ঐতিহ্যের শহর ইস্তানবুলে
কাকলি সেনগুপ্ত
~ ইস্তানবুলের তথ্য ~ ইস্তানবুলের আরো ছবি ~
গত ৩১ মে দুপুর দু'টোর সময় আমরা ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে নামলাম। তার আগের রাত থেকেই তাক্সিম স্কোয়ারে পুলিশের অতি সক্রিয়তা শুরু হয়ে গেছে। ঘুমন্ত বিক্ষোভকারীদের তাঁবু থেকে বের করে এনে জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, পেপার স্প্রে নিয়ে পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। কিন্তু সেদিন বিকেলে আমরা ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক অঞ্চল "সুলতান আহমেদ স্কোয়ার"-এ পৌঁছে দেখলাম সেখানে বিক্ষোভের ছোঁয়ামাত্র লাগেনি। স্থানীয় আর বিদেশি মানুষের ভিড়ে পুরো জায়গাটা জমজমাট হয়ে আছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্তের নমাজ শুরু হয়ে গেল। সুলতান আহমেদ মসজিদ বা নীল মসজিদ থেকে প্রথম সুর উঠছে। আশপাশের সমস্ত মসজিদের মিনারেট তার রেশ ধরে প্রার্থনা করছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ধ্বনি-প্রতিধ্বনির খেলা। কিন্তু একটু খটকা লাগলো। আমাদের দেশে যে সুরে-ভাষায় আজান দিতে শুনেছি, এ প্রার্থনার সুরটা তেমন তো নয়! পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুর্কীস্থান হল পৃথিবীর একমাত্র মুসলিম প্রধান দেশ যেখানে আরবির বদলে স্থানীয় ভাষা তুর্কীতে আজান দেওয়া হয়।
আজানের সুর ধরে আমরা হিপোড্রোমে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে একদল স্কুলপড়ুয়ার ভিড় – খুব হুল্লোড় করছে তারা। আমার ছেলে পাবলোকে দেখে তারা উৎসাহ করে এগিয়ে এলো – ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, "তোমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছো? নিউ দিল্লি?" পাবলোর বয়সীই হবে ওরা। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ভারতে দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েরা ক'জন তুর্কীস্থান সম্বন্ধে জানে! আমরা এলাহাবাদে থাকি; তাই বললাম, " নিউ দিল্লি নয়, তবে তার কাছাকাছি।" আবার প্রশ্ন এলো, "তবে কি তোমরা আগ্রায় থাকো?" এবার আমরা বাক্যহারা!
এবছর জুনের শুরুতে আমরা চারদিন কাটিয়ে এলাম তুর্কীস্থান বা তুর্কী-র অন্যতম প্রধান শহর ইস্তানবুলে। এই শহরের মজাটা হল এর কিছু অংশ ইউরোপে, বাকিটা এশিয়ায়। এখানকার মানুষজনের মধ্যেও তার প্রভাব রয়েছে। এশিয়ার মানুষদের ব্যবহারের উষ্ণতা ও সহজাত মেলামেশা করার স্বভাব ওদের রয়েছে। যেখানেই গেছি শুনেছি, " ফ্রম ইণ্ডিয়া? ওয়েলকাম"। আবার ইউরোপীয়দের সহজাত নিয়ম মানার অভ্যাসটাও ওদের মধ্যে রয়েছে। ট্রামে-বাসে দেখেছি সাধারণ লোকজন নিয়ম মেনে চলে, ধাক্কাধাক্কি নেই, এবং বিদেশিদের সাহায্য করার চেষ্টা করে। ইস্তানবুল খুব আধুনিক মনোভাবের শহর। লোকজন ইংরেজি বোঝে ও বলতে পারে। ইউরোপের যে কোনো শহরের মতোই এখানে প্রচুর কাফে-বার, আর সেগুলো সবসময়ই জমজমাট হয়ে আছে।
জুনের শুরুতে ইস্তানবুলে তখন চমৎকার আবহাওয়া। ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝেমাঝেই মারমারা সমুদ্র থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে আসছে। আর বছরের এই সময় দিন বেশ লম্বা বলে অনেকটা বেশি সময় পাওয়া যায় বেড়ানোর জন্য। পয়লা জুন প্রথমেই আমরা নীল মসজিদে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি অবাক করা ব্যাপার – পুরুষরা মসজিদে ঢোকার জন্য স্কাল ক্যাপ বা কিস্তি টুপি পড়েনা। আর মহিলাদেরও মসজিদে প্রবেশ নিয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তুর্কী বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে এটা সম্ভব হয়েছে। আমিতো উৎসাহে টগবগ করছি। আমার নিজের দেশের মসজিদে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। নিজেদের জুতো থলিতে ভরে (কী কাণ্ড!) আমরা নীল মসজিদে ঢুকলাম। ভিতরের সজ্জা নীল ইজনিক টালি দিয়ে তৈরি বলেই এর নাম নীল মসজিদ। চমৎকার! সুন্দর। কিন্তু ভারতে সুলতান ও মুঘল সম্রাটদের সময় যে সমস্ত মসজিদ-প্রাসাদ বা অন্যান্য স্থাপত্য তৈরি হয়েছে, তার তুলনায় কিছুই নয়। ভারত থেকে নাদির শাহ-র লুঠ করে নিয়ে যাওয়া একটি সিংহাসন ( ময়ূর সিংহাসন কী!?) তোপকাপি প্রাসাদে রাখা আছে। সূক্ষ্ম কারুকার্য আর সৌন্দর্যে ওটোমান সুলতানদের কোনো সম্পদ তার তুলনায় আসেনা। দিল্লি-আগ্রা-রাজস্থানের প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিদেশিদের ঘুরতে দেখে আমার বারবার মনে হত এরা কেন ভারতে আসেন? কিসের আকর্ষণে? নীল মসজিদ বা ওটোমান সুলতানদের প্রাসাদ দেখে বুঝলাম তুর্কীর ইসলামিক স্থাপত্য দেখে যদি কেউ মুগ্ধ হয়, তাকে ভারতে আসতেই হবে প্রাচ্য শিল্পের সর্ব্বোত্তম প্রকাশরূপটি উপলব্ধি করতে।
আমার অবশ্য সুলতান আমলের স্থাপত্যের থেকে বাইজেনটাইন আমলের (৩৩০-১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) স্থাপত্যশিল্প অনেক বেশি ভালো লেগেছে। শুধুমাত্র কলোসিয়াম দেখার জন্য যেমন রোমে যাওয়া যায়, তেমনি শুধুমাত্র আয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) দেখার জন্য একবার অন্তত ইস্তানবুল যাওয়া উচিত। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে আনন্দে আবেগে গলার কাছে অদ্ভুত কান্না দলা পাকায়। আয়া সফিয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার একই অনুভূতি হয়েছে। মানুষের সৃষ্টি ওই শিখরে উঠতে পারে! ৫৩৭-১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ এটি ছিল অর্থোডক্স চার্চের বেসিলিকা। এখানে বাইজেনটাইন স্টাইলের মোজেইক কাজ অপূর্ব সুন্দর। ওই বিশাল মাপের সৃষ্টিতে যিশু ও অন্যান্যদের মুখে কী অসাধারণ মানবিক অভিব্যক্তি! ১২০৪-১২৬১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্যাথলিক চার্চের অনুগামীরা এই বেসিলিকার ওপর হামলা চালিয়েছে। ১৪৫৩ তে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ রাতারাতি এই বেসিলিকাকে মসজিদে বদলে দেন। অসাধারণ সব মোজেইক-ফ্রেসকোগুলো ঢেকে দেওয়া হয়। এত কিছুর পরেও আয়া সোফিয়া অপূর্ব স্থাপত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
'দ্য ভিঞ্চি কোড'-এর লেখক ড্যান ব্রাউনের নতুন বই 'ইনফেরনো' যাঁরা পড়ে ফেলেছেন তাদের আয়া সোফিয়া থেকে একবার সিস্টার্ন-এ যেতেই হবে। সেখানেই যে এই উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স! মাটির তলায় সিস্টার্ন বা জলাধার। এতে নতুনত্ব কী? তাহলে সেখানেই নেমে পড়া যাক। কী আশ্চর্য! রয়েছে আস্ত একটা বেসিলিকা। ৩৩৬ টি অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য করা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই বেসিলিকা। ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে বাইজেনটাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান এই বেসিলিকাকে জলাধার বা সিস্টার্ন বানিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। প্রাসাদের জল সরবরাহ হত এখান থেকেই। আশা করছি, হলিউড খুব শীঘ্রই এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলবে। আর সেই সুযোগে আমাদের আবার "আয়া সোফিয়া" ও "বেসিলিকা সিস্টার্ন" দেখা হয়ে যাবে।
