বনে বনে পথ চলা

মহম্মদ মহিউদ্দিন

~ তথ্য - কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ~

একটু দূরে গাছের ডালে বসে থাকা মাছরাঙ্গা পাখি দেখছি আর মন ভরে ছবি তুলছি। একটু শব্দ হলেই বোধহয় উড়ে যাবে। তাই সবাই নিঃশব্দেই দেখছিলাম, হঠাৎ এক রকম জোরালো আমন্ত্রণেই আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে আনল একদল মুখপোড়া হনুমান। নীরবতা যেন তাদের একটুও পছন্দ না। ঠিক মাথার উপর বসে থাকলেও আমরা ওদের দেখছি না, তাই হয়তো এমন ডাকাডাকি। এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে, ঝুলে দুটি হনুমান তো রীতিমত কসরত দেখাতে দেখাতে গাছ থেকে পড়েই যাচ্ছিল। তাদের দলের একটি মা তার বাচ্চাকে নিয়ে চুপচাপ বসে এই খেলা দেখছিল আর বনের মাঝে বেমানান আমাদের। স্তব্ধ বনের মধ্যে হঠাৎ এমন হনুমানদের ডাকাডাকিতে পরিবেশ বেশ কিছুক্ষণ গরম ছিল। মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম পালানোর জন্য, যদি আমাদের আক্রমণ করে!
না, আসলে এরা আমাদের প্রতিপক্ষের চোখে দেখছে না। খেলার ছলেই আমাদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাল। আর আমরাও অবাক নয়নে শুধু দেখেই গেলাম রোমাঞ্চকর এই মুহুর্ত।
হ্যাঁ, অভয়েই আছে আমাদের টিঁকে থাকা কিছু প্রাণী সম্পদ হবিগঞ্জের কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্টে। খানিকটা সময় এদের সাথে কাটাতে গত ১৩ এপ্রিল চলে আসি এখানে। ১ বৈশাখ ছুটির দিন সব বন্ধুরা চলে গেছে কোথাও না কোথাও। তাই ঘরে মন টিঁকছিল না একদম। আর ঠিক তখনই মুঠোফোনে জানাল আমার এক বন্ধু ডায়না, ওর ভাই কালেঙ্গা ফরেষ্টের বাংলোটিতে ব্যবস্থা করতে পারবে থাকার জন্যে। তাই ঘর থেকে বেরোবে এমন মানুষদের খোঁজ করলাম। প্ল্যান করলাম সেদিনই রওনা হব নয়তো পরদিন। তাই হুট করে সিদ্ধান্ত নিতে সবারই একটু সময় লাগছিল। সময়টা এমনই দীর্ঘ ছিল যে কারোরই পাকাপোক্ত ঘোষণা পেলাম না। তারপরও সকাল ৮টায় সায়দাবাদে রিপোর্টিং সময় জানিয়ে ঘুমুতে গেলাম। যে আসবে তাকে নিয়েই রওনা হব, নয়তো...।
ঘড়িতে সময় সকাল ৭:২০মিনিট। সায়দাবাদ বাসস্ট্যাণ্ডে যাবার মাঝ পথে আমি। মুঠোফোনে বেগ ভাইয়ের ঘোষনা নিশাত আপু যাচ্ছে। সাথে তিনিও। ডায়না তো প্রথম থেকেই ছিল। আমাদের সঙ্গে না গেলেও রাতে রওনা হবে বিপ্লব ভাই। ব্যাস আর কি লাগে!!
ঠিক ৮ টায় পৌঁছালো সবাই বাসস্ট্যান্ডে। আগে থেকেই দেখে রাখা লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। প্রি-প্ল্যান ছিলনা বলে লোকাল বাসই আমাদের ঠিকানা হল। বাসে উঠেই শুরু হয়ে গেল ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণা। ৮.৩০ -এ বাস ছেড়ে যাত্রাবাড়ি পার হতেই সময় হয়ে গেল ৯.৩০। মনে একটাই সান্ত্বনা ছিল যে, আমাদের পৌঁছাবার কোন তাড়া নেই। তাই গল্পে গল্পে চলছিলাম পথ। পথিমধ্যে এক ছাগল ব্যাপারী তার ছাগল গুলোকে বাসে তুলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন এটা লোকাল বাস। রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। যেখানেই থামছে গাড়ি ৫-১০ মিনিট করে সময় নিচ্ছে। তার উপর কন্ডাকটারের সাথে যাত্রীর ঝগড়া। বেশ উপভোগ করছিলাম সাধারণ মানুষের ভিড়ে পথের এই অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ ৬ ঘন্টার সফর শেষে শায়েস্তাগঞ্জে নামিয়ে দিল বাসটি। দুপুর হয়ে যাওয়াতে রাস্তার এক ভাতের দোকান থেকে নলা মাছ দিয়ে দুপুরের ভুরিভোজ করে নিলাম। খেতে খেতে বেগ ভাই এলাকার সম্পর্কে কিছু কথা শুনালেন আমাদের।
শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গা ফরেস্ট অফিস অব্দি খুব বেশি ভাড়া চাইছিল অটোরিক্সাগুলো, তাই লোকাল নিয়মে জনপ্রতি ১৫ টাকায় চুনারুঘাট আসলাম। সেখান থেকে কিছু ড্রাইফুড ও একটি তরমুজ কিনে আবারও অটো রিক্সায় চেপে বসলাম। শহর থেকে অনেক দূরে আমরা। চারিদিকে শুধুই সবুজের রাজত্ব। গ্রামের সরু পথ ধরে চলছি। ৩০ মিনিটের এই পথের অনেক অংশই এখনো গাড়ি চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয় নি। মেঠোপথ ভালই লাগছিল। দিনের শেষ ভাগে আমরা হাজির হলাম কালেঙ্গা ফরেস্ট অফিসে। টিলার উপর অফিস হওয়াতে এখানকার মানুষ অফিস টিলা নামেই জানে এই ফরেস্ট অফিসকে।
ফরেস্ট অফিসার আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা তাঁর ছোট ছেলেও আমাদের পেয়ে বেজায় খুশি। খানিকক্ষণ গল্প চলল অফিসের সামনে বসে। আমাদেরকে বাংলো পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন বিট অফিসার। সবাই আমাদের ও বিশেষ করে নিশাত আপুকে পেয়ে খুবই আনন্দিত মনে হলো। যাই হোক সূর্য এখনো পশ্চিম আকাশে আলো ছড়াচ্ছে। সময় কিছু হাতে আছে, কোন রকম ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়বো বিকালটাকে কাজে লাগাতে। কাল যখন বাকি তিনজন যোগ হবে তখনই যাব ঘন জঙ্গলের ভেতর, তাই আজ সিদ্ধান্ত হল আলো থাকতেই অন্য দিকটা যতটুকু দেখা যায় দেখে নেব। ও হ্যাঁ বিপ্লবভাইয়ের সাথে শাহীন ও তার বন্ধু মেহেদী আমাদের সাথে যোগ হবে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানালেন বেগ ভাই।
একটি টিলার উপর বাংলোটি - তিন রুম ও বারান্দার সমন্বয়ে খুবই সুন্দর ও পরিপাটি। তার উপর সামনে একটি বড় আয়তনের ঘাসের গালিচা বেছানো মাঠ। বনের শত শত গাছে সেজে আছে চারপাশ। এখানে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় দিনের পর দিন। বাংলো থেকে বনের দিকে যাওয়ার শুরুতেই হাতে ডানে দেখতে পেলাম বিজিবি-এর ক্যাম্প। আরও একটু এগোতেই পেলাম ছন বাড়ির পাড়া। বন কর্মকর্তাদের কাছে জানতে পারলাম এইখানে যারা বসবাস করে তাদের বেশির ভাগই বাঙালি। মারমা পাড়াও আছে কিছু। তবে তারা থাকে একটু ভেতরের দিকে।
