অমরনাথের পথে
সুদীপ্ত দত্ত
~ অমরনাথের তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ যাত্রার ট্রেক রুট ম্যাপ ~
২৪ জুন ২০১৪, দুপুর ২টো
ট্রেন ঠিক সময়েই কলকাতা স্টেশন ছাড়ল। জম্মুতাওয়াই এক্সপ্রেস।
আমাদের টিকেট আর.এ.সি. ছিল, শেষ মুহূর্তে রিজার্ভেশন চার্টে দেখলাম কনফার্মড, কিন্তু আমার আর অলিম্পকদার সিট একই কামরার দুই প্রান্তে। ওদিককার এক প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে সিট অ্যাডজাস্ট করে চলে এলাম অলিম্পকদার ব্লকে। একটু পরে অলিম্পকদা (AD) খবর দিল ট্রেনে একটা ছুঁচো ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানি না ছুঁচোর বিস্কুট কতটা প্রিয়, ব্যাগের বিস্কুটগুলো নিয়ে একটু চিন্তাই হল।
AD কে অনেকক্ষণ ধরে তাসের রামি খেলা শেখানোর চেষ্টা করলাম, সব মন দিয়ে শুনল, তারপর কমেন্ট করলো, "খুব কমপ্লিকেটেড। এর চেয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ ভালো"!
রাত ১০ : ৩০
বিকেলে বোকার মত ঠকে গেলাম। কীভাবে ঠকলাম, কেন ঠকলাম তার ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই। ট্রেনে মোবাইলের সোলার চার্জার বিক্রি করছিল একটা ছেলে। কী ইচ্ছে হল একটা চেয়ে নিলাম। টেস্ট করলাম। দেখলাম কাজ করছে। মোবাইলে দেখাচ্ছে "চার্জিং"। দাম বলল ৩৫০ টাকা! আমি নেবনা বলেই ঠিক ছিল। ছেলেটা বলল, "কত দেবেন?" বলে নিজেই ৩০০ টাকা বলল। আমি খানিকটা মজা করেই বললাম ১৫০। ও মা, দেখি তাতেই রাজি হয়ে গেল! বাধ্য হয়েই কিনেই নিলাম। ছেলেটা আমাকে চার্জার গছিয়েই কামরা থেকে হাওয়া! পাশের ব্লকের লোকজন তখন বলল ওই চার্জারের দাম ৫০ টাকাও না। মজার ব্যাপার হল এই ফালতু চার্জার আমি আগেও দেখেছি। ভালো ভাবেই জানি কোনও কাজের নয়। সোলার সেলও লাগানো থাকে না। তবুও সময় সময় কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে যায়। অন্যকে কিনতে দেখে নিজে কতবার মনে মনে হেসেছি! আজ হঠাৎই সামান্য সময়ের মতিভ্রমে নিজেই ঠকে গেলাম!
এর মধ্যে অনেকের সঙ্গেই আলাপ হল যাঁরা অমরনাথ যাচ্ছেন। ব্যানার্জী দাদা–বৌদি - দেবাশীষদা আর জয়ন্তী বৌদি, বর্ধমান থেকে আসছেন - গত বছরও অমরনাথ গেছিলেন। আমাদের অভয় দিলেন – "প্রথম দু' দিন সিওর যেতে দেবে। যদি আটকায় তবে তারপর"। আসলে শুরুতেই শুনেছিলাম রাস্তায় প্রচুর বরফ জমে আছে।
আর দত্ত দাদা–বৌদি, দুলালদা আর বিপাশা বৌদি, এসেছেন উত্তর দিনাজপুর থেকে। বিপাশা বৌদি ভীষণ হাসিখুশি। মোটামুটি একাই জমিয়ে দিলেন আসরটা। প্রথমবার অমরনাথের পথে। কাস্টমসে কাজ করেন। হাই সুগার, কোলেস্টেরলের পেশেন্ট। ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতে হয় প্রায়ই। তার মধ্যেই হেঁটে পহেলগাঁও – চন্দনবাড়ি হয়ে অমরনাথ যাবেন।
২৫ জুন সকাল ৮ টা
ট্রেনে এমনিই আমার ঘুম কম হয়। সকালে ঘুম ভাঙল সাড়ে চারটে নাগাদ। আপার বার্থে ছিলাম। খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলাম। একটু পরে হাত–মুখ ধুয়ে নিলাম। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। এ যেন আমাদের গ্রাম বাংলারই চেনা ছবি। হঠাৎ কয়েকটা ময়ূর দেখে বেশ আনন্দ লাগল। ময়ূর এখানে খুবই সাধারণ দৃশ্য, কিন্তু আমাদের অনভ্যস্ত চোখে নতুন ঠেকে। ট্রেন যখন অযোধ্যা ছেড়ে আচার্য নরেন্দ্রদেব নগরে পৌঁছল দেখতে পেলাম স্টেশনে অসংখ্য বাঁদর - বাচ্চা, বুড়ো, মা সবাইকে নিয়ে বাঁদরের ভরা সংসার । স্টেশনে ঢুকতেই সবাই দলবেঁধে ট্রেনটাকে ঘিরে ধরল। বাঁদরের বাঁদরামোর অনেক কাহিনি জানা আছে । তাই ওদের ঘাঁটাতে সাহস পেলাম না । এরই মধ্যে বিপাশা বৌদি গুড মর্নিং জানিয়ে গেলেন । এখন ব্রেকফাস্ট টাইম ।
২৭ জুন সকাল ১০ টা
কাল ডায়েরি লেখার সময় পাইনি। আসলে যখন সময় পেয়েছিলাম তখন আর এনার্জি বা ইচ্ছে কোনওটাই ছিল না। কাল জম্মুতে ট্রেন থেকে নামলাম তখন মনে হয়নি যে সারা দিন এতটা ঘটনাবহুল হবে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম, সঙ্গে দুলালদা, বিপাশা বৌদি, দেবাশীষদা আর জয়ন্তী বৌদি। জম্মু নেমেই লক্ষ্য করলাম আমাদের মোবাইল ফোন কাজ করছে না। প্রি–পেইড মোবাইল জম্মু–কাশ্মীরে অচল। পোস্ট পেইড কানেকশন কাজ করে, কিন্তু কারো কাছেই পোস্ট পেইড কানেকশন ছিল না। অবশ্য অমরনাথ যাত্রার পারমিট নেওয়ার পর যে কোনও যাত্রা ক্যাম্প থেকে সাময়িক ফোন কানেকশন পাব। তবে জম্মুতে এখনও সেই কানেকশন নেওয়ার কাউন্টার খোলা হয় নি। দেবাশীষদার এক আত্মীয় জম্মুতে থাকেন। তাঁকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল। জম্মুতে নেমে একটা বুথ থেকে সেই আত্মীয়কে ফোন করা হল। তিনি বললেন "আজ জম্মুতে থেকে যান, কাল গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনিতেও আপনারা আজ যেতে পারবেন না"। দেবাশীষদা বুঝলেন গাড়ির ব্যবস্থা হয়নি, নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে। কাছেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে একদম সামনে বেশ কতগুলো কাউন্টার খোলা আছে। সেখানে কাটরা যাওয়ার কোন গাড়ির কত ভাড়া তার বিস্তারিত চার্ট দেওয়া আছে। কিন্তু কোথাও পহেলগাঁও, বালতাল বা শ্রীনগরের ভাড়ার কথা লেখা নেই। জিজ্ঞাসা করতে শুনলাম – নতুন চার্ট কয়েক দিনের মধ্যে