অমরনাথ দর্শন
শুভ্রনীল দে
~ অমরনাথের তথ্য || অমরনাথের আরও ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~
"...The Swami was full of the place. He felt that he had never been to anything so beautiful. He sat long silent. Then he said dreamily, "I can well imagine how this Cave was first discovered. A party of shepherds, one summer day, must have lost their flocks, and wandered in here in search of them. Then, when they came home to the valleys, they told how they had suddenly come upon Mahadev!..."
- From "The master as I saw him" by Sister Nivedita
হর পার্বতী হিমালয়ে বসে কথা বলছেন। পার্বতীর ইচ্ছে, অমরত্বের গোপন রহস্য জানার। স্রষ্টার কাছেই সৃষ্টির এই গোপন রহস্য জানতে ধরে বসলেন স্বামী ভোলানাথকে, বলতেই হবে। সংসারের অনেক স্বামীদের মতই মহাদেব স্ত্রীর আবদারের কাছে হার স্বীকার করলেন কিন্তু তার জন্য চাই এমন এক জায়গা যেখানে নিরিবিলিতে বসে সমস্ত প্রাণী জগতের চোখ কান বাঁচিয়ে এই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন।
চলতে চলতে হিমালয়ের এক জায়গায় এসে মহাদেব তাঁর বাহন নন্দীকে ত্যাগ করলেন। পুরাকালের বয়লগাঁও আজকে পহেল গাঁও নামে পরিচিত। আরও কিছু পথ যাবার পর তিনি নাগকেও ত্যাগ করলেন, বর্তমানে যে স্থান শেষনাগ বলে পরিচিত। এভাবে সব কিছু ত্যাগ করতে করতে বর্তমানের পঞ্চতরণী-তে এসে তিনি তাঁর পঞ্চত্বকেও বিসর্জন দিলেন; সর্বস্ব ত্যাগ করে দুজনে এসে পৌঁছালেন পর্বত শিখরে ঘেরা লোকচক্ষুর আড়ালে একটি গুহামুখের সামনে। গুহার মধ্যে কোনও প্রাণী থাকলেও থাকতে পারে ভেবে ভোলানাথ তাঁর তৃতীয় নয়ন দিয়ে গুহার সব কিছু ছাই করে দিলেন। তারপর একটি পাথর খণ্ডের ওপর বসে পার্বতীকে শোনালেন অমরত্বের গোপন সেই রহস্যকথা। যার সাক্ষী রইলনা কেউ। না, ভুল বললাম। গুহামধ্যের একটি কোণে একখণ্ড পাথরের তলাতে সযত্নে রাখা দুটি ডিমের ভেতর দুটি পায়রা ছানা তখনও বেঁচে ছিল। তারাই একমাত্র জানতে পারল সেই রহস্য।
যে গুহাতে বসে মহাদেব পার্বতীর কাছে এই রহস্য উন্মোচন করেছিলেন বলে গল্পকথা, সেটাই বর্তমানের তুষারতীর্থ অমরনাথ। আর আজও অমরনাথ দর্শনে ওই প্রতিকূল পরিবেশে দুটি পায়রার দর্শনও পাওয়া যায়। এই দুটি পায়রাই অতীতের সেই দুটি কবুতর শাবক কিনা সে নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু তীর্থ হিসাবে অমরনাথের প্রাচীনত্ব ও ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। আর তার টানেই আজও রাস্তা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও বহু তীর্থযাত্রী এই বিপদ সঙ্কুল পথে পাড়ি দেন। এই যাত্রা পথে বিপদ যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পথের কঠিনতা ম্লান হয়ে যায় তার কাছে।
১৮৯৮ স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা গিয়েছিলেন অমরনাথ দর্শনে, পথ দুর্গম - অত্যন্ত কষ্ট ; তা সত্ত্বেও পথের সৌন্দর্যে দু'জনেই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন -
"It was a beautiful little ravine floored, for the most part with sandy islands in the pebble-worn bed of a mountain stream. The slopes about it were dark with pine-trees and over the mountain, at its head, was seen, at sunset, the moon, not yet full. It was the scenery of Switzerland or Norway, at their gentlest and loveliest." (" The Master as I saw him ")
পূর্ব ইতিহাস
পুরাণে উল্লেখ না থাকলেও এই তীর্থযাত্রা শুরু নিয়ে দুটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। একটি প্রবাদ বলে, পুরাকালে প্রবল জলোচ্ছাসে যখন সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকা জলমগ্ন হয়ে পরে তখন ঋষি কাশ্যপ প্রচুর নদ-নদী সৃষ্টি করে কাশ্মীরকে রক্ষা করেন। পরবর্তীকালে মহর্ষি ভৃগু হিমালয় পরিক্রমাকালে এই গুহার সন্ধান পান। তিনিই সর্ব সাধারণকে এই গুহার হদিস দেন। অন্য একটি প্রবাদ অনুযায়ী, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, এক মেষপালক বুটা মালিক মেষ চড়াতে চড়াতে হিমালয়ের পর্বতের এক নির্জন জায়গায় এক সন্ন্যাসীর দেখা পান। নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও সন্ন্যাসীর যথাসাধ্য সেবা করেন। সন্ন্যাসী বুটার ওপর খুশি হয়ে বাড়ি ফেরার সময় একটি পোঁটলা ভর্তি করে ধুনির কাঠ কয়লা উপহার দেন। বাড়িতে ফিরে এসে পোঁটলা খুলে তিনি দেখলেন, কোথায় কয়লা, এ যে পোঁটলা ভর্তি সব সোনা দানা। বুটা বুঝতে পারেন যাঁর দর্শন পেয়েছেন তিনি যে সে কেউ নন। উদভ্রান্তের মত ছুটে যান সেই মহাত্মার খোঁজে। চলতে চলতে বুটা এসে পৌঁছন সেই গুহায়, যেখানে শিব তুষারের রূপ নিয়ে বিদ্যমান। তিনি বুঝতে পারেন এটাই সেই কাঙ্খিতের দর্শন। পরবর্তীকালে তাঁর মাধ্যমেই এই গুহার খোঁজ পান সাধারণ মানুষ।
পুরাণে অমরনাথ গুহার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না, এছাড়াও সেখানে যে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের বর্ণনা দেওয়া আছে তাতেও অমরনাথের কোনো উল্লেখ নেই। তবে মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্রের শ্লোকের নাম ও স্থান বিশ্লেষণ করলে এই রহস্যের সমাধান সম্ভব।
হরিদ্বারে মহেশানি গঙ্গাধর ইতি স্মৃত।
বদরিকাশ্রমমধ্যে কপিনাথেশ্বররোহ্যহম ।।
রজতাচলমধ্যে তু কুবেরেশ্বর ঈরীতঃ ।
অযোধ্যায় কৃত্তিবাসো কাশ্মীরে কপিলেশ্বর।।
কাশ্মীরের ওই কপিলেশ্বর-ই আজকের এই অমরনাথ। মহর্ষি কপিলের দ্বারা পূজিত পুরাকালের সেই তুষার লিঙ্গই আজ সমস্ত তীর্থযাত্রীর কাছে বাবা বরফাণী।
যাত্রারম্ভ
