স্বপ্নের দেশে কয়েকদিন
সুমিতা সরকার
~ অরুণাচল প্রদেশের তথ্য ~ অরুণাচল প্রদেশের ছবি ~ তাওয়াং-এর ছবি ~
ডিসেম্বরের এক সুন্দর সকালে আমরা কলকাতা থেকে রওনা দিলাম, গন্তব্য অরুণাচল। আমরা অর্থাৎ আমি, আমার স্বামী এবং কন্যা। প্রথমে গৌহাটি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা ১৮১ কিমি দূরে তেজপুর। সেখানে এক রাত থেকে পরেরদিন বেড়িয়ে পড়ি তাওয়াং এর পথে। তেজপুর থেকে ৬০ কিমি দূরে অসম-অরুণাচল সীমান্তে পড়ে ভালুকপং। জিয়াভরলি নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। ভালুকপং থেকে প্রায় ৫ কিমি দূরত্বে রয়েছে টিপি অর্কিড সেন্টার। সেখানে দুর্লভ প্রজাতির নানান অর্কিড দেখলাম। এখান থেকে গাড়ি উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে। দু’পাশের পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন প্রজাতির ফার্ন, বাঁশ, কলা আর নাম না জানা গাছেদের রাজত্ব। পথে পড়ল জিরো পয়েন্ট। সেখানে রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। একটা পথ গেছে ডানদিকে পূর্ব কামেং জেলার সদর শহর সেপ্পাতে, আরেকটা পথ রূপা, টেংঙ্গা ভ্যালি হয়ে পৌঁছেছে বমডিলা। উচ্চতা ৮২০০ ফুট। আমরা এপথেই বমডিলা পৌঁছে সেদিনের মতো বিশ্রাম নিলাম।
বমডিলা বেশিরভাগ সময়েই মেঘে ঢাকা থাকে। সকালের দিকে মেঘ সরে গেলে রোদে ঝলমল করে ওঠে ছোট্ট শহরটি। আমরা পায়ে পায়ে দেখে নিলাম দুটি গুম্ফা, ক্র্যাফট সেন্টার ইত্যাদি দ্রষ্টব্যগুলি। শুনেছিলাম বমডিলার কাছে পিঠে অনেক আপেল বাগানও রয়েছে। যেহেতু ডিসেম্বর মাস যেকোনো সময়ে বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই বমডিলা থেকে খুব সকাল সকাল দিরাং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। দিরাং এখান থেকে প্রায় ৪২ কিমি।
পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর দিরাং। উচ্চতা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট। চটপট দেখে নিলাম আপেল আর নাশপাতির বাগান, ইয়াক রিসার্চ সেন্টার ও উষ্ণ প্রস্রবণ। দিরাং ছেড়ে গাড়ি খানিকটা পথ যেতেই আমাদের ড্রাইভার দাদা 'সোনম' দেখালেন বরফে ঢাকা শৃঙ্গরাজি - ওই হল সেলা পাস, যার উচ্চতা ১৩,৭২১ ফুট। চলার পথে একধারে খাদ আর একধারে উঠে গেছে পাহাড়। ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি যত ওপরের দিকে উঠতে লাগল চোখে পড়তে লাগল পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা ফার্ন, পাইন গাছের পাতা সব সাদা বরফে ঢাকা। পথের দু'ধারে পড়ে আছে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো বরফ। তবে রাস্তা পরিস্কার। হঠাৎ একটা বাঁক নিতেই সামনে এলো বহু প্রতীক্ষিত সেলা পাস।
২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১। সময় বিকেল পাঁচটা। দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাস-ভূগোল খ্যাত সেলা পাসে। একদিকে সেলার আত্মত্যাগের গল্পকথা মনে পড়ছে আর অন্যদিকে উচ্চতার রোমাঞ্চ। বেশ একটা অদ্ভুত ভাললাগা ছড়িয়ে যায় সারা শরীরময়। সেলা গেট পার হয়ে গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো সেলা লেকের ধারে। অবাক বিস্ময়ে আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ। একি! পুরো লেকটাইতো জমে বরফ! এখানে দুটো লেক আছে, দুটোই জমে গেছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়ি এই অপার্থিব সৌন্দর্যকে মন ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে। যদিও অতিরিক্ত উচ্চতার একটা কষ্ট থাকে কিন্তু হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোকা ৩০ এবং মনের উত্তেজনা শরীরের ক্ষমতা যেন হঠাৎই বাড়িয়ে দিয়েছে। সোজা নেমে গেলাম বরফ জমা লেকের ওপরে এবং অবিশ্বাস্য মনে হলেও লেকের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবিও তোলা হোল।
আমাদের ড্রাইভার দাদা এরপর গাড়ি দাঁড় করালেন সেলা পাস থেকে একটু নেমে চায়ের এক ছোট্ট দোকানে। সেখানে গরম গরম চা খেয়ে শরীরের যেটুকু কষ্ট হয়েছিল তাও মুহূর্তে উধাও। গাড়ি এবার উতরাই পথ ধরে পৌঁছাল এক ঝরনার ধারে। ওমা, ঝরনাও যে জমে বরফ! নামটিও বেশ। জং ফলস।
এগিয়ে চললাম যশবন্তগড়ের দিকে। বীর সৈনিক যশবন্ত সিং রাওয়াতের স্মৃতি মন্দির। চিন –ভারত যুদ্ধের সময় ১৯৬২ সালে চিনা সৈনিকদের আক্রমনের সময় এই সেনাচৌকি দীর্ঘক্ষণ আগলে রেখে বীরের মৃত্যু বরণ করেন যশবন্ত। এঁরই প্রেমিকা ছিলেন সেলা। শোনা যায় ভারতে ঢোকার গোপন রাস্তার কথা তিনি জানতেন। তাই চিনা সৈনিকরা যখন তাঁর পিছু নেয়,পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন সেলা। যশবন্ত গড়ে গিয়ে জানা গেল, যশবন্ত সিং এমন একজন সৈনিক যিনি মৃত্যুর পরেও বেতন পান এবং যার উন্নতিও হয় কারণ অন্যান্য সৈনিকদের এবং সেনাবিভাগের মতে তিনি এখনও "অন ডিউটি"। এখানকার পাহাড়ি বাতাসে সেলা-যশবন্তের প্রেম আর বীরত্বের কাহিনি আজও যেন ভেসে বেড়ায়।
এরপর আমাদের গাড়ি আবার চড়াইয়ের পথ ধরল। সন্ধ্যে নাগাদ দেখতে পেলাম তাওয়াং এর গেট । ছোট্ট সুন্দরী তাওয়াং। জায়গা মিলল হোটেল সামদ্রুপ্লিং-এ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় লেপের তলায় খুঁজে পেলাম ওম। রুম সার্ভিসে চলে এল গরম ধোঁয়া ওঠা কফি আর পকোড়া। শরীরে যেতেই আবার সব চাঙ্গা। বেড়িয়ে পড়লাম। হোটেলের সামনেই ছোট্ট একটা বাজার। আলপিন থেকে সোয়েটার – সবকিছুই পাওয়া যায়। হোটেলের নীচেতেই আবার মিলিটারি পোশাক-আষাকের দোকান। মেয়ের আদুরে বায়নায় কেনা হোল মিলিটারি ক্যাপ। এছাড়াও চেনা-পরিচিতদের জন্য কিছু উপহার। এখানে বেশ তাড়াতাড়ি রাত নামে, তাই আমাদেরও চটপট ঘরে ঢুকে পড়তে হল। হোটেলের ম্যানেজার জানালেন কাল সকাল ৮ টায় গাড়ি আসবে। ঘুরে দেখব তাওয়াং।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। চোখ জুড়িয়ে গেল অরুণাচলের লুকোনো স্বর্গকে দেখে। অরুণাচলিরা সাধারণত নিজেদের জাতীয় পোশাকেই স্বছন্দ। হঠাৎ চোখ গেল দূরের পাহাড়ের গায়ে রাস্তায় সার দিয়ে চলেছে মিলিটারি ভাইয়েরা। মন যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।
সম্বিৎ ফিরল কর্তার ডাকে - "গাড়ি এসে গেছে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও"। ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গিয়েছিল। চটপট জ্যাকেট সোয়েটার চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়া গেল। প্রথম গন্তব্য তাওয়াং থেকে ১৬ কিমি দূরে প্রায় ১৪৭০০ ফিট উচ্চতায় পিতি সো । পথে পড়ল মিলিটারি ক্যাম্প। সেখানে আই এল পি অর্থাৎ পারমিট দেখাতে হোল। এরপর শুরু হোল সেই রাস্তা যে রাস্তার প্রত্যেক বাঁক ঘুরলেই খুলে যাচ্ছিল একটার পর একটা রহস্যের দরজা। কোনও বিশেষণেই যেন মন ভরছিল না। ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করছিলাম এই অপার সৌন্দর্য। এসব মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে কখন যেন পৌঁছে গেলাম পিতি সো। চারদিকে পাহাড় ঘেরা এই লেক এখন জমে বরফ। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে পেঁজা বরফ। লেকের জলে থুড়ি বরফে ছায়া পড়েছে পাশের পাহাড়ের। অসাধারণ মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য। সবাই নেমে গেলাম লেকের ধারে। বরফ নিয়ে খেলা শুরু হল। দুঃসাহসে ভর করে কিছুটা হেঁটে এলাম লেকের জমে যাওয়া বরফের ওপর দিয়েও।
কিছু সময়ের জন্য হলেও এই স্বর্গীয় পরিবেশ যেন আমাদেরও ছেলেবেলাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, ভুলিয়ে দিয়েছিল সংসারের কঠিন বাস্তবকে। এবার এগিয়ে চললাম সাঙ্গেসার লেক অর্থাৎ জনপ্রিয় মাধুরী লেক দেখতে।এখানে এক একটা বাঁক ঘুরলেই দেখা মেলে এক একটি অপূর্ব সুন্দর লেক। কোনটার আধা বরফ আধা জল, কোনটায় শুধুই জল(পবিত্র লেক), কোনটা পুরো দুধ সাদা বরফে ঢাকা। বরফ আর বরফ। চারদিকে শুধু সাদা –কালোর রাজত্ব। পৌঁছে গেলাম সাঙ্গেসার লেক। এই লেকের বিশেষত্ব হল লেকের জলের ভিতর থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গাছের কাণ্ড। শোনা যায়, এক সময় ভূমিকম্পে গাছে ভরা পাহাড় নীচে বসে যায় এবং তা জলে পূর্ণ হয়ে তৈরি হয় এই লেক।
শহরে ফিরে এসে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। এবারে দ্রষ্টব্য তাওয়াং মঠ আর ওয়ার মেমোরিয়াল। মঠের বুদ্ধমন্দিরে রয়েছে ২৬ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। বাইরের দেওয়ালে নানা উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করে আঁকা রয়েছে বুদ্ধদেবের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। এখানকার মিউজিয়ামটিও দেখার মত। এরমধ্যে সযত্নে রক্ষিত তিনশো থেকে হাজার বছরের পুরনো পুঁথি, বৌদ্ধ লামাদের ব্যবহৃত জিনিষ, পুরনো বাসনপত্র, থাঙ্কা। রয়েছে দুটি বিশাল হাতির দাঁত, কাঠের মুখোশ ইত্যাদি সব বহুমূল্য জিনিষ। এই মঠের থেকে দাঁড়িয়ে পুরো তাওয়াং শহরকে দেখা যায়।
এর পর যাওয়া হল ১৯৬২ সালে নিহত ভারতীয় সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত ওয়ার মেমোরিয়ালে। এখানে শোভা পাচ্ছে বোফর্স কামান। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরলাম হোটেলে। মন কানায় কানায় পূর্ণ।
এবার ফেরার পালা। ঠিক করেছিলাম হেলিকপ্টারে ফিরব। সেইমত পরেরদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম হেলিপ্যাডে। পবনহন্স হেলিকপ্টার। চেকিং পর্ব সেরে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা নিয়ে উঠে পড়লাম। ঘণ্টা দুয়েকের সেই অসাধারণ উড়ান সারা জীবনের সম্পদ। পাখির চোখে দেখলাম ভুটানের নদী জঙ্গল পাহাড়, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা। গৌহাটি বিমানবন্দরে নেমে মনে হল যেন স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে পা দিলাম ।
~ অরুণাচল প্রদেশের তথ্য ~ অরুণাচল প্রদেশের ছবি ~ তাওয়াং-এর ছবি ~
নৃত্য বিশারদ সুমিতা ভালবাসেন বই পড়তে ও গান শুনতে। ঘর সামলানোর ফাঁকে অবসর আর সুযোগ পেলেই সপরিবারে বেড়িয়ে পড়েন অচেনা অদেখা প্রকৃতির অমোঘ টানে।