এসে যাবে। বুঝলাম এই রুটে ভাড়া ইচ্ছেমত ওঠানামা করে। যাই হোক, একটা গাড়ি বুক করা হল, পড়ল ৬৫০০ টাকা, অবশ্য টাকাটা আমরা সবাই শেয়ার করে নেব। প্রথমে যাব পহেলগাঁও। সেখান থেকে কাল চন্দনবাড়ি পৌঁছে অমরনাথের পথে হাঁটা শুরু। সকাল ১০টা নাগাদ জম্মু থেকে রওনা দিলাম। সঙ্গে ড্রাইভার বিজয় শর্মা। প্রথমে তাওয়াই নদী আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। পরে সেই দায়িত্ব পড়ল চিনাব নদীর ওপর। ছানি বলে একটা জায়গায় দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারলাম। এদিকে আকাশটা একটু মেঘলা হয়ে এল দেখে ড্রাইভারকে বললাম গাড়ির মাথার ওপরে থাকা ব্যাগ-পত্তরগুলোকে ঢেকে দিতে। সে বলল – ঢাকার মত কোনও ত্রিপল থাকলে তবে তো ঢাকবে! কুদ থেকে ত্রিপল কিনে নেওয়া হল। পথে খুনীনালা বলে একটা জায়গা পড়ল। আগে এখানে ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা হত - অনেকে মারাও গেছে। এখন রাস্তাটা পাহাড়ের থেকে একটু সরিয়ে বানানো হয়েছে। পাশে তৈরি হয়েছে একটা মন্দির। এখন নাকি আর পাথর পড়ে না। রামসু পৌঁছলাম দুপুর বারোটায়। দেখি সামনে সার বেঁধে গাড়ি দাঁড়িয়ে। শোনা গেল বানিহালে কোথাও একটা অয়েল ট্যাঙ্কার উল্টে গেছে। গাড়ির সারি প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ জুড়ে রয়েছে! রামসু-তে একটা সরু নালা বয়ে গেছে। আমি ঢালু পথ ধরে নেমে গেলাম নালার ধারে। পরিচয় হল গুজরাতের পীযুষ প্যাটেলের সঙ্গে। কাশ্মীর ঘুরতে এসে আমাদের মতই আটকে পড়েছে। প্রায় চার ঘন্টা আটকে থাকার পর আস্তে আস্তে গাড়ি চলা শুরু করল। বানিহালে গিয়ে আবার গেল থমকে। বানিহাল শহরটা বেশ জমজমাট। জায়গায় জায়গায় গরম জামাকাপড়ের দোকান। প্রচুর ব্যাঙ্ক আর ATM, কিন্তু একটাও STD বুথ খুঁজে পেলাম না। প্রায় সাতটা বেজে গেল ট্রাফিক জ্যাম থেকে ছাড়া পেতে। জম্মু ও কাশ্মীরের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তার ওপর জওহর টানেলে গাড়ি পৌঁছলে মনে হল হয়তো এতক্ষণে সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। তাই শুনে বাবা অমরনাথ অলক্ষে হাসলেন।
জওহর টানেল, প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা। পাহাড় ভেদ করে পাশাপাশি দুটো টানেল, দুদিকে গাড়ি যাতায়াত করার জন্য। চারদিকে নিরাপত্তার বেষ্টনী। সন্ত্রাসবাদীরা কতবার চেষ্টা করেছে ভারতবর্ষের এই গর্বকে ধ্বংস করার। কিন্তু আমাদের বীর সেনাবাহিনী প্রতিবার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে। জওহর টানেল থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি আবার গাড়ির লম্বা লাইন। তখন ঘড়িতে রাত আটটা। অথচ তখনও দিনের আলো রয়েছে। এখানে সন্ধ্যা হয় অনেক দেরিতে। শুনলাম সামনে টোল প্লাজা। সেখানেই নাকি অয়েল ট্যাংকারে গোলযোগ। এভাবেই কেটে গেল ঘন্টা দু'য়েক। এখান থেকে দু'টো রাস্তা পহেলগাঁও গেছে। একটা সোজা রাস্তা আর দূরত্বও কিছু কম। অন্যটার দূরত্ব প্রায় ২০–৩০ কিলোমিটার বেশি। ড্রাইভার বিজয়জি প্রায় উদ্ভ্রান্তের মত চেষ্টা করে গেলেন দুটো রাস্তার কোনও একটা দিয়ে যাওয়ার। তাঁর কথায় – "ইয়ে জাগা বহৎ খতরনাক হ্যায়"। কিন্তু একটা রাস্তার টোল বন্ধ করা হয়েছে, অন্যটা দিয়ে কোনও গাড়ি যাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম অথচ একটা গাড়িকেও যেতে দেখলামনা। আমাদের গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার থেকে দোকানপাট একটু দূরে। মনে হচ্ছিল হয়তো সারারাত গাড়িতেই কাটাতে হবে। বিজয়জি গাড়ির মুখ ঘোরানোর একবার চেষ্টা করলেন যদি কোনও থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা যায়। অন্ততঃ রাতটা গাড়িতে বসে কাটাতে হবে না। এদিকে বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে। গাড়ির ছাদ থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে নেওয়া হল। গাড়ি উলটো দিকে ঘুরিয়েও বিশেষ লাভ হল না। শ'দুয়েক মিটার গিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। অসংখ্য গাড়ির মাঝে ফেরত যাওয়ার রাস্তাও প্রায় বন্ধ। গাড়িকে যেখানে দাঁড় করানো হল সেখানে কিছু দোকানপাট আছে। চা, বিস্কুট আর পানীয় জল পাওয়া গেল। ঠিক কত রাত হবে বলা মুশকিল - ঘড়ি দেখার ইচ্ছেটাও তখন চলে গিয়েছিল।
খানিক পরে আবার গাড়ি এগোল। খুব সম্ভব তখন রাত দশটা কি সাড়ে দশটা। টোল-এর কাছে পৌঁছলে বিজয়জি খুব তাড়াতাড়ি কুপন কেটে, গাড়ি বের করে নিয়ে এলেন। কোথাও কোনও খারাপ হওয়া ট্যাঙ্কার দেখতে পেলাম না। যা দেখা গেল সেটা হল টোল-এ কুপন কাটার জন্য ড্রাইভারদের লম্বা লাইন। কে জানে "খতরনাক" হওয়ার জন্য হয়তো নিরাপত্তার কারণেই রাস্তা বন্ধ করা হয়েছিল। টোল পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছল কাজিগুন্ডে। আপার বাজার কাজিগুন্ডে এসে ড্রাইভারজি খাওয়া দাওয়া করে নিলেন। আমাদের তখন আর খিদের অনুভূতি নেই। হয়তো থাকার একটা ব্যবস্থা করা যেত, কিন্তু পহেলগাঁও না পৌঁছে এখানে থাকতে কেউই রাজি হলাম না। বাজারটা একটু ঘুরে দেখলাম। এখানে খুব ভালো কাঠের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ক্রিকেট ব্যাট, হকি স্টিক, কাঠের