লোকালয় ছেড়ে হাঁটছি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারিদিক। বন থেকে কিছু চাষাবাদের জন্য জমি ছিনতাই করে নিয়েছে এখানকার জনগোষ্ঠী। তাই প্রথম প্রথম বন আমাদের রাস্তা থেকে একটু দূরে দূরে ছিল। দূরে দেখা যাচ্ছিল বড় বড় গাছ যেন পাহাড়া দিচ্ছে বনকে। গাছের ডালে ডালে খেলছে শালিক, ফিঙ্গে, বউ কথা কও, কোকিল, ময়না, টিয়া, হলদে পাখি, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, ঘুঘু, সাদা বকসহ নাম না জানা শত শত পাখি। চলতে চলতে গাঁয়ের পথ রূপ নিল বনের পথে। পথটি চলল টিলা বেয়ে,ধীরে ধীরে ঘন হয়ে উঠলো বন। বিকেলের প্রায় শেষ প্রান্তে আমরা। এখানে একটা দৃশ্য মনটাকে বড় খারাপ করে দিল - বড় বড় গাছ চুরির একি অভিনব পদ্ধতি! বড় গাছগুলির গোড়া কেটে অথবা পুড়ে এমনভাবে গর্ত করে রাখা যেন একটু জোর বাতাসে আপনাতেই গাছগুলি ভেঙে পড়ে। আর ঝরে পড়া গাছ কাটতে তো কোন অপরাধ নয়। বোঝো! হঠাৎ একটি অপরিচিত ডাক আমাদের কানে ভেসে এল। শব্দটির সাথে পরিচয় করালেন বেগ ভাই, এটা তক্ষকের ডাক। গুই সাপের মত দেখতে অনেকটা টিকটিকির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও বলা যায় একে। কখনো শিকারে বেরোয় না। ঠায় বসে থাকে,মুখের সামনে পোকা মাকড় এলে তবেই বেশ আয়েশ করে গলাধ্বঃকরণ করে। দেড় ফিটের মত হবে এই তক্ষক। বনের ভেতর থেকে একে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা পেলাম অরেঞ্জ বেলি কাঠবিড়ালির। পুরো শরীরটা কালো। খুবই ব্যস্ত হয়ে ঘরে ফিরছিল। বিরামহীন এ গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে ঠিক একইভাবে যেতে দেখলাম আরেকটি কাঠবিড়ালিকে। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নামিয়ে দিল বলে। আমাদেরও ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।
কাল পহেলা বৈশাখ। পাশেই দেব বাড়িতে উপজাতির বাসভূমি। সন্ধ্যাকে উপেক্ষা করে সেই পথ ধরলাম। কোন উৎসব যদি পেয়ে যাই এই আশায়। সাথে দুটি টর্চও ছিল তাই অন্ধকারের ভয় ছিল না। সন্ধ্যায় যেন এক ভূতুড়ে রূপ নিল বন। ঘন জঙ্গল পেরিয়ে দেব বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম। তখনও সন্ধ্যার আলো নিভে যায় নি। দূর থেকে পাড়াতে কোন রকম উৎসবের আভাস পাওয়া গেল না, তাই অসময়ে তাদের বিরক্ত না করে ফেরার পথ ধরলাম।
সবাই একটু ক্লান্ত। সারাদিনের জার্নি সেইসাথে ট্রেকিং সব মিলিয়ে আরামের ঘুম দিতে চাই একটু গোসলের। টিলার উপর বাংলো তাই এখানে পানির ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র টয়লেটে ব্যবহারের পানি একজন এসে দিয়ে যায়। আমাদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রহিম ভাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। অত রাতে তার বাসায় নিয়ে গেল গোসলের ব্যবস্থা করতে। আমি ও বেগ ভাই নামলাম পুকুরে আর নিশু আপু, ডায়না বাড়ির টিউবওয়েলে। বন্য এলাকার পাশে পুকুর, একটু ভয় ভয় করছিল। সাঁতার না জানার কারণে বেগ ভাইকে দিয়ে আমার সীমানা ঠিক করে নিলাম। খোলা আকাশের হাজার তারার মেলায় পুকুরে গোসল করার মজাই আলাদা। রাতে রহিম ভাইয়ের বাসায় আলু ভর্তা, ডিম ভাজি ও ডাল দিয়ে ভাত গোগ্রাসে খেলাম সবাই। পরে বাংলোর উঠানে চাদর বিছিয়ে কিছু সময় তারার স্নিগ্ধতা উপভোগ করে ঘুমাতে গেলাম।
