ঢাকা থেকে সিমলা
তুহিন ডি. খোকন
~ হিমাচল প্রদেশের তথ্য ~ হিমাচল প্রদেশের আরো ছবি ~
একেবারে হঠাৎ করেই ট্যুর প্ল্যানটা। ভারতীয় হাই কমিশনারের জারিকৃত নতুন নিয়মে ই-টোকেন রেজিষ্ট্রেশন করলাম ৭ তারিখে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে কর্মরত বন্ধু নিউটনের কল্যাণে ভিসা সংক্রান্ত ভোগান্তি অনেকটাই লাঘব হলো। ১৪ তারিখ বিকেলে প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেই বন্ধু নোমান তার পরিবার ও আমার পরিবারের ভিসা সম্বলিত পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করলো। এরমধ্যে কলকাতা প্রবাসী এক আত্মীয়কে ফোনে শিয়ালদহ-দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে টিকিট করতে বললাম। পরদিন দুপুর বারোটা নাগাদ 'তৎকাল স্কিমে' টিকেট কনফার্মেশন ম্যাসেজ পেলাম। ছুটলাম সোহাগ কাউন্টারে, যেতে যেতে ফোনে নোমানকে ডেকে নিলাম। বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম সুবিধাজনক কোন সিটই নেই। এদিকে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের সাথে সময় মেলাতে গেলে একেবারে টায়েটায়ে হয়ে যাচ্ছে। এক ঘণ্টার নোটিশে দু'জন যার যার মিসেসকে খবর দিলাম ইমার্জেন্সি ব্যাগ গোছাতে। সময় যেখানে অতি সংক্ষিপ্ত সেখানে বাস কাউন্টার থেকে বাসায় ফেরার জন্যে রিকশা অথবা সিএনজি কিছুই যেতে রাজি হচ্ছিল না। বিকেল ৪.৩০ টায় বাস, হাতে সময় আছে মাত্র চল্লিশ মিনিট। কিছুটা দৌড়িয়ে, কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিকশায় চড়ে শেষে বাসায় যখন পৌঁছালাম তখন বাজে ৪-০৫। স্ত্রী-কন্যাকে অনেকটা বগলদাবা করেই কোনক্রমে বাস স্টেশনে পৌঁছালাম। ততক্ষণে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে আরও পাঁচ মিনিট বেশি হয়ে গেছে। কোনক্রমে লাগেজ বুথের এন্ট্রি শেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের নির্দিষ্ট সিটে হেলান দিতেই শরীর প্রায় অবশ হয়ে এলো। বুঝলাম বয়স এবং টেনশন দুটোই মারাত্মক হয়ে দেখা দেয় এসব আন-সার্টেন ট্যুরে।
প্রায় পৌনে বারটা নাগাদ বাস বেনাপোলে পৌঁছালো, তড়িঘড়ি ইমেগ্রেশন-কাস্টমস সম্পন্ন করলাম। ওপারে অপেক্ষমান বাসে উঠে দু'ঘণ্টার মধ্যে মধ্যমগ্রামে সোহাগের ব্যবস্থাপনায় ও নিজের টাকায় প্রথম ভারতীয় লাঞ্চ খেলাম। পাঁপড়, দু'বাটি ভাত, কসানো মাংস আর কাঁচা পেঁয়াজ। চরম ক্ষুধায় তাই অমৃত মনে হলো। ঠিক তিনটায় কলকাতার মারকিউস স্ট্রিট সংলগ্ন সোহাগ কাউন্টারে বাস দাঁড়াল। হোটেল ওরিয়েন্টাল - আপাতত আমাদের রাতঠিকানা।
সন্ধ্যায় বেরোলাম আশপাশের এলাকা পরিদর্শনে। পাশেই নিউমার্কেট এলাকা, আমার ও নোমানের স্ত্রীর জোরাজুরিতে সেখানেই গেলাম। টুম্পা ও ফারহানা ভাবি বিপুল উৎসাহে শপিংয়ে ব্যস্ত। আমি আমার মেয়ে কান্তম ও নোমান তার দু'মেয়ে ইসাবা ও আরিনাকে সাথে নিয়ে নিউমার্কেট চত্বরের নিয়ন আলোতে দাঁড়িয়ে আছি। নিয়ন আলোর হলুদ আভায় বড্ড অদ্ভুত লাগছে দুশো বছরের পুরাতন কলকাতা নগরী। তাড়াহুড়ায় ফেলে আসা চটি জুতা আর সানগ্লাস কিনে নিলাম বেশ সস্তায়। নিকটস্থ 'রাঁধুনি রেস্তোরাঁয়' রাতের খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে পরদিনের পরিকল্পনায় বসলাম। পরে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না!
বহুদিনের অভ্যাস তাই ভোর পাঁচটাতে ঘুম ভাঙলো। চপটপ শর্টস ও জগিং সু পরে রাস্তায় নামলাম। রাতজাগা কলকাতা নগরী তখনও ঘুমে। মিনিট বিশেক হেঁটে হোটেলে যখন ফিরলাম আমার স্ত্রী ও কন্যা তখন জেগে গেছে। হালকা নাস্তার অর্ডার দিলাম। আটটায় ব্রেকফাস্ট। নাস্তা শেষে শর্ট ডিস্টেন্সের দর্শনীয় স্থান দেখার প্রস্তাব এলে নোমান দম্পতি চলে গেল ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়াল দেখতে। সাড়ে এগারটা নাগাদ নোমান এলে পাসপোর্টসহ গেলাম ফেয়ারলি প্লেসে দিল্লি টু কালকার টিকিট করতে। ফরেনার কোটায় সবক'টা টিকিট পেয়ে গেলাম নির্দিষ্ট দিনের।
বেলা সোয়া চারটায় রাজধানী এক্সপ্রেসে পা রাখলাম জীবনে প্রথমবারের মতো। সেন্ট্রাল এসি ট্রেন - আমাদের সিট থ্রি টায়ারে। কাঁটায় কাঁটায় ৪.৫৫ মিনিটে গাড়ি ছাড়লো। নিজেদের ও সহযাত্রীদের সাথে গল্পগুজব করতে করতেই মোটামুটি ছাব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আমি ও নোমান ছাড়া বাকি সবার এটিই প্রথম দূরপাল্লার ট্রেন ভ্রমণ। তাই তাদের মনে অনেক চমক, অনেক বিস্ময় লাল রঙের এই ট্রেনকে ঘিরে। পরদিন দুপুর দেড়টায় দিল্লি পৌঁছতেই কুখ্যাত ‘ড্রাই হট ওয়েদারের’ মুখোমুখি হলাম। ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কেউই একটুও ঘামছি না কিন্তু প্রচন্ড রোদ আর গরম হাওয়ার দাপটে পোশাকের বাইরের আবরণহীন ত্বকে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। ভাবলাম এখানে মানুষ থাকে কেমনে! যতটা দ্রুত সম্ভব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়েটিং রুমে সবাইকে রেখে নোমান আর আমি দুরন্ত এক্সপ্রেসে দিল্লি-কলকাতা ফেরার টিকিট কেটে নিয়ে পুরানো দিল্লিতে যাবার জন্যে ট্যাক্সি ঠিক করতে বেরোলাম। এর মধ্যে সুযোগসন্ধানী এক ট্রাভেল এজেন্টের খপ্পরে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। পুরানো দিল্লি পৌঁছে স্টেশন সংলগ্ন বিখ্যাত ম্যাকডোনাল্ডে লাঞ্চ খেলাম সবাই। লাঞ্চ সারতে সারতে বেলা তিনটা বাজলো। বাইরের ভয়াবহ তাপদাহ থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি আশ্রয় নিলাম স্টেশনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়েটিং রুমে। ছ’টার দিকে রোদ একটু পড়ে এলে নোমান প্রস্তাব দিল কাছেই দিল্লির লালকেল্লা দেখে যেতে। মালপত্র স্টেশনের লাগেজ রুমে গচ্ছিত রেখে রিকসা করে বেরিয়ে পড়লাম।
দিল্লির লালকেল্লা। সতেরশ' শতাব্দিতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রতিষ্ঠিত সুবিশাল দুর্গ। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো দু'পাশের সারিবদ্ধ অ্যান্টিক ও স্যুভেনির শপগুলো। রকমারি-বাহারি পণ্যে সজ্জিত। মূল দুর্গের ভেতরে দেওয়ান-ই-আলম। দেওয়ান-ই-খাস, নুর-ই বেহেশত, জেনানা, মতি মসজিদ, বক্স বাগসহ অন্যান্য প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন দেখা শেষে খোলা প্রান্তর ও জলাশয়ের কাছে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল।
পাহাড়ি ছোট রেল স্টেশন কালকা। অনেকটা মফসসলি ট্রেন স্টেশনের মতো। এখান থেকে সড়ক পথে সিমলা ৮০ কিলোমিটার। ছোট গাড়ি বা জিপে সাড়ে তিন ঘণ্টা। পর্যটকদের জন্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ১৯০৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চালু করা টয় ট্রেন। তবে 'শিবালিক এক্সপ্রেস' বা 'হিমালয়ান কুইন' নয়, সময়ের স্বল্পতার জন্য একটা 'টাটা ইন্ডিকা' ভাড়া করলাম। আমাদের যাত্রা হলো শুরু।
সিমলা - ১৮৬৪ সালে হিমাচল প্রদেশের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 'কুইন অব হিল' নামে পরিচিত এই পাহাড়ি শহর তৎকালীন ব্রিটিশ রাজাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে পরিগণিত হতো। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২২০৫ মিটার বা ৭২৩৪ ফুট। আমাদের গাড়ি প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চললেও চারদিকের নয়নাভিরাম পাইন ও ওক গাছের ঘন জঙ্গল মুহূর্তেই মনে অভিযাত্রী ভাব এনে দিল। উপভোগ্য কোমল শীতল হাওয়া যাত্রাপথের ক্লান্তি অনেকটাই দূর করে দিচ্ছে। প্রায় ১১টা নাগাদ সিমলা মূল বাস স্টেশন সংলগ্ন হোটেল পাড়ায় পৌঁছলাম। আমাদের ড্রাইভারের প্রদর্শিত কুলিদের দেখে বেশ আশ্চর্য হলাম। লাল চামড়ার দীর্ঘদেহী সুদর্শন এই যুবকগুলোই নাকি এখানকার কুলি! পোশাকে আশাকে অনেকটা কাশ্মিরী। আমাদের ড্রাইভার ইশারা করতেই তারা বেশ সহজভাবেই আমাদের মালপত্তর তুলে নিয়ে হোটেল দেখাতে নিয়ে চলল। মূল বিড়ম্বনার শিকার হলাম এখানেই। প্যাকেজ ছাড়া এবং কোন ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যম ছাড়া হোটেল পাওয়া অতি কঠিন ব্যাপার। প্রায় দু' ঘণ্টা খুঁজে ছাব্বিশ হাজার টাকার চুক্তিতে 'সিমলা (লোকাল সাইড সিয়িং) -মানালী- ধর্মশালা- ডালহৌসি' প্যাকেজ ঠিক করলাম এক স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে। প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত একখানা টাটা সুমো জিপ, সাথে ড্রাইভার আর মাঝারি হোটেল থাকার ব্যবস্থা। খাওয়া দাওয়া ও শপিং খরচ আমাদের নিজেদের। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম ঘুম ভাব চলে এলো। রুমের বিশাল জানালা দিয়ে অর্ধেক বরফে মোড়া ফাগু-সিমলার পাহাড় দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পেলাম না। দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখি বিকাল ৪টা। আমাদের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কম্বলের আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে হলো না। তবুও মনের টানে ঘর ছাড়লাম।
বাইরে বেরিয়ে মনটা বেশ প্রশান্ত হয়ে গেল। মরে আসা রোদে তীব্র সুনীল আকাশ আর তার নীচে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের টিউডর রিভাইভাল নিও-গথিক আর্কিটেকচারে গড়ে তোলা বিল্ডিং ও ঘরবাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেদের বড্ড আগন্তুক মনে হলো। বাংলাদেশ ছেড়ে এত হাজার মাইল দূরের এই সিমলা শহরের সৌন্দর্য উম্মুখ করে তুলল সবাইকে। আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার চব্বিশ বছরের এক স্থানীয় যুবক, নাম বিনোদ। বেশ হাসিখুশি, মজার কথাবার্তা চালাতে পারে সাবলীল হিন্দিতে। বিনোদের মূল কারিশমা টের পেলাম দুর্গম ও মারাত্মক বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথে তার অসাধারণ ড্রাইভিং নৈপুণ্য দেখে। ট্যুরের সাতদিনই সে আমাদের সঙ্গে ছিল।
প্রথমে গাড়ি নিয়ে আমরা গেলাম সিমলা ট্রেন বুকিং-এ। পাঠানকোট টু নয়াদিল্লির টিকিট কেটে নিলাম। তারপর চললাম প্রায় ৮৬০০ ফুট উঁচুতে কুফরিতে। সিমলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। কুফরি যাওয়ার পথে 'হিমালয়ান ওয়াইল্ড লাইফ -জু' পড়লেও সময়ের অভাবে কয়েকটি হিমালয়ান ভাল্লুক ও একটি চিতা ছাড়া অন্য কিছু দেখার সৌভাগ্য হলো না। আশপাশের মধ্যে কুফরির চূড়াই সর্বোচ্চ। গাড়িপথ শেষ হবার পর এবার আমরা চারটি ঘোড়া ভাড়া নিলাম কুফরির চূড়ান্ত চূড়া বা পিক 'মাহাষু'-তে ওঠার জন্যে। খাড়া পাহাড়ি পথ, কাদা-পাথর ও ঘোড়ার বিষ্ঠায় একাকার। এসব তুচ্ছ করে অজানাকে জানার আগ্রহ আমাদের ক্রমশ উৎসাহ জোগাচ্ছিল। প্রথমে ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় নিজেকে ওয়েস্টার্ন ছবির তারকা 'ক্লিন্ট ইস্টউড' মনে হচ্ছিল। যদিও পথের দুর্গমতায় এই 'ভাব' কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে গেল। এক পাশে খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর, অন্যপাশে জঙ্গলঘেরা গভীর খাদ যেখানে কোন কারণে যদি কেউ পড়ে তো সেনাবাহিনী দিয়ে লাশ তোলাতেও সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। কখনও একেবারে খাড়া আবার কখনও একেবারে নীচু বন্ধুর পথে আমাদের প্রশিক্ষিত ঘোড়াগুলো ধীরে ধীরে গন্তব্য পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে দিল। ঘোড়া থেকে নেমে আমরা আশপাশ ঘুরে দেখতে বেরোলাম।
যদিও গ্রীষ্মকাল, পাহাড়চূড়ার শীতাতুর আবহাওয়া তা ভুলিয়ে দিল। ছোটবেলায় ইংরেজি বর্ণমালা শেখার সময় Y-তে ইয়াক পড়েছিলাম, ছবিও দেখেছিলাম। কুফরির এই পাহাড় চূড়ায় দেখি সত্যি সত্যি দুটি ইয়াক সুবিশাল দেহে কালো লোমের ঝালর ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই তাদের সহিস। মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকায় পিঠে চড়ে ছবি তোলা যাবে। প্রথমে বেশ আগ্রহ নিয়ে কাছে গেছিলাম ছবি তুলব বলে, কিন্তু ফুট দশেক দূর থেকেই ইয়াকের গায়ের তীব্র বোটকা গন্ধ ব্যাপারটাকে অসাধ্য করে তুলল। পরিবর্তে ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট পার্ক ও চিনি বাংলো দেখে ঘোড়ায় চড়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
বিকেল প্রায় শেষের দিকে। পথে গাড়ি থামিয়ে হাজারো ফার ট্রিতে ছাওয়া গ্রিন ভ্যালি দেখলাম। এর স্থানীয় নাম চপল। সবুজের এই অফুরন্ত সৌন্দর্য যে কোন পর্যটককে বিমোহিত করবে। পুরো উপত্যকা যেন ফারের কার্পেট বিছানো!
কুফরি থেকে সিমলা শহরে যখন ফিরলাম তখন আকাশ প্রদীপ নিভে গেছে। পাহাড়ের খোপে খোপে বসতবাড়ির আলোগুলোকে মনে হলো যেন টুনি বাল্ব বা এক ঝাঁক তারা পাহাড়ের গায়ে জাঁকিয়ে বসে ঝিকমিক করছে।
পরদিন সকালে মানালির উদ্দেশ্যে আমরা যখন বেরোলাম তখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা। সিমলা থেকে কুলুর দূরত্ব ২১০ কি.মি আর মানালি ২৬০ কি.মি। দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথ। রওনা হওয়ার ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে প্রচণ্ড রোদ জিপের ভেতরটাকে একেবারে নরক করে তুললো। ঘোর গ্রীষ্মকাল। বিনোদ জানালো গত দু'মাসে মাত্র একবার বৃষ্টি হয়েছে এখানে। তাই পাহাড়ি এই জনপদ একেবারে ধুলোয় ধূসরিত। গরমে-ঘামে ও ধুলোয় সবাই অস্থির হয়ে উঠল।বেলা দেড়টা নাগাদ ধরলা ঘাট, বিলাসপুর ও সুন্দরনগর ফেলে আমরা উপস্থিত হলাম মান্ডি শহরে। আশেপাশের শহরগুলোর মধ্যে আয়তন ও জনসংখ্যায় মান্ডি অন্যতম। চার চারটি ন্যাশনাল হাইওয়ের জংশন শহর বিলাসপুরের পরই এর অবস্থান। খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিল তাই সবাই মিলে এখানেই লাঞ্চ সারলাম।
সিমলা শহর থেকে এতক্ষণ আমরা উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম, মান্ডি থেকে গাড়ি এবার ঘুরে গেল উত্তর-পশ্চিমে। এখানেই দেখা মিললো হিমালয়ের বরফ গলানো স্বচ্ছ তোয়া বিয়াস নদীর। বিয়াস পাহাড়ি খরস্রোতা পাথুরে নদী; এর কোথাও অত্যধিক গভীরতা আবার কোথাও বা হাঁটুজল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এ সমস্ত বড় বড় পাথরগুলোও পাহাড়ি স্রোতের সাথে নেমে এসেছে হিমালয় থেকে। অপেক্ষাকৃত নীচু পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সকলে ঘাম ও ধুলোয় মাখা হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম।
গাড়ি ঢুকলো বিশাল এক পাহাড়ি টানেলের মধ্যে -দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটারেরও বেশি। বিনোদ বলল এখান থেকে মাইল পাঁচেক সামনে রাইসান নামক এক জায়গায় র্যাফটিং এর সুব্যবস্থা আছে এবং তা আমাদের পাশে পাশে বয়ে চলা এই বিয়াস নদীতেই। আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে 'হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং' ও 'রেপলিং এন্ড রিভার ক্রসিংয়ের' বিশাল আয়োজন দেখে চমৎকৃত হলাম। নদীপাড়ের পাইনের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় পাঁচ ছয়টি র্যাফটিং জোন গড়ে তুলেছে কয়েকটি কোম্পনি। নদীর পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হওয়াতে শুধুমাত্র মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের শেষ নাগাদ এই রেপলিং ও র্যাফটিং চালু থাকে। উজানপথে প্রতিবার র্যাফটিংয়ে মোটামুটি প্রায় ১৪ কি.মি. পর্যন্ত ভাসা যায়। পুরু রাবারের একটি বোটে একসাথে চারজন আরোহী ও একজন ইনেস্ট্রাকটর থাকে। খরস্রোতের তীব্র টান, নদীতে বিছিয়ে থাকা ধারালো পাথর ও ঠাণ্ডা জল মুহূর্তের অসতর্কতায় বড়সড় বিপদ ঘটাতে পারে। নিরাপত্তার জন্য থাকে শক্ত হেলমেট, লাইফজ্যাকেট ও রাবারের তৈরি বিশেষ পোশাক। এরপরও হর হামেশা দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে।
মধ্য বিকেলে কুলু শহরের ভেতর যখন আমরা প্রবেশ করলাম তখন কুলুর স্পেশাল লেডিস শালের কারখানা ও মার্কেট দেখে শপিং স্পেশালিস্ট ফারহানা ভাবি দারুণ উত্তেজিত। তার এখনই এসব মার্কেটে ঢোকা চাই। মহিলাদের শালের দোকানে পাঠিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আমি ও নোমান চললাম আশ-পাশে হেঁটে বেড়াতে। বেশি দূর যেতে হলো না। এক গৃহস্থের আঙ্গিনায় ফলে ভরন্ত দুটি আপেল গাছ (জীবনে প্রথমবার) দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। বাড়িওলার অনুমতি নিয়ে গাছের নিচে পড়ে থাকা কাঁচা কয়েকটি কুড়িয়ে নিলাম; গাছের ধরন, পাতা ও কুঁড়ির প্রকৃতি ও অপেক্ষাকৃত পরিণত ফলগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম খাঁটি বোটানিস্টের মতো। বিনোদ জানালো সামনেই মানালিতে অসংখ্য আপেল বাগান দেখতে পাব।
কুলু থেকে মানালির দীর্ঘ ৪০ কি.মি পথ নয়নাভিরাম শীতকালীন অর্কিড, অগণিত আপেল ও পালামের বাগান, ফার ও আলপাইন ট্রির সবুজের মধ্যেই অতিক্রান্ত হলো। বিকেল প্রায় শেষ, সূর্য ডুবুডুবু, এরই মধ্যে দেখা মিললো অপরূপ শোভা বেষ্টিত কয়েকটি তুষার শুভ্র পর্বত চূড়ার। এরই মধ্যে সূর্যের শেষ রশ্মিতে সেগুলো উজ্জ্বল-গাঢ় সোনালি, কোনটা রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা মানালিতে ঢুকলাম। হোটেল পাড়া ও ম্যল চত্ত্বরের যানজট পেরিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা।
বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের অ্যালার্মে গভীর ঘুম একটু একটু হালকা হতে লাগলো। মনে হলো এই মাত্র তো ঘুমিয়েছি! দশ সেকেন্ড পর ফের অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে সচকিত হয়ে উঠলাম, মোবাইলের উজ্জ্বল ডিসপ্লেতে তখন ভোর চারটে।পাঁচটায় আমাদের বেরোবার কথা - রোটাং পাসের উদ্দেশে। হোটেলের গাড়ি বারান্দায় যখন নামলাম তখন সবে পুব আকাশ ফিকে হতে শুরু করেছে। দেখি বিনোদ এরই মধ্যে চালকের আসনে সওয়ারি। সবাই ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লাম। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে সবগুলো কাচ তুলে দেওয়া হলো। এক-দেড় কিলোমিটার গিয়েই বিনোদ গাড়ি থামালো। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালো, যে কাপড়-চোপড় ও জুতা আমরা পরেছি তা স্নো-পয়েন্ট রোটাং পাসের জন্যে মোটেও উপযুক্ত না। রাস্তার দু'পাশের পোশাকের সারিবদ্ধ দোকান দেখিয়ে বললো এখান থেকেই বিশেষ পোশাকগুলো ভাড়া নিতে হবে। সারিবদ্ধ দোকানগুলোতে এবার মনোযোগ দিলাম। আইস-স্কেটিং এর বিশেষ সরঞ্জাম, পোশাক ও বরফে চলার জুতো সাজিয়ে রাখা প্রতিটি শপে। স্থানীয় মধ্যবয়স্কা এক দোকানির কাছ থেকে অনেক দরদাম করে পোশাক ও জুতো এবং এক জোড়া আইস স্কেটিং সরঞ্জাম ও ইনস্ট্রাকটর ভাড়া করলাম। ফের চলা শুরু হলো। ইতিমধ্যে তুষার ধবল পাহাড় চূড়ায় উঁকি দিল সূর্য। রক্তিম আভায় হাজারো অজানা পাখির কলরব ও দিগ্বিদিক ওড়াউড়িতে মনে হলো অজানা কোন স্বর্গে এসে পৌঁছেছি। যতই আলো ফুটছে ততই শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করতে লাগলাম আমরা। চারদিক বরফ আবৃত পর্বত চূড়া, অর্কিড ও আপেল বাগান, চিরসবুজ দেবদারু ও পাইনের ঘন বন - নৈসর্গিক স্থান। বিনোদ জানালো এই একই পথ দিয়েই কাশ্মীর উপত্যকার লাহল, স্পিতি ও কিন্নরে যাওয়া যায়।
পথের দুর্গমতার কারণে ধীরে ধীরে চলছে আমাদের জীপ, লক্ষ্য ৪১১১ মিটার বা ১৩৪০০ ফুট উঁচুতে স্নো-পয়েন্ট রোটাং পাস। মানালি শহর থেকে প্রায় ৫১ কি.মি. উত্তরে এর অবস্থান। বছরের অন্যান্য সময় প্রায়ই বন্ধ থাকে এ পথ, বরফ ও বৃষ্টির কারণে। তখন শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুমতিক্রমে এবং রোড ক্লিয়ারেন্স এর প্রেক্ষিতে সেখানে যাওয়া যায়। এই একই পথ ধরে লে-লাদাখ হয়ে জম্মু কাশ্মীরেও পৌঁছান যায়। পথের একপাশে খাড়া পাহাড় প্রাচীর, অন্যদিকে গভীর খাদ সমৃদ্ধ সংকীর্ণ এই রাস্তা।