ঘড়ি, হরেক রকম কাঠের শো-পিস ছাড়াও দেখলাম শীতের কাপড়, আখরোট, খোবানি, কাজু, কিস্মিস্ এমনকি আমসত্বও। বাজার ঘুরে এসে গাড়িতে পৌঁছে আবার এক নতুন খবর পেলাম। পহেলগাঁও থেকে অমরনাথ যাত্রা বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্ততঃ ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখ যেতে দেওয়া হবে না। ১ তারিখ আবার পুনর্বিবেচনা করা হবে। আমি আর অলিম্পকদা যেন একটা প্রচন্ড শক্ খেলাম। প্রায় ৫ মাসের প্রস্তুতি, তিল তিল করে গড়ে তোলা অমরনাথ দর্শনের আশা, স্বপ্ন সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে! মনে পড়ল, সেই কবে পাশের বাড়ির মেজদা প্রথম বলেছিল অমরনাথ যাত্রার পরিকল্পনা। মেজদা আগে একবার অমরনাথ দর্শন করেছিল, আবার মন টানছিল পথে নামার। কথাটা সৌরভদাকে বলতে সেও এক কথায় রাজি হয়ে গেল। মানবদা আর অলিম্পকদা যখন জানতে পারল, এক মুহূর্ত না ভেবেই আমাদের সঙ্গী হওয়ার কথা জানিয়ে দিল। তারপর ফেব্রুয়ারি–মার্চে যখন ফিটনেস টেস্টে মেজদা আর সৌরভদা পারমিশন পেল না, সেটা ছিল আমাদের কাছে প্রথম বড় ধাক্কা। তা সত্ত্বেও আমরা তিনজন যাওয়ার জন্য মনে প্রাণে প্রস্তুত ছিলাম। যাত্রার মাত্র দিন চার-পাঁচেক আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে, লিগামেন্টে চোট পেয়ে মানবদার যাওয়াও বাতিল হল। আমরা দু'জন শেষ পর্যন্ত আশা জিইয়ে রেখেছি। বন্ধু আত্রেয়ী বারবার সতর্ক করেছিল পথে বিপদের কথা জানিয়ে। বলেছিলাম – "কোনও চিন্তা নেই। ঠিক চলে যাব অমরনাথ"। আর এখানে এসে শুনছি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ! ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা চার তারিখের। তাই ইচ্ছে থাকলেও যাত্রা শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব কী না জানি না।
দেবাশীষদা একটু পরে খবর এনে দিলেন যে বালতাল হয়ে অমরনাথ যাওয়ার রাস্তা খোলা আছে। আর ২৮ তারিখ যাদের চন্দনবাড়ি হয়ে যাওয়ার পারমিট করা আছে তাদের বালতাল দিয়ে যেতে দেওয়া হবে। খবরটাই যেন কোথায় আবার একটা আশার আলো দেখতে পেলাম। আসলে সমস্ত ব্যাপারটা আমরা আগেই জানতে পারতাম যদি জম্মুতে নেমে কোনও খবরের কাগজ কিনতাম বা যদি ফোন কানেকশন কাজ করত। দেবাশীষদার আত্মীয়ও এটাই বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষের কথাগুলো আর শুনে ওঠা হয় নি।
কাজিগুন্ড থেকেই আমরা নতুন করে যাত্রাপথ ঠিক করলাম। ঠিক হল, পহেলগাঁও নয় - আমরা সরাসরি চলে যাব শ্রীনগর। পহেলগাঁওতে আমাদের দু'দিনের হোটেল বুক করা ছিল, সেই বুকিং ক্যানসেল করারও কোনও উপায় এখন নেই।
শ্রীনগর যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় রাত দু'টো। বিজয়জির যোগাযোগে অত রাতেও আমরা শ্রীনগরে একটা হোটেল পেলাম, মাত্র ১৩০০ টাকায়। হোটেল কর্তৃপক্ষের আতিথেয়তায় আমরা সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলাম। আমাদের সমস্ত ব্যাগ-পত্তর হোটেলের লোকরাই ওপর পর্যন্ত তুলে নিয়ে এল। অত রাতেও খাবারের ব্যবস্থা করল। হোটেল ম্যানেজার নিজেই তাঁর মোবাইল এগিয়ে দিলেন বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। সত্যিই জানি না কিভাবে ড্রাইভার বিজয়জি ও হোটেল কর্তৃপক্ষকে কৃতজ্ঞতা জানানো যায়। বিজয়জি শ্রীনগর পর্যন্ত আসায় অতিরিক্ত ২২০০ টাকা চাওয়ায় দেবাশীষদা বিশেষ অসন্তুষ্ট হলেও অতটা অতিরিক্ত পথ, অত রাত্রে আমাদের নিরাপদে শ্রীনগর নিয়ে আসার যে দায়িত্ব নিজে থেকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শুধু মানবিকতার খাতিরে, তা অস্বীকার করি কি করে? বলা বাহুল্য আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যে তরতাজা, ঝরঝরে লাগছে তার পুরো কৃতিত্বই তো বিজয়জির।
সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সেই কবে বাড়ি থেকে স্নান করে বেরিয়েছিলাম! তারপর একটু হাঁটতে বেরোলাম। জানতে পারলাম জায়গাটার নাম শিবপুরা। পাশে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তার আড়ালেই নাকি বিখ্যাত ডাল লেক। এখানকার সব বাড়িতেই দেখলাম লেখা BBC। কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন স্থানীয়কে জিগ্যেস করেই ফেললাম এর মানে। ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন এর সঙ্গে ব্রিটিশ সম্প্রচার সংস্থার কোনও যোগাযোগ নেই। B B C হল বাদামি বাগ ক্যান্টনমেন্ট। সামনেই একটা সেনা চৌকির অন্তর্গত এলাকা এটি। আরও জানা গেল, পাশের আপাত নিস্তরঙ্গ নদীটিই ঝিলম, যার উৎপত্তি ভেরিনাগ হ্রদ থেকে, গিয়েছে পাকিস্তানে। নদীর ওপর ভেসে বেড়াতে দেখলাম কতগুলো ক্যানো জাতীয় নৌকা - এগুলোই "শিকারা"। আরেকটু এগিয়ে যেতে একটা বাজার এলাকা দেখতে পেলাম, নাম বাটওয়ারা। কাছেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গুলমার্গ, সোনমার্গ আর জম্মুর ভাড়া জানতে চাইলাম। জানা গেল ২২০০, ২৫০০ আর ৬৫০০ টাকা। সামনে একটা ফেয়ার টেবিলে দেখলাম অনেক কম ভাড়া লেখা আছে। প্রশ্ন তুলতেই জানানো হল – ওটা বহু পুরানো লিস্ট, ২০১২ সালের। দু'এক দিনের মধ্যেই নতুন লিস্ট আসবে। মনে ধন্ধ রয়েই গেলো, একই উত্তর কি জম্মু, শ্রীনগর সব জায়গাতেই পাওয়া যায়!
২৭ জুন বিকেল ৫টা
দুপুরে আবার একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল। মোবাইলটা চার্জে বসিয়েছিলাম। হঠাৎ একটা ফট্ করে শব্দ করে চার্জারটা নষ্ট হয়ে গেল। অতঃপর ভরসা সেই "সোলার চার্জার"। হাতে দুটো অতিরিক্ত ব্যাটারি আছে ঠিকই কিন্তু কদিন চলবে জানি না। আর সোলার চার্জারেই বা কতটা ভরসা করা যায় কী জানি! দুপুরে দুলালদা একটা তরমুজ কাটল। এটা আসার সময় রামবন থেকে কেনা হয়েছিলো। তরমুজ খাওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ আমরা ফেলেছিলাম ডাষ্টবিনে। কিন্তু দেবাশীষদা ফেলছিলেন হোটেলের লনে। পরে অলিম্পকদার কাছে শুনেছিলাম, সেগুলো হোটেল মালিক নিজে হাতে পরিস্কার করেছেন। দেবাশীষদাকে জিজ্ঞাসা করায় নাকি বলেছেন – "আমি ফেলিনি । কে যে করে এমন কাজ ... " ! ভোর রাতে আমাদের বেরোতে হবে বালতালের উদ্দেশ্যে। চেষ্টা করব ক্যাম্প থেকে একটা মোবাইল সিম জোগাড় করার।
২৯ জুন, রাত ৯টা
প্রায় দেড়দিন ডায়েরি লিখতে পারি নি। লেখার মত পরিস্থিতিই ছিল না। পুরো সময়টাই ঘটনাবহুল। গতকাল ভোর চারটে নাগাদ হোটেল থেকে গাড়ি রওনা দিয়েছিল বালতাল। যাত্রী আমরা ছ'জন। বালতাল পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল ছ'টা। আমাদের সঙ্গের মালপত্রগুলো চেক করা হল। ব্যাগে একটা স্টীলের ফ্লাক্স ছিল, এক্স-রে তে সেটাও ধরা পড়ল। আবার ব্যাগ খুলে দেখাতে হল যে ওটা জলেরই বোতল, বিপজ্জনক কিছু না। যাত্রা পারমিট দেখিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম মেন গেটের (Access Control) দিকে। পথে দেখি এক ঘোড়াওয়ালা ঘোড়াকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটার মাথায় হাত বুলিয়ে সহিসকে জিগ্যেস করলাম ঘোড়ার নাম কি? বলল – "রাজু"। AD জিগ্যেস করল "বালতাল থেকে গুহা অবধি কত পড়বে? বেচারা সবে তার ঘোড়া নিয়ে ক্যাম্পে এসেছে। বলল, আমি এখনও রেট জানি না। একটু এগিয়ে যেতেই আরেক সহিসকে পাওয়া গেল। এ ছেলেটি অলরেডি রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছে। গলায় ঝোলানো আইডেন্টিটি কার্ড। আমি বা অলিম্পকদা, কেউই দরদস্তুর করতে পারি না। ওর বলা ২২০০ টাকাতেই রাজি হয়ে গেলাম। গুহা পর্যন্ত যাওয়া আবার বালতাল ফিরে আসা পর্যন্ত ঘোড়া আমাদের সঙ্গে থাকবে। ইচ্ছে ছিল, যতটা পারব আমরা হেঁটেই চলব। ঘোড়ার কাছে থাকবে আমাদের ব্যাগগুলো। আমাদের কেউ হাঁপিয়ে গেলে খানিকক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে এগোব। সহিসের নাম আলতাফ মালিক। ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতাফকে জিগ্যেস করলাম – "তোমার ঘোড়ার নাম কি?" উত্তর এলো – "রাজু"! রাস্তার ধারে দেখলাম এক বয়স্ক লোক লাঠি বিক্রি করছে। দুজনের জন্য দুটো লাঠি চল্লিশ টাকা করে কিনে নিলাম। সঙ্গে নিলাম ধুলো আটকানোর মাস্ক। আলতাফই বলল কিনে নিতে। দশ টাকার একটা মাস্কে নিজের মুখটা আটকে নিলাম।
মাইকে অ্যানাউন্স করছিল সকাল আটটার পর আর কাউকে যাত্রাপথে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। আমরা তাড়াতাড়ি মেন গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেন গেটের দূরত্বটা আন্দাজের থেকে একটু বেশিই। 'দোমেইল' প্রায় দু'মাইল বলেই মনে হল, আসলে দু'কিলোমিটার। গেটে আরেক দফা চেকিং হল। পারমিট দেখানো হলে যাত্রার অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম অসংখ্য ভাণ্ডারা। বিশেষভাবে নজরে এল পাঞ্জাবী, গুজরাতি আর উত্তরপ্রদেশের ভাণ্ডারা। একজন আমাদের হাতে কিছু লজেন্স ধরিয়ে দিল। আলতাফ আবার কয়েকটা কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিল। তাতে একদিকে ছিল বাবা ভোলানাথের ছবি ও উল্টো দিকে প্রণাম মন্ত্র। ঘোড়ার পিঠে আমাদের ব্যাগ দুটো তুলে আমরা আস্তে আস্তে চড়াই পথে উঠতে থাকলাম । পথে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীর কাছে শুনেছিলাম এবার অমরনাথ যাত্রা সুরক্ষিত করার দায়িত্বের বড় অংশ রয়েছে বাংলা ব্রিগেডের হাতে। তাই মিলিটারির একটা বড় অংশ বাঙালি। সামনে দু'জন মিলিটারিকে দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করলাম –তাঁরা কোত্থেকে এসেছেন। পালটা প্রশ্ন এল – আপনি কোত্থেকে ? কলকাতা বলতেই এক মিলিটারি আরেক জনকে দেখিয়ে বলল, "ও এসেছে বেঙ্গল থেকে"। মালদার দীপঙ্কর দাস সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন যাত্রী সুরক্ষার দিকে। হঠাৎ দেখি সামনে একটা ঝঞ্ঝাট তৈরি হয়েছে। সমস্ত ঘোড়াকে এক লাইনে রেখে ডান দিক দিয়ে পায়ে হাঁটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই দেখে ঠিক করলাম, আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই, একটু পরেই আলতাফ–রাজু আমাদের ধরে ফেলবে। আমরা এগোতে থাকলাম। একটু পরেই চোখে পড়ল একটা বড় ভাণ্ডারা, মোরাদাবাদের। ভাণ্ডারায় শিবের নামগান চলছে আর সবাই তার তালে তালে নাচছে। যারা খাবার পরিবেশন করছে তারাও সেই তালে তাল মিলিয়েছে। সামান্য কিছু খেয়ে ঘোড়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিপাশা বৌদির হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে একটা ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়েছিলেন। তিনিও ভাণ্ডারায় এসে পড়লেন। কিন্তু আমাদের ঘোড়ার কোনও খোঁজ নেই। নানা দিকে খোঁজ করলাম, মিলিটারিকে জিগ্যেস করলাম, একটাই উত্তর পেলাম – "সহিসের আইডেন্টিটি কার্ডটা আপনার কাছে আছে তো? তাহলে ঠিক পেয়ে যাবেন"। আমার হঠাৎ খেয়াল হল প্রায় সব টাকা পয়সাই ওই ব্যাগে রয়ে গেছে ! এবার যদি ঘোড়াকে খুঁজে না পাই কপর্দকশূন্য হয়ে বাকী পথ কাটাতে হবে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে মা কিছু টাকা পকেটে দিয়ে দিয়েছিল। এটা মায়ের অনেকদিনের অভ্যাস। স্কুল যাওয়ার সময় আমার কাছে টাকা-পয়সা না থাকলে মা কিছু টাকা দিয়ে দিত। আমিও চেষ্টা করতাম টাকাটা বাঁচিয়ে রাখতে। এবারও মায়ের দেওয়া সেই টাকাটাই আমার একমাত্র সম্বল। শুধু একটা লাঠি হাতে এগিয়ে চললাম। অলিম্পকদা আমার পেছন পেছন আসতে লাগল। সবচেয়ে ভালোভাবে এগিয়ে চললেন দেবাশীষদা আর জয়ন্তী বৌদি। বেশ কয়েকটি ট্রেকিং –এর অভিজ্ঞতা আছে ওঁদের। দুলালদা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। পরপর বেশ কয়েকটা চড়াই পেরিয়ে এলাম। এবার আস্তে আস্তে গতি কমে আসছে। অলিম্পকদাও খুবই ক্লান্ত। জলের বোতল রয়েছে ঘোড়ার পিঠের ব্যাগে, যার কোনওই খোঁজ নেই। বিপাশা বৌদি ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে গেছেন। দুলালদা অনেক পেছনে। একটু পরে দেখি অলিম্পকদাও একটা ঘোড়ায় চড়ে বসল। ওকে সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগছিল। আমাকেও বলল একটা ঘোড়া করে নিতে। রাজি হলাম না। আসলে আমার ধারণা ছিল যে আর খুব বেশি পথ বাকি নেই। এক মিলিটারিকে দূরত্ব জিগ্যেস করতে উত্তর এল – "বাস অউর দো চড়াই, উস্কে বাদ স্রেফ উতরাই"। অলিম্পকদা চলে যাওয়ার পর একা পথ চলতে লাগলাম।
কিন্তু "দো চড়াই" তো আর শেষ হয় না! ক্রমশঃ ওপর দিকে উঠেই চলেছি। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এই চড়াইটা শেষ হলেই পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যাব। কিন্তু যখন সেইপর্যন্ত পৌঁছাই দেখি আরও ওপরে পাহাড় যেন নতুন করে গজিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে ক্লান্তি বাড়তে লাগল। কখনও থমকে দাঁড়াচ্ছি। কখনও রাস্তার পাশে বসে পড়তে বাধ্য হচ্ছি। আমার ক্লান্ত চেহারা দেখে সবাই বসার জায়গা করে দেয়। পথে একজায়গায় দেখি একটি ছোট ছেলে, বাবার সঙ্গে এসেছে অমরনাথ দর্শনের আশায়, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল পথের পাশে। আবার একটু পরে "ব্যোম ভোলে" বলে উঠে পথ চলা শুরু করল। হাতে সামান্যই টাকা আছে, তাতে ঘোড়া নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। কে জানে আলতাফকে আর খুঁজে পাব কি না। ধীরে, খুব ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম। আমরা রওনা দিয়েছিলাম যাত্রার একদম প্রথম দিনেই। তাই ভাণ্ডারার সংখ্যাও ছিল খুব কম। পথে ফ্রুট জুস কিনতে বাধ্য হলাম। কুড়ি টাকার ফ্রুট জুস কিনতে হল পঞ্চাশ টাকায়। এতটাই আস্তে পা ফেলছিলাম যে সবাই যেতে যেতে একবার আমার দিকে করুণার চোখে তাকাচ্ছিল। তবুও থামছিলাম না। অনেকেই হয়তো আমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একটু পরে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় তাদের আবার ধরে ফেলছিলাম। প্রত্যেকেই উৎসাহ দিচ্ছিল – "জয় ভোলে"! অস্ফুট গলায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম – "ব্যোম ভোলে"। এ যেন অনেকটা কাউকে দেখে "Good Morning" জানালে প্রত্যুত্তরে "Good Morning" শুনতে পাওয়ার মত, তফাৎ একটাই, "জয় ভোলে" ধ্বনি যেন এক নতুন উদ্দীপনা জোগায়। যেন আশ্বাস দেয় – তুমি পারবে, ঠিক পারবে। একটু এগিয়ে যেতে দেখি এক ভদ্রমহিলা, বেশ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করে হাঁক দিলাম – "জয় ভোলে"। কোন উত্তর না পেয়ে আবার এগিয়ে গেলাম। একটু পরে দেখলাম উনিও ঘোড়াকে পথের সঙ্গী করে নিয়েছেন। উপায় থাকলে হয়তো আমিও ঘোড়ার পিঠে নিজেকে সঁপে দিতাম, কিন্তু বাবা অমরনাথ যতটুকু দরকার ততটুকু রেখে বাকিটুকু সরিয়ে রেখেছেন নাগালের বাইরে। এ যেন বাবা-মা তার সন্তানকে বড় করার জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু দেন, বাকিটা রেখে দেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, সেরকমই। ক্লান্তিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম । বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু দাঁড়াতেই চোখে পড়ল এক তুষারধবল গিরিচূড়া। নীল আকাশ যেন সেই গিরিশিখরকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নীচে গভীর খাতের পুরোটাই হিমবাহে ঢাকা।
হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু হয়েছে প্রথম দিন থেকেই। তিনটে হেলিকপ্টার যাতায়াত করছে, একটা অনেক ওপর দিয়ে, একটা আমাদের লেভেলে, আর অন্যটা আমাদের লেভেলের অনেক নীচে, গিরিখাতের মাঝ দিয়ে। চলতে চলতে রাস্তার প্রকৃতিরও পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথম দিকে রাস্তা ছিল পাথরের। ছোট ছোট নুড়ি দিয়ে তৈরি। এরপর পেলাম মাটির রাস্তা। ঘোড়ার যাতায়াতে মাটি প্রায় ধুলো হয়ে গেছে। মাস্কটা দিয়ে কোনও রকমে ধুলো আটকানোর চেষ্টা করছি। চলতে চলতে আবার একটা ভাণ্ডারার কাছে এসে উঠলাম। দেখলাম দেবাশীষদারা কিছু খেয়ে নিচ্ছে। আর্মি থেকে সবাইকে গরম জল খাওয়ানো হচ্ছে। ভাণ্ডারার কাছে রাস্তা বরফে পিছল হয়ে আছে। মিলিটারি সাহায্য করছে রাস্তা পার হতে। দুর্বল পায়ে এগোতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। হাতের লাঠি ও এক মিলিটারির সাহায্যে কোনও রকমে সামলে নিলাম। এগোতে এগোতে যখনই উল্টো দিক থেকে কাউকে আসতে দেখি একবার জিগ্যেস করি – "অমরনাথজির গুহা আর কতদূর"? উত্তরটা প্রায় সবসময়ই এক থাকে। অর্থাৎ মনে করছি অনেক হেঁটেছি কিন্তু আসলে একটুও এগোইনি। একবার একজনকে জিগ্যেস করে উত্তর পেলাম ৫ কিলোমিটার। কিছু পরে আরেকজনের কাছে উত্তর পেলাম ৭ কিলোমিটার। ধন্ধে পড়ে যাই মাঝে মাঝে, রাস্তা ঠিক ১৪ কিলোমিটারই তো? একটা জায়গায় দেবাশীষদাদের দেখাদেখি শর্টকাট নিতে গিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চড়াই পেরোতে হল। কোনও রকমে ওপরে উঠে বসে রইলাম প্রায় ১০ মিনিট। তারপর কাছের এক দোকান থেকে একটা জলের বোতল কিনে নিলাম । ততক্ষণে বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে। ভাবছি অলিম্পকদা আর বিপাশা বৌদির এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। ওরা কি আবার আমায় খুঁজতে পেছনে আসবে? না আমার জন্য অপেক্ষা করবে? পাশে দেখি একটি মেয়ে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ক্লান্ত, এগিয়ে চলেছে বাবা ভোলানাথের নামগান করতে করতে। কী সুন্দর সেই শ্লোক! হয়তো তার এক লাইনও আমার মনে নেই, কিন্তু সেই সুর মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে এগিয়ে চলি। পথে পড়ল একটা পাহাড়ি ঝরনা। সুন্দর কাঠের সাঁকো ঝরনাটা পেরোনোর জন্য। সাঁকোর পাশ থেকে ঝরনার জল হাতে নিই, শীতল পরশ অনুভব করি। যেন কিছুটা হলেও ক্লান্তি দূর হয়। কখন যেন রাস্তা অনেক সমতল হয়ে এসেছে। চলার ক্লান্তি কিছুটা হলেও গা-সওয়া হয়ে গেছে। এখন চলার পথ পাতলা পাথরে ঢাকা। কোথাও কোথাও জল পড়ে কর্দমাক্ত। আমার পায়ের জুতোটা নামী কোম্পানির ট্রেকিং স্যু। তাই বেশি অসুবিধা হয় না, কিন্তু অনেকেই দেখলাম অবলীলায় খুব সাধারণ জুতো পরেই রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। আরও বেশ কিছুদূর গিয়ে একজনকে গুহার কথা জিগ্যেস করতে উত্তর পেলাম – এই ব্যস পৌঁছেই গেছেন। আর মাত্র দুই কিলোমিটার। অথচ সামনে তো গুহার কোনও চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না! কেবল রুক্ষ পাহাড়, বরফেরও কোনও চিহ্ন নেই। মনে মনে হিসেব করলাম আমার চলার যা গতি তাতে এক কিলোমিটার যেতে অন্ততঃ এক ঘন্টা লাগবে। মানে আরও দু'ঘন্টা আমায় হাঁটতে হবে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন এল – অতক্ষণ বাবার মন্দির খোলা থাকবে তো? আমি কি সুযোগ পাব বাবার চরণে প্রণাম নিবেদন করার? পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার পরে আর কোনও যাত্রী আছে কী না। আশ্বস্ত হই, আরও অনেকেই লাঠি হাতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে একই পথে, এখনও একা হয়ে যাইনি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে দেখতে পেলাম এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। একটা তুষার-ধবল উপত্যকা। যেন মনে হচ্ছে সমস্ত এলাকাটা দুধের ধারায় স্নান করানো হয়েছে। দু'পাশে দুটি পাহাড় আর তার গা ঘেঁষে দু'তিনটি রাস্তা। একদিকের রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি, অন্য রাস্তাও জনবিরল নয়, ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের সারি এগিয়ে চলেছে মায়াবী উপত্যকার দিকে। ক্লান্ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও অবাক চোখে চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ সেই উপত্যকার দিকে। বিস্ময়ে ছবি তুলতেও ভুলে গেলাম সেই মোহময় দৃশ্যের। আচমকা মনে পড়ল মন্দির বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এল। আমাকে পৌঁছতেই হবে। আবার ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। এক ফিরতি পথচারীকে জিগ্যেস করলাম – গুহা আর কতদূর? ভদ্রলোক খুব অবাক হলেন, তারপর আমার ক্লান্ত চেহারা দেখে উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন – আপনি পৌঁছেই গেছেন। এই সামনের বাঁকটা ঘুরলেই বাবার গুহা দেখতে পাবেন। জয় ভোলে! খুশিতে মনটা ভরে উঠল। আস্তে আস্তে বাঁকের দিকে এগিয়ে চললাম। বরফের ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। পায়ে জোর পাচ্ছিলাম না। মাঝে দুবার পা পিছলে পড়েও গেলাম। অন্যরা ধরে তুলল। উপত্যকায় প্রবেশের ঠিক মুখে দেখি বিপাশা বৌদি বসে আছেন অসহায় ভাবে। দুলালদা এসে পৌঁছাননি। বৌদি তখনও খুব দুর্বল। পয়সাকড়িও দাদার কাছে। আমাকে দেখে যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলেন। আমি বললাম, আমি গুহার দিকে এগোচ্ছি, আপনিও ধীরে ধীরে আসার চেষ্টা করুন। যেখান থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে সেখানে পৌঁছে চেষ্টা করব অলিম্পকদাকে খুঁজে বার করার। বলে আবার কাঁপা পায়ে, পিছলে পড়তে পড়তে এগিয়ে যেতে লাগলাম গুহার দিকে। হঠাৎ পাশ থেকে একটা ডাক ভেসে এল – "আরে বাবু। হাম কব সে আপকা ইন্তেজার কর রহে হ্যায়। আপ ইতনা দের তক কাঁহা থে?" তাকিয়ে দেখি আলতাফ ওর ঘোড়া রাজু আর আমাদের ব্যাগজোড়া নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ও অনেক আগে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। ওর সঙ্গে অলিম্পকদারও দেখা হয়নি। মনে হল যেন এক পরম বন্ধুকে খুঁজে পেলাম। বললাম আমি অলিম্পকদাকে খুঁজতে যাচ্ছি গুহার দিকে। শরীরের অবস্থা দেখে আলতাফ আমাকে রাজুর পিঠে উঠিয়ে দিল। আমরা এগোতে থাকলাম অমরনাথজীর গুহার দিকে। কিছুদূর এগোতেই দেখি অলিম্পকদা রাস্তার পাশে সদ্য তৈরি হতে যাওয়া একটা দোকানে গালে হাত দিয়ে চিন্তিত ভাবে বসে আছে। আমাকে দেখেই AD-র চোখে একটা খুশির ঝিলিক দেখতে পেলাম। ধরাধরি করে রাজুর পিঠ থেকে নামানো হল আমাকে। আলতাফকে দুজনেই ধন্যবাদ জানালাম। ওকে আগেই বলেছিলাম যে আমার ব্যাগে একটা জলের বোতল আছে, তেষ্টা পেলে যেন সেখান থেকে জল খেয়ে নেয়। বলল, ও শুধু সামান্য জল খেয়েছে। অমরনাথের পথে যে সহিসরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাত্রীদের ভোলেবাবার দর্শনের ব্যবস্থা করে দেয়, তারা গরীব হতে পারে, কিন্তু কখনোই অসৎ নয়। আলতাফ আমাদের বলেছিল যে ও জয়পুরের এক মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা করছে। চূড়ান্ত আর্থিক কষ্টের মধ্যেও ও কিন্তু শিক্ষাকে অবহেলা করেনি। আমরা ঠিক করলাম শেষ বিকেলে আর বালতালের পথে পা বাড়াব না। বরং গুহার কাছেই তাঁবুতে রাতটা কাটিয়ে দেব। সেইমত আলতাফ এবং রাজুকে বিদায় জানালাম। আমার দেখা না পেয়ে অলিম্পকদা ভীষণ মুষড়ে পরেছিল। ভেবেই নিয়েছিল এ যাত্রা আর হয়তো অমরনাথজীর পুজো দেওয়া হবে না। অন্ততঃ সে দিন তো নয়ই। এবার আবার নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি শুরু করল। হাতে সময় অল্প, একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে মন্দির। দুজনেই অসম্ভব ক্লান্ত - গুহা প্রায় ৫০০ মিটার দূরে। অলিম্পকদা খুব তাড়াতাড়ি একটা টেন্ট ভাড়া করে ব্যাগপত্র সেখানে রেখে এল। কাছের একটা দোকান থেকে পুজোর সামগ্রী কিনে নিলাম। দুটো ডুলির ব্যবস্থা করা হল। ডুলি পিছু পড়ল ২০০ টাকা। তারা পৌঁছে দিল একেবারে মন্দিরের দোরগোড়ায়।
এখানে জুতো খুলে জমা রেখে আমাদের উঠতে হবে বেশ কয়েকধাপ সিঁড়ি। পাথরের সিঁড়ি কনকনে ঠান্ডা। পা অবশ হয়ে আসে। অমরনাথ আসার আগে আমার এক শুভাকাঙ্খী পরামর্শ দিয়েছিলেন সঙ্গে পলিথিন রাখার। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় তাতে পা মুড়ে নিলে ঠান্ডা লাগবে না। পলিথিন সঙ্গে এনেছিলাম, কিন্তু সে তো ব্যাগেই রয়ে গেছে। অগত্যা খালি পায়েই ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলাম। প্রত্যেকটা সিঁড়িকে পেরোনো মনে হচ্ছিল একটা বড় মাইলস্টোন পার হওয়া। কখনও কখনও অলিম্পকদা এগিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে পৌঁছলাম গুহার শেষ মাথায়। দেখলাম সেই অলৌকিক শিবলিঙ্গ। পাশে পার্বতী ও গণেশ, যারা আপাত নির্বাক, নিষ্প্রাণ - বরফের স্তুপ। কিন্তু অদ্ভুত তাদের আকর্ষণী ক্ষমতা। মুহূর্তের ঝলকে যেন দেখতে পেলাম শিবলিঙ্গের মাথার কাছে এক জোড়া সাদা পায়রা। একটু পরেই মনে হল তা যেন হাতে আঁকা ছবি । কি জানি হয়তোবা আমার মনের ভুল, অথবা হয়তো সত্যি।
অমরনাথজীকে দর্শন করে পুজো সেরে খুবই ধীরে ধীরে নেমে এলাম সিঁড়ি বেয়ে। এর মাঝেই আবার হারিয়ে খুঁজে পেলাম অলিম্পকদাকে। এবার কন্ট্রোল রুমে এসে দুলালদা-বিপাশা বৌদির খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। শুনলাম দুলালদা এনকোয়ারি অফিসে এসে বিপাশা বৌদির খোঁজ নিয়েছেন, সম্ভবতঃ পেয়েও গেছেন। মিলিটারির কথায়, একটু আগে দুলালদা "গেটের সামনেই তো দাঁড়িয়ে ছিলেন"। আমরা তবু আমাদের টেন্টের নম্বর কন্ট্রোল রুমে রেখে এলাম যদি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। ফিরে এলাম তাঁবুতে। মাথাপিছু ৩০০ টাকার তাঁবু। আমাদেরটায় ভেতরে আলোর ব্যবস্থাও ছিল না। বরফের ওপর একটা স্লিপিং ম্যাট আর কার্পেট। মাথার কাছে একটা লেপ। এক টেন্টে ৯ জন থাকার ব্যবস্থা। যাত্রীদের জন্য পাহাড়ের বেশ কিছু ওপরে পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
একটা লেপ নিচে পেতে নিলাম। ভেতরে একটা সোয়েটার, তার ওপর ভারী জ্যাকেট আর লেপ মুড়ি দিয়েও ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। হবে নাই বা কেন? টেন্ট তো পুরোটাই বরফের ওপরে। আমাদের পর আরও তিন জন অমরনাথ যাত্রী এলেন। বিহার থেকে ছেলে তার বৃদ্ধ বাবা–মাকে নিয়ে এসেছেন অমরনাথ দর্শনের জন্য। প্রভুজির দর্শন পাওয়া তাঁদের পরম প্রাপ্তি। একটা সময় মনে হয়েছিল হয়তো আসতে পারবেন না। যে টাকার দরকার তা আর জোগাড় করে উঠতে পারছিলেন না। শেষে এক মুসলিম শুভানুধ্যায়ী টাকার ব্যবস্থা করে দেন।
রাতে হয়তো ভাণ্ডারায় খেতে পারতাম, কিন্তু আর ইচ্ছে করল না ঠান্ডার মধ্যে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতে। সঙ্গে মুড়ি ছিল, তাই খেয়েই দু'জনে শুয়ে পড়লাম। টেন্টে শুয়েই শুনতে পেলাম অমরগঙ্গার প্রবল জলস্রোতের শব্দ। সব আওয়াজ ছাপিয়ে একটাই শব্দ কানে ভাসতে লাগল – অমরগঙ্গার দৃপ্ত পদধ্বনি। একে গর্জন বলে না, বরং যেন প্রাণচঞ্চলতার প্রতীক। রাতটাকে মনে হল অনেক অনেক বড়। লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। একটু পরেই দেখলাম নাকের কাছে লেপটা ভিজে গেছে। আবিষ্কার করলাম, প্রচন্ড ঠান্ডায় নিশ্বাসের বাস্প জমে গিয়ে লেপ ভিজিয়ে দিয়েছে। লেপের বাইরেও কিছুটা ভিজে ভাব। টেন্টে রাত কাটানোর পরিকল্পনা ছিল না। পহেলগাঁও-এর পথে যদি অমরনাথ আসতাম তাহলে টেন্টেই থাকতে হত। তাই সঙ্গে স্লিপিং ব্যাগ আর এয়ার পিলো (পাম্প বালিশ) নিয়ে বেরিয়েছিলাম । কিন্তু যখন রাস্তা বদল করে বালতাল হল, সবকিছু শ্রীনগরের হোটেলেই রেখে এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সেসব সঙ্গে থাকলেই ভালো হত।
রাতে কতবার যে ঘুম ভাঙল ঠিক মনে নেই। প্রতিবারই কাঁধ আর ঘাড়ের কাছে একটা ব্যথা অনুভব করছিলাম। আসলে মাথায় কোনও বালিশ নেই, অক্সিজেনের ঘনত্বও কম, আর নীচ থেকে একটা প্রচণ্ড ঠান্ডা উঠছে।
সকাল হল। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর বাইরে বেরোলাম। খুবই কম লোক চলাচল করছে। সকালবেলার উপত্যকার ছবি ক্যামেরা বন্দী হল। বাইরে থেকেই গুহার কিছু ছবি তুললাম। কাল যখন পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, পুরো জায়গাটা ভালো করে দেখতে পাইনি। এখন ঠিক মাঝখান থেকে পুরো উপত্যকাকে অনুভব করলাম। গোটাটাই পর্বতে ঘেরা। পদ্মের পাপড়ি যেমন ফুলের ভেতরের অংশকে ঘিরে রাখে, তেমনি পাহাড়ও এই উপত্যকাকে আড়াল করে রেখেছে। পর্বতের গায়ে সামরিক বাহিনির সেনা চৌকির নম্বর দেওয়া আছে। এরাই এই অঞ্চলের দেখাশোনা করে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অমরগঙ্গার উৎপত্তি এখানেই। এখানে যেন একটা নালা মাত্র, অথচ প্রবল স্রোতে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার স্বাতন্ত্র্যের কথা।
ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। আসলে আকাশে হাল্কা মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ি পথে বৃষ্টিতে যে কোন সময় রাস্তা বন্ধ হওয়ার ভয়। যা হোক করে দু'টো ঘোড়া জোগাড় করা হল । ঘোড়া পিছু ১৪০০ টাকা থেকে কমিয়ে আমরা ১৩০০ তে রাজি করিয়েছিলাম, কিন্তু বাদ সাধল ঘোড়ার মালিক। বাধ্য হলাম ১৪০০ তেই ঘোড়া বুক করতে। ঘোড়ার মাথায় হাত বোলালাম। সহিসকে অভ্যাস মত জিগ্যেস করলাম তোমার নাম কি? উত্তর পেলাম – ইব্রাহিম। আর ঘোড়ার নাম? ও বলল – রাজু!
ফেরার পথ ধরার আগে এ যাত্রায় শেষবারের মত অমরনাথজির গুহা, অমরগঙ্গা আর দুধ-সাদা উপত্যকার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। জানি না আর কোনওদিন এখানে আসা হবে কী না। তারপর "রাজু"-র পিঠে চড়ে রওনা দিলাম বালতালের দিকে। যে পথে এসেছিলাম, ফেরার পথ তার চেয়ে কিছু আলাদা। ঘোড়ার চলার পথ অনেক বেশি দুর্গম, কোথাও কোথাও অনেক বেশি ঢাল। ঘোড়ার চলার সঙ্গে নিজের শরীরের ভারসাম্য রাখাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যখন ঘোড়া ওপর দিকে ওঠে তখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে হয়, আবার যখন নীচের দিকে নামে, দেহের ভারটা পেছন দিকে দিতে হয়। ইব্রাহিম আমাকে পুরো ব্যাপারটা পাখি পড়ার মতো বুঝিয়ে দিল। পিঠে ব্যাগ নিয়ে চেষ্টা করলাম শক্ত হাতে জিন ধরে বসে থাকার, কোনও অবস্থাতেই জিন ছাড়া চলবে না। লাগাম হাতে ইব্রাহিম সামনে এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ যেতেই পিঠের ব্যাগটা আলগা হয়ে গেল। তাতে সেটা এককাত হয়ে পিঠে আটকে রইল। এভাবেই চললাম পুরো পথ। ঘোড়ার চলার সিস্টেমটা বড়ই অদ্ভুত। পরপর লাইন দিয়ে এগোতে থাকে। খুব সরু পথেও নিজের ভারসাম্য রেখে এগিয়ে চলে। সামনের পা জোড়া যেখানে পড়ে, একটু পরে পেছনের পা জোড়া এসে সেই জায়গা নেয়। চার পায়ে চলায় ভারসাম্য মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। কি বরফ, কি পাথর, কি কাদামাটির এবড়ো-খেবড়ো পথ, নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে ঘোড়া এগিয়ে চলে। সমস্যা একটাই। ঘোড়া চলে রাস্তার একদম কিনারা দিয়ে। নীচের দিকে তাকাতেও এক এক সময় ভয় হয়। একটা বিশাল ঢাল বেয়ে নেমে এলাম সঙ্গমে এখানে অমরগঙ্গা এসে মিশেছে সমতলে। সঙ্গমে সে পুরোদস্তুর নদী। কোথাও আবার হিমবাহের আড়ালে মুখ ঢেকেছে। এখানে কিছু সেনাচৌকি আর তাঁবু রয়েছে সেনাদের জন্য। কত যে চড়াই উৎরাই পেরোলাম তার হিসেব নেই, কিন্তু এবার তেমন কষ্ট হচ্ছে না, কারণ আমার কষ্টের সমস্ত ভার "রাজু" নিয়ে নিয়েছে। কাল প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছিলাম, ফেরার পথে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সোজা রাস্তায় খুব সহজেই পার করলাম। যে জায়গায় পা পিছলে পড়ে গেছিলাম, অবলীলায় সে রাস্তা পেরিয়ে এলাম। খুব খারাপ লাগছিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হতে, কিন্তু তাড়াতাড়ি বালতাল পৌঁছতে হবে, আর কোন উপায়ও নেই।
একটু পরপর হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে যাত্রীদের নিয়ে। এ রাস্তা দিয়েই হয়তো আমরা আগের দিন গিয়েছিলাম, কিন্তু ফেরার দৃশ্য পুরো আলাদা। যাওয়ার সময় যে অপরূপ দৃশ্য আমাদের পেছনে পড়ে ছিল এখন তাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সহিসরা মাঝে মধ্যে তাদের ঘোড়াকে চাবুক মেরে জোরে ছুটতে বাধ্য করছিল। এক সওয়ারি প্রতিবাদ করল, সহিসকে দু'কথা শুনিয়েও দিল। আমরাও সেই সওয়ারির কথায় সায় দিয়ে ঘোড়াওয়ালাকে বললাম ঘোড়াকে না মারতে। একটু পরেই সরু রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় হয়ে গেল। একদিক দিয়ে যাত্রীরা গুহার দিকে যাচ্ছে আর অন্য দিক দিয়ে আমরা নামছি। অমরনাথ যাত্রার একদিন পেরিয়ে গেছে। ভাণ্ডারার সংখ্যা এখন আরও বেশি। এই একদিনে আরও অনেক নতুন ভাণ্ডারা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোথাও একটাও বাঙালি ভাণ্ডারা চোখে পড়ল না। এক জায়গায় ভেড়া ও ছাগলের পাল আমাদের পথ অবরোধ করল। কিছুক্ষণের জন্য চারদিক ধুলোয় ঢেকে গেল। মাস্কের উপযোগিতা আবারও অনুভব করলাম। প্রায় ঘন্টা তিনেক পরিশ্রমের পর ইব্রাহিম আর রাজু আমাদের নিরাপদে বালতাল পৌঁছে দিল। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় আমি পেছন দিক দিয়ে পা নামানোর চেষ্টা করছিলাম। তাই দেখে আরেক ঘোড়াওয়ালা চেঁচিয়ে উঠল – "আপকো উতরনা হ্যায় ইয়া চড়না হ্যায়?" বুঝলাম ঘোড়ার পিঠে ওঠার সময় পেছন দিক দিয়ে পা তুলতে হয়। আর নামার সময় ঠিক উল্টো, সামনের দিক দিয়েই পা নামাতে হবে।
এবার আমাদের প্রথম কাজ ছিল একটা সিম কার্ড জোগাড় করা। যাত্রা পারমিটের সঙ্গে একটা সিম পারমিট দেওয়া ছিল। পুলিশকে জিগ্যেস করে জেনে নিলাম কোথায় সিমকার্ড পাওয়া যাবে। বলে দিল যে ওরা চারশ-পাঁচশ টাকা চাইলেও আপনি দুশো টাকার মধ্যে রফা করার চেষ্টা করবেন। কয়েকজন মিলিটারি এগিয়ে এল, হাসিমুখে বলল – যাত্রা সেরে ফিরলেন? কেমন হল যাত্রা? কিন্তু আসল নজরটা দেখলাম পিঠের বড় ব্যাগের দিকে। কথার ফাঁকে ব্যাগটা বম্ব ডিটেক্টর দিয়ে চেক করে নিল। মিলিটারির সদা সতর্ক দৃষ্টির জন্যই হয়তো এই যাত্রা সুরক্ষিত। অনেক কষ্টে একটা যাত্রা–সিম জোগাড় করা গেল। ৬৫০ টাকা পড়ে গেল সিম কার্ড জোগাড় করতে। বোঝা গেল এরা কৃত্রিম অভাব তৈরি করছে। কিন্তু সিমটা আমাদের ভীষণ দরকার। সিম পেয়ে প্রথমে বাড়িতে ফোন করে ফেরার খবরটা জানালাম।
বালতালের দৃশ্য যাওয়ার সময় উপভোগ করার তেমন সময় পাই নি । ফেরার সময় কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল। পাশের সিন্ধ নদীর প্রবল রূপ যাওয়ার সময়ও দেখেছিলাম, কিন্তু তখন তা উপলব্ধি করার মত সময় ছিল না। দুই তুষারাবৃত গিরিচূড়ার মাঝে নির্মল নীল আকাশ আর সেই আকাশে পাখির মত ভেসে চলা সাদা মেঘের পুঞ্জগুলো তখন পেছনেই পরে ছিল। এখন বালতালের দৃশ্য দেখে মনে হল এ যেন যথার্থই স্বর্গদ্বার। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা করে তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আদর্শ জায়গা। এখানকার রক্ষণাবেক্ষণ করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট। কোন জনবসতি নেই। পাহাড়ি ছাগল নির্ভয়ে পাহাড়ের গায়ে খেলা করে বেড়ায়। ভেড়ার পাল চড়ে বেড়ায় উন্মুক্ত মাঠে। সিন্ধ নদীর জলে তেষ্টা মেটায় টাট্টু ঘোড়া। সবুজে ঢাকা পাহাড় যেন প্রকৃতির খেলার মাঠ আর সেই মাঠে খেলার উপকরণ হল ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নুড়ি–পাথর। অমরনাথ যাত্রা উপলক্ষে বালতালে বসেছে অস্থায়ী ক্যাম্প, অস্থায়ী সেনা শিবির। তৈরি হয়েছে অস্থায়ী ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সবই নদীর তীর ঘেঁসে। এই নদী গিয়ে মিশেছে ঝিলম এর সঙ্গে।
আমরা হোটেলে ফেরার জন্য একটা গাড়ি বুক করলাম। বালতালকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম শ্রীনগরের পথে।
[ হোটেলে ফিরে জানতে পেরেছিলাম সেদিনই অমরনাথে ওপর থেকে পাথর পড়ে এক জওয়ান ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টিও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বেশ কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে দুলালদা-দেবাশীষদারা নিরাপদেই নেমে আসতে পেরেছিলেন। আবার একবার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম এযাত্রায় আমাদের সাহায্য করার জন্য। ]
~ অমরনাথের তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ যাত্রার ট্রেক রুট ম্যাপ ~
রিষড়ার সুদীপ্তর দত্তের ঘুরে বেড়ানোর সখ অনেকদিনের, কিন্তু বিধি বাম। তাই বেশিরভাগ সময় হয় অসুস্থতা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য যাত্রা বাতিল হত। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো ছিল যে কেউ সঙ্গে নিতেও সাহস পেত না। তবে সম্প্রতি উটি ঘুরে আসার পর পরিস্থিতি পাল্টেছে। রক ক্লাইম্বিং এর বেসিক পাঠ নেওয়ার পর উৎসাহ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এখন একটা ট্যুরে যাওয়ার আগেই পরের ট্যুরের প্ল্যান রেডি থাকে।