নীল-সবুজ পাহাড়, রংবেরঙের ফুল আর অর্কিড , আদিবাসী সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, মার্শাল আর্ট আর পোলোর বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে ভারতের মণি মণিপুরে। এখানে এমন অনেক কিছু আছে যা এই অঞ্চলের নিজস্বতাকে ফুটিয়ে তোলে। এখানকার এক ঐতিহ্য হাতে বোনা তাঁত আর বেত ও বাঁশের হস্তশিল্প। প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে তাঁতযন্ত্র। দেশীয় খেলাধূলার পরম্পরাও এখানকার আরেক বৈশিষ্ট্য। পোলো খেলার জন্ম মণিপুরেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মণিপুরি খেলোয়াড়দের একটি দল কলকাতায় এসে ব্রিটিশ দলকে হারিয়েছিল। সারা বিশ্বেই এখন পরিচিতি লাভ করেছে নান্দনিক মণিপুরি নৃত্য। প্রধান জনজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতিদের পাশাপাশি বাস করছে নাগা আর কুকি-চিনা-মিজো নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের দিক থেকেও রীতিমতো সমৃদ্ধ এই অঞ্চল।
ইম্ফল (Imphal)- মণিপুরের রাজধানী। শহরের মধ্যেই রয়েছে বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্যস্থান। প্রাচীন রাজপ্রাসাদের কাছে বৈষ্ণব সংস্কৃতির এক প্রধান কেন্দ্র শ্রীগোবিন্দজির মন্দির। সোনায় মোড়া দুই গম্বুজ। মন্দিরের প্রাঙ্গণ ও হলগুলি ঘুরে দেখতে হবে। স্টেডিয়ামের কাছে স্টেট মিউজিয়াম সংগ্রহালয়ে রয়েছে মণিপুরের রাজাদের ও এই রাজ্যের আদিবাসী ঐতিহ্যের স্মারক নানান পোশাকপরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্র, ঐতিহাসিক নথিপত্র এবং প্রাচীন চিত্র প্রভৃতি। শহরসীমান্তে ওয়ার সিমেটরি। এখানে শান্তিতে শায়িত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাদের দেহ। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শান্ত পরিবেশ।
শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে মণিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ, ভালুক, সিংহের সাথে দেখা মিলবে প্রায় বিলুপ্ত বাদামি সাঙ্গাই হরিণের। ১৬ কিলোমিটার দূরে খোংঘামপাত অর্কিডারিয়ামে অর্কিডের ৫০০ টির মতো প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে অনেকগুলিই খুবই দুর্লভ। অর্কিডারিয়ামে প্রায় ১০০টির মতো বিরল অর্কিড রয়েছে। এপ্রিল-মে মাসে সবথেকে বেশি ফুল ফোটে ।
পর্যটকদের কাছে মণিপুরের সেরা আকর্ষণ লোকতাক লেক আর লেকের পাড়ে মৈরাং (Moirang) শহর। আগে মৈরাং ছিল মেইতি সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। ‘লাই হারাওবা’ উৎসবে মেতে ওঠেন এখানকার মানুষজন। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল এই মৈরাং-এই আই এন এ পতাকা উত্তোলিত হয়। এখানে আই এন এ মিউজিয়ামও রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মিষ্টি জলের সর্ববৃহৎ হ্রদ লোকতাক (Loktak Lake)। লোকতাকে বেশ কয়েকটি দ্বীপ ভাসমান। দ্বীপের ওপর মনোরম বাগিচা আর স্থানীয়দের কুড়েঁঘর। সেন্দ্রা দ্বীপের উপর ট্যুরিস্ট হোমে থাকা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। লোকতাক হ্রদের উপর ভাসমান কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক (Keibul Lamjao National Park)। সাঙ্গাই হরিণের এটাই শেষ প্রাকৃতিক বাসস্থান। অন্যান্য বন্যপ্রানীরও দেখা মিলবে এখানে।
ইম্ফল থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে ‘লাল পর্বত’ বা রেড হিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই জায়গাটিতেই এসেছিল জাপানিরা। গড়ে তুলেছিল ‘ভারত শান্তি সৌধ’ বা ‘ইন্ডিয়া পিস মেমোরিয়াল’। ছোট্ট পাহাড় লংথবল। ইম্ফল থেকে ৮ কিলোমিটার পথ। কাঁঠাল গাছ আর পাইন গাছের মাঝখানে এক ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ। ২৭ কিমি দূরে বিষ্ণুপুরে প্রাচীন একটি বিষ্ণুমন্দির আছে। মায়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত মোরেহ শহর। পথে পড়বে আজাদ হিন্দ বাহিনির স্মৃতিবিজরিত প্যালেল আর থংগজম। ২৯ কিমি দূরে বৈষ্ণবতীর্থ কায়না। প্রাকৃতিক শোভায় অনন্য ১৬ কিমি দূরের কাংচুপ। ৭১ কিমি দূরে ৬০০০ফুট উচ্চতায় মনোরম শৈলাবাস উখরুল।
কেনাকাটাঃ কেনাকাটার সেরা জায়গা ইম্ফলের ইমা বাজার ঘুরে দেখতে ভারি ভালো লাগে। এখানকার প্রধান আর্কষণ নানা রঙের নানান ধরনের হাতে বোনা কাপড়। মণিপুরী পুতুল, মাটির বাসনপত্র, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় সহজেই জায়গা করে নেবে।
যাওয়াঃ দিল্লি, কলকাতা, গৌহাটি , আইজল, জোরহাট ও শিলচর থেকে বিমানে সরাসরি ইম্ফল যাওয়া যায়। কাছাকাছি রেলস্টেশন ডিমাপুর। রেগুলার বাস সার্ভিসও চালু রয়েছে।
থাকাঃ ট্যুরিজমের হোটেল ইম্ফল। এছাড়া শহরে প্রচুর হোটেল আছে।