-->
আমাজন বা আমাজোনিয়া (Amazonia) পৃথিবীর বৃহত্তম ট্রপিকাল রেনফরেস্ট। দঃ আফ্রিকায় আমাজন নদীর অববাহিকাতে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন একর আয়তনের এই অরণ্য বিস্তৃত মূলতঃ ব্রাজিল ছাড়া আরও আটটি দেশে। দেশগুলি হল -পেরু, কলোম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়না, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গায়না। জীববৈচিত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আমাজন রেনফরেস্টে বসতি নানান প্রজাতির গাছ গাছালি, রংবেরঙের পাখি আর লক্ষাধিক ধরণের পোকামাকড়ের। এখানের জল-জঙ্গলের বাসিন্দা বিভিন্ন প্রকারের চতুষ্পদ প্রাণী, বিরল প্রজাতির সরীসৃপ ও নানা রকমের মাছ। ব্ল্যাক কাইমন বা কালো কুমীর এই জঙ্গলের বিশেষত্ব। হিংস্র প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে জাগুয়ার, কুগার ও বহু জনশ্রুত আনাকোন্ডা। আমাজনের জলে আছে ইলেকট্রিক ইল এবং পিরানহা। বিষাক্ত পোকামাকড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ট্যারেন্টুলা ও ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। এই ভ্যাম্পায়ার ব্যাট কামড়ালে জলাতঙ্ক হতে পারে। বিরল প্রজাতির গাছ গাছালি, বিভিন্ন রকমের পশু ও পাখি এবং অজস্র পোকামাকড়ের বিচরণভূমি এই আমাজন রেন ফরেস্টের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য ভীষণভাবে আকর্ষণ করে পর্যটকদের।
সভ্যতার আলো প্রবেশ করেনি আমাজনের গভীর জঙ্গলের কোন গাছের পাতার ফাঁকে। আছে কেবল নিশ্ছিদ্র অকৃত্রিম আদিমতা। স্থানীয় নৌকায় করে আমাজনের জল পেরিয়ে পর্যটকরা যখন জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছান তাঁদের মনপ্রাণ অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় শিহরিত হয়ে ওঠে। নৌকায় চড়ে বিহারের সময়ে চোখে পড়বে ব্ল্যাক কাইমন। অনেক সময়ে এদের কোনটিকে নৌকায় তুলে কায়দা করে ধরে সুন্দর ছবি তোলা যায়। তবে জ্যান্ত কাইমনকে চেপে ধরে রাখার কৌশল না জানা থাকলে বাগে পেলে কাইমন এমন লেজের ঝাপটা দেবে যে শখের ছবি তুলতে গিয়ে নদীর জলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই কাইমনের সঙ্গে ছবি তোলার সময় পর্যটকদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
রঙের স্বর্গ আমাজনের জঙ্গল। মাথার ওপর ঘন সবুজ গাছের আচ্ছাদন, সূর্যের মুখ দেখাই যায় না বললে চলে। তারমধ্যে রংবেরঙের পাখিদের আনাগোনা। সবথেকে নজরকাড়া হল স্কারলেট ম্যাকাও পাখিদের কীর্তিকলাপ। কখনও তারা এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে যুগলে আবার কখনও নিছক গাছের ডালে বসে মেতে আছে অলস আড্ডায়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে আরও কত অজানা অচেনা জীবজন্তু আর গাছগাছালি। গাছে ওঠা ব্যাঙ বা ট্রি ফ্রগের রঙ একেবারে গাছের পাতার মতই সবুজ। এই ব্যাঙ লাফিয়ে গাছে ওঠার ক্ষমতা রাখে।
ফরেস্ট ট্রেকিং করতে হলে একজন অভিজ্ঞ গাইডের প্রয়োজন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং করতে গেলে দুহাতে গাছপালা ঠেলে সরিয়ে পথ করে নিতে হবে, নির্দিষ্ট পথ বলে কিছু নেই। পথে পোকামাকড়ের উপদ্রব আর ভ্যাপসা গরম সঙ্গী হবে। এরই মধ্যে ট্রেকিং করতে করতে দেখা পাওয়া যেতে পারে ম্যাজিক ট্রির। এই গাছ থেকে বেরোয় এক সম্মোহনকারী সুগন্ধ। মনে হবে জঙ্গলের মধ্যে কে যেন একমুঠো সুবাসিত আতর ছড়িয়ে দিয়েছে, শ্রান্ত পথিককে মুগ্ধ করার জন্য। এর খেজুর গাছের পাতার মত পাতাগুলি গ্রামবাসীদের ঘর ছাইতে কাজে লাগে।
আমাজন নদীর বুক থেকে সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতাও আসাধারণ। সেক্ষেত্রে কাকভোরে ডিঙি-নৌকায় চেপে যেতে হবে ব্ল্যাক রিভারে। একই সঙ্গে ফেরার পথে উপভোগ করা যাবে ডলফিনদের জলকেলি।
যাদের মাছধরার নেশা আছে তারা একদিন ফিশিং-এ যেতে পারেন। মাছ ধরার জন্য আমাজন নদীতে নির্দিষ্ট স্থান আছে যেখান থেকে মনের সুখে মাছ ধরতে পারা যায়। তবে হ্যাঁ, ইকোলজিকাল ব্যালান্সের কথা মনে রেখে ছিপ দিয়ে ধরা সেই মাছগুলি আবার নদীবক্ষে ফিরিয়ে দিতে হবে -হোটেলের ঘরে নিয়ে গিয়ে ভেজে খাবার লোভ সম্বরণ করেই।
ইচ্ছা থাকলে দেখে নেওয়া যায় আমাজনের জঙ্গলের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু আদিবাসী গ্রাম। আদিবাসী গ্রামে ছোট ছোট পরিবার। প্রত্যেক গ্রামে জনসংখ্যা গড়ে পঞ্চাশের নীচে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম। শিশুরা সঙ্গীতের ভক্ত। বাদ্যযন্ত্রেরও অনুরাগী। আদিবাসী গ্রামে আছে ডাক্তার ও শিক্ষক শিক্ষিকা। এই গ্রামগুলির শিশুরা এখনো যন্ত্রসভ্যতার পরশ পায়নি -তবু সবাই পড়াশোনা করতে ভালোবাসে। হয়তো বার্গার, কোল্ড ড্রিংকস এবং সভ্য জগতের আরো অনেক কিছু আনুষাঙ্গিক পাওয়া যায় না এই গ্রামে, কিন্তু মায়া মাখানো গ্রামগুলিতে আছে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মানবিকতা যা বাইরের জগতে এখন দুর্লভ।
বর্তমানে আমাজনের জঙ্গলে প্রধানতম সমস্যা ডিফরেস্টেশন। এর অন্যতম কারণ বনে আগুন লাগা আর সভ্যতার বিস্তারের পাশাপাশি মানুষের লোভ। কাঠপাচারকারীরা নির্মমভাবে গাছ কেটে নিঃশেষ করে দিচ্ছে আমাজনের জঙ্গল। গত কুড়ি বছরে কয়েক লক্ষ কিলোমিটার অরণ্য মুছে দিয়ে তৈরি হয়েছে গবাদি পশুর চারণভূমি। পরিবেশবিদদের মতে এই জঙ্গলের আয়তন হ্রাস পাওয়ায় বহু গুণ বেড়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর হার।
যাওয়াঃ আমাজনের জঙ্গলের যাবার প্রধান উপায় ব্রাজিলের বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে মানস (Manaus) যাওয়া। পেরু দিয়েও আমাজনের জঙ্গলে যাওয়া যায়। তবে মানস দিয়ে যাওয়াটাই বেশি প্রচলিত। নিগ্রো আর সলিমোস নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত মানস শহর। আমাজোনিয়ার রাষ্ট্রগুলির ক্যাপিটাল বলা চলে এই শহরটিকে। উত্তর ব্রাজিলের প্রাণকেন্দ্র এই শহরে সারা বছরই আমাজনের জঙ্গলে ঘোরায় আগ্রহী পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।
~ ভ্রমণ কাহিনি - আমাজনের জলে-জঙ্গলে ~