ওটোমান আমলে চোরা চার্চটিকেও মসজিদে বদলে ফেলা হয়েছিল। তবে খুব ছোট চার্চতো; বিশেষ নজরে পড়তনা। তাই হয়ত ভাঙচুরটাও একটু কম হয়েছে। এখানে মোজেইকের কাজ খুব সুন্দর। ফ্রেস্কোগুলোও যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে।
এবার ইস্তানবুলের অন্য আকর্ষণের কথা বলি – এখানকার খাওয়া-দাওয়া অতি চমৎকার। তুর্কিশ দোনের কাবাব তো আজ পৃথিবী বিখ্যাত। আর এক মিষ্টি আছে, বাকলাভা – দেবভোগ্য মিষ্টান্ন। আমার ছেলে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাকে চাঙ্গা করতে খুব কাজে লেগেছে। অন্যান্য খাবার আমাদের মতন – তবে মশলা কম। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো মশলার ব্যবহার বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও হয়না! এই খাবারের প্রসঙ্গেই আরেক অভিজ্ঞতা হল। একটি রেস্টুরেন্টে আমরা নিয়মিত লাঞ্চ করতাম। তৃতীয় দিনেও আমরা যখন গরুর মাংসের কাবাব অর্ডার করলাম, অবাক হয়ে আমাদের প্রশ্ন করলো, "আর ইউ ফ্রম পাকিস্তান?"
স্কুলে থাকার সময় ইতিহাসে পড়তাম "হাজার বছরের বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য" আর তার রাজধানী "কনস্ট্যানটিনোপল"। কোথায় যে সেই জায়গাগুলো ভালো করে জানা হত না। পাড়ার ফাংশানে আবেগঘন নজরুলের কবিতার আবৃত্তি শুনেছি "কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই"। কিন্তু এই কামাল ভাই কে, তিনি কী কামাল করেছে – সেই খবর ক'জন বাঙালি নিয়েছেন! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা মনে হয় খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না - এই কামাল হলেন কামাল আতাতুর্ক, আধুনিক তুর্কীর প্রথম রাষ্ট্রপতি। আজকের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশটা তৈরির পেছনে এই মানুষটির বিরাট ভূমিকা ছিল। আর সেদিনের কনস্ট্যানটিনোপল-ই আজকের আধুনিক ইস্তানবুল। আমরা ওদের সম্পর্কে তেমন না জানলেও, ওরা কিন্তু আমাদের কথা অনেক বেশি করে জানে। দোকানে "কোলাভেরি ডি" বাজতে শুনেছি; পার্কে বসে শুনেছি দুই যুবক "তারে জমিন পর" নিয়ে আলোচনা করছে। হয়তো ঐতিহ্য, হয়তো বাণিজ্যের কারণেই ভারত ওদের কাছে আজও এত প্রাসঙ্গিক, এত প্রিয়। দোকানে দেখেছি ভারতীয় শাল, মশলার পাশেই রয়েছে ভারতীয় কাজল। একই ঐতিহ্যের অধিকারী এই দুই দেশ। বারবার মনে হয়েছে ওরা কত যত্ন করে তাকে রক্ষা করছে, আমরা আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণে আরেকটু কি যত্ন নিতে পারি না? আমাদের সন্তানরা হয়তো সেই সময়টা দেখতে পাবে, যখন ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের যত্ন নেওয়া হবে, সাধারণ মানুষ তার মূল্য বুঝতে পারবে। এত সুন্দর ঐতিহ্যবাহী একটা শহর, একটা দেশে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের মত সুপ্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে এইটুকু ভাবতে বা আশা করতে সত্যিই বড় ইচ্ছা করে।
~ ইস্তানবুলের তথ্য ~ ইস্তানবুলের আরো ছবি ~
মফস্বল শহর বালীতে বড় হয়ে ওঠা কাকলি সেনগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েছেন ১৯৯৭ সালে। তারপর নানা জায়গা ঘুরে ২০০৪ সাল থেকে থিতু হয়েছেন গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্হলে - এলাহাবাদে। গল্প করে ও গল্প বলে লোকজনকে বিরক্ত করার জন্য খ্যাতি আছে। বেড়ানোর সাথে সাথে দেশ-বিদেশের খাদ্য ও পানীয়র ব্যাপারে সমান আগ্রহী।