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ ট্রেন জম্মু স্টেশনে পৌঁছাল। স্টেশন থেকে আমাদের গন্তব্য আগরওলাজির ধর্মশালা। যাঁরা বৈষ্ণোদেবী বা অমরনাথ যাত্রা করেন তাঁদের এবং জম্মুর অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের কাছে এই ধর্মশালা খুবই পরিচিত। এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তীর্থযাত্রীদের থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু আগে থেকে বুকিং করে না গেলে এই সময় থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আমাদেরও শেষ অবধি তাই পাশের হোটেলেই ব্যবস্থা করতে হল। স্নান করার পর সোজা চলে গেলাম ধর্মশালাতে দুপুরের প্রসাদ পাওয়ার জন্য। গরম ভাত, ডাল, সবজি আর আচার। আহা! কী যে সুস্বাদু লাগল সে বলে বোঝানো যাবে না।
কাল সকালে আমাদের যাত্রা করতে হবে বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে। তাই আজ বিকেলেই জম্মুতে যা যা দেখার দেখে নিতে হবে। আমার ইচ্ছে, খুব বেশি না ঘুরে জম্মুর বিখ্যাত রঘুনাথ মন্দির গিয়ে একটু ভালো করে দেখা। মন্দির দেখে ফিরে এসে রাতের বেলা পরের দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে বসলাম। যেহেতু দলের তিন জনের কাছেই CHC ( Compulsory Health Certificate ) আছে তাই শুধুমাত্র পারমিট হলেই আমরা যাত্রা শুরু করতে পারব। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের নির্দেশিত আধিকারিকদের সই আর স্ট্যাম্প দেওয়া সি.এইচ.সি. ছাড়া এই যাত্রা করা যাবেনা। প্রত্যেক যাত্রীকে হেলথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার পর তবে যাত্রা পারমিট নিতে হবে। আগামী কাল ভোরবেলা পারমিটের লাইন দিতে হবে তাই একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
পহেলগাঁও-এর রাস্তা খারাপ থাকায় আপাতত বন্ধ, তাই বালতাল দিয়ে যাত্রার অনুমতি পেলাম। বালতাল-এর দিকের রাস্তা সাধারণত সবাই দর্শন করে ফেরার জন্য ব্যবহার করে। প্রচণ্ড খাড়া হবার কারণে এই রাস্তায় চড়াই বেশ কষ্টকর। পারমিট অনুযায়ী আমাদের পরশু ভোরের মধ্যে বালতাল গেটে রিপোর্ট করতে হবে। সকাল দশটা নাগাদ একটা শেয়ার গাড়িতে রওনা দিলাম ।
পথের কথা
শহরের অলিগলি ছাড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি গাড়ি জাতীয় সড়ক ১-এ-তে পড়ল। সামনে প্রথমে পড়বে পাটনি টপ। খুব জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট, মধুচন্দ্রিমার জন্য আদর্শ। জম্মু থেকে দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। সেখান থেকে শ্রীনগর-এর দূরত্ব ১৯৫ কিলোমিটার আর তারপর শ্রীনগর থেকে বালতাল প্রায় ১০৫ কিলোমিটার ।
সার সার পাহাড়চূড়া। তাতে চাদরের মতন পাইনের সারি। ফাঁকে ফাঁকে ছবির মতন সাজানো রংবেরঙের একটা-দুটো কাঠের বাড়ি আর মাথার উপর নীল আকাশে মেঘের আলপনা। রোদের ভয়ানক তেজ। পাহাড়ের গায়ে পাক খেতে খেতে যত ওপরের দিকে উঠছি রোদের তাপ যেন আরও বেড়েই চলেছে। তবু রক্ষে যে গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে বেশ সুন্দর হাওয়া আসছে। যাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তো দেখি ঠাণ্ডা হাওয়া পেয়ে ঘুমিয়েও পড়েছেন।
দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটা-একটা নাগাদ পাটনিটপের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়াল। পাহাড়ের গায়ে খানিকটা জায়গাকে সমতল করে পাঞ্জাবের ফিরোজপুরের শ্রী নীলকন্ঠ মহাদেব সেবা সমিতির সদস্যরা একটা ভান্ডারা স্থাপন করেছেন। হাত মুখ ধুয়ে থালাতে অল্পদুটো ভাত আর ডাল নিলাম। খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম সামনের দিকে। কোথাও বেশিক্ষণ দাঁড়াবার উপায় নেই। গন্তব্য যে এখনও বহুদূর। অনেক যাত্রী দেখলাম না দাঁড়িয়ে যতটা পারছেন এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের হয় রামবান না হয় বানিহালে র কোনও ভাণ্ডারাতে দাঁড়াতে হবে খাবার জন্য। যদিও তাতে প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। পথে চলতে চলতে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম পড়ছে। কুড়ি-পঁচিশটা বাড়ি নিয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। চা এর দোকান; ছোটো মুদি দোকান। যেন ছবির মত সাজানো।
গাড়ি থামিয়ে চায়ের কাপে চুমুকের সময় চোখে পড়ছে নাম না জানা পাহাড়ি ফুলের মতো সুন্দর ছোটো বাচ্চারা কলকল শব্দ করে চারপাশে খেলা করছে। পাহাড়ের কোলে এই রকম এক একটি গ্রাম যেন এক একটি শান্তির তপোবন। বাড়ির মহিলারা ঘরকন্নার পাশাপাশি বন থেকে ঘাস, কাঠ কেটে মাথায় করে বয়েও আনছেন। পুরুষেরাও তাঁদের রোজকারের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সাহায্য করছেন।
ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ থাকা হয়না। সূর্য মধ্য গগনে। রামবান পার করে গাড়ি চলেছে। এই রাস্তাতে গাড়ির গতি বেশি করার উপায় নেই। একধারে খাড়া পাহাড় আর অন্য দিকে কয়েক হাজার ফুট গভীর খাদ। তার মধ্যে অপরদিক থেকে আসা গাড়িকে যাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যেই জায়গা করে দিতে হচ্ছে। একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সামনে যত দূর দৃষ্টি চলে গাড়ির লম্বা লাইন!