বউ কথা কও পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো সকালে। ওদিকে সূর্য উদয়ের আগেই হাজির হলেন বিপ্লব ভাই, শাহীন ও তার বন্ধু মেহেদী। দলটি পেল পরিপূর্ণ রূপ।
তাড়াতাড়ি সবাই প্রস্তুত হলেও নাস্তা আমাদের একটু দেরি করিয়ে দিল। আজ পহেলা বৈশাখ। কাল রাতে কিছু ভাত পান্তা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল। তাই বাঙালী ঐতিহ্য পান্তা ইলিম না পেয়ে শুকনো মরিচ পোড়া ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেয়ে নিই। সাথে খিচুড়ি ও ডিম ভাজা খেয়ে পেট ভরপুর।
আজ আমাদের পথ দেখাবে একজন গাইড। কি কি পশু পাখি আছে এই বনে এবং কোথায় দেখা যায় সে তা ভাল করেই জানে। পথের শুরুতেই চশমা পরা বানর আমাদের স্বাগত জানালো ও বুঝিয়ে দিল আজ অনেকে কিছু দেখার সুযোগ আছে। তার জন্য চোখ কান সজাগ রেখে যতটুকু সম্ভব নিঃশব্দে পথ চলতে হবে। চৈত্রের তাপে গাছের শুকনো পাতা পায়ের নিচে মচ মচ করে শব্দ করছে। ধীরে ধীরে বনের মধ্যে ঢুকে গেলাম। নানা পাখির ডাক শুনছি। যেগুলো চোখে পড়ছে তাদের নাম ও স্বভাব জানিয়ে দিচ্ছে গাইড। এই কালেঙ্গা বনে তিনটি ট্রেইল আছে - আধা ঘন্টা, তিন ঘন্টা ও চার ঘন্টার ট্রেইল। তবে গাইডকে আমরা সেই ট্রেইল থেকে সরিয়ে বনের আরও গভীরে যেতে রীতিমত বাধ্য করলাম।

অনেক পুরাতন গাছ রয়েছে এ বনে। গাছের গোড়া এতই মোটা যে ৫-৬ জন লাগবে হাতে হাত মিলিয়ে জড়িয়ে ধরতে। সেই গাছগুলোতে জড়িয়ে আছে বেশ মোটা মোটা লতা। বনের রাজা টারজান-এর চলাচলের জন্য উপযুক্ত এ বন। আমাদের বিপ্লব ভাইও মাঝে মাঝে টারজানের মত লতা ধরে ঝুলে থাকার চেষ্টা করছিলেন। আমাদের গাইড ইশারায় দেখাতে লাগলেন বিভিন্ন রকমের ও রঙের পাখি। তেমন একটি মাছরাঙা  দেখছি। হঠাৎ করেই এক দল মুখপোড়া হনুমান হট্টগোল শুরু করে দিল। ভয় দেখাচ্ছিল না খেলা বুঝে উঠতে পারলাম না। বেগ ভাইতো বলেই ফেললেন, আমরা এসব সত্যি দেখছি না থ্রি ডি কোন মুভি চলছে। সত্যি, প্রকৃত বন এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে আমাদের। যত ভেতরে ঢুকছি আশা করছি ঘন বন সামনে আরও দেখতে পাব কিন্তু তেমনটা পেতে একটু বেশি ভেতরে যেতে হল। এখানকার স্থানীয় মানুষ হয়তো তাদের চলাচলের সুবিধার্থে বনে বিশাল অংশ পুড়িয়ে ফেলেছে। সে আগুনে অনেক ছোট, মাঝারি গাছ পুড়ে গেছে। কত যে দেশীয় গাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে এভাবে। খুব খারাপ লাগছিল বিবর্ণ এ চিত্র দেখতে। বন কর্মকর্তার সাথে কথা হল এ বিষয়ে। তিনি জানালেন এখানকার আদিবাসীরা এ কাজ করে থাকে তবে বর্তমানে অনেক নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন তাঁরা। দোয়া করি এরা যেন আরও আন্তরিক হয় এ ব্যাপারে। গাইড ভাইয়ের একটি মূল দায়িত্ব ছিল আমাদের উল্লুক দেখাবেন। যদিও তিনি বলেছিলেন সকাল ৮.৩০-র দিকে উল্লুক ডাকাডাকি করে আর তখনই তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। বনে ঝোপঝাড় পেরিয়ে উল্লুকের এলাকায় আসতে আমাদের ১০টা বেজে গেল। সেই সুযোগ হাত ছাড়া। অনেক খোঁজাখুজি করেও তারা আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে গেল। এই বনে মোট ৫টি উল্লুক আছে। পিপাসার্ত চোখে উঁচু উঁচু গাছগুলো স্ক্যান করার মত এগিয়ে চললাম।
