মুন্সিয়ারির কথা

অদিতি ভট্টাচার্য্য

~ মুন্সিয়ারির তথ্য ~ মুন্সিয়ারির আরো ছবি ~

'মুন্সিয়ারি' - যার মানে বরফে ঢাকা ক্ষেত্র বা জায়গা, উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলার একটি শহর। নামটা শুনেছিলাম বেশ কিছু বছর আগে। তখন বিশেষ পর্যটক সমাগম হত না সেখানে। যাওয়ার সুযোগ হল দুহাজার এগারো সালের দুর্গাপুজোর সময়ে। চৌকরিতে ভোরবেলা থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূলের অপরূপ শোভা দেখতে দেখতেই কখন যেন ন'টা বেজে গেল। তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে রওনা দিলাম মুন্সিয়ারির পথে।
গাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে যত ওপরে উঠতে লাগল হিমালয় ততই নতুন নতুন রূপে ধরা দিতে লাগল চোখের সামনে। তার বিশালত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হতে লাগল বার বার। মনে হচ্ছিল যেন কোন অসীমের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি আমরা। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি। রাস্তার একপাশে পাইন, স্পার, রডোডেনড্রনের ঘন বন তো অন্য পাশে অতলস্পর্শী খাদ। কোথাওবা সঙ্গী সগর্জনে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী রামগঙ্গা। একবার সুবিধে মতো জায়গায় গাড়ি থামিয়ে পায়ে পায়ে নেমে গেলাম রামগঙ্গার পাথর ভরা তীরে। যুগ যুগ ধরে কত নুড়ি পাথরকে ক্ষইয়ে, কত পাথরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে সবুজ রঙের জলের স্রোত ছড়িয়ে বয়ে চলেছে রামগঙ্গা। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলছিল ছবি তোলা আর পাইনের কোন কুড়োনো।
দেখতে দেখতে পৌঁছলাম মুন্সিয়ারির কিছু আগে বিরথি ফলসে। একশ পঁচিশ মিটার ওপর থেকে ধবধবে সাদা ফিতের মতো নেমে এসেছে বিরথি জলপ্রপাত। ব্যাকগ্রাউণ্ডে যার গগনচুম্বী সবুজ হিমালয়। সত্যিই ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয় বিরথিকে। ইচ্ছে করলে নুড়ি পাথর ভর্তি এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে জলের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার সে সাহস হয়নি কারণ রাস্তা অত্যন্ত পিচ্ছিল। বিরথির ঠিক পাশেই অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের হোটেল। সেখান থেকে আলুর পরোটা, আচার আর চা সহযোগে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে আবার গাড়িতে চড়ে বসা। মন ততক্ষণে অধীর মুন্সিয়ারি পৌঁছনোর জন্যে।
মুন্সিয়ারি যাবার আর ওখান থেকে ফেরার সময়ে প্রতিটা গাড়ি মুন্সিয়ারি থেকে কিছুটা ওপরে অবস্থিত একটা স্পট অবশ্যই ছুঁয়ে যায় তা হল কালামুনি টপ - এক সাধকের আশ্রম, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাকালীর মন্দির। এই নিয়মের অন্যথা কেউ করে না বলেই শুনলাম আমাদের গাড়ির ড্রাইভার অশোকভাইয়ার কাছে। প্রতিটা গাড়ি অল্পক্ষণের জন্যে হলেও এখানে থামে। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আকাশে অল্প মেঘও ছিল। কাজেই তাড়াতাড়ি মন্দির দর্শন সেরে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। মুন্সিয়ারিতে যখন পৌঁছলাম বৃষ্টি পড়ছে। হোটেলের কর্মচারীরা বলল রাতে জোর ঠাণ্ডা পড়বে কারণ দূরে পাহাড়ে তুষারপাত হচ্ছে আর কাল সকালে আকাশ ঝকঝকে থাকার সম্ভাবনাই বেশী।
পরেরদিন সূর্য উঠতে না উঠতেই সোয়েটার, চাদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে সোজা হোটেলের ছাদে। ঠিকই বলেছিল ওরা - আকাশ একদম পরিষ্কার। চোখের সামনে রোদ্দুরে ঝলমল করছে বরফে মোড়া পঞ্চ চুল্লি। না, আকাশের গায়ে আটকানো তিনকোণা শৃঙ্গ নয় শুধু, মনে হল যেন সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালাকায় পাঁচজন। এই সেই পঞ্চচুল্লি যাদের দেখার জন্যে এতদূরে ছুটে আসা। যাদের দিকে শুধুই চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, দেখে দেখে যেন আশ মেটে না। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মহাপ্রস্থানে যাবার আগে পঞ্চ পাণ্ডব এখানেই রান্না করে খেয়েছিলেন। শুধু পঞ্চচুল্লি নয় দর্শন পেলাম হংসলিঙ এবং নাম না জানা আরও অনেক শৃঙ্গের। দর্শন পাওয়াই বটে। ওখানেই শুনেছিলাম যে এরকম ঘটনাও ঘটেছে সাতদিন একটানা থেকেও একবারও এক মুহূর্তের জন্যে পঞ্চচুল্লি দেখতে না পাওয়া।

বেলার দিকে বেরোলাম মুন্সিয়ারি ঘুরে দেখতে। প্রতিটা বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া চাষের জমি। যেখানে বেশী চোখে পড়ল আলু আর রাজমার খেত। এই দুটোই ওখানকার প্রধান ফসল। অনেক অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম নন্দাদেবীর মন্দির দেখতে। পাহাড়ের মাথার ওপর অল্প একটা গোল জায়গায় ছোট্ট সুন্দর মন্দির, হিমালয় যাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। তখন নবরাত্রি চলছিল, মন্দির তাই সুসজ্জিত। এত সুন্দর, শান্ত পরিবেশ যে এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে গৌরীগঙ্গা নদী, মিলাম গ্লেসিয়ার থেকে যার উৎপত্তি। গেলাম দ্বারকোট গ্রামে। দেখলাম ঘরে ঘরে কার্পেট বোনা চলছে। এখানকার বাসিন্দারা আঙ্গোরা খরগোশ পোষে উলের জন্যে।
পরেরদিন মুন্সিয়ারি থেকে বিদায় নেবার পালা। সেদিন যেন পঞ্চ চুল্লি আরও সুন্দর, আরও অপরূপ। গাড়িতে অশোকভাইয়া বলল যে আমাদের আটকানোর চেষ্টা করতেই বোধহয় পঞ্চ চুল্লি আজ এইভাবে ধরা দিয়েছে, নয়তো এরকম ভিউ পাওয়া নাকি নেহাতই ভাগ্যের ব্যাপার। আবার কালামুনি টপ যাওয়া। সেখানেও সেদিন পঞ্চ চুল্লি সত্যিই ছিল স্বমহিমায় ভাস্বর। দুচোখ ভরে তাকে দেখে নিয়ে নামতে শুরু করলাম।

~ মুন্সিয়ারির তথ্য ~ মুন্সিয়ারির আরো ছবি ~

অদিতির পড়াশোনা সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণ, ছবি তোলা, এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয নিয়মিতই।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher