্চিত। গ্রামের পুরুষরা কাজ করে না, নেশা করে ঘুমিয়ে কাটায় আর মহিলারা সারাদিন পরিশ্রম করে সংসার চালায়।
অবশেষে চায়ের দোকান পাওয়া গেল। নদীর কিনারে কাঠের একটা ঘর, সুন্দরী যুবতী মিঠা চা খাওয়ালো। দূরে গাঙ্গোর গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কিছু লজেন্স আরও কিনে রাস্তায় বাচ্চাদের দিতে দিতে গেলাম। একটা সেতু পেরিয়ে আবার কঠিন চড়াই। স্বর্গারোহিনী মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে। রোদের তেজ ফিকে হয়ে আসছে। নদীর তীরে এক দল কিশোরকে দেখা গেল। এরা চন্ডীগড়ের একটি স্কুল থেকে এসেছে। আজ এরা এখানেই টেণ্টে থাকবে। আমরাও প্রায় এসে গেছি। বিকাল ৫টা নাগাদ সীমা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে এসে পৌঁছলাম। গরম গরম ম্যাগি, কফি খেয়ে সোজা বিছানায়। একঘন্টা পর অনিন্দ্যর ডাকে ঘুম ভাঙল। সারা শরীর ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে আছে, কী জানি কাল কী করে হাঁটব? আমাদের পাশের ঘরেই এক বাঙালি এসেছেন একা, তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। উনি আমাদের মত নভিশ নন, একমাসের ছুটি নিয়ে বেরিয়েছেন। ৫৭ বছর বয়স, হিমালয়ের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। অনেক এক্সপিডিশনেও গিয়েছেন। চা খেতে খেতে ওনার বেড়ানোর অনেক গল্প শুনলাম। সঙ্গে রান্নার সামগ্রী নিয়েই এসেছেন। পোর্টার ছেলেটি রান্নাবান্না সব করছে। আমাদের পাশেই ধাবায় গিয়ে খেতে হল। রুটি, রাজমা, ভাত আর লিংড়ার সব্জি। অল্প পরিমাণে খেয়ে গরম জলে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। এখানে গ্যাস, কয়লা বা কেরোসিন কিছুই নেই। জঙ্গলের কাঠ জ্বেলে রান্না করতে হয়, কিন্তু রান্নার স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি।
৩ জুন সকালে চা পান করে , আলুর পরাঠা, আচার প্যাক করে সীমা ছাড়লাম যখন সাড়ে সাতটা বাজে। আজও ১২ কি.মি. হাঁটতে হবে আর ৮৫০০ফুট উচ্চতা থেকে ১১৫০০ ফুট উচ্চতায় উঠতে হবে। আজকেও আকাশ পরিস্কার, সুন্দর রোদ্দুর উঠেছে। নতুন উদ্দ্যমে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আজ কঠিন চড়াই আছে,কালকের মত জঙ্গলের রাস্তাও নয়। সূর্যের তাপ সরাসরি মুখে লাগবে। ফরেস্ট রেস্ট হাউস ছেড়ে খানিকটা যেতেই সুপিন নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রীজ, এখান থেকে কিছু ছবি তোলা হল। তারপরই আধ কি.মি. সাঙ্ঘাতিক চড়াই,শুধু তাই নয় এখানে আলগা পাথুরে মাটি তাই পা স্লিপ করছে। লাঠির সাহায্যে উঠলাম। বাঁদিকে ওঁসলা গ্রামের রাস্তা গেছে, এপথের শেষ গ্রাম এটি। শোনা যায় মহাভারতের কৌরবদের উত্তরসূরিদের বাস এখানে, দুর্যোধনের মন্দিরও আছে। আমাদের সময় না থাকায় আমরা সোজা পথ ধরলাম।
একটু পরেই গরমে জ্যাকেট খুলে ফেলতে হল। বারবার জল তেষ্টাও পাচ্ছে। অনেক ঝরনা রাস্তায় পড়ছে, সঙ্গের জল শেষ হলেই ওই বোতলে ভরে জিওলিন দিয়ে পান করছি। ঠাণ্ডা আর স্বাদও ভাল। যেতে যেতে এক বিশালাকার ঈগল মুর্হূতের জন্য দেখা দিল। শট নেবার সুযোগ দিল না। তবে সারাক্ষণ একটা পাখির মিস্টি গান শুনতে পাচ্ছি। নাম না জানা এই পাখির তো আমি প্রেমে পড়ে গেছি, ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়েই লুকিয়ে পড়ছে। অনিন্দ্য অনেক কষ্টে ফোকাস করতে পারল। আজ হাঁটতে আরও বেশি ভাল লাগছে। সামনেই স্বর্গারোহিনী, বন্দরপুঞ্ছ হাতছানি দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্কুল পড়ুয়ার দলও হেঁটে চলেছে নিজের নিজের স্যাক নিয়ে । শর্টকাট রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে সাঙ্ঘাতিক চড়াই উঠতে হল। তারপরই একটা অপরূপ সুন্দর ভ্যালিতে পৌঁছলাম। কাঁচের মত স্বচ্ছ নীল আকাশ, বরফ শৃঙ্গ আর সবুজ গমের ক্ষেত যেন আমাদের জন্য স্বর্গ রচনা করেছে। গম গাছগুলো বাতাসের দোলায় হিন্দোলিত হচ্ছে,নরম মিঠে রোদ পড়েছে তার ওপর। ক্ষেতের বুক চিরে সেই পথেই আবার এগিয়ে চললাম। এবার একটু গতি বাড়ালাম। বেশ অনেকটা সমতল দিয়ে হেঁটে গেলাম। এরপর কিছুক্ষণের বিরতি। পরাঠা,আচার,মিষ্টি,চানাচুর খেয়ে আবার পথ চলা। এই রাস্তায় বড় গাছ প্রায় নেই। লাল, বেগুনি, আকাশি নানা রংয়ের ছোট-বড় ফুল সবুজ ঘাসে ফুটে আছে, ঠিক যেন এক ঝাঁক প্রজাপতি। এখানে ফুলের বাগান যেন প্রকৃতি নিজেই সাজিয়ে রেখেছে। ফুলের অনেক ছবি তুললাম,ওদের স্পর্শ করলাম না।
দুপুর ১২টা, সূর্যদেব মধ্যগগনে, বারবার জল তেষ্টা পাচ্ছে আর খানিকটা ক্লান্ত হয়েও পড়েছি তখনি ফুলের উপত্যকা থেকে অনেকটা খাড়া পাহাড়ে চড়তে হল। হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়া শুরু হল। আবার জ্যাকেট চাপালাম। গা ছমছম করছে, চারদিক শুনশান, নিচে গভীর খাদ। এই জায়গাটি কালকাতিয়া ধার নামে পরিচিত। হর কি দুন নালা ও যমদ্বার নালা মিলিত হয়েছে। একটা বড় পাথরে ছোট পাথর সাজিয়ে কারা যেন রেখেছে আর তার ওপর ফুল দিয়ে পুজোও করেছে,আমরাও ফুল দিয়ে প্রণাম করলাম।
এখনও আদ্ধেক রাস্তা বাকি। আর যেতে ইচ্ছা করছে না,এখানেই যদি থাকার জায়গা থাকত ! রোজই ৬/৭ কি.মি.র পর মনের জোরে বাকি পথ যাই। তখন মনে হয় এত কষ্ট করতে কেন বেরোই বাড়ি থেকে? চলার গতি কমে আসছে, ধীরে কিন্তু না থেমে এগিয়ে চলার নীতি অবলম্বন করলাম। জানি একসময় ঠিক পৌঁছে যাব। তাছাড়া হারিয়ে যাব না বা কোন বিপদের আশঙ্কা নেই।। বড় বড় গাছ দেখতে পাচ্ছি আবার। একটা সুন্দর ফলস্-এর কাছে একটু জিরিয়ে নিলাম। আবার চলা। আলুর পরাঠা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, কাজু-কিসমিস খেয়ে খিদে ভুলে আছি। এতক্ষণ রাস্তা হেঁটেছি কিন্তু কোন বিপদের মুখে পড়িনি। এই প্রথম আমরা এক বিপজ্জনক স্থানে এসে উপস্থিত হলাম। দুরন্ত গতিতে ‘হর কি দুন’ নালা নেমে আসছে,তার ওপর তিনটে কাঠের গুঁড়ি রাখা আছে কোন সাপোর্ট ছাড়াই। এটা ক্রস করে ওপারে আমাদের যেতে হবে। পা পিছলে গেলেই সলিল সমাধি। চমনের হাত ধরে দু’জনে পার হলাম মৃত্যুফাঁদ। খরস্রোতা নদীর পাশ দিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর ঘাসের মাঠ পার হলাম। তখনি দূর থেকে টেন্ট দেখতে পেলাম। উফফ্ এ আমি কোথায় এলাম! স্বপ্ন দেখছি না কি! অসাধারণ সুন্দর। মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানালাম অনিন্দ্যকে। সত্যি ভ্যালি অফ গডস্ – ঈশ্বরের আপন দেশ। দূর থেকে দেখা পিকগুলো এখন যেন হাতের নাগালে...
উপত্যকাটা অনেকটা দোলনার মত ঝুলে আছে যেন। কথিত আছে স্বর্গের পথ গেছে এখান থেকেই, মহাভারতের পঞ্চ পান্ডব এ পথেই স্বর্গ যাত্রা করেন। গাড়োয়ালের উত্তর পশ্চিমে ফতেহ পর্বতের ৩৫৬ মিটার উঁচু এ উপত্যকা। মারিন্দা তাল থেকে সৃষ্ট হর কি দুন নালা থেকে জন্ম যমুনার শাখা নদী টন্স। তাই এর আরেক নাম টন্স ভ্যালি। থাকার জন্য ফরেস্ট রেস্ট হাউস আর জি এম ভি এন-এর বাংলো আছে। ফরেস্ট রেস্ট হাউসেই আমাদের জায়গা হল। কিন্তু খাবার ব্যবস্থা নেই,তাই আমাদের থাকার ব্যবস্থাই হল কেবল,খাবারের নয়। এদিকে আমাদের সঙ্গে কটা বিস্কুট আর এক প্যাকেট ম্যাগি শুধু আছে। ক্ষিদেতে পেট তখন জ্বলছে। চা পানের নিমন্ত্রণ করেছিলেন চন্ডিগড়ের স্কুলের মাস্টারমশাই। বিকালের চা ও রাতের ডিনার ওনাদের সঙ্গেই করলাম। সেদিন ওনার এই উপকার ও আন্তরিকতা এক পরম প্রাপ্তি। ফরেস্ট বাংলো থেকে ভ্যালিটাকে চমৎকার লাগছিল। দরজা খুলেই স্বর্গারোহিনী পিক্, যমদ্বার গ্লেসিয়ার, যার থেকে যমদ্বার নালার উৎপত্তি। এখান থেকে ৪/৫ কিমি ট্রেক করে যেতে হয় গ্লেসিয়ারে। তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জন্য আরও দূরে চলে গেছে তাই ৯ কিমি গেলে তবেই গ্লেসিয়ার দেখতে পাওয়া যাবে। আমরা তাই যমদ্বার যাবার প্ল্যান বাতিল করলাম। এই ভ্যালির সৌন্দর্য পাগল করে দিচ্ছে। এখানেই দুদিন কাটাব। চন্দ্রালোকে গোটা ভ্যালি প্লাবিত। নির্মেঘ আকাশ,বরফের মুকুট পরা পাহাড়,নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন - যা এতদিন স্বপ্নে দেখতাম তাই আজ সত্যি দেখছি। এত ভাল আবহাওয়া এর আগে কোনদিন পাইনি। তাঁবুর পাশে ক্যাম্পফায়ারের আনন্দে ছোটদের সঙ্গে আমরাও মেতে উঠলাম। কোনও ক্লান্তি নেই আর,সারারাত জেগে প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ দেখেও আশ মিটবে না। জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ছে। ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। ফিরে দেখি চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে।