প্রকৃতির কাছে আমন্ত্রিত আমরা, এই প্রকৃতি তার মেহমানদের আপ্যায়ন না করে থাকে কিভাবে? মাঝ পথে আম গাছ পেলাম। গাছের নিচে অনেক আম পড়ে আছে। বেগ ভাই লবন ও মরিচ সাথে এনেছিলেন সুতরাং আম কুচি ভর্তা হয়ে গেল মূহুর্তেই। খাওয়া হলো এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। সব ব্যবস্থাই রেখেছে প্রকৃতি। গাছের লতাগুলো এমনভাবে সাজানো ছিল ডায়না দোল খাওয়া শুরু করলো আর বেগ ভাইতো রীতিমত ঝুলানো বিছানা পেয়ে শুয়ে আরাম করে নিলেন।
জানাই ছিল ভারতের সীমানা বেশি দূরে নয় তাই সেই দিকেই পথ ধরলাম। মানুষের চলাচলের বেশ ভাল পথ আছে সীমানা এলাকায়। চলতে চলতে গাইড হঠাৎ থেমে গেলেন একটা ভ্যালির মাঝামাঝি এসে। সবাইকে সতর্ক করে দিলেন তিনি। ভারতের কাঁটা তারের বাঁধ-এর খুব কাছে চলে এসেছি। বিদ্যুতের লম্বা থাম দেখা যাচ্ছে কাছেই।  নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমরা। পিছিয়ে আসতেই চোখে পড়ল সীমান্ত চিহ্নিতকারী পিলারটি। এখানে বেশ কিছু ছবি তুলে ফিরতি পথ ধরলাম। দুপুর বোঝাতে সূর্য মাথার উপর দিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করেছে। সকালের খিচুড়ি- পান্তা অনেক আগেই তাদের শক্তি যোগানোর কাজ থেকে রিটায়ার করেছে। তাই পানি শূণ্য ছড়ার পথে বসে কাঁধে করে বয়ে আনা তরমুজ আর পাঁউরুটি খেয়ে আবারও যাত্রা শুরু করলাম।

ফেরার পথে আরো কিছু বানর, কাঠবিড়ালি আমাদের সাথে লুকোচুরি খেললো। অনেক ধরণের বট গাছ দেখলাম এখানে। কিছু বট গাছ তো অন্যের ঘাড়ে বড় হয়ে তার অস্তিত্বই শেষ করে দিয়েছে। মজার এক গুচ্ছ অর্কিড দেখা গেল উঁচু গাছের মাঝের ডালগুলোতে। লতার সাহায্যে সেই অর্কিডগুলো ঝাড়বাতির রূপ নিয়েছিল। এই কালেঙ্গা বনের আরেকটা আকর্ষণ হলো বড় কাঠবিড়ালী। আমরা দুধরনের কাঠবিড়ালী দেখেছি, বাদামী কাঠবিড়ালী ও কমলা পেটের কাঠবিড়ালী। বাকি ছিল বড় কাঠবিড়ালী। দুপুর বেলায় উঁচু গাছের সমান্তরাল ডালে শুয়ে থাকে সে, জানালো গাইড। ভাগ্য ভাল ছিল তাই একটি বড় কাঠবিড়ালী এ গাছ ও গাছে যাওয়ার পথে আমাদের চোখে ধরা পড়ল।
সারাদিনের হাঁটায় ক্লান্ত সবাই কিন্তু চোখে মুখে পরিতৃপ্তির আভা স্পষ্ট। ফেরার একদম শেষদিকে প্রাকৃতিক একটি ঝিল দেখতে পেলাম। একেতো পরিশ্রান্ত, তার উপর ঝিলের টলটলে পরিষ্কার পানি দেখে লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই ঝিলের জলে ডুব দিলেন। এ যেন এক শুভ সমাপ্তি।

~ তথ্য - কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ~

মাউন্টেনিয়ারিং আর নানান অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা ছেলেবেলা থেকেই। 'এক্সপ্লোর বাংলাদেশ' ট্যুরিজম সংস্থার ট্রাভেল এক্সিকিউটিভ মহি-র স্বপ্ন সাইকেলে সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher