বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com
বার্সের চিঠি
বর্ণালী রায়
প্রিয় আমাদের ছুটি,
রডোডেনড্রনের কথা প্রথম পেয়েছিলাম রবি ঠাকুরের লেখায়। শুনেছিলাম সেই ফুল নাকি ভারি সুন্দর। কিন্ত কখনও কাছ থেকে দেখা হয়নি। অনেকদিনের সেই ইচ্ছাটাকে পরিতৃপ্ত করতে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিয়েছিলাম ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে। গন্তব্য পশ্চিম সিকিমের এক প্রান্তিক জনপদ - বার্সে। কেউ কেউ ভার্সেও বলে থাকেন। এশিয়ার অন্যতম একটি রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি রয়েছে এখানে - এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত ফুল দেখা যায়।
রাতের দার্জিলিং মেল ধরে রওনা দিলাম শিয়ালদহ থেকে। এক ঘুমে সকাল। মনের ভিতর প্রবল উত্তেজনা। সেই সবুজ পৃথিবীতে কখন পৌঁছব যেখানে আছে রডোডেনড্রন।
সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। এখানে এলে আপনিই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবার মন ভালো হওয়ার বদলে মন খারাপের পালা ছিল। ট্রেনেই শুনেছি সেদিন শিলিগুড়ি বন্ধ। কোনো একটা রাজনৈতিক দল বনধ্ ডেকেছে। মাথায় বজ্রাঘাত! বিকেল চারটের মধ্যে হিলে পৌঁছতে না পারলে বার্সে যেতে পারব না আজ। হিলে থেকে ৫ কিমি হাঁটা পথ। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল জোড়থাং যাওয়ার শেয়ার জিপগুলো শিলিগুড়ির পায়েল সিনেমার কাছ থেকে ছাড়ে। কোনো রকমে একটা রিক্সা নিয়ে পায়েল সিনেমা পৌঁছে দেখি সব শুনশান। মনের মধ্যে আশঙ্কা আর মনখারাপ দুই-ই দানা বাঁধছে। স্থানীয় এক জন বললেন তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ডে চলে যান। কিছু পেলেও পেতে পারেন। এক রাশ সংশয় নিয়ে আবার ওই রিক্সাটা নিয়েই রওনা দিলাম বাস স্ট্যান্ডের দিকে। পৌঁছে দেখি কয়েকটা মাত্র জিপ দাঁড়িয়ে আছে। এক ছুটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম একটি জিপই জোড়থাং যাবে। সব সিট ভর্তি শুধু একদম পিছনে দুটো সরু সিট। একবার ভাবলাম এত দূর - ৮৫ কিমি রাস্তা প্রায় ঘন্টা তিনেক পাহাড়ি পথে এমন ভাবে যাব কী করে? কিন্তু ওই এক মুহূর্ত দ্বিধা করেই চট করে উঠে পড়লাম। অবশেষে পৌঁছলাম জোড়থাং। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। এত ভালো লাগছে যে যাত্রা পথের যাবতীয় ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিতে হবে। এদিকে দু'টো বাজে। যত তাড়াতাড়ি হোক বেড়িয়ে পড়তে হবে হিলের উদ্দেশ্যে। মোমো প্যাক করে নিলাম। ছাতা আর নুনের প্যাকেটও কিনে নিলাম। শুনলাম ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে।
একটা বোলেরো গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম। আমাদের ড্রাইভার গোপাল শর্মা। পথের নৈসর্গিক দৃশ্যে বিভোর হয়ে ভুলেই গেলাম সকালের সব বিড়ম্বনার কথা। গুম্বাদাড়া,সোম্বারিয়া আর কত নাম না জানা ছোট-বড় গ্রাম পেরিয়ে ৪৭ কিমি পথ পেরিয়ে হিলে পৌঁছলাম। পথ খুব বেশি না হলেও খারাপ রাস্তার জন্য প্রায় তিনঘন্টা সময় লাগল। বিকেল পাঁচটা বাজে। ধীরে ধীরে কুয়াশা চারপাশকে ঢেকে দিচ্ছে। গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। সামনেই রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির প্রবেশ পথ। রাতঠিকানা বার্সে। তাই টিকিট কেটে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যের পথে পা বাড়ালাম। আমাদের সাথী গাইড কেলা শেরপা গাছ থেকে ছাল ছিঁড়ে শক্ত দড়ির মত একটা জিনিস তৈরি করে আমাদের মালপত্রগুলো ওর নিজের পিঠে বেঁধে নিল। তারপর নিজের ভাষাতে গান গাইতে গাইতে চলতে লাগল। অচেনা সেই পাহাড়ি গানের সুর আমাদের মুগ্ধ করেছিল। আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী ছিল আরও একজন। একটি সারমেয়। সে-ও আমাদের সঙ্গে পুরো দু'দিন বার্সেতে কাটিয়েছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। কেলাকে যত দেখছি তত অবাক হওয়ার পালা। একটা ব্যাপার আমাদের অভিভূত করেছিল – সেটা হল ওর পরিবেশ সচেতনতা। আমাদের মত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ যারা আবর্জনা ফেলে পথ-ঘাট অপরিচ্ছন্ন করি তাদের সব ময়লা ও নিজে হাতে সাফ করতে করতে চলল। লজ্জায় আমরা চুপচাপ ওকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কেলা অবিচল চিত্তে গান গাইতে গাইতে ময়লা কুড়াতে কুড়াতে এগোতে লাগল। এই পাঁচ কিমি পথের প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে অপার সৌন্দর্য। বহু পুরনো বড় বড় গাছ গাছালি, ঘন সবুজ এই গহন জঙ্গল যেন কত রহস্যময়। কিছুটা চড়াই কিছুটা উতরাই পেরিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। যখন বার্সেতে ফিরলাম তখন ঘড়িতে ৬টা ১০। চারদিক ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বেশ ঠাণ্ডা। বার্সে ফরেস্ট ব্যারাকে আমাদের পৌঁছে দিয়ে কেলা চলে গেল।
ফরেস্ট ব্যারাকটি ছিমছাম। বিদ্যুতের সংযোগ নেই। লক্ষ্য করে দেখলাম মোবাইল ফোনে টাওয়ারও নেই। মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম। ভাবলাম যাক এই দুটো দিন জাগতিক পৃথিবীর অন্তরালে থাকা যাবে। প্রকৃতির কোলে নিজের সঙ্গে একান্তে থাকার এইতো সুযোগ। এই ফরেস্ট ব্যারাক নামক হোম স্টে-টির দায়িত্বে আছেন যিনি তাঁর নাম পুশাই। তাঁর আন্তরিকতা আর সহযোগিতা ভোলা যায় না। মোমবাতির আলোয় উজ্জ্বল ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলাম দুটি সুদৃশ্য বিছানা পাতা আছে। কম্বল,বালিশ সবই মজুত। পৌঁছতেই পুশাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমাদের আপ্যায়নে। গরম জল, চা সব কিছুর ঠিকঠাক যোগানে। ঠিক করলাম তাড়াতড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। রাতে সুস্বাদু দেশী মুরগির ঝোল আর রুটি খেয়ে রসনার তৃপ্তি করলাম।
একঘুমে সকাল। ভোর ৬ টা বাজে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে যে দৃশ্য দেখলাম তা কোনোদিন ভুলব না। এক অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা চারিদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যত দূরে চোখ যায় পাহাড়গুলি লালে লাল। সবুজ পাতার আড়ালে লালিমার বিচ্ছুরণ। কী অভুতপূর্ব দৃষ্টি নান্দনিকতা তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমাদের ব্যারাকের ঠিক পিছনদিকে ছিল মাইলের পর মাইল রডোডেনড্রন গাছ। আর তারই ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে শৈলশ্রেণী। বরফের পাহাড়। তাড়াতাড়ি চা, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা দেখব বলে। সঙ্গী হল পুশাই। সে পথ দেখাতে দেখাতে চলল।
আমি দুচোখ ভরে এই প্রান্তিক জনপদটির অনাবিল রূপ অনুভব করছিলাম। যত দূরে চোখ যায় শুধুই লাল ফুল ফুটে আছে। রাস্তাগুলোও ফুলের পাঁপড়িতে ঢাকা। নিজেকে বেশ রানি মনে হচ্ছিল। ভাবতে ভালো লাগছিল অন্য কেউ নয় প্রকৃতি নিজের হাতে তার ভাঁড়ার থেকে একমুঠো সুখ আমার জন্য উজাড় করে দিয়েছে।
বার্সেতে ফরেস্ট ব্যারাক ছাড়া আর একটিই থাকার জায়গা আছে - বার্সে গুরাস কুঞ্জ। আমরা লক্ষ্য করছিলাম সেদিন বার্সেতে আমরা ছাড়া আর কোনো পর্যটকই ছিল না। তবে দেখলাম কিছু স্থানীয় লোক একটা জায়গায় তাঁবু খাটাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম বিকেলে কয়েকজন বিদেশি পর্যটক আসছেন। এখান থেকে সিঙ্গালিলা পর্বত আরোহণের জন্য রওনা দেবেন। গোচালা পর্বতে আরোহণের জন্যও এই বার্সেতেই বেসক্যাম্প করা হয়। জায়গাটার বিষয় যত জানতে পারছি, যত দেখছি আরও ভাল লাগছে। রডোডেনড্রন গাছগুলি যে এত বড় বড় হয়, এত তার বিস্তার, এত গহীন, এত গভীর তার বেড়ে ওঠা আমার জানার অতীত সব তথ্য আজ আমার ঝুলিতে। ওখানে কাছাকাছিই ছিল একটি কৃত্রিম জলাধার। জলাধারের চারপাশে হাজার হাজার লাল লাল রডোডেনড্রন। মনে হচ্ছিল যেন ঈশ্বর নিজের হাতে মানুষের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন তার পান্থশালাখানি। বার্সে জিরো পয়েন্ট দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল কোথাও যদি স্বর্গ থাকে তবে তা হল এটাই।
এই ভাবেই কেটে গেল আর একটি দিন। পৃথিবী যেন তার সময়ের চাকা কয়েক মুহূর্ত আমার জন্য থামিয়ে দিয়েছিল নিজেকে চিনে নেওয়ার জন্যই। এবার ফেরার পালা। এই মনমোহিনী ধরিত্রীর অপার সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করে কেলা আর আমাদের সেই পুরোনো সাথী সারমেয়টির সঙ্গে রওনা দিলাম হিলের উদ্দেশ্যে।
আমার বেড়ানোর আনন্দ আর অভিজ্ঞতার কথা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে লিখে পাঠালাম। সঙ্গে রইল আমার তোলা কিছু ছবিও। তোমাদের পছন্দ হলে আমারও খুব ভাল লাগবে।
ভালো থেকো সবাই।
~ বার্সের তথ্য ~ বার্সের আরও ছবি ~
শিক্ষাবিজ্ঞানের ছাত্রী বর্ণালী রায় ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল লেখা এবং সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। পেশায় হাইস্কুল শিক্ষিকা। অংশ নিয়েছেন কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক দপ্তর আয়োজিত সর্বভারতীয় প্রশিক্ষণ শিবিরে। লেখালিখি ছাড়াও ভ্রমন পিপাসু - বারবার বেড়িয়ে পড়েন প্রকৃতির টানে.বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের মন ও মনন বুঝতে চাওয়াটাই তাঁর নেশা।
সুন্দরবনের অন্দরে
মনিরুল ইসলাম মল্লিক
গতবছর সুন্দরবন দ্বীপাঞ্চলে পুজো পরিক্রমায় ডাক পেয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। খাঁড়িপথে দ্বীপে দ্বীপে প্রতিমা দর্শনের এমন সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে মথুরাপুর। সেখান থেকে ম্যাজিক ভ্যানে চেপে রায়দিঘি। এখান থেকেই জলপথে ছোট লঞ্চে চেপে আমাদের যাত্রা শুরু। বেরিয়ে পড়লাম রহস্যময় বাদাবনের জঙ্গলের উদ্দেশে।
কাহিনি শুরুর আগে সুন্দরবন সম্পর্কে কিছু না বলে নিলে যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। জীববৈচিত্রে আর সৌন্দর্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই সুন্দরবন। ভারত আর বাংলাদেশ মিলে প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এর বিস্তৃতি। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ প্রাচীর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বড় বড় সামুদ্রিক ঝড় থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ছোট-বড় নদী - মিষ্টি আর নোনা জলের মিশ্রণ আর প্রতিনিয়ত তাতে জোয়ার-ভাঁটার খেলা। তারই মাঝে মাঝে জেগে ওঠা চর আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দ্বীপগুলি। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হেঁতাল ছাড়াও রয়েছে ঝাঁটি, ধানি ঘাস, কাঁকড়া গাছ, চোড়া, কেওড়া, গোলপাতা, ধুঁধুল সহ নানান ধরনের গাছগাছালি। হেঁতাল গাছগুলো অনেকটা খেজুর গাছের মত দেখতে, পাতাগুলো সবুজ-হলুদ। হেঁতাল পাতা আর কাণ্ডের রঙের সঙ্গে বাঘের গায়ের রঙ মিলে যাওয়ায় শিকার ধরার সময় বাঘ এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে। নদীপথে যেতে যেতে আমার এই হেঁতাল গাছই সবচেয়ে বেশি চোখ টেনেছিল।
অগ্নিশিখা ফুলের উপর আগুন রঙের প্রজাপতির ছটফটানি স্বাগত জানাল আমাদের। পঞ্চকোট পাহাড়ের রায়দিঘি হয়ে মনি নদী বেয়ে আমার দ্বীপের কাছে পৌঁছলাম। এখানে মানুষের বসতি নেই। তবে জীবিকার সন্ধানে আশেপাশের দ্বীপগুলি থেকে বাসিন্দারা কাঁকড়া ধরতে প্রায়ই এই দ্বীপে হানা দেয়। কয়েকজনকে দেখলাম এক কোমর কাদায় নেমে হাত দুটো পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে কী কৌশলে কাঁকড়া ধরছে। মাছ-কাঁকড়া এসব ধরেই এদের সংসার চলে।
আমার দ্বীপের মত টেমারী দ্বীপেও মানুষের কোনো বসতি নেই। সুন্দরবনে এরকম ছোটখাটো দ্বীপ অনেক আছে যেখানে আদৌ মানুষের বসতি গড়েই ওঠেনি। নদী এখানে দুভাগে ভাগ হয়ে একটা ঠাকুরাইনের দিকে আর অন্যটা পাথরপ্রতিমার দিকে চলে গেছে। আমরা পাথরপ্রতিমার দিকে এগিয়ে চললাম। মাঝে হরিণডাঙায় একবার নেমেছিলাম। এই দ্বীপটিতে একসময় প্রচুর হরিণ ছিল তাই এই নাম হয়েছে। হরিণডাঙা, কেদার, পঞ্চম এইসব দ্বীপাঞ্চলে কয়েকটি পুজো মণ্ডপ ঘুরে সেদিনের মত রাতে রায়দিঘি ফিরে এলাম। রায়দিঘির কাছাকাছি অনেক হোটেল রয়েছে। তবে লঞ্চেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
পরদিন আবার নদীপথে বেরিয়ে পড়লাম। দোমকর দ্বীপ, কুয়েমুরি, বনিদ্বীপ হয়ে আমরা বাঘের দ্বীপে এসে পৌঁছলাম। এই দ্বীপটিতে না এলে হয়ত সুন্দরবনের আসল রূপটাই ঠিক বুঝতে পারতাম না। এটাই সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। লঞ্চের চালক মাধবদা বলল, বাঘ দেখতে চাইলে চুপচাপ থাকুন, যদিও কমই দেখা যায় – জল খেতে মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে হানা দেয়। আমরাও চুপ। সকলে বড় বড় চোখ করে গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছি। নিস্তব্ধ রোমাঞ্চে ভরা এক মায়াবী পরিবেশ যেন সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে। এমন সময় কে যেন বলে উঠল, 'ওই তো বাঘ'। উত্তেজিত হয়ে বাকীরাও এমন চেঁচাল যে বাঘের টিকিটুকুও আর দেখতে পেলাম না।
বাঘের দ্বীপেই রয়েছে বনবিবির মন্দির। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার এই মন্দিরে বনবিবির পুজো হয়। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এদিন নাকি বাঘ কাউকে আক্রমণ করেনা। বিভিন্ন দ্বীপ থেকে শয়ে শয়ে মানুষ এসে এখানে পুজো দেয়। আসলে এই জঙ্গলে কাঠ, মধু সংগ্রহ করতে এসে অনেকেরই আর ঘরে ফেরা হয়না। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনায় এই পুজো।
বাঘের দ্বীপের ঠিক বিপরীতে নদীর ওপারে বিধবা পাড়া। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের হাতে স্বামী মারা গেছেন এমন অনেক মহিলাই এখানে বাস করেন। তাই লোকের মুখে মুখে এই নাম। দ্বীপগুলির মধ্যে দিয়ে সরু সরু খাঁড়ি পথে ছোট ছোট নৌকায় এখানকার বাসিন্দারা মাছ, কাঁকড়া আর বনজ সম্পদ আহরণে বের হন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এভাবেই বেঁচে আছেন স্থানীয় মানুষজন। আবার নিয়মিত গাছকাটা আর লোকালয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যহত হচ্ছে এই বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, ক্রমশ কমে আসছে বাঘের সংখ্যাও। সুন্দরবনের জীব পরিমণ্ডল রক্ষার জন্য তাই একদিকে বনাঞ্চল এবং বাঘ সংরক্ষণ যেমন অত্যন্ত জরুরি তেমনই দরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আর জীবনযাত্রার মান্নোনয়ন। সুন্দরবনের অরণ্য, মানুষ, উৎসব সব দেখে ফেরার পথে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল।
~ সুন্দরবনের তথ্য ~ সুন্দরবনের আরও ছবি ~
সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী মনিরুল ইসলাম মল্লিক ভালোবাসেন বেড়াতে। বর্তমানে যুক্ত রয়েছেন প্রভাত খবর এবং পথিক ভ্রমণ পত্রিকার সঙ্গে।