চতুর্দশ শতকের গোড়ায় জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল মেলাক্কা - তার মশলার খ্যাতি পৌঁছেছিল সুদূর ইউরোপেও। এর অনেক আগে থেকেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বিদেশি নাবিক আর ব্যবসায়ীরা আরব, শ্যামদেশ প্রভৃতি কাছে-দূরের দেশ থেকে এসে ভিড় জমিয়েছিল দক্ষিণ-চিন সমুদ্রের বুকে বন্দরনগরী মেলাক্কায়। বাদ যায়নি ইউরোপীয় বণিকরাও। ব্যাবসার সূত্রে এসে কলোনিস্থাপনের চিরাচরিত ইতিহাসের গল্প এখানেও। প্রথমে পর্তুগিজ, তারপরে ডাচ এবং সর্বশেষে হাতবদল হয়ে ক্ষমতা দখল করে ব্রিটিশরা। তখন ব্রিটিশসাম্রাজ্যে সত্যিই সূর্য অস্ত যায় না।
ভারত স্বাধীন হওয়ার দশবছর পর ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট মালয়েশিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুয়ানকু আবদুল রহমান ঘোষণা করলেন ব্রিটিশ শাসনের অবসান - স্বাধীন মালয়েশিয়ার জন্ম হল। ১৯৬৩ সালে সাবা আর সারওয়াক যোগ দেয় মালয়েশিয়ার সঙ্গে। সিঙ্গাপুরও সেইসময় মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৯৬৫ সালে আবার আলাদা হয়ে যায়।
প্রাচীন ঐতিহ্য আর ঝকঝকে আধুনিকতা নিয়ে আজকের মালয়েশিয়া। পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার, বৃহত্তম গুহা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উচ্চতম পর্বতমালার দেশ। নীল সমুদ্র, রুপোলি বালুকাবেলা, সুউচ্চ পাহাড়, ট্রপিকাল রেনফরেস্ট, রহস্যময় গুহার সারি, প্রবালদ্বীপ, নদী আর হ্রদের মেলা নিয়ে বহু বৈচিত্রের রূপকথা। ফুল, অর্কিড, নানা বন্যপ্রাণী আর পাখির রাজ্য। স্থানীয় মালয়ালিদের জনস্রোতে মিশে গিয়েছে ভারতীয়, চিনা, জাপানি ও ইউরোপীয় নানা দেশের মানুষ ও তাদের বহুবর্ণের সংস্কৃতি। জনস্রোতে হাঁটতে হাঁটতে ' মালয়েশিয়া - ট্রুলি এশিয়া ' - মালয়েশিয়া ট্যুরিজমের এই জিংগল বড়ো বেশি সত্যি মনে হয়।
কুয়ালালামপুর (Kualalumpur) - রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর দিয়েই মালয়েশিয়া বেড়ানো শুরু করা যায়। সময়টা ১৮৫৭ সাল। ভারতে তখন সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। কুয়ালালামপুরও ব্রিটিশ রাজত্বেরই অধীন। একদল চিনা ভাগ্যান্বেষী ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন এই অঞ্চলে। ব্রিটিশদের অনুমতি নিয়ে জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর কুয়ালালামপুর। যদিও আজকের কর্মচঞ্চল, ঝকঝকে আধুনিক শহরের দিকে তাকালে একথা বিশ্বাস করাই শক্ত।
আসলে বোধহয় মালয়েশিয়া দেশটার মধ্যেই একটা আপন করে নেওয়ার স্বভাব আছে। সেটা আরও বোঝা যায় কুয়ালালামপুর শহরটার বিচিত্র চরিত্রে। শিল্প-সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, খাবারদাবার সবেতেই ভারতীয়, চিনা, মালয়ালি, ইসলাম আর ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের এক অনন্য মিশ্রণ। পুরোনো ঔপনিবেশিক স্থাপত্যগুলির পাশেই গড়ে উঠেছে ঝকঝকে মার্কেট প্লাজা, আবার কোথাওবা হর্কাস কর্নার। চৌকিট বাজারের মন্দির আর মসজিদ এলাকা পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোলেই চেনা চেনা দৃশ্যগন্ধ আর পানওয়ালাদের নিয়ে লিটল ইন্ডিয়া(Little India)।
শহরের সেরা আকর্ষণ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু (১,৪৮৩ফুট) পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার(Petronas Tower)। স্টিলের তৈরি ঝকঝকে এই টাওয়ার দুটির চূড়া শহরের নানা জায়গা থেকেই দৃশ্যমান। ৮৮ তলা টাওয়ারের ৪১ ও ৪২ তলা জুড়ে স্কাইব্রিজ যুক্ত করেছে টাওয়ার দুটিকে। স্কাইব্রিজ থেকে অনেকটা নীচে শহরের প্যানোরমা অসাধারণ। বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম ও এশিয়ার উচ্চতম টেলিকমিউনিকেশন টাওয়ার মেনারাও রয়েছে এখানেই, বুকিট নানাস এলাকায়। এই টাওয়ারটির উচ্চতা ৪২১ মিটার। টাওয়ারের উপরে ভিউয়িং ডেকে সাজানো টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে কুয়ালালামপুর শহর দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। রাত্রিবেলায় অন্ধকারে ভেসে থাকা উজ্জ্বল লাল-নীল বলের মতো টাওয়ারের চূড়াটি খুব সুন্দর লাগে।
শহরের হৃৎপিন্ড মারডেকা স্কোয়্যারের(Merdeka Square) বিশাল চত্বরের মাঝখানে রয়েছে বিশ্বের উচ্চতম (১০০ মিটার) পতাকাদন্ড। ‘মারডেকা’ কথার অর্থ স্বাধীনতা। স্বাধীন মালয়েশিয়ার জাতীয় পতাকা এখানেই প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে এখানে জমকালো প্যারেড হয়। মারডেকা স্কোয়্যারের আশেপাশেই কুয়ালালামপুরের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানান স্থাপত্যগুলি রয়েছে। সুলতান আবদুল সামাদের প্রাসাদটি একসময়ে ব্রিটিশ শাসকদের অফিস হয়ে উঠেছিল। আজ সেখানেই বসেছে সুপ্রিম কোর্ট। মারডেকা স্কোয়্যারের বিপরীতে ১৯০৯ সালে তৈরি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম(National History Museum)। পাশেই লাইব্রেরি। লাইব্রেরির উল্টোদিকে টেক্সটাইল মিউজিয়াম। মারডেকা স্কোয়্যারের একপাশে রয়্যাল সেলাঙ্গার ক্লাবের গায়ে ব্রিটিশ আমলের আরেক অসাধারণ নজির সেন্ট মারিজ ক্যাথিড্রাল। ১৯০৯ সালে ক্ল্যাং ও গোমবাক নদীর সঙ্গমে গড়ে উঠেছিল অপরূপ স্থাপত্যের জামেক মসজিদ। ব্রিটিশ স্থপতি আর্থার বেনিসন হারবাক ভারতের মুঘল মসজিদগুলির আদলে এটি নির্মাণ করেন। মালয়েশিয়ায় ক্ল্যাং-গোমবাকের তীরে এই অঞ্চলেই প্রথম টিন পাওয়া যায়। যে টিনের খোঁজে একদিন বসতি গড়েছিলেন চিনা ভাগ্যান্বেষীরা। স্বাভাবিকভাবেই মালয়েশিয়ায় প্রথম সমাধিক্ষেত্রটিও এখানেই। স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে প্রাচীন এই মসজিদটি এখনও আদরণীয় হলেও অধিক জনপ্রিয় পরবর্তীকালে মালয় ও মুসলিম স্থাপত্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মসজিদ নেগারা। ইসলামিক স্থাপত্য ও আর্ট সম্বন্ধে আগ্রহীরা ঘুরে নিতে পারেন ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম। প্রাচীন পুঁথি, ধাতুর জিনিসপত্র, মুঘল আমলের গয়না, পোশাক প্রভৃতি নানান দ্রষ্টব্য রয়েছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিশ্বের নানান স্থানে থাকা মুসলিম স্থাপত্যের মিনিয়েচার। যার মধ্যে ভারতের তাজমহল থেকে মক্কার মসজিদ সবই রয়েছে। মিউজিয়াম সংলগ্ন দোকানটিতে সারা বিশ্বের আর্ট বইয়ের সংগ্রহ দেখার মতো। রেস্ত থাকলে কিনেও নেওয়া যায়।
কুয়ালালামপুরের প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম জে ইয়া মন্দির। প্রধান আরাধ্যদেবতা জিয়ান শি ইয়ে। তবে ভগবান বুদ্ধও পূজিত হন এখানে। চিনা সংস্কৃতির নিদর্শন কোয়াং সিউ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন টেম্পল। অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে রয়েছে চান সি সু উয়েন টেম্পল, শ্রী মহা মারিয়াম্মাম টেম্পল। মারিয়াম্মাম মন্দিরটিই এখানকার সবথেকে প্রাচীন হিন্দুমন্দির বলে মনে করা হয়। চিনামন্দিরের শান্ত পরিবেশ পেরিয়ে এসে মারিয়াম্মাম মন্দিরের গোপুরমের সামনে পৌঁছোলে কানে ভেসে আসবে পরিচিত মন্ত্রোচ্চারণ আর ঘন্টাধ্বনি। ইন্দো-ইসলামিক, ভিক্টোরিয়ান, গথিক আর আরবি শৈলীর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা আরেক চমকপ্রদ নিদর্শন দুধসাদা রঙের কুয়ালালামপুর রেলস্টেশনের বাড়িটি। স্টেশনের দক্ষিণে টিলার উপরে অপরূপ রাজপ্রাসাদ। তবে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় ছাড়া সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
ইতিহাসের অলিতে-গলিতে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শহরের মধ্যেই একটুকরো সবুজের ঠিকানায় চলে যাওয়া যায় বিভিন্ন থিমপার্ক আর সাজানো-গোছানো উদ্যানগুলিতে। মারডেকা স্কোয়্যারের পশ্চিমে ১০৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া মনোরম পিকনিক স্পট লেক গার্ডেন্স। বাগানের মাঝখানে টলটলে জলের হ্রদ তাসিক পেরদানা। লেক গার্ডেন্সের প্রধান আকর্ষণ বার্ড পার্ক আর বিপরীতে অর্কিড উদ্যান। ৮০০-রও বেশি প্রজাতির বিচিত্র অর্কিডের ঠিকানা। নানা বর্ণের রঙিন রঙিন প্রজাপতি আর বিচিত্র পোকামাকড়ের দেশ বাটারফ্লাই পার্কটিও এখানেই। মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুল ‘বুঙ্গা রায়া’ - আমাদের জবা। ‘ক্যুইন অফ ট্রপিকাল ফ্লাওয়ার্স’ নামে পরিচিত জবার নানা প্রজাতির দেখা মিলবে হিবিস্কাস গার্ডেনে।
লেক গার্ডেন্সের পাশেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম বা মুজিয়াম নেগারা। কেনাকাটার সেরা জায়গা জালান পেটলিং-এ চিনা শহর চায়নাটাউন। জমজমাট বাজার-দোকান দিনরাতই খোলা থাকে। এখানে গাড়ি ঢোকা বারণ।
শহর থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই বেশ কয়েকটি দারুণ বেড়ানোর জায়গা রয়েছে যা সফরসূচিতে রাখতেই হবে। মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরেই স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাগটাইটের প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে অপরূপ বাতু কেভ। ২৭২টি সিঁড়ি ভেঙে গুহায় পৌঁছোতে হবে। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত গুহা খোলা থাকে। কুয়ালালামপুর থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে বাতু গুহায় পৌঁছোনো যায়। ২৫ কিলোমিটার দূরে সবুজে ছাওয়া স্যাটেলাইট শহর পুত্রাজয়া। কুয়ালালামপুরের সরকারি কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বাসস্থান এখানেই। পুত্রাজয়া হ্রদকে কেন্দ্র করে সবুজ জলাভূমি তামান ওয়েটল্যান্ড। অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, পুত্রা পার্দানা পার্ক, মালয় ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। স্থানীয় হ্যান্ডিক্রাফটসেরও খ্যাতি রয়েছে পুত্রাজয়ার। কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনপথে পুত্রাজয়ায় পৌঁছোতে হবে। কুয়ালালামপুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে থিমপার্ক, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাসিনো নিয়ে ছুটি কাটানোর আইডিয়াল স্পট শৈলশহর গেন্টিং আইল্যান্ডস। কুয়ালালামপুর থেকে বাসে বা এয়ারপোর্ট কোচ সার্ভিসে গেন্টিং স্কাইওয়েতে পৌঁছোতে হবে। এরপর স্কাইওয়েতে চড়ে একেবারে হোটেলের দোরগোড়ায়। শহর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের তীরভূমির কোলঘেঁষে সবুজ দ্বীপ কুয়ালা সেলাঙ্গোর। নর্ডম্যান গ্রিনস্যাঙ্ক ও ম্যানগ্রোভ পিট্টার মতো বিরল পাখির সন্ধানে ঢুঁ মারাই যায় সেলাঙ্গোর নেচার পার্কে। নয়তো সমুদ্রের তীর ধরে পায়ে পায়ে দীর্ঘভ্রমণ। মাড স্কিপার, মাড লোবস্টার, লেপার্ড ক্যাট আর লিফ মাঙ্কির দেখা মিলতে পারে। কাঠের বোটে ভেসে পড়া যায় সেলাঙ্গোর নদীতে। কুয়ালা সেলাঙ্গোর থেকে কুয়ালা কুয়ানটান - অবিস্মরণীয় জলসফর। বাসে বা ট্যাক্সিতে কুয়ালা সেলাঙ্গোর পৌঁছোনো যায়।
মেলাক্কা (Malacca) - দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বন্দর শহর মেলাক্কার অবস্থান কুয়ালালামপুরের ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ১৫১১ সালে পোর্তুগিজদের হাত ধরে মেলাক্কাতে ইউরোপীয় উপনিবেশের পত্তন ঘটলেও বহু আগে থেকেই চিনা, ভারতীয় ও আরব নাবিকদের আনাগোনায় মিশ্র সংস্কৃতির এই শহর গড়ে উঠেছিল। চতুর্দশ শতকে সুমাত্রার রাজপুত্র পরমেশ্বর এই নগরীর পত্তন করেন। মালয়েশিয়ার বিচিত্র বর্ণময় ইতিহাসের একটা বড়ো অংশই রয়েছে মেলাক্কাকে ঘিরে।
মেলাক্কা নদীর দুই তীরেই ছড়িয়ে রয়েছে মেলাক্কা শহর। দ্রষ্টব্যস্থানগুলির অধিকাংশই অবশ্য পশ্চিমতীরে। পাথরে বাঁধানো রাস্তা জুড়ে দুপাশে অতীতের নীরব সঙ্গী হেরিটেজ বিল্ডিংগুলি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া যায় জমজমাট স্ট্রিট মার্কেটগুলিতে।
পুরোনো মেলাক্কায় সেন্ট পলের চার্চ ও দুর্গের ভগ্নাবশেষটিই ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন। যাঁরা গোয়ায় সেন্ট জেভিয়ার্সের সমাধি দেখেছেন তাঁরা ইতিহাস খুঁজতে এখানে আসতেই পারেন। ১৫৩৩ সালের ২২ মার্চ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেন্ট জেভিয়ার্সের দেহটি এখানেই সমাধিস্থ ছিল। খোলা কবরটিও রয়েছে।
প্রাচীন সেন্ট পল গির্জা থেকে ১৭৫৩ সালে পোর্তুগিজরা তাঁদের প্রার্থনাস্থল সরিয়ে নিয়ে যান নতুন মেলাক্কার মেন স্কোয়্যারে ক্রাইস্ট চার্চে। ১৮২৬ সালে এই চার্চ ব্রিটিশরা দখল করে। মেলাক্কার প্রাচীন বিশালাকায় টাউন হল বিল্ডিংটি এখন মিউজিয়াম অফ মেলাক্কান হিস্ট্রি অ্যান্ড এথনোগ্রাফি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে। মালয়েশিয়ার প্রাচীনতম চিনা বৌদ্ধমন্দির চেন হুন তেন-এর উল্টোদিকে মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ কামপুং ক্রিং। কাছেই দক্ষিণ ভারতীয় চেট্টিয়ার গোষ্ঠীর তৈরি শ্রী পোয়াত্থাবিনায়াগার মন্দির। শহরের কাছেই ওয়াটার থিম পার্ক আর কাউবয় টাউন নিয়ে গড়ে উঠেছে আফামোসা রির্সট।
সেন্ট পল পাহাড়ের পাদদেশে সুলতানেট প্যালেসের আদলে তৈরি প্রাসাদোপম বাড়িটির অভ্যন্তরে রয়েছে কালচারাল মিউজিয়াম, মেরিটাইম মিউজিয়াম ও মিউজিয়াম রাকয়াট।
কুয়ালালামপুর থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে ঘন্টা দুই-আড়াইয়ে মেলাক্কা পৌঁছোনো যায়। মেলাক্কা ও তার আশপাশ পায়ে হেঁটে বা ভাড়া করা সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। সুদৃশ্য সাজানো-গোছানো রিকশা কিংবা ট্যাক্সিতেও সওয়ার হতে পারেন। আর বাস তো রয়েইছে।
মেলাক্কা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে আয়ের কেরো। লেক, গলফকোর্স, হেলথ ক্লাব, লাক্সারি রিসর্ট আর অজস্র থিমপার্ক নিয়ে আকর্ষণীয় বেড়ানোর জায়গা। এখানকার সেরা আকর্ষণ ক্রোকোডাইল ফার্ম, মেলাক্কা জু আর রিক্রিয়েশনাল ফরেস্ট। সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত চিড়িয়াখানা খোলা থাকে।
শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট দ্বীপ পুলাউ বেসার। মেলাক্কাবাসীদের কাছে উইকেন্ড ট্যুরের আইডিয়াল জায়গা। ট্যুরিস্টদের জন্যও নীল সমুদ্র, দীর্ঘ বেলাভূমি আর জঙ্গল ট্রেল আকর্ষণীয়। মেলাক্কার উমবাই জেটি থেকে নিয়মিত ফেরি যাচ্ছে পুলাউ বেসারে।
লাং কাউয়ি (Langkawi) - কাচের মতো স্বচ্ছ সমুদ্রের জলে যখন অস্তগামী সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে - দূরে দূরে দ্বীপগুলো তখন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে - অলৌকিক রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়ে তীরভূমিতে যেখানে আজও রানি মাসুরির লৌকিক উপকথা জীবন্ত হয়ে আছে। অসাধারণ সমুদ্রতট, ঘন সবুজ জঙ্গল, চুনাপাথরের আদিম গুহা আর নানা লৌকিক গাথা নিয়ে দেশবিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু লাং কাউয়ি। মালয়েশিয়ার উত্তর সীমানায় থাইল্যান্ডের কাছে অবস্থিত লাং কাউয়ি দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর কুয়া। কুয়ার আশপাশে ছড়িয়ে থাকা সমুদ্রতটগুলির মধ্যে পানতাই সেশং, পানতাই কক আর পানতাই তানজুংরু অন্যতম।
পানতাই ককের সমুদ্রতীরে রয়েছে ঐতিহাসিক সামার প্যালেস। এখানে ‘আন্না অ্যান্ড দ্য কিং’ চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছিল। সেটটি এখনো একইরকম সাজানো আছে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকত পানতাই তানজুংরু বা ‘ক্যাসুরিনা বিচ’। ভাটার সময় সমুদ্রতটের গভীরে হেঁটে বেড়িয়ে বা চুনাপাথরের গুহায় স্ট্যালাগমাইট-স্ট্যালাগটাইটের অপরূপ ভাস্কর্য প্রত্যক্ষ করে কাটিয়ে দেওয়া যায় সময়। নৌকা করে পাড়ি দেওয়া যায় কিলিম নেচার পার্কের(Kilim Nature Park) ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। আইল্যান্ড ক্রুইজে ল্যাং কাউয়ির আশেপাশের অন্যান্য ছোটো-বড়ো দ্বীপগুলো বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
এশিয়ার বৃহত্তম অ্যাকোয়ারিয়াম - ওশানারিয়ামটিও রয়েছে লাং কাউয়িতেই - পান্তাইসেনাং-এ। প্রায় ৫,০০০ প্রজাতির সমুদ্রিক ও মিষ্টিজলের প্রাণী রয়েছে এই বৃহৎ অ্যাকোয়ারিয়ামে।
লাং কাউয়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে পুলাউ পায়ার, পুলাউ সেগানটাং, পুলাউ কাকা ও পুলাউ লেম্বু এই চারটি দ্বীপ নিয়ে পুলাউ পায়ার মেরিন পার্ক। স্নর্কলিং, স্কুবা ডাইভিং প্রভৃতি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের আইডিয়াল জায়গা। কোরাল বাগানের আনাচা-কানাচে রঙিন মাছেদের আনাগোনা - যেন এক অন্য পৃথিবী।
মাকাম মাসুরি (Makam Masuri) - কুয়ার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে কামপুং মাওয়াটে রয়েছে মাসুরির স্মৃতিসৌধ মাকাম মাসুরি। অপরূপ সুন্দরী রাজবধূ মাসুরিকে ব্যভিচারের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেন তাঁর শ্বশুর। নিরাপরাধ মাসুরিও অভিশাপ দেন, এই দ্বীপে পরবর্তী সাত প্রজন্ম দুঃখে কাটাবে। আশ্চর্যজনকভাবে মাসুরির মৃত্যুর পরপরই থাইল্যান্ড আক্রমণ করে লাং কাউয়ি। সেইসময় মাসুরির স্বামী-পুত্রসহ অনেক মানুষই দ্বীপ ছেড়ে চলে যান। বহু বছর পরে ২০০২ সালে মাসুরির এক উত্তরাধিকারী দ্বীপে ফিরে এলে তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা করা হয়।
পেনাং (Penang) - লাং কাউয়ি থেকে ১১২ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘প্রাচ্যের মুক্তা’ পেনাং। জল, স্থল ও আকাশপথে কুয়ালালামপুর থেকে পেনাং পৌঁছোনো যায়। এশিয়ার দীর্ঘতম এবং বিশ্বে পঞ্চম, ১৩.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পেনাং ব্রিজ মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে পেনাং দ্বীপভূমিকে। মালয় ভাষায় পেনাং শব্দের অর্থ পাম। পামে ছাওয়া এই দ্বীপভূমির রাজধানী শহর জর্জটাউন। তানজুং বুংগা, বাটু ফিরিংগি-অপরূপ সব সৈকতবেলা, চায়নাটাউন আর ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সঙ্গী প্রাচীন বাড়িগুলি জর্জটাউনের আকর্ষণ। চায়নাটাউনের প্রধান দ্রষ্টব্য ড্রাগন মাউন্টেন হল নামে পরিচিত জর্জটাউনের বৃহত্তম চিনামন্দিরটি। খু গোষ্ঠীদের এই মন্দির খু কংসি নামেও বিখ্যাত। মন্দিরের দেয়ালের কাঠের কারুকাজ, বিশাল ড্রাগনের সারি, রঙিন ঝাড়লন্ঠনের সাজ নজর কাড়বে। ১৯১১ সালে চিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হ্য়। মাঞ্চু রাজবংশের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন চিনের জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান ইয়াৎ সেন। ১২০, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে তাঁর বাড়িটি অবশ্যদ্রষ্টব্য। এই বাড়িতে বসেই তিনি গণঅভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। পেনাংয়ে প্রাচীনতম চিনা ধর্ম স্থান কুয়ান ইন তেং মন্দিরটির অবস্থানও চায়নাটাউনে। এখানে চিনা দেবদেবীর পাশাপাশি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন হিন্দুমন্দির শ্রী মারিয়াম্মান মন্দিরটি লিটল ইন্ডিয়ায়। মন্দিরে ২৩টি গোপুরম রয়েছে। ৩৮ জন হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে মন্দিরের নানা অংশে। এর মধ্যে সবচেয়ে জমকালো সোনা-রূপা-হিরে-চুনি-পান্নায় সাজানো লর্ড সুব্রাহ্মণ্যমের মূর্তিটি। জানুইয়ারির শেষে থাইপুসম উৎসবের সময় মূর্তিটি নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। শ্রী মারিয়াম্মান মন্দিরের কাছেই কাপিতান কেলিং মসজিদ। মালয়েশিয়ার একেবারে প্রথমদিককার মুসলিম সেটলমেন্টের সময় এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন সেন্ট কর্নওয়ালিস ফোর্ট ও সেন্ট জর্জেস চার্চ। চার্চের গায়েই পেনাং মিউজিয়াম পেনাং-এর অতীত ইতিহাসের সাক্ষী।
পেনাং থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে মালয়েশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমন্দির কেক লোক সি বর্মীয়, চিনা ও থাই স্থাপত্যের সংমিশ্রণের নির্দশন। সাততলা প্যাগোডা বা বান পো থর চমৎকৃত করে। ছোটো ট্রেনে চড়ে পাহাড়ের বুকে একের পর এক টানেল পেরিয়ে মিনিট কুড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায় ২,৪২৮ ফুট উচ্চতায় পেনাং পাহাড়ের মাথায়। উপর থেকে অসাধারণ লাগে বিস্তীর্ণ দ্বীপভূমি। এখান থেকে আরও ৬ কিলোমিটার দূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন। জর্জটাউন থেকে বাসে আয়ার ইতামে পেনাং হিল কেবল ট্রেন স্টেশনে পৌঁছোতে হবে। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রঙবেরঙের প্রজাপতির দুনিয়া বাটারফ্লাই ফার্ম। ১২ কিলোমিটার দূরে সর্পমন্দির।
অল্পদিনের বেড়ানোয় মালয়েশিয়ার অনেক বিষ্ময়ই অধরা রয়ে যায়। একটু অফরুটে বেড়াতে চাইলে ঘুরে আসা যায় সবুজ চা-বাগিচায় ঢাকা পাহাড়ি এলাকা ক্যামেরুন হাইল্যান্ডস (Cameron Highlands) বা তামান নেগেরার (Taman Negara) আদিম অরণ্যে। বেড়ানো-কেনাকাটার পাশাপাশি উপভোগ করা যায় র্যাফটিং, প্যারাসেলিং, ট্রেকিং, স্কুবা ডাইভিং-এর মতো নানান অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসও।
যাওয়াঃ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ান কুয়ালালামপুর যাচ্ছে। কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়ার উড়ানে সরাসরি কুয়ালালামপুর পৌঁছানো যায়। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর জন্য রয়েছে রেল, বাস, বিমান ও ফেরিপথ। ট্যাক্সি ও মনোরেলও রয়েছে।
নিয়মকানুনঃ বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা থাকতে হবে। প্যাকেজট্যুরের জন্য অনেক ক্ষেত্রে সংস্থাগুলিই কাগজপত্র তৈরিতে সাহায্য করে।
খাওয়াদাওয়াঃ বিদেশে বেড়াতে গেলে অবশ্যই সেখানকার স্পেশ্যালিটি ফুডের স্বাদ নেওয়া উচিত। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার সাতে - কাঠকয়লার আগুনে ঝলসানো মাংসের কাবাব এবং নাসিলেমাক - কলাপাতায় মোড়া সুগন্ধি মশলা ও নারকেলের দুধে জারানো ভাত। ‘কোপি তিয়াম’ বা চিনা কফিশপে বসে স্থানীয় কফির স্বাদ নেওয়া যায়। ওয়ানটান মি এবং কারি লাক্সার - গরমাগরম এগ নুডলসেও পেট ভরিয়ে নেওয়া যায়। নানারকম ভারতীয় খাবারও বেশ জনপ্রিয় মালয়েশিয়ায়। মেলাক্কায় স্বাদ নিতে হবে চিকেন রাইসবলের। কুয়ালালামপুরের রোজাক আর পেনাংয়ের আসাম লাসকার স্বাদ নিতেই হবে।
কেনাকাটাঃ রাস্তার ধারে বড়ো বড়ো শপিংমল আর পথের দুপাশে সাজানো হকারদের পশরা - কেনাকাটার মজাই আলাদা মালয়েশিয়ায়। সুতি ও সিল্কের ওপরে বাটিকের কাজ, পিউটার ধাতুর তৈরি চাবির রিং, পেট্রোনাস টাওয়ারের রেপ্লিকা, পুতুল, মেলাক্কার অ্যান্টিকদ্রব্যাদি রাখতে পারেন কেনাকাটার তালিকায়। আবার কুয়ালালামপুরের পাসার মালামের রাতের বাজারে আর চায়নাটাউনে দরাদরি করে কিনে ফেলা যায় পোশাক, বিদেশি পারফিউম, ঘড়ি ইত্যাদি হরেক জিনিস।
জরুরিঃ মালয়েশিয়ার আই এস ডি কোড ০০৬০। সারা বছরই মোটামুটি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকে। সমতলের তাপমাত্রা মোটামুটি ২১-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় ভারতের থেকে আড়াই ঘন্টা এগিয়ে। স্থানীয় মুদ্রা রিংগিট। ভারতীয় মুদ্রায় মোটামুটি ১ রিংগিট মানে ১২-১৩ টাকার মতো।
ধর্মস্থানে জুতো খুলে ঢুকতে হবে।
কয়েকটি মালয় শব্দ - ইয়া - হ্যাঁ, টিডাক - না, তেরিমা কাসি - ধন্যবাদ, এয়ার মেনাম - পানীয় জল, টেহ - চা, তানদাস - শৌচালয়।
অন্যান্যঃ মেলাক্কার শপিং লিস্টে অ্যান্টিক রাখতেই হবে। জোঙ্কার স্ট্রিটের স্থানীয় ক্র্যাফটসের দোকানগুলোয় ঢুঁ মারতে পারেন। দুরিয়ান দোদোল কেক বা মেলাক্কার বিখ্যাত মিষ্টি গুলা মেলাকা জ্যাগেরি টেস্ট করতে যেতে পারেন লক্ষ্মণ চেং হো-তে তান কিম হফ প্রোডাক্ট সেন্টারে। পাদাং পাহলাওয়ানে বান্দা হিলির-এ লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোতে মেলাক্কার ইতিহাস প্রত্যক্ষ করা যায়।
|| ভ্রমণ কাহিনি - মালয়েশিয়ার দুই প্রান্তে ||