৪ঠা জুন। আজ আমরা যাব মারিন্দা তাল। ৩কিমি হেঁটে যেতে হবে। সকালেও টেন্টে ব্রেকফাস্ট করার নিমন্ত্রণ ছিল কিন্তু আমরা আর যাইনি, ম্যাগি খেয়ে বাকিটা প্যাক করে সঙ্গে নিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরলাম। প্রায় পুরোটাই চড়াই। যত এগোচ্ছি হাঁটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পাথর, বোল্ডারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। হাল্কা বেগুনি রঙের রডোডেনড্রন দেখতে পেলাম। শেষ আধ কি.মি. রাস্তায় কোন সবুজের চিহ্ন নেই, ভীষণই রুক্ষ্ম। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। পৌঁছবার পর সব কষ্ট গায়েব। তালের স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কাটল। মারিন্দা তাল থেকে হর কি দুন নালার জন্ম। মারিন্দা ছাড়িয়ে পর্বতপ্রেমীরা বারাসু পাস ক্রস করে হিমাচলে প্রবেশ করে। 'সীমা'-য় একদল বাঙালি যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল,দেখি তারাও যাচ্ছে এপথে।
আজ আমাদের ফেরার কোন তাড়া নেই। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ৩ ঘন্টা কেটে গেল। শুভ্র পাহাড়চুড়া, মেঘেদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে যেন হারিয়ে গেলাম। সেভাবে বরফ পেলাম না, অন্যান্য বছর এই সময় প্রচুর বরফ থাকে। দূরে দূরে বরফের সাদা দাগ যেন দেখা যাচ্ছে, আমরা এগিয়ে গেলাম। তারপর বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা হল, একটু বরফ ছুঁড়ে খেলাও হল। দুপুরে ফিরে লাঞ্চ করে বিশ্রাম।
৫ তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি দূরের পাহাড়গুলো বেশ সাদা দেখাচ্ছে আর নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা বেড়ে গেছে যেন। হর কি দুন থেকে আজ আমরা বিদায় নেব। ছবির মত সুন্দর ভ্যালি ছেড়ে একই রাস্তা ধরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরার পথ ধরতে হবে, দুদিনের স্মৃতি ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি আর মনের অনুভূতি ডায়েরির পাতায় রাখা। সীমায় ফিরে ঘণ্টা দুয়েক বর্ষণের পর জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়ল রাতে।
৬ ই জুন সকালে উঠে দেখলাম আকাশ পরিস্কার,তবে মেঘ আছে,পরে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের আজকেই সাঁকরি পৌঁছতে হবে। পুরলা এলাম দেড়টা নাগাদ,ওখানে লাঞ্চ করে আবার হাঁটা, কারণ জীপ কিছুক্ষন আগে চলে গেছে। ৭ কিমি হাঁটার পর বাকি রাস্তা জীপে গেলাম। রাতটা সাঁকরিতে কাটিয়ে সকালের বাসেই সমতলে ফিরে যাওয়া।
আবার অপেক্ষা হিমালয়ের ডাকের।

হর-কি-দুনের তথ্য || ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি

Jhuma Mukherjee

নিজের সংসারকে সুন্দর করে রাখার ছাড়াও ঝুমা ভালোবাসেন অনেককিছুই। তাঁর ভালোলাগা-ভালোবাসার তালিকায় বই পড়া, গান শোনা, নতুন নতুন রান্না করার পাশাপাশি রয়েছে ইন্টারনেট সার্ফ করে পাহাড়ের ছবি দেখা আর নানা ট্রেককাহিনি পড়া। তাঁর কাছে সবার চেয়ে প্রিয় এই ট্রেকিং-ই। পাহাড়ের ডাকে বছরে অন্তত দুবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনই। আর এই বেড়ানোয় তাঁর সঙ্গী প্রিয়জনদের তালিকায় রয়েছে ডায়েরি আর কলমও।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher