-->
মনে মনে আমরা সবাই ভুবনভ্রামণিক – কিন্তু বাস্তবে যখন ইন্দ্রিয় দিয়ে এর রূপ, রস আর গন্ধের আস্বাদ নিই তখন ঘটে যায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য – বোঝা যায় দেখার চোখ কত আলাদা হতে পারে, তাই অভিজ্ঞতাও হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন। কথোপকথনে আমরা সেই ভিন্নতাকে ধরারই চেষ্টা করেছি। আর সেই জন্যই এমনই কিছু অন্যরকম ব্যক্তিত্ব - যাঁরা সামান্যতেই খুঁজে পান অসামান্যের ইশারা, তাঁদের ভাবনায় ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করতে চেয়েছি ‘আমাদের ছুটি’ আর তার আগ্রহী পাঠকদের।
এই সংখ্যায় আমরা কথা বলেছি কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে।
ছেলেবেলাতো আপনার বাংলাদেশেই কেটেছে। সেইসময়ে বেড়ানোর কোন স্মৃতির কথা মনে পড়ে?
- বেড়ানোর সঙ্গে টাকাপয়সার একটা সম্পর্ক আছে। ছেলেবেলায় আমাদের পরিবারের যে আর্থিক দশা ছিল তাতে কোথাও বেড়াতে যাবার ভাবনাটা ছিল স্বপ্নবিলাস। বেড়ানো বলতে তখন শুধু বুঝতাম পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়িতে যাওয়া, কখনো-বা মামাবাড়ি। অবশ্য, সত্যিকারের বেড়ানোরই একটা স্বাদ মিশত তাতে, কেননা ওসব যাওয়া মানে ছিল অনেক নদীপ্রান্তর পেরিয়ে, অনেক রূপ-রূপান্তর। পাবনা জেলায় পদ্মাপাড়ের ছোটো একটা শহর থেকে অনেক দূরে বরিশালের কোনো গ্রামে পৌঁছনো, কিংবা মেঘনাপাড়ের চাঁদপুরে। যেতে হতো ভেঙে ভেঙে, আর সেটাই ছিল খুব উপভোগের। ভোরবেলায় পাকশী ছেড়ে রানাঘাট, রানাঘাট থেকে বনগাঁ, বনগাঁ থেকে খুলনা। সন্ধে হয়ে আসত ততক্ষণে, ট্রেনযাত্রা ছেড়ে উঠতে হতো তখন স্টিমারে। শেষ রাতে সেই স্টিমার পৌঁছত এক গঞ্জে, সেখানে নামতে হবে আমাদের। আর স্টিমার চলে যাবে বরিশাল শহরে, আমরা বসে থাকব ভোরের প্রতীক্ষায়। ভোর হলে, দরদাম করে উঠে বসব এক নৌকোয়। সারাদিন ধরে দুলকি চালে চলবার পর সন্ধের মুখে পৌঁছে যাব আমাদের গ্রামে। এই-যে নানা বাহনে যাওয়া, ভিন্ন ভিন্ন জেলার পথঘাট তরুপ্রান্তর নদীখাল দেখতে দেখতে যাওয়া, দুদিন ধরে যাওয়া, এটাই ছিল আমাদের ছেলেবেলাকার বেড়ানো।
অনেকদিন পরে পর্যটক হিসেবে নিজের দেশের মাটিতে পা রাখার অনুভূতিটা কেমন?
- ‘রোমাঞ্চ’ শব্দটা পড়েছি অনেকসময়ে, ব্যবহারও করেছি, কিন্তু আক্ষরিক ভাবে শারীরিকতায় তার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছি যখন অনেকদিন পরে ছেড়ে-আসা-দেশের-মাটির ছোঁয়া পেলাম। এক মুহূর্তে গোটা অতীতটা বর্তমানের মধ্যে সঞ্জীবিত হয়ে উঠবার সে-অনুভূতিটা ভুলবার নয়। এ-রকম অবস্থায় অনেকেরই মনে হয় যে সবকিছু পালটে গেছে, কিছুই আর আগেকার মতো নেই। আমার হয়েছিল উলটো। মনে হয়েছিল সবই যেন ঠিক তেমনি আছে, বদলে গেছে শুধু মানুষজনের চেহারা। সে তো বদলাতেই পারে।
ছোটবেলায় ওপার বাংলায় থাকলেও, কলকাতাতেই জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন। এই শহরে বেড়ানোর কোন প্রিয় ঘটনা বলবেন?
- এই শহরের মধ্যেই বেড়ানো? হ্যাঁ, তেমনও অনেক স্মৃতি আছে, ছেলেবেলারই। তিন থেকে সাত বছরের সময়টা পর্যন্ত কলকাতাতেই ছিলাম আমরা। তখন, ইচ্ছে হলে ট্রাম কোম্পানি থেকে নেওয়া যেত অল্-ডে টিকিট। সে টিকিটে শহরের যে-কোনো প্রান্তে যে-কোনো ট্রামে চলাফেরা করা যেত সারাদিন ধরে। ভাইবোনেরা সবাই মিলে বাবা-মার সঙ্গে তেমনি একবার ঘুরে দেখছিলাম কলকাতা, চিনছিলাম তার জাদুঘর বা চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা অক্টার্লোনি মনুমেন্ট(এখন যার নাম শহিদ মিনার) -ঘুরে ঘুরে বা চুড়োয় উঠে সেসব দেখার তৃপ্তি আজও কিছু জেগে আছে মনে।
আমেরিকা, বাংলাদেশ, ভুটান -কবিতার টানে অনেক দেশই ঘোরা আপনার। আবার ভারতেরও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। এইসব নানান জায়গার মধ্যে আলাদা করে কোনোটার কথা মনে পড়ে?
- যে-কোনো নতুন জায়গাতে গেলেই আমার ভালো লাগে, বিশেষ কোনোটির কথা আলাদা করে বলা মুশকিল। মনের মধ্যে এক-এক জায়গার এক-এক চিহ্ন থেকে যায়। সবটাই বিশেষ।
অন্যদেশে বেড়াতে গিয়ে কি কখনো এখানের সঙ্গে তেমন কোন পার্থক্য আপনার মনে দাগ কেটেছে?
- প্রত্যেক দেশে পৌঁছেই নিজের দেশের সঙ্গে তুলনা করে ভাবাটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরিচ্ছন্ন পথঘাট দেখলেই মনে হয় আমাদেরও-বা হবে না কেন এরকম, শৃঙ্খলা দেখলে মনে হয় আমাদের কেন হলো না এটা। কেবলই এই না-এর ধাক্কাটা লাগে। একটা ব্যাপারে শুধু জয়ী লাগে মনে। নানা দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টুকরো টুকরো দেখতে দেখতে ভাবি, আমাদের দেশের মতো এমন দেশ কি আর আছে যেখানে প্রকৃতির সম্ভার এসে জড়ো হয়েছে একত্র !
সম্প্রতি কোথায় বেড়াতে গেছেন?
- শেষ যেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম সে হলো থাইল্যান্ড। এ কোনো বহুবিজ্ঞাপিত পর্যটন-কোম্পানির সঙ্গ নেওয়া নয়, একেবারেই পারিবারিক এক ভ্রমণ, স্বনির্ভরতায়। নজনের এক দল। তার মধ্যে তিনজনই শিশু। অনেক জায়গাতেই ঘোরা গেল সে-দেশে, উত্তর থেকে দক্ষিণ। সেখানকার মনে রাখার মতো অনেক ছবির মধ্যে একটার কথা বলি। দেশের উত্তরতম প্রান্তে, মেকং নদীর ধারে, চিয়াং-মাই নামের জায়গাটিতে, বসে থেকেছি বা ঘুরে বেড়িয়েছি দুপুর থেকে সন্ধে। এ হলো তিন দেশের এক সংযোগ বিন্দু। নদীর উত্তরে তাকালে বাঁ-পাশে মায়ানমার, আর ডাইনে লাওস। মেকং নদীর ধার বরাবর পরিচ্ছন্ন ফুটপাতে বড়ো বড়ো মাদুর ছড়িয়ে সারি সারি খাবার দোকান, সেখানে বসেই পছন্দমতো বেছে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। নদীর ধারে, প্রায় পিকনিকের ভঙ্গিতে থাই -খাবার খেতে খেতে দেখেছি অপরিচিত দেশের হালচাল, আস্তে আস্তে কোমল হয়ে আসছে রোদ, তারপর নেমে আসছে সন্ধ্যা। জলের ধার পর্যন্ত নেমে গিয়ে দলের বাচ্চারা কুড়িয়ে নিচ্ছে নদীকূলের নুড়িপাথর, বড়োরা হয়তো তুলে নিচ্ছে নাম -না -জানা ফুল।
বেড়ানোর যে গল্পটা এখনো কোথাও লেখেননি তেমন একটা গল্প শোনাবেন?