খাড়া পথ ধরে আমাদের জীপ উঠছে, যতই উঠছে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডার প্রকোপ। ঘণ্টা দু'য়েক বিরামহীন ওঠার পর স্পষ্টত অক্সিজেনের অভাব টের পেলাম। সবারই শ্বাস নিতে অস্বস্তি হচ্ছে। যতই উঠছি অস্বস্তি ততই বাড়ছে। তবুও জীবনে প্রথমবার বরফচূড়ায় পৌঁছানোর লোভে আমরা সবাই এতটাই উন্মুখ ছিলাম যে, এই কষ্টটুকু স্বীকার করতে রাজি ছিলাম। অবশেষে চূড়াতে উঠে এলো আমাদের জীপ। চারদিকে বরফ আর তুষারের রাজ্য, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। দু'টি চূড়ার মধ্যবর্তী ভ্যালিতে স্কেটিং-এর বিশাল আয়োজন। ইতিমধ্যে আমাদের আগেই অনেক ট্যুরিস্ট সেখানে পৌঁছে গেছে। অনেকেই স্কেটিং করছে আবার অনেকে বরফের উপরে চলা বিশেষ গাড়িতে মোটর স্কেটিং-এ ব্যস্ত। ৯০ ডিগ্রি ঢালু পাড় মাড়িয়ে নেমে এলাম ভ্যালিতে। শুরু হলো একে একে স্কেটিং করা। ছোটরাই প্রথমে ইনস্ট্রাকটরের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী শুরু করলো। নিজের পালা যখন আসলো তখন বুঝলাম সঠিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন ছাড়া আইস স্কেটিং করা মোটেও সহজ নয়।
সকালে কারও ব্রেকফাস্ট হয়নি। ফলে একদিকে গ্লুকোজ ও অন্যদিকে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে ঘণ্টাখানেকের ভেতরই সবাই কাহিল হয়ে পড়লাম। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই অভিযানের ইতি টেনে গাড়িতে উঠলাম সবাই ফিরবার উদ্দেশ্যে। গাড়ি চলা শুরু হতে না হতেই বাধলো বিপত্তি - সামনে বিশাল যানজট। সংকীর্ণ পাহাড়ি রাস্তায় একটু এদিক ওদিক হলেই যানজট সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা জ্যামে আটকে আমাদের অনেকেরই প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। পথের পাশে বরফের উপরই কাঠ ও চট বিছিয়ে কচি ভুট্টা বিক্রি করছিল কয়েকজন। তাদের কাছ থেকে সবার জন্য ভুট্টা কিনলাম। আগুনে আধ ঝলসানো লেবু মিশ্রিত সেই ভুট্টাকেই তখন অমৃত মনে হলো। যানজট ছুটতেই ফিরতি পথে চলতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। পথে দু'জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালাম প্যারাগ্লাইডিং ও হেলিকপ্টার রাইডিং দেখার জন্যে। প্যারাগ্লাইডিং-এ দুই আসনের একটিতে আরোহী ট্যুরিস্ট ও অন্যটিতে ইনস্ট্রাকটর, প্যারাসুট মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পর্বত চূড়া থেকে হাজার ফুট নিচে। ধীরে ধীরে অনেকটা চিলের মতো ভেসে ভেসে মর্ত্যে নেমে আসা। অদ্ভুত মাউন্টেন বাইকিং করতে দেখলাম শ্বেতাঙ্গ কিছু পর্যটককে - ডাবল প্যাডেল সাইকেল দিয়ে খাড়া পাহাড়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা!
মানালি শহরে যখন নেমে এলাম তখন বিকেল প্রায় শেষ। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। তারপর ম্যলের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। যেতে যেতে বিনোদ জানালো এখানকার রেড ওয়াইন নাকি বিখ্যাত। তাকে বললাম লিকার শপে নিয়ে যেতে। চেখে দেখলাম, সুদৃশ্য বোতলে ভরা হালকা লাল রঙের পানীয়টি সত্যিই সুস্বাদু। নেমে আসা সেই শীতল-ধূসর সন্ধ্যাকে দারুণ উপভোগ্য করে তুলল। এর মধ্যেই নোমান জানালো আজ তার ছোট মেয়ে আরিনার জন্মদিন এবং এখানেই তা উদ্যাপন করার প্ল্যান আছে। হোটেলে ফিরে নোমান আবার বেরুল ফারহানা ভাবীকে সাথে করে; উদ্দেশ্য শপিং, বার্থডে সরঞ্জাম ইত্যাদি কেনাকাটা। আমি গেলাম হোটেলের খোলা লবিতে। কিছুক্ষণ আগে পান করা ওয়াইনের আমেজ শারীরিক ক্লান্তি দূর করে মেজাজকে ফুরফুরে করে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে রাত নামছে। উত্তর পশ্চিমে বাতাস বইছে মন্থর। সেই সঙ্গে নামছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। শেষে শীতের কামড় থেকে বাঁচতে রুমে ফিরতে বাধ্য হলাম। বিশাল কাঁচে ঘেরা জানলার পর্দা সরাতেই আবছা আলোয় সামনের পাহাড়টিকে দেখলাম। নিশ্চুপ নিঃস্তব্ধ পরিবেশ। চাঁদ দেখা না গেলেও আকাশটাকে বড্ড প্রাণবন্ত লাগছে, মিটমিট করছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র! নির্ভেজাল এই প্রকৃতিতে নিজেকে হারালাম কিছুক্ষণের জন্যে। রাত নয়টার দিকে নোমানরা ফিরলে হোটেলের ডাইনিং -এ ডিনারে গেলাম। প্রথমে কেক কেটে, বেলুন ফুটিয়ে আরিনার জন্মদিন উদযাপন করা হলো। ইসাবা আর কান্তম-ই মজা করলো বেশি। পরে নোমানের সৌজন্যে স্পেশাল ডিনার।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল উত্তর হিমাচলের আরেকটি জেলা ধর্মশালা। মানালি থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫০ কি.মি.। পাহাড়ি পথ, প্রায় ৮/৯ ঘণ্টার জার্নি। পাইন ও দেবদারুর সবুজে ঘেরা এই শৈলশহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে হিমালয়ের তুষার আবৃত সুউচ্চ শৃঙ্গ ধৌলাধার। জানা যায়, পাঞ্জাবের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর ডেভিড ম্যাকলয়েড ১৮৪৮ সালে এই শহরের পত্তন করেন। ম্যাকলয়েড সাহেবের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবেই এই শহরের নামকরণ হয় ম্যাকলয়েড গঞ্জ। ১৯০৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে পরিত্যক্ত হয় এই নগরী। পরে চীন কর্তৃক তিব্বত অধিগৃহীত হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসো তাঁর কিছু অনুগামীসহ গোপনে দেশত্যাগ করে এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দালাই লামার অনুসারী গাংচেন কিশয়াং, যোগীবাবা, গমরু, হিরু, ভাগসু, ধরমকোট ও নাদি সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমশ ভিড় করতে থাকে এখানে। ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে এই শহর। বর্তমানে দুই থেকে তিন হাজার তিব্বতী উদ্বাস্তু ও সমান সংখ্যক তিব্বতী ভিক্ষুর বাস এখানে। দুটি ভাগে বিভক্ত এই শহরের উপরের অংশকে আপার ধর্মশালা এবং নিচের অংশকে লোয়ার ধর্মশালা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক ধর্মশালায় ভিড় করে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে। অনেকে দালাই লামার সাথে সাক্ষাৎ, বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও শিক্ষা লাভের আশায় এখানে আসেন। এখানে বেশ কয়েকটা আধ্যাত্মিক যোগ-কেন্দ্রও আছে।
মানালি থেকে মান্ডি হয়ে যখন আপার ধর্মশালায় পৌঁছলাম তখন রাত দশটা। পথে ঝাটিং গ্রি, যোগীন্দ্রনগর, পালামপুর নামক বিভিন্ন পাহাড়ি জনপদ ও শহর অতিক্রম করলাম। অতি সংকীর্ণ, খাড়া ও প্যাঁচানো সড়কপথটি যেখানে শেষ হলো তার অদূরেই আমাদের জন্যে বুকিং করে রাখা হোটেল। দীর্ঘ জার্নির ধকলে সকলেই বেশ ক্লান্ত। কিন্তু হোটেলে ঢুকেই ঘর দেখে বিরক্ত হলাম। খানিক বাদানুবাদের পর হোটেল বদলিয়ে দিতে বাধ্য হলো এজেন্ট। মিনিট তিনেকের দূরত্বের যে হোটেলটিতে আমরা উঠলাম তা মোটামুটি চলনসই।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলে হঠাৎ মনে হলো সময় যেন স্থির হয়ে আছে। বিছানায় শোয়া আমি, শুধু পায়ের ওপরে যে জানালাটা চোখে পড়ছে, সেখানে একটুকরো চারকোণা আকাশ দেখতে পেলাম, ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে সেখানে। টুম্পাকে না জাগিয়ে নিঃশব্দে হোটেলের বারান্দায় এলাম। রাতের অন্ধকারে খেয়ালই করিনি কোথায় এসে উঠেছি। কিন্তু এখন যা দেখলাম তাতে গতরাতের সব তিক্ততা ঘুচে গেল। গাঢ় সবুজ পাইনবন তার ঠিক ওপরে বরফ আবৃত এক বিশাল পর্বত দাঁড়িয়ে আছে যেন আমার জন্যে। অভূতপূর্ব এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ধীরে ধীরে আলো ফুটছে আর উত্তুঙ্গ ধৌলাধার পর্বত শৃঙ্গ ক্রমশ রক্তিম থেকে সোনালি বর্ণ ধারণ করছে। প্রাকৃতিক এই নৈসর্গতায় নিজেকে খুব সাদামাটা ও তুচ্ছ মনে হলো। মনে মনে পাহাড়ি গভীর অরণ্যের মাঝে গড়ে তোলা এই রিসর্টের স্থপতির প্রশংসা না করে পারলাম না। এতক্ষণ টের না পেলেও প্রচণ্ড শীতের এক ঝলক হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। রুমে ঢুকে জ্যাকেট চড়িয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল ছেড়ে। দুর্লভ এই প্রকৃতিকে একটু কাছ থেকে অনুভব করতে চাই! রিসর্টের সামনের পায়ে চলা পথটিই ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে শহরের দিকে। তার ঠিক উল্টো দিকের পথটি ধরলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা একটি ক্ষীণ স্রোত ঠিক নালার মতো আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করেছে পথটিকে। পারাপারের জন্যে সুদৃশ্য এক কালভার্টও রয়েছে। ঘন পাইনবন ক্রমশ খাড়া পাহাড়ের গায়ে মিশেছে এমনভাবে যে মাটির অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সূর্য উঠে এলো শৃঙ্গের মাথায়। আরও প্রায় মাইলখানেক হেঁটেও সুস্পষ্ট কোন ট্র্যাক না পেয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। এই যাওয়া আসার পথে বেশ কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ যুবক-যুবতী ও তিব্বতী-ভিক্ষুর দেখা পেলাম।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে সবাইকে নিয়ে শহরে নেমে এলাম। সংকীর্ণ পরিসরে ছোটখাট একটি বিপনি কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সিকি মাইল আয়তনের জায়গার মধ্যেই। অনেকগুলো দোকানপাট এরই মধ্যে খুলে গেছে আর তা দেখে ফারহানা ভাবি ও টুম্পা আনন্দে আটখানা। কতক্ষণ এই দোকানে, কতক্ষণ ওই দোকানে ছোটাছুটি করছে। বিপণির এক পাশে পথের ওপর এক স্থানীয় মহিলাকে দেখলাম ট্যুরিস্টদের গায়ে উল্কি আঁকতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বিভিন্ন প্রকার উল্কির ধরণ ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি। দু'ঘণ্টার মাথায় বিনোদ এসে জানালো ডালহৌসির উদ্দেশ্যে আমাদের এখনই রওনা দিতে হবে নতুবা পৌঁছতে পৌঁছতে গতকালের মতো রাত হয়ে যাবে। ধর্মশালা যখন ছাড়ছি তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মিনি সুইজারল্যান্ড হিসেবে খ্যাত ডালহৌসির খাজিয়ার। ধর্মশালা থেকে বাই পাস রোড ধরে শাহপুর, সেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে নূরপুর। ছোট ছোট জনপদ লাহরু, টুনুহাটি দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে আয়তনে সংকীর্ণ ও পৃথক পাহাড়ি সড়ক ধরে ডালহৌসি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা তিনটে।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে নয় হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ডালহৌসি পাঁচটি শৈলশিখর নিয়ে গঠিত। চতুর্দিকে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আক্ষরিক অর্থে স্থানটিকে ভূস্বর্গে পরিণত করেছে। শহরের চারদিকে নয়নাভিরাম সবুজ, তার মাঝে স্কটিশ ও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যে নির্মিত বাংলো আর গীর্জা স্থানটিকে দিয়েছে মার্জিত লাবণ্য। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহরটিতে ওঠার পথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেখা মিললো। কিছুদুর এগোতেই নজরে এলো ভারতীয় সেনানিবাস। অনেকগুলো প্রাচীন মন্দিরের চূড়াও দৃষ্টিগোচর হলো যাদের গন্তব্য পথ কঠিনতম পাহাড়ি ঢালে নির্মিত। তীক্ষ্ণ বাঁকগুলো সত্যিই দুর্গম।
ডালহৌসি প্রাচীন চাম্বা পার্বত্য রাজ্যের (বর্তমান হিমাচল প্রদেশের জেলা) প্রবেশ পথ। খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এক সুপ্রাচীন রাজ বংশের শাসনাধীন এই রাজ্য হিন্দু সংস্কৃতি, শিল্পকলা, মন্দির ও হস্তশিল্পের জন্যে বিখ্যাত। চাম্বা এই সংস্কৃতির কেন্দ্র স্থল। এই রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ভারসৌর গদ্দি ও গুজর উপজাতির বাসভূমি। বেশিরভাগ মন্দিরই খ্রীষ্টিয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি খাজিয়ারে গিয়ে পরে ডালহৌসিতে ফিরে কোনো হোটেলে থাকা। কিন্তু খাজিয়াদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের এতটাই বিমোহিত করলো যে এখানে থাকাই মনস্থ করলাম। হোটেল ভাড়া বেশ চড়া এখানে, তাই শিবমন্দির কর্তৃক পরিচালিত অপেক্ষাকৃত একটি কম ভাড়ার হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হলো। পাইন ও ফারের সমারোহ তিন দিকের পাহাড়ে, অন্যদিকে চাম্বা ভ্যালির নীচু উপত্যকা। হোটেলের সামনেই পিচঢালা একমাত্র রাস্তাটি সেতুবন্ধন রচনা করেছে অন্যান্য জেলার সাথে।
স্নান শেষে সবাই ফ্রেশ হয়ে মন্দির দর্শনে বেরুলাম। হোটেলের ঠিক পেছনেই মন্দিরের খোলা চাতালে ত্রিশূলধারী ব্রোঞ্জের শিবমূর্তিটি দেখে একাধারে চমৎকৃত ও বিস্মিত হলাম সবাই। প্রায় এগারতলা সমান উচ্চতার মূর্তিটির নির্মাণশৈলী এত নিখুঁত ও চমৎকার যে এর সঠিক শৈল্পিক মান অনুধাবন করা কঠিন। এরপর রওনা হলাম খাজিয়ারের মূল আকর্ষণ গ্রিন ফিল্ডে। সেখানে আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। চারপাশে ঘন সারিবদ্ধ ফারগাছের মাঝে নয়নাভিরাম সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সুবিশাল ময়দান। আয়তনে যা চারটি ফুটবল স্টেডিয়ামের সমান। মুহূর্তেই মনে হলো সত্যিই বুঝি সুইজারল্যাণ্ডের মাঠ এটি! জায়গাটি মূলত মালভূমিই। মাঠের একপাশে বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলার আয়োজনসহ দু'তিনটি রেস্তোরাঁ চোখে পড়লো। কান্তমকে কোল থেকে নামাতে অতি পরিচিত জায়গার মতোই খোলা মাঠে দৌড়তে শুরু করলো। প্রান্তরের বিশালতা যেন খুদে এই শিশুর মনকেও আনন্দে বিহ্বল করে তুলেছে। সে ছুটছে তো ছুটছেই। খানিকপর তার সাথে যোগ দিল আরিনা ও ইসাবা। বাচ্চাদের এই প্রাণোজ্জ্বল উচ্ছলতা মনকে প্রসন্ন করে তুললো। বৃত্তাকার মাঠের মাঝখানটি ঈষৎ ঢালু, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে অস্থায়ী এক ঝিলের সৃষ্টি হয়েছে। ঝিলের উপর স্কটিশ কায়দায় নির্মিত কাঠের ছাউনি ঘেরা মাচায় দর্শনার্থীদের বসবার ব্যবস্থা। পড়ন্ত বিকেলে মিষ্টি রোদ্দুর, খানিকটা শীত-শীত আমেজ, থেকে থেকে দেওয়া ফুরফুরে হাওয়া এসব কিছুই প্রশান্তিতে ভরে তুলছে আমাদের মনকে। গত পাঁচদিনের ক্রমাগত সড়কপথের জার্নিতে বিপর্যস্ত আমাদের এটুকু যেন অবশ্য প্রাপ্য ছিল। জুতো খুলে মাঠের সেই মনোরম সবুজ ঘাসে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। অনেকটা যেন জীবনানন্দ...। তারপর সেই নরম ঘাসের উপরই বসে সূর্যাস্তের প্রতীক্ষায় থাকলাম। রক্তিম আভায় দিগন্ত ভাসিয়ে দিয়ে সূর্য পাটে গেলে সবাই মিলে নিকটস্থ রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। টোস্ট ও চা সহকারে বৈকালিক নাস্তা সারলাম। তারপর গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত সেই সন্ধ্যার আলোয় পায়ে হেঁটে হোটেলের পথ ধরলাম।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নোমান, আমি, টুম্পা ও ফরহানা ভাবী চারজনে মিলে মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণের জন্যে। হোটেলের বৈদ্যুতিক আলোয় প্রতিফলিত হয়ে চারপাশের অন্ধকার অরণ্যকে বড্ড রহস্যময় মনে হলো। লিকার শপ থেকে কিনে আনা ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে গল্প হলো অনেকক্ষণ।
মাঝরাতে প্রচন্ড দুলুনিতে হঠাৎ জেগে উঠলাম। মনে হলো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। খাট, ড্রেসিং টেবল, ঘরসহ পুরো হোটেল দুলছে এপাশ-ওপাশ। বাতাসের শো-শো প্রবল গর্জন, সেই সাথে অন্ধকারকে সম্পূর্ণ চিরে ফেলা মুহুর্মুহু বিজলির তীব্র আলো। মনে হলো কেয়ামত বুঝি আসন্ন! ভয়ে আমার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। অন্ধকার সেই রুমে আমরা অতি অসহায় তিনটি প্রাণী। বাইরে টর্নেডো তার দোর্দণ্ড দাপটে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে চারপাশ। ৯১'-এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়লো আমার। ঝড়ের শুরুতেই বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ লাইন উড়ে গেছে আগেই, তাই বিদ্যুৎহীন পুরো হোটেলটাই অন্ধকার পুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এক পর্যায়ে ঝড় এমনই রূপ নিলো যে ভাবলাম হায়! ঘরে বুঝি আর ফেরা হলো না, ভ্রমণ পথের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে জীবন যাত্রাও বুঝি ফুরিয়ে গেল এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে একসময় ভোরের আলো ফুটলো। এর মধ্যে ঝড় তার তাণ্ডব থামিয়েছে। রুমের দরজা খুলতেই প্রবল ঠাণ্ডা ধাক্কা মারলো - বাইরে যেন হিম-যুগ। দ্রুত মাঙ্কি ক্যাপ ও জ্যাকেট চাপিয়ে বাইরে এলাম। বেরিয়ে দেখি বড় বড় পাইনগাছ মূল শুদ্ধ উপড়ে পড়ে আছে সামনের রাস্তা জুড়ে। ছেঁড়াপাতা ও গাছের ঢাল অবিন্যস্ত চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গত সন্ধ্যা থেকেই মন্দিরে বাৎসরিক উৎসবের আয়োজন চলছিল। আয়োজকেরা সেই ভোরবেলাতেই খুঁজতে বেরিয়ে গেল ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া লোহার হাঁড়ি-কড়াই। কয়েকটির সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো ততক্ষণে পাহাড়ের গভীর খাদে নিমজ্জিত।
ব্রেকফাস্ট সেরে নতুন জায়গা দেখতে বেরুলাম। কথা ছিল ভিয়ার হিলে যাবো। কিন্তু সময় ও দূরত্ব বিবেচনা করে তা বাতিল করলাম। পরিবর্তে খাজিয়ারের অন্যান্য দ্রষ্টব্য দেখতে বেরুলাম। ছোট থালা আকৃতির ছবির মতো সুন্দর এই পাহাড়ি শহর বিশ্বের ১৬০টি দ্রষ্টব্যের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ঘন পাইন ও দেবদারুর সবুজ চারদিকে পিচ ঢালা কালো রাস্তার দু'পাশে ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষ কাঠের ঝোলানো টবে অর্কিডের চাষ করেছে। পশ্চিমা পর্যটকদের ভাষায় এর সৌন্দর্য "Panoramic & Breathtaking "। সুইস রাষ্ট্রদূত ১৯৯২ সালের ৭ই জুলাই খাজিয়ারকে অফিসিয়ালি মিনি সুইজারল্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সুদূর সুইজারল্যাণ্ড থেকে একখণ্ড পাথর এখানে এনে মূর্তি গড়া হয়েছিল। খাজিয়ারের অদূরেই আরেকটি অপেক্ষাকৃত সমতল চূড়া কালাটপ। বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত এই জায়গায় সহজেই হরিণ, ভাল্লুক, চাইকি অনেক সময় হিমালয়ান চিতারও দেখা মেলে।
দুপুর বারোটা নাগাদ হোটেলে ফিরে স্নান সেরে সবাই তৈরি হলাম। একটার মধ্যে লাঞ্চ সারলাম। আধঘণ্টা বিশ্রাম শেষে পৌনে দু'টো নাগাদ গাড়িতে উঠে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য পাঞ্জাবের পাঠানকোট রেল স্টেশন। সেখান থেকে রাত দশটায় দিল্লিগামী ট্রেন ধরে নয়াদিল্লি। আমাদের অরণ্যবাস মোটামুটি শেষ। শরতের এই দুপুর যেন সবার মনের মধ্যে একটা ঘোর ঘোর ভাব সৃষ্টি করেছে। ভুতুড়ে নিশব্দতায় দেবদারু ও পাইনবন। সবারই মন খারাপ।
শুরু হলো ফেরা। পাহাড় থেকে পাহাড় হয়ে ক্রমশ নেমে চলেছি সমতলের উদ্দেশ্যে। খাজিয়ার থেকে লাহরু হয়ে নুরপুর। সেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে চাক্কি, তারপর পাঠানকোট শহর। পাঠানকোট মূলত ভারতীয় সেনানিবাস ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সকাল সাড়ে সাতটায় পুরানো দিল্লি স্টেশনে পৌঁছলাম। রাতে দূরন্ত এক্সপ্রেস। পরদিন বেলা দেড়টায় কলকাতায় ঢুকলো ট্রেন। শেয়ালদা স্টেশনে বেরিয়েই দেখি বৃষ্টি। বৃষ্টি! বৃষ্টির বল্লমের শরশয্যায় কলকাতা। এরই মধ্যে কয়েক জায়গায় পানি জমে গেছে। প্রবল বৃষ্টিতে যেন ভেঙে চুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে কলকাতা। একটু বাদেই শুনলাম পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ পুরো পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ ডেকেছে সিটু। একে তো বৃষ্টি তার উপর পরিবহন ধর্মঘট। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বৃষ্টি একটু থেমে এলে হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে এলো স্টেশন চত্বর ছেড়ে। অথচ সরকারি-বেসরকারি বাস, অটো রিক্সা, যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি সব বন্ধ। উদ্বেগ ও দুঃশ্চিন্তায় মাথা খারাপের অবস্থা হলো। সাদা রঙের কয়েকটি প্রাইভেট অ্যাম্বাসাডরকে দেখলাম সুযোগ সন্ধানীর মতো তিন চার কিলোমিটারের ভাড়া হাঁকছে পাঁচশো থেকে সাতশো রুপি। আমাদের এই জায়গায় দাঁড় করিয়ে নোমান গেল গাড়ির খোঁজ করতে।
চারদিকে টিভি সাংবাদিক ও পত্রিকা অফিসের ফটোজার্নালিস্টদের ভিড়। ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদেরও ফটাফট কয়েকটি ছবি তুলে নিয়ে গেল তাদের কয়েকজন। দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অনেকটা দেবদূতের ভঙ্গিতে নোমান উপস্থিত হয়ে বললো, গাড়ি একখানা পাওয়া গেছে। শুনে ভীষণ খুশি সবাই। লাগেজ ধরে টানা হেঁচড়া করতে করতে নোমানের পিছন পিছন গিয়ে দেখি তিন-চাকার মাল টানা একখানা রিক্সা ভ্যান দাঁড়িয়ে। নোমানকে জিজ্ঞেস করলাম গাড়ি কই! সে হাত তুলে ভ্যান গাড়িটিকেই নির্দেশ করে বললো আজকে এটাই আমাদের মার্সিডিস কার। অগত্যা মাল পত্তর সব তুলে তার ওপরেই সবাই বাবু সেজে বসলাম। গন্তব্য মারকিউস স্ট্রিটের সেই হোটেল ওরিয়েন্টাল।
পরদিন দুপুর বারোটায় সোহাগ পরিবহনে রওনা হয়ে একদিন পর বাংলাদেশ পৌঁছলাম।
~ হিমাচল প্রদেশের তথ্য ~ হিমাচল প্রদেশের আরো ছবি ~
মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত তুহিনের বেড়ানোর নেশা ছোটবেলা থেকেই। বড় হয়ে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ফটোগ্রাফিও। বই পড়া ও গান শোনার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করছেন বেশ কয়েকবছর ধরেই।