দেখে তো মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কোনও গাড়ির যে নড়াচড়ার লক্ষণ নেই। আমাদের গাড়িও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। নেমে এগিয়ে গেলাম। অবস্থাটা কেন হল যদি বোঝা যায়। স্থানীয় লোকেদের কথায় যা বুঝলাম, এমনিতেই এই জায়গাটার খুব একটা সুনাম নেই। জম্মু থেকে বালতাল যাবার পুরো রাস্তার মধ্যে এই অংশটাই সব থেকে খারাপ। বাম হাতে খাদ আর ডান পাশে খাড়া পাহাড়। ওপর থেকে মাঝে মধ্যেই বড় বড় পাথরের চাঙড় খসে পড়ছে। কোনও কোনও জায়গাতে দুটো গাড়ি পাশাপাশি যাবারও উপায় নেই। কিছুটা এগিয়ে দেখলাম যে একটা যাত্রী সমেত গাড়ি খারাপ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে আছে, চেষ্টা চলছে সেটাকে সারাবার। ফলে পেছনের সমস্ত গাড়ি যাবার রাস্তা হয়ে গেছে বন্ধ। খারাপ গাড়িটাকে কিছু সেনা জওয়ান ঘিরে রেখেছে। এছাড়াও দুটো গাড়ি করে বেশ কয়েকজন জওয়ান পুরো লাইনটাকে পাহারা দিচ্ছে। উগ্রপন্থী হামলার ভয়। এই উগ্রপন্থী নামক রোগটা আস্তে আস্তে আমাদের সমাজে ভয়ঙ্কর সব অসুখের থেকেও মারাত্মক হয়ে প্রভাব বিস্তার করছে। কোন ওষুধে এ সারবে কেউ জানেনা। নীচে চোখ রাখলাম। রাস্তা থেকে প্রায় ৮০০ ফুট হবে। একটা ছোট নদী অনেকটা U-এর মতো বাঁক নিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে। U-এর পেটের কাছে একটা উঁচু মতো টিলা। তার ওপর বেশ কিছু পাথরের ঘর। খালি চোখে ঠিক মতো দেখা যায়না। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে দেখলাম যে ওটা একটা ছোট বসতি। দশ-বারোটা ঘরের স্থানীয় বসতি। কিছু মহিলা ও পুরুষ দেখলাম ঘরের বাইরে বসেও আছেন। ঘরের আঙিনায় গুটিকয়েক খচ্চর ও বাঁধা আছে। এই মানুষগুলো কী ভাবে ওই দুর্গম জায়গাতে বাস করে সেটা ভেবে কোনও কুল পেলাম না। বসতির চারধারেই উঁচু পাহাড়। সবথেকে কাছে যে লোকালয় সেটা প্রায় আট-নয় কিলোমিটার দূরে। তিন দিকে নদী। খুব ছোটখাটোও যদি কিছু কেনবার দরকার পড়ে তবে প্রথমে পাহাড়ের গায়ের পাকদণ্ডি দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার উপরে উঠতে হবে তার পর আবার অতটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তবে লোকালয়ে পৌঁছাতে হবে। এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার লড়াইকে দূর থেকে স্যালুট জানালাম।
দশ-পনেরো ফুট করে যাওয়ার পর আবার আধঘণ্টার বিরতি। এভাবেই গাড়ি এগোচ্ছে। আজ যে আমরা বালতাল পৌঁছাচ্ছিনা এটা নিশ্চিত। গাড়ির সারথি শামিম এর কাছ থেকে জানলাম যে নীচের ওই ছোট নদীই সেই কুখ্যাত খুনিনালা। যে সব গাড়ি এই জায়গাতে এসে দুর্ঘটনাতে পড়ে তার বেশিরভাগই গড়িয়ে ওই নালায় গিয়ে ডুবে যায়। শুনে খুব একটা খুশি অনুভব করলাম না। ঘণ্টা তিনেক এভাবে যাওয়ার পর গাড়ির গতি স্বাভাবিক হল। দুপুরের বদলে বিকেল নাগাদ গাড়ি বানিহাল পার হল। বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এই এন.এইচ. ওয়ান-এ-এর দায়িত্বে রয়েছে। আমাদের গাড়ি এবার ভালো রাস্তা পেয়ে দারুণ গতিতে ছুটছে। সন্ধ্যে নাগাদ অনন্তনাগ পার করলাম। গাড়ি দাঁড় করাবার কোনও লক্ষণ দেখলাম না। শামিম এর সাথে কথা বলে বুঝলাম যে সে চেষ্টা করছে যাতে আজই আমাদের বালতাল পৌঁছে দিতে পারে। বললাম, যেহেতু আমরা এখনও শ্রীনগরই পৌঁছাইনি তাই অহেতুক তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। রাতটা পথেই কোথাও থেকে পরদিন পৌঁছানো যাবে। আর তাছাড়া আমাদের পারমিট অনুযায়ী যাত্রা শুরুর নির্দিষ্ট সময় আগামী পরশু সকালে।
রাত ন'টা। খিদেতে পেট চুঁই চুঁই করছে। দুপুরে দু'চামচ ভাত তো পেটে পড়ার দশ মিনিটের মধ্যেই হজম হয়ে গেছে। তারপর থেকে জল ছাড়া আর কিছুই প্রায় পেটে পড়েনি। বাকীদেরও একই অবস্থা। গাড়ি ছুটে চলেছে। কাঁচ তুলে দেওয়া সত্ত্বেও ফাঁক দিয়ে যেটুকু হাওয়া আসছে তাতেই বাইরের ঠাণ্ডা টের পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রীনগর ঢুকে যাব। জুলাই মাস হওয়া সত্ত্বেও রাতের দিকে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশ কম। বলতে বলতেই সারি সারি আলোকজ্জল হাউসবোটের পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমাদের গাড়ি শ্রীনগর পৌঁছে গেল। ডাল লেকের ধারে ধারে সুন্দর সুন্দর হাউসবোট তাদের মায়াবী রূপের পসরা নিয়ে পর্যটকের জন্য অপেক্ষা করছে। হাতছানি উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে।
আধঘন্টা মত যাবার পর দেখি রাস্তার ওপর ব্যারিকেড। কী ব্যাপার! কয়েকজন জওয়ান হাতের ইশারাতে আমাদের গাড়ির কাচ নামাতে বলল। ড্রাইভারকে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে বলে আমাদের বাইরে নামার জন্য বলা হল। কথা বলে জানলাম আজ আমাদের আর সামনে যেতে দেওয়া হবেনা। কারণ এর পরের রাস্তা বেশ বিপদসংকুল। উগ্রপন্থী হামলার আশঙ্কা !!
যে যার ব্যাগপত্তর নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চেকিং-এর লাইনে দাঁড়ালাম। জায়গার নাম গান্ডেরবাল। এখানে বেশ খানিকটা জায়গাকে পুরোপুরি নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে অমরনাথগামী যাত্রীদের রাত্রিবাসের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিচয়পত্র ও অমরনাথ যাত্রার পারমিট দেখা এবং সব ব্যাগপত্তর ভালো করে তল্লাশির পর ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেলাম। এই সবের মধ্যেই দেখি বিশাল পাগড়িধারী একজন রাজস্থানি বয়স্ক ভদ্রলোককে জওয়ানরা খুব বকাঝকা করছে। তল্লাশির সময় নাকি ওঁর পাগড়ির মধ্যে থেকে ধূমপানের বেশ কিছু সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। উনি জানতেন না যে ওই ঘেরাটোপের ভেতর কোনও রকম নেশার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া যাবেনা। গাড়ি থেকে নামার পরই বেশ ঠাণ্ডা টের পেয়েছিলাম।আমরা যে যার ব্যাগ গাড়ি রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাতে রাখা আমাদের গাড়িতে রেখে দিলাম। একটা রাত কোনমতে ঠিক কেটে যাবে। শুধুমাত্র খুব দরকারি জিনিস একটা হাত ব্যাগে নিয়ে প্রথমেই সামনের ভান্ডারাতে গেলাম কিছু খাবার জন্য। যত হাঁটছি তত বুঝতে পারছি যে সকালের জম্মুর সঙ্গে রাতের এই গান্ডেরবালের তাপমাত্রার কতটা পার্থক্য!
হাত মুখ ধুয়ে গরম ভাত, ডাল আর সব্জি দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। এত রাতে এই জায়গাতে যে গরম ভাত পাব, কল্পনাও করিনি। দেখলাম সারি সারি ভান্ডারাতে আমাদের মতন প্রচুর যাত্রী পরম নিশ্চিন্তে সেবা গ্রহণ করছেন। রাত প্রায় এগারটা। বড় বড় হ্যালোজেনের আলোতে যেটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বে এই যাত্রী নিবাস করা হয়েছে। মাঠের একদিকে সার দিয়ে যেমন খাবার জন্য ভান্ডারা করা হয়েছে তেমনি অপরদিকে ফেলা হয়েছে অনেক ছোট ছোট তাঁবু। পুরো মাঠের চারদিকে উঁচু উঁচু টাওয়ার, যেখান থেকে জওয়ানরা কড়া নজর রাখছেন। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর তাঁবুর ভেতর রাখা কম্বলের তলাতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল টেরই পেলাম না।
ভোরের আলোতে ভালো করে জায়গাটাকে দেখলাম। চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি, মাঝখানে খানিকটা সমতল নিয়ে এই অঞ্চল। দূরে পাহাড়ের পায়ের কাছে বেশ কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ল। পাহাড়ের পেছন থেকে খানিকটা লুকোচুরি খেলার মত করেই সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করলেন। ভোরের প্রথম কিরণ বিপরীত দিকের পাহাড়ের শিখরে সাদা বরফের ওপর পরার পর হীরের মতন ঝকমক করে উঠল। হিমালয়ের যে কোনও স্থানের সৌন্দর্য ও বিচিত্রতা কোনও ভাষা দিয়েই বোঝানো যায়না। এ শুধু চোখ ভরে দেখার।
সবাই মিলে ছ'টা বাজার আগেই গাড়ির কাছে পৌঁছালাম। শামিম আগেই গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসে আছে। গেট এখনও খোলা হয়নি। অবশেষে গাড়ি ছাড়ার অনুমতি পাওয়া গেল। ভোরের হিমশীতল হাওয়ার সঙ্গে আমাদের গাড়ি যেন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে লাগল। রাস্তাটা একটা কালো সাপের মত এঁকে বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে। দু' ধারে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পাহাড়ের সারি - ডানপাশে একটা নাম না-জানা নদী সুন্দরী যুবতীর মতো তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে পথের ছোটোখাটো বিঘ্নকে জয় করে ছলছল শব্দে এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ের ঢালে পাইনের সারি। ঢাল ছাপিয়ে বরফের চাদর চলে এসেছে একেবারে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার দূরত্বে। বরফের সেই পুরু আস্তরণ আস্তে আস্তে গলে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট জলের ধারা, আর তা মিশছে সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে। শামিম বলল এই নদীর নাম সিন্ধ্ নালা, নদীর খানিকটা অংশ পাকিস্তানের মধ্যে দিয়েও বয়ে গিয়েছে।
সামনে একটা লোকালয় দেখতে পাচ্ছি। জায়গার নাম কঙ্গন। খুব সুন্দর মিষ্টি নামটা। স্থানীয় মানুষেরা সদ্য ঘুম থেকে উঠে রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে ভিড় জমিয়েছে। কাশ্মীরিরা সাধারণত চা খেতে খুব ভালবাসে। চায়ের সঙ্গে রকমারি রুটির পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সোনমার্গের রাস্তায় চলে এলাম, যার স্থানীয় নাম সোনামার্গ। আস্তে আস্তে লোকালয় শেষ হয়ে এল। দূরে দূরে সবুজ কার্পেট পেতে রাখা পাহাড়ের ঢালে কিছু ঘোড়া আর মাঝে মধ্যে টহলরত জওয়ানদের জিপ, এছাড়া সামনের প্রায় কুড়ি কিলোমিটার আর কিছু চোখে পড়ল না। রাস্তা আবার খারাপ হতে শুরু করল। এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে আমাদের গাড়ি টাল খেতে খেতে এগিয়ে চলল। একটা জায়গাতে এসে দেখি রাস্তাতে ধস নেমেছে। রাস্তা যেটুকু ছিল সেটাও আর নেই। পাথরের উঁচু ঢিপির পাশ দিয়ে কোনমতে গাড়ির একটা চাকা যেতে পারে। ভাবছি কী করা যায়। বালতালের বেস ক্যাম্প আর মাত্র পাঁচ-ছ'কিলোমিটার । বাকি পথটা কি হেঁটেই যেতে হবে? ও বাবা! শামিম দেখি গাড়ি দাঁড় করাবার বদলে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। চোয়াল শক্ত, চোখ স্থির। গাড়ি নিয়ে সোজা উঠে গেল ঢিপির ওপর। ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি গেল কাত হয়ে। কয়েক মুহূর্ত পরেই গাড়ি আবার নেমে পড়ল সোজা হয়ে। ধড়ে প্রাণ এল। আর একটু হলেই গাড়ি শুদ্ধ কয়েকশো ফুট গভীর খাদে সমাধি ঘটত। বলা যায় প্রায় ঢেঁকির ওপর সওয়ারি হয়ে শেষ পথটুকু পাড়ি দিলাম।
অবশেষে সামনে চোখে পড়ল আর্মি চেকপোস্ট। শামিমকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগপত্তর নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। চেকিং শেষ হলে ঢুকে পড়লাম ভারতীয় সেনা পরিবেষ্টিত একটা বিরাট ঘেরা জায়গার মধ্যে। সকাল ১০:৪৫। আগামীকাল যাত্রা, রাতের মত মাথা গোঁজার একটা আস্তানা তো চাই।
স্বর্গের প্রতিচ্ছবি
তাঁবু ঠিক করে জামা কাপড় পাল্টে নিয়ে ভান্ডারাতে গিয়ে দাঁড়ালাম আর সবার সঙ্গে। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি।
এখানের বেশির ভাগ ভান্ডারাই এসেছে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা, জলন্ধর ও আরও অন্যান্য জায়গা থেকে। গরম গরম ভাত, ডাল আর রাজমার তরকারি দিয়ে বেশ জমিয়ে খেলাম। প্রচুর ভান্ডারা আর ততোধিক যাত্রী। সমস্ত তীর্থে যেমন বিভিন্ন পসরা নিয়ে রাস্তার দুধারে দোকানিরা ভিড় জমায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গরম জামাকাপড়, পাহাড়ে হাঁটার উপযোগী জুতো, স্থানীয় মানুষদের হাতে তৈরি নকশা করা চুড়িদারের পিস, বিভিন্ন রকম জড়িবুটি আর মালা, মোবাইলের সিম কার্ডের দোকান, যাত্রার স্মৃতি হিসাবে নিয়ে যাবার জন্য ভোলেনাথের ছবির দোকান আর অগণিত চায়ের দোকান, কী নেই এই ভিড়ে! অনেক দোকান, অনেক মানুষ আর তাদের অনেক রকম ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে নেশা লেগে যায়।
পরিচয় করলাম আমাদের তাঁবুর বাইরে রাস্তার ধারে একটা ছোটো গুমটি মতো জায়গাতে জলের বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে বসে থাকা তাঁবুর মালিক অল্প বয়সী ছেলেটির সঙ্গে। ইশফাক। বেশ সুন্দর নাম। টিপিকাল কাশ্মীরির মত খাড়া নাক, টকটকে ফরসা গায়ের রং আর গালে হাল্কা কুচকুচে কালো দাড়ি। জিনগত ভাবেই কাশ্মীরি ছেলে বা মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব সুদর্শন হয়। কথা হচ্ছিল ইসফাকের সঙ্গে। সে আর তার বড় ভাই আসিফ মিলে এই চারখানা তাঁবু বসিয়েছে। স্থানীয় যুবকেরা এই সময় কিছু রোজগারের জন্য এই ধরণের বিভিন্ন কাজ করে।
কথা হচ্ছিল কাশ্মীরি যুব সমাজকে নিয়ে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর দেখলাম ইশফাক তার মন খুলে ধরেছে আমার সামনে। আমাদের মত যারা তীর্থদর্শন বা বেড়ানোর জন্য কাশ্মীর যায় তাদের চোখে এই জায়গা ভূস্বর্গ, কিন্তু যারা থাকে তাদের কাছে নয়। মূল সমস্যা সেই বেকারি। আপেলের ব্যবসা, কেশর, আখরোট, ক্রিকেটের ব্যাট তৈরি করা বা শীত বস্ত্রের ব্যবসা ছাড়া মরশুমের সময় পর্যটন শিল্প থেকে কিছু রোজগার হয় ঠিকই কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ঠিকঠাক শিল্প বলতে আমরা যা বুঝি সেটার অভাব। ইশফাক নিজে বি কম সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে একটা ছোট মুদিখানাও করেছে। ভবিষ্যতে হয়ত ওটাই ওর উপার্জনের মূল জায়গা হয়ে দাঁড়াবে। তীর্থযাত্রীদের জন্য বেস ক্যাম্পের ভেতর তাঁবু করলেও আর সবার মতই ইশফাকের বাড়িও এখান থেকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার দূরের কঙ্গন বা সোনমার্গ। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার রাস্তা তারা রোজ সকাল বিকেল পাড়ি দেয় কয়েকটা পয়সার জন্য। আমরা কাশ্মীরের রূপ দেখার জন্য যতই ছুটে ছুটে আসি না কেন, যারা এখানকার ভূমিপুত্র তারা কিন্তু খুব একটা ভাল নেই। বেকারত্বের জ্বালাটা কোথাও যেন চাপা স্ফুলিঙ্গের মত ধিকি ধিকি করে জ্বলছে। খুব তাড়াতাড়ি যদি এই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না করা হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে ইশফাক বা আসিফ এর মত যুবকেরা অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে। এটা আমার নিছক অনুমান নয়, আশঙ্কা!!
বেলা প্রায় দুটো। তাপমাত্রা প্রায় ৮ - ১০ ডিগ্রি। কলকাতায় জানুয়ারি মাসে যে রকম আবহাওয়া থাকে ঠিক তেমনই, শুধু পর্বতশ্রেণীর ফাঁক ফোঁকর দিয়ে একটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে আসছে তাতেই মনে হচ্ছে তাপমাত্রা বোধহয় অনেকটাই কমে গেছে। বেসক্যাম্পের যে জায়গাতে আমরা আছি সেই অংশটা সমতল হলেও দু'পাশে প্রাচীরের মতো পাহাড়ের সারি উঠে গেছে। যে জিনিসটা চোখে পড়ার মত সেটা হল যে, সেনাবাহিনী বা সরকারি আধিকারিকদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষরাও আপ্রান চেষ্টা করে চলেছেন যাতে কোনও ভাবেই এই স্বর্গীয় পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট না হয়। দু'মাস পর যখন সমস্ত যাত্রীরা ফিরে যাবেন তখন আবর্জনার স্তূপ না পড়ে থাকে।
তাঁবুতে ফিরে এসে ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল প্রবল সোঁ সোঁ আওয়াজ আর মানুষের আর্ত চিৎকারে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় যারা ছিল তারা আশ্রয়ের জন্য খোঁজে ছুটছে, যারা তাঁবুতে ছিল তারা তাঁবু বাঁচাবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ের মাঝে ঝড়ের পাল্লাতে যারা পড়ছেন তারা ভালো করেই জানেন কী ভয়ঙ্কর এর রূপ। চোখের পলক পড়ার আগেই সব একেবারে তছনছ হয়ে যায়। আবার চকিতেই একেবারে শান্ত। আমাদের তাঁবুও দেখি প্রায় উড়ে যাবার জোগাড়। আসিফ আর ইশফাক দেখি তাঁবুর খুঁটিগুলো আরও গভীরে পুঁতে দিচ্ছে। খাট থেকে নামার কোনও উপায় নেই। এরমধ্যেই দেখি শরীর ভীষণ রকম কাঁপতে শুরু করেছে। জামা, প্যান্ট, মোজা, টুপি,কম্বল চাপা দিয়েও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছেনা।
সবারই প্রায় একই অবস্থা। কাঁপতে কাঁপতেই সবাই ভিতর থেকে তাঁবুর চারধার চেপে ধরে বসে থাকলাম যতক্ষণ না ঝড়টা একটু কমে। মনে আশঙ্কা জাগল সব কিছু ভেস্তে না যায়। কারণ এই ভাবে বৃষ্টি হলে ওপরে ওঠার অনুমতি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া যাবেনা। এমনিতেই যাত্রার পথ অত্যন্ত খারাপ, তার ওপর এই আবহাওয়া, মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আসিফ বলল চিন্তার কিছু নেই, এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ হবেনা। তবে এর ফলে ওপরে হয়তো আজ রাতে আবার বরফ পড়তে পারে। ওটাই যা চিন্তার। যত বরফ পড়বে ততই কষ্ট বাড়বে। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। আরও মিনিট চল্লিশ পর যে ভাবে হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেই রকম আচমকাই সব থেমে গেল।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম পাশের একটা অস্থায়ী দোকানে যাত্রা মোবাইলের সিমের এর খোঁজে। জম্মুতে পা দেবার পর থেকেই আমার ফোন কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। জম্মু-কাশ্মীরে একমাত্র পোস্ট পেড কানেকশন চালু থাকে।
পরিচয়পত্র, তিন কপি ফটো আর যাত্রার অনুমতিপত্রের জেরক্স দিয়ে একটা বি.এস.এন.এল.-এর সিম সংগ্রহ করলাম। বাড়িতে কথা বলায়, তারাও একটু নিশ্চিন্ত হল। দোকানের ছেলেটির নাম ইজাজ। কমার্স নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি করেছে, পাশাপাশি দেখলাম খুব সুন্দর গানের গলা। কিছুক্ষণের পরিচয়েই তার এই প্রতিভার নমুনাও পেলাম। অমরনাথ যাত্রার দু'মাস এই দোকানই তার ঘরবাড়ি। যাত্রার মরসুম শেষে ফিরে যাবে নিজের ঘর গান্ডেরবালে। সেখানে অপেক্ষা করছে তার মা, বাবা, বিবি আর তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে। বছরের বাকি মাসগুলো ইজাজ শ্রীনগরে একটা বড়ো জামা কাপড়ের দোকানে হিসাব রক্ষকের কাজ করে। সেখান থেকে এই দুই মাস সে ছুটি নিয়ে নেয় এই দোকানের সাহায্যে কিছু বাড়তি রোজগারের আশায়। কথা বললে দেখা যাবে যে বেশির ভাগ স্থানীয় ছেলেরই এই একই কাহিনি। দু মাসের এই তীর্থযাত্রা শুধুমাত্র কিছু পুণ্যপিপাসু মানুষের মিলনস্থলই নয়, জড়িয়ে আছে আরও প্রচুর মানুষের হাসি, কান্না, ব্যস্ততা ও তাদের পরিবারেরও ভাল মন্দ। গতকালের গাড়ির ড্রাইভার শামিম থেকে শুরু করে আসিফ, ইজাজ, ইশফাক - আরও অনেক নাম, এরাও সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন অমরনাথজীর দর্শন শুরু হবে আর তারা তাদের পরিবারের জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারবে।
অনুভবে
সন্ধে নামল অনেক দেরিতে। ঘড়িতে রাত আটটা। পড়ন্ত সূর্যের আলোর ছটা এসে পড়েছে দিগন্তবিস্তৃত পর্বত শ্রেণীর মাথায় চাদরের মতো বিছানো সাদা বরফের উপর। এখন আর বরফের রং সাদা নয়, অস্তগামী সূর্যের আভায় আগুনে লাল। তাঁবু থেকে একটু দূরে ছোট একটা টিলা মতন জায়গাতে বসে হিয়ালয়ের এই অপরূপ শোভা উপভোগের পাশাপাশি মনে পড়ছিল শতদ্রু নদীর উপত্যকাতে কিন্নর রাজ্য ভ্রমণের মনোরম অভিজ্ঞতার কথা।
বেশ কিছুক্ষণ একান্তে কাটাবার পর মনটা একটু চা-চা করতে লাগল। টিলা থেকে নেমে একটু সামনে এগিয়েই দেখলাম রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান। কয়েকজন স্থানীয় লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতে গেলাস ধরে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। পরণে আলখাল্লার মতন পোশাক, যার স্থানীয় নাম চোলা। বেশি ঠাণ্ডা লাগলে হাত দুটো বের করে বুকের কাছে জড়ো করে রাখা যায়। চায়ের ফরমাশ করে কয়েকজনের সঙ্গে একটু আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম। পেশাতে এদের মধ্যে বেশিরভাগই ঘোড়াওয়ালা। বছরের বাকি সময় ভেড়া চড়ালেও যাত্রার এই দু'মাস তীর্থযাত্রীদের ঘোড়ায় করে অমরনাথজীর দর্শন করাতে নিয়ে যায়। এ এক সাংঘাতিক কঠিন জীবন সংগ্রাম। কিন্তু এত কষ্ট সত্ত্বেও মুখের দিকে তাকালে এতটুকু বোঝার উপায় নেই। এক মুহূর্তেই আপন করে নেবার কি অসীম ক্ষমতা। জাগতিক দুঃখ কষ্ট যেন এদের সারল্যের কাছে হার মেনেছে। শহরের জটিল জীবনে অভ্যস্ত মানুষ যখন এই সমস্ত পাহাড়িয়া মানুষের মুখোমুখি হয়, তখন তাদের মনে প্রথমেই এই চিন্তা আসে, এই রকম মানুষও হয়! এতো কষ্টের মধ্যেও এতো আনন্দে এভাবেও বেঁচে থাকা যায়! গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলাম ঠিক যা চেয়েছিলাম তাই পাওয়া গেছে। টিপিকাল কাশ্মীরি চা। দুধ, চা পাতা, লবণ আর সামান্য খাবার সোডা দিয়ে বানানো এ এক অদ্ভুত জিনিস। এখানকার মানুষেরা এই চায়ের দিওয়ানা বললেও কম বলা হয়। দুপুরের পর ঝড় বৃষ্টি হওয়াতে ঠাণ্ডাটাও বেশ জমিয়ে পড়েছে। গরম চায়ের গেলাস হাতে গল্প করতে বেশ দারুন লাগছে।
তাঁবুতে ফিরে দেখি সঙ্গী বাকী দু'জন বেশ জুত করে খাটে বসে গল্পে মশগুল। আমাকে দেখে হইহই করে উঠল। " আরে দাদা গিয়েছিলেন কোথায় ? আমরা তো আপনাকে খুঁজতে পুরো চত্ত্বর ঘুরে ফেললাম, দেখতে না পেয়ে শেষমেশ ভাবলাম যেখানেই যান তাঁবুতে তো আসবেনই , তাই ফিরে এসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। কাল ভোর চারটের সময় না উঠলে পরে অসুবিধা হবে তাই চলুন ভান্ডারাতে গিয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে শুয়ে পরা যাক।" সামনেই জলন্ধরের থেকে আসা শিব শক্তি ভান্ডারা। বেশ ভিড়। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। অনেকটা জায়গা নিয়ে এই ভান্ডারা। ভেতরে একপাশে লাইন দিয়ে খাবার নেবার পর বসার জন্য চেয়ার টেবিলেরও ব্যবস্থা আছে। অনেক ভিড় থাকা সত্ত্বেও পুরো ব্যাপারটাই বেশ সিস্টেমেটিক ভাবে চলছে। যার ফলে কোন রকম অসুবিধা হচ্ছেনা। খাবারের পদের বাহার দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। এই প্রতিকূল পরিবেশেও তিন রকম রুটি, ভাত, খিচুড়ি, পাঁচ-ছয় রকমের তরকারি, চাটনি, মিষ্টি, পঁচিশ প্রকার পান মশলা, পান এবং সব শেষে কেশর দেওয়া গরম দুধ। জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না! পুরোপুরি একটা বিয়েবাড়ির আয়োজন। খাওয়া শেষ করে তাঁবুতে ফিরলাম রাত দশটা নাগাদ। ঠাণ্ডাতে হাত পায়ের সাড় পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝলাম আজ রাতে কপালে দুঃখ আছে। সমস্ত পোষাকের উপর দুটো করে পেল্লায় মোটা কম্বল চাপিয়েও যেন মনে হচ্ছে গায়ে যেন কিছু নেই। সারা গায়ে কে যেন বরফ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে! গুড়ি সুঁড়ি মেরে কম্বলের তলায় ঢুকে গেলাম।
দর্শন যাত্রা
ভোর চারটে বাজার অনেক আগেই এক ঝটকায় সব কিছু ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়লাম। উফ কী ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা! যেন হাড়ের ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। এর মধ্যেই বাইরের রাস্তায় পুণ্যার্থীদের কোলাহল টের পাওয়া যাচ্ছে। সবাই চেষ্টা করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাত্রা শুরু করার। সব সারা হলে তিনজনে যখন প্রস্তুত হয়ে তাঁবুর বাইরে পা দিলাম ঘড়িতে সকাল পৌনে পাঁচটা।
তাঁবুর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সামনের পর্বতশ্রেণীর মাঝে হারিয়ে গেছে, "জয় বাবা ভোলে নাথ - জয় বাবা বরফাণী - জয় মাতা পার্বতীজি" ধ্বনি দিয়ে সেদিক দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় দেড় কিলোমিটার পর আমাদের যাত্রা পারমিট চেক হবে। তারপর আর কোথাও সেটার দরকার নেই। এই ভোরবেলাতেও দেখি রাস্তার দুপাশে ভান্ডারাগুলোর স্বেচ্ছাসেবকরা হাতে গরম চায়ের কেটলি, বিস্কুটের প্যাকেট, টফি ছাড়াও আরও অন্যান্য অনেক রকমের শুকনো খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীদের সেবার জন্য।
ঠিক করেছিলাম, প্রথম তিন-চার কিলোমিটার রাস্তা একটানা চলে তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়ানো হবে বিশ্রামের জন্য। গতকালের বৃষ্টির ফলে রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। জায়গায় জায়গায় জল জমেছে। সঙ্গে মিশেছে ঘোড়া আর খচ্চরের বর্জ্য। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। কিছুটা পথ যাবার পরই দেখি সামনের রাস্তা প্রায় খাড়া গিয়ে অন্য একটা রাস্তাতে মিশে গেছে। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে কোনও রকমে ওপরের রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। আমাদের পাশাপাশি চলছিল একটি পাঞ্জাবি তীর্থযাত্রী পরিবার। দলে দু-তিন জন বয়স্ক মহিলাও রয়েছেন। আমাদের সামান্য সাহায্য নিয়ে তাঁরা দেখলাম বেশ তড়তড়িয়ে খাড়া জায়গাটা পার করলেন। আরও প্রায় আধ কিলোমিটার রাস্তা যাবার পর দেখি সামনে চেকপোস্টে ঘোড়াওয়ালা আর পায়ে হাঁটা যাত্রীদের আলাদা আলাদা লম্বা লাইন। চেকিং-এর পর আমরা ঠিক করলাম মিনিট পাঁচেকের জন্য দাঁড়াব। কিন্তু ঘোড়া আর খচ্চরের গন্ধে দাঁড়ায় কার সাধ্য! বাধ্য হয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। কোনো যাত্রী যদি ডুলি বা ঘোড়ায় যেতে চায় তবে এখান থেকে সে সব ভাড়া পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা যাবার পর শরীর বেশ গরম হয়ে গেল, বলা উচিত গা প্রায় ঘেমে উঠল। এবার গরম জামা খুলতে হবে। দাঁড়িয়ে পড়লাম পথের পাশে। পথ বলতে পাহাড়ের গা কেটে ফুট চারেকের একটা এবড়ো খেবড়ো পরিসর। বাঁ হাতে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আকাশ ফুঁড়ে আবার ডান দিকে একটু উঁকি দিলেই দেখা যাবে গভীর খাদ নেমে গেছে যেন পাতাল ভেদ করে। নীচে আর চারধারে বিছানো রয়েছে বরফের চাদর। আশে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়চূড়া।
চলতে চলতে হাঁপ ধরে গেলেই একটু বসে পড়ি। শুরুর সঙ্গীরাও সব বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার আমি দলছুট। এই ভালো হয়েছে। যখন ইচ্ছা পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম, আবার একটু পরেই পথ চলা। চলতে চলতেই পরিচয় হলো গেরুয়া ধারী এক মহারাজের সঙ্গে। পাকাপাকি নিবাস বলে তেমন কিছু নেই। এখন চলেছেন বাবার দর্শনে। দর্শন শেষে আবার চলে যাবেন কেদারের পথে। ওঁর মুখে কেদারনাথ এর কথা শুনে মনটা আবার আনচান করে উঠল।
বছর ছয়েক আগের কথা। যোশী মঠ থেকে বেড়িয়ে গৌরী কুণ্ড আর রামওয়াড়ার রাস্তায় কেদার চলেছি; পথমধ্যে পরিচয় এই রকমই এক সন্ন্যাসীর। কোমর অবধি জটা, হাতে লম্বা ত্রিশূল। গায়ের রঙ হিমালয়ের তীক্ষ্ণ রোদ আর সূর্যের প্রখর তাপে তামাটে বর্ণ ধারন করেছে। কপাল জোরে একত্রেই দর্শন হল। ফেরার পথ ধরার সময় বললেন,"এবার আমার যাবার পালা, তুমি চলে যাও তোমার রাস্তায়, আমি চললাম নাগ বাসুকির কোলে বিশ্রাম নিতে। কপালে থাকলে আবার ভেট হবে।" বুঝলাম উনি কিছুদিন কেদারের আরও ওপরে বাসুকি তালে কিছুদিন বিশ্রামের কথা বলছেন। সেবার খুব ইচ্ছে থাকলেও ওঁর সঙ্গ নিতে পারিনি। তবে ওঁর শেষ কথাটা মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। " কপালে থাকলে আবার ভেট হবে", পরের বছর হলও তাই। যোশী মঠে দেখা হয়ে গেল দুজনায়। আমি চলেছি বদরীবিশালজীর দর্শনে আর উনি দর্শন শেষে নেমে আসছেন। দেখেই চিনতে পারলেন। প্রণাম করে কুশল জিজ্ঞাসা করায় বললেন, দেহ এখনও সুস্থ, এখান থেকে সোজা চলে যাবেন হিমালয়ের পথে গোমুখ। সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম করার ইচ্ছা। এরপর আর দর্শন হয়নি। এবার এই যাত্রায় আবার তাঁরই এক প্রতিবিম্বের সাক্ষাত পেলাম।
দুজনে আস্তে আস্তে প্রায় আট-ন' কিলোমিটার রাস্তা চলে এলাম। দেখতে পেলাম পাহাড়ের গা কেটে খানিকটা সমতলের মতো করে দুখানা ভান্ডারা খোলা হয়েছে। পথশ্রমে ক্লান্ত যাত্রীরা এখানে দুদন্ড জিরিয়ে নিচ্ছে। কেউবা সামান্য কিছু খেয়েও নিচ্ছে। দর্শন শেষে তবে খাব এই চিন্তা করে আমার আজ আর কিছু খাওয়ার ব্যাপার নেই। দুজনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথে নামলাম। বেশ কিছুটা যাবার পর পথ আরও সরু হয়ে আসে। সামনে দূরে দেখি ঝরনার বরফ গলা জল ঝরঝর শব্দে পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসছে। যেন কোনও সুন্দরী তরুণী তার রূপের ডালি সাজিয়ে নিয়ে ছুটে চলেছে পাহাড়ের এক অলিন্দ থেকে আর এক অলিন্দে। পিপাসা পেয়েছিল, ঝরনার এক পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে জল খেয়ে নিলাম। এত সুন্দর স্বাদ বোধ হয় অন্য কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়েনা। ঝরনার সামনে দিয়েই পথ চলে গেছে। লোহার পাইপের ওপর কাঠের পাটাতন ফেলে একটা পুলের মতো করা হয়েছে। খুবই পিছল সে পথ। নীচে তাকালে দেখা যায় ঝরনার জল ওপর থেকে পড়ে বহু দূরে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে সরু সুতোর মতো বয়ে চলেছে। যেন কোনও শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁত এক ছবি। ক্ষণিকের বিশ্রাম। আবার পথ চলা। চলতে চলতে আবার একা। এপথে একা হয়েও অবশ্য কেউ একা নয়। কেউ না কেউ ঠিক পাশে পাশে চলতে থাকে। কোনো রকম ভয়ের কারণ হলেই সাহায্যের হাত সামনে এগিয়ে আসে।
দেখলাম প্রচুর অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের দলও চলেছে বাবার দর্শনে। বেশ ভালো লাগল। মুখে ভোলেবাবার নাম, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, কলকল করতে করতে এগিয়ে চলেছে। ওদের দেখে দেহের ক্লান্তি অনেকটা কমে গেল।
কিছুটা চলার পর বুকে বেশ খানিকটা চাপ অনুভব করলাম। প্রায় ১৪০০০ ফুট উঠে এসেছি। অক্সিজেনের মাত্রা এখানে বেশ কম। নিশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। একটা বাঁকের ধারে পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। পাহাড়ে চলতে চলতে কখনোই বেশি সময় কোথাও বিশ্রাম নিতে নেই। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি একবার বসে পড়লে তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা বেশ কষ্টকর।
পাহাড়ের এই অংশ থেকে সামনের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, এক বিশাল পর্বতসমুদ্রে আমরা ক'জনা ডিঙি নৌকার মতো ভাসছি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মতো পাহাড়ের মাথাগুলোতেও বরফের শুভ্রতা। বহু নীচে গিরিখাত সাদা বরফের চাদরে ঢাকা। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে বেশ কিছু ছবি তুললাম, কিন্তু যে দৃশ্য চোখে দেখছি সেটা বন্দী করব কোন ক্যামেরায়? ঘড়িতে প্রায় দুপুর বারোটা। আর বাকী চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ। যত পথ ফুরিয়ে আসছে ততই কঠিন হচ্ছে চলা। একটা খুব বড় চড়াই - এর পর সামনে দেখি পথ সোজা নেমে গেছে হিমবাহের মধ্যে। পাহাড়ের গা কেটে বানানো প্রায় দেড়শোটা সিঁড়ি বেয়ে তবে নামতে হবে। একেই পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর, তার ওপর ভোরবেলা থেকে পেটে পড়েছে শুধু মাত্র ঝরনার জল। নামতে গিয়ে অন্যমনস্কতায় ডান পাটা গেল আচমকা মচকে। ব্যথায় চোখে জল চলে এল। এতই বেশি ব্যথা করছে যে সিঁড়ির ওপরেই বসে পড়লাম। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। মনে আশঙ্কা জাগল। তবে কি এতো দূরে এসেও বাবার দর্শন হবে না? এবারে আর ব্যথায় নয়, দর্শন না হবার আশঙ্কায় দু'চোখে নামলো জলের ধারা। বেশ কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে রুমাল বের করে হাঁটুর কাছে কষে বেঁধে দিলাম। হাতের লাঠি দু'হাতে ধরে সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম, ভোলেনাথ তুমিই রক্ষা কর। তাঁর নাম সম্বল করে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছে যন্ত্রণায় মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। এক পা এক পা করে সব কটা সিঁড়ি শেষ করে যখন হিমবাহের উপর এসে দাঁড়ালাম ততক্ষণে ডান পায়ের কোনো সাড় নেই।
পথের যাত্রীরা ধ্বনি তোলেন, "বোলো সাচ্চে দরবার কি ... জয় , মাতা পার্বতী কি... জয়, বাল গণেশ কি ... জয়, ভোলে ভাণ্ডারী কি ... জয়।" মনে জোর পাই। সহযাত্রীরা সাহস জোগান, এই তো এসে পড়েছেন, সামনেই বাবার গুহা, আর একটু ... আর একটু । চোখ তুলে তাকাই, মুখে হাসি আনার চেষ্টা করি। মনে মনে চিন্তা করি ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন পার্থকে বলছেন -
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরনং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়ীষয়ামী মা শুচঃ।।
অর্থাৎ সব ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও, আমি তোমাকে সমস্ত কষ্ট থেকে রক্ষা করব। আমিও এই মুহূর্তে অন্যান্য সমস্ত চিন্তা পরিত্যাগ করে শিব-শম্ভুর শরণাগত হলাম। আর কী করে যে শরীরে জোর পেলাম তা বলতে পারব না। পিচ্ছিল বরফে লাঠির মাথা গেঁথে গেঁথে একপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। আর মাত্র দু'কিলোমিটার। এখান থেকেই গুহা মুখ দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে গুহা মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনও যোগী পুরুষ সারি সারি গিরি শ্রেণীর মাঝে ধ্যান মগ্ন হয়ে বসে আছেন।
শক্তি দাও বাবা...শক্তি দাও। বুঝতে পারি হাঁটু ফুলে আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তবে ব্যথা বেশ কমেছে। গুহা মুখের কাছ অবধি প্রায় সাড়ে তিনশো সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে। একদম নীচে বেশ কিছু তাঁবুতে পূজার সামগ্রী কেনা বেচা হচ্ছে। এইসব অস্থায়ী দোকানগুলো সব বরফের ওপর পলিথিনের চাদরের উপর বিছিয়ে করা হয়েছে। এদের কাছ থেকে পুজোর সামগ্রী কিনলে ব্যাগপত্র যত্ন সহকারে রেখে দেন। ফিরতি পথে সংগ্রহ করে নিলেই হল।
এক পা আর হাতের লাঠির সাহায্যে বরফের চাঙড়গুলো টপকাতে টপকাতে এগিয়ে চলেছি। আচমকা দেখি সামনের পথ চিরে গভীর নালা কাটা। জওয়ানরা বরফ গলা জল বের করে দেবার জন্য নালা কেটেছেন। পার হবার উপায় নেই। কিছুটা পথ ঘুরে তবে আবার যাবার রাস্তা। আমার এই অবস্থায় আবার কিছুটা ঘুরে যাবার মানে আরও খানিকটা বাড়তি কষ্ট। একজন জওয়ান আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। হাত ধরে পরম যত্নে নালাটা পার করে দিলেন। পার হবার পরে মাথা তুলে দেখি উনি নেই। হয়তো অন্য কারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেছেন। মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। একেবারে শেষে একটা বেশ বড়সড় দোকান। এটি অমরনাথ ট্রাস্টি বোর্ডের। এখান থেকেই পুজোর সামগ্রী কিনে সাথে সাথে ব্যাগটা তাদের জিম্মায় দিয়ে দিলাম।
প্রতীক্ষার অবসান
পথ এখনও শেষ হয়নি। সামনে আছে পাথরের সাড়ে তিনশ উঁচু সিঁড়ি। সিঁড়ির দুপাশে প্রায় পাঁচ ফুটের বরফের দেওয়াল। খালি পায়ে গেট পার করে সিঁড়িতে পা দিলাম। কনকনে পাথুরে ঠাণ্ডা। অনেকে পথশ্রমে এতই ক্লান্ত যে, এতদূর এসেও আর এই সিঁড়ি কটা পার করতে না পেরে সিঁড়িতেই বসে বসে চোখের জল ফেলছেন। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা তাঁদের ভরসা দিচ্ছেন। খাবার জল দিচ্ছেন। নজর সবদিকে। শিব শম্ভুর নাম মুখে নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে চললাম।
রাখী পূর্ণিমার দিন যদি কেউ অমরনাথ দর্শনের জন্য আসে তবে তার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে। ওই দিন হল ছড়ি যাত্রার দিন। এই ছড়ি যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছিল কেউ জানেনা। কথিত আছে যে, মহর্ষি ভৃগু সর্পরাজ তক্ষকের হাতে একটি রুপো বাঁধানো ছড়ি দিয়ে বলেছিলেন অমরনাথ যাত্রা করার জন্য। এই ছড়ি তাকে পথের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবে। তক্ষক ওই ছড়ি নিয়ে বাবা মহাদেবের দর্শন করেছিলেন অক্ষত দেহে। সেই থেকে রাখী পূর্ণিমার দিন হাজার হাজার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রচুর সন্ন্যাসী রূপার তৈরি ছড়ি সঙ্গে রেখে অমরনাথ যাত্রা করেন।
সেই রকমই একটি ছড়ি আজ আমার হাতে। এই ছড়ি না থাকলে এক পায়ে এ যাত্রা হয়তো আমি শেষ করতে পারতাম না। একে একে সব সিঁড়ি পার করে গুহা মুখের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বর্তমানে গুহা মুখের সামনে একটা লোহার ঘেরা টোপ তৈরি হয়েছে। কয়েক বছর আগেও বাবা ভোলেনাথকে স্পর্শ করা যেত। কিন্তু অনেক মানুষের চাপে শিবলিঙ্গের ক্ষতি আটকাতেই এই ব্যবস্থা। গেটের সামনে প্রচুর জওয়ান পাহারা দিচ্ছেন। হাতের লাঠি যদিও বাইরে রেখে ঢোকার নিয়ম, কিন্তু আমার এই অবস্থায় ওঁরা আমাকে লাঠি সমেতই গেটের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু তাই না, আমাকে লাইনে না দাঁড়িয়ে সবার আগে গিয়ে পুজো দেওয়ার জন্যও তাঁরা বললেন। ধন্যবাদ জানিয়ে সকলের সঙ্গে লাইনেই দাঁড়ালাম। আমার থেকেও খারাপ অবস্থা নিয়ে অনেক যাত্রী বাবার দর্শনের জন্য হেঁটে আসছেন, সেটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। আমার বদলে তাঁরা যেন এই সুবিধাটুকু পান।
গুহার উচ্চতা প্রায় ১২০-১৩০ ফুট। বরফগলা জল মাথার ওপর বাবার আশীর্বাদের মতন টপ টপ করে ঝরে পড়ছে। গুহাটির গভীরতা বেশি না, মাত্র ৬০ ফুট, আর চওড়ায় ৮০ ফুট মতন। সামনে তাকালেই চোখে পড়লো ডান হাতে আট -নয় ফুট উচ্চতার ধবধবে সাদা বরফের তৈরি শিব লিঙ্গ। একদম বাঁ হাতে উচ্চতায় একটু ছোট মাতা পার্বতীর তুষার প্রতিমূর্তি আর দুজনার মাঝখানে আরও একটু কম উচ্চতার আরও একটি বরফের স্তূপ। শ্রী গণেশজী - মা আর বাবার মাঝখানে আদুরে সন্তানের মতো চুপটি করে বসে আছেন। গুহার ভিতর আধো অন্ধকারে একটু ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ল দুটি সাদা পায়রা। বেশ আনন্দ হল। হাত জড়ো করে দু'চোখ ভরে দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর পরই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।এত কষ্টের পর দর্শন পাওয়ায় শরীর আর মনের ক্লান্তি কোথায় যে হারিয়ে গেল সেটা বুঝতেই পারলাম না। অগণিত ভক্তের মুখে ওঁ নমঃ শিবায় ধ্বনি ছাড়া কানে আর কোনও আওয়াজ আসছেনা।
রেলিঙের বাইরে দাঁড়ানো এক সৌম্যদর্শন পুরোহিতের সাহায্যে পুজা সম্পন্ন করলাম। দু'চোখের আনন্দাশ্রু আর গায়ের কাঁটা কাঁটা ভাব আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল। দেবাদিদেবকে প্রণাম করে বললাম, বাবা দেহটাকে আরো কিছুদিন সুস্থ রেখ, যেন বারে বারে তোমার দর্শন পাই। আর আমার মনকে রেখ মেঘহীন নীল আকাশের মত।
বার বার একজন পরিব্রাজকের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায় বলি -
" Life is a pilgrimage. The wise man does not rest by the roadside inns. He marches direct to the illimitable domain of eternal bliss, his ultimate destination."
- স্বামী বিবেকানন্দ।
~ অমরনাথের তথ্য || অমরনাথের আরও ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~
কর্মসূত্রে একটি বেসরকারি সংস্থায় যুক্ত রয়েছেন শুভ্রনীল দে। তবে অন্তরের 'যাযাবর' মানুষটিই তাঁর প্রকৃত আত্মপরিচয়। ভ্রমণ তাঁর কাছে বেঁচে থাকার অন্য নাম, ভালবাসেন ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রাখতে ভাল লাগার মুহূর্তগুলো। পথে বিভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষের সাথে পরিচয় করাটাও আরেক নেশা। প্রথম পছন্দ হিমালয়। ভালবাসেন একা একা হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পাহাড়ের চড়াই উতরাই ভাঙতে। বছরে বেশ কয়েকবার না বেরোলে মনে হয় যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। যতদিন সচল আছেন বেড়ানোর রাস্তাতেই খুঁজবেন তাঁর আকাঙ্খিত বেঁচে থাকার রসদ।