- আরো একবার বাংলাদেশে ঘুরে আসতে হলো কদিন আগে। ছোটো একটা সরকারি দলের সঙ্গে এই ঘুরবার একটা রাবীন্দ্রিক সূত্র ছিল। ঢাকা থেকে সাজাদপুর, সাজাদপুর থেকে কুষ্টিয়া, আবার সেখান থেকে শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ি কুঠিবাড়িগুলি দেখাটাই ছিল সফরের মূল উদ্দেশ্য। দুই দেশের সরকার একসঙ্গে মিলে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের কথা ভাবছেন তখন, সেই উপলক্ষে এই দেখাশোনার ব্যবস্থা। জায়গাগুলি আমার আগেই জানা, কিন্তু একটা সরকারি দলের সঙ্গে ঘুরবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম, সেজন্য ভিন্ন রকমের একটা কৌতুকবোধ হচ্ছিল আপ্যায়নের ঘটা দেখে। যাওয়াটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে আরো একটা কারণে। সাজাদপুর থেকে কুষ্টিয়া যাবার পথে গোটা কন্ভয়টা হঠাৎ একটু বেঁকে গেল মূল পথ থেকে ডাইনে, হাজির হলো পদ্মাতীরের এক মফস্বল শহরের ছোটো একটা স্কুলে। এই স্কুলে আমি পড়েছিলাম। বিকেল তখন, কিন্তু তবু কেমন করে সেখানে জড়ো হয়ে গিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং প্রাক্তন কিছু ছাত্র। অল্প সময়ের জন্য একটা যেন প্রাক্তনী সম্মেলনই ঘটে গেল সেখানে।
সরকারি পর্যটন বলে সামনে পিছনে ছিল কিছু পুলিশি গাড়ি। ওই অবেলায় স্কুলের সামনে পুলিশ আর অতসব গাড়ি দেখে সাধারণ মানুষজনের একটা ভিড় জমে গিয়েছিল। ফিরে আসছি যখন, আমাদের দলের একজনের কাছে পৌঁছল এক স্মরণীয় সংলাপ। ভিড়ের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঠেছেঃ ‘এরা কারা? কী হচ্ছে এখানে?’ উত্তরে শোনা গেলঃ ‘ইস্কুল দেখতে এয়েচেন ইস্কুলের মা-বাবা!’
এমন কোনো জায়গার কথা মনে হয় যেখানে আপনি যাননি কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে। কেন?
- ম্যাপ খুলে বসলে যে বিন্দুটা চোখে পড়ে, সেখানেই চলে যেতে ইচ্ছে করে আমার। এ-ইচ্ছের কোনো শেষ নেই। কেন ইচ্ছে করে? কেননা সবটুকুকেই জানতে চায় মন, চোখের দেখা দিয়ে।
বাংলা সাহিত্যে বেড়ানো নিয়ে লেখার চলটা চিরকালই ছিল। দিকপাল সাহিত্যিকরা সাহিত্যের এই ধারাটিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু আজকের প্রজন্মের লেখার মধ্যে ভালোলাগার সেই অনুভূতিটা তেমনভাবে কি পাওয়া যায়?
- ‘সাহিত্য’ বলে তো আলাদা কিছু ব্যাপার থাকে না ভ্রমণলেখায়। লেখার সাবলীলতায় তৈরি হয়ে ওঠে একটা আলগা সৌন্দর্য, আর সেটাকেই তখন বলি সাহিত্যগুণ। এটা ঠিক যে এখনকার ভ্রমণবিষয়ক অনেক লেখাই হয়ে উঠেছে তথ্যপুঞ্জ শুধু, যেন কোনো বিস্তারিত ট্রাভেল-গাইড। সে-রকম শুকনো লেখায় ভরে যাচ্ছে কাগজগুলো, তা ঠিক। কিন্তু ভ্রমণকথার অন্য সরস রূপটা যে একেবারে লুপ্ত হয়ে গেছে তা মনে হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন লেখেন তাঁর কোনো ভ্রমণের কথা, তখন তো সবসময়েই সেটা সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিংবা নবনীতা দেবসেন। কিংবা অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। পরবর্তী প্রজন্মের লেখায় এই ধরনটা খুব একটা দেখতে পারছিনা সেটা সত্যি। আপনাদের যে অন্যরকম মনে হচ্ছে তার একটা কারণ হয়তো এখনকার তুচ্ছ লেখার অজস্রতা। ভ্রমণবিষয়ের পত্রিকাই এখন অনেক, আবার অন্যান্য পত্রিকাতেও একটা অংশ হিসেবে থাকে ভ্রমণকথা। এতসব স্তূপের মধ্যে সাহিত্যরসের লেখাগুলি অনেকসময়ে হয়তো চাপা পড়ে যায়, তা ঠিক।