অমরনাথের ডায়েরি
অপূর্ব ঘোষ
~ তথ্য- অমরনাথ || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেক রুট ম্যাপ ~
ইচ্ছা অনেকদিনেরই। নানা কারণে আগে হয়ে ওঠেনি। এবার তাই মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছিলাম অমরনাথ দর্শনে আমি যাবই। ক্যামেরার সাথে সঙ্গী ছিল খাতাকলমও। মনের পাতায় ফুটে ওঠা দৃশ্যগুলো হারিয়ে যেতে দেবনা, অনেকদিন পরেও ডায়েরির পাতা উলটে অনুভব করব অনন্য অভিজ্ঞতার সেই স্পর্শ।
২৬ জুন -২৮ জুনঃ- ২৬ তারিখ দুপুর ঠিক ১টা ৪৫মিনিটে বর্ধ্মান স্টেশন থেকে জম্মু- তাওয়াই এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম অমরনাথ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্রমে বাংলা ছাড়িয়ে ট্রেন বিহারে প্রবেশ করল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বিহারের কোডারমা থেকে গয়া পর্যন্ত দুধারে ছোট ছোট পাহাড়, জঙ্গল আর একের পর এক টানেল। আলো-আঁধারিতে ভীষণ ভালো লাগছিল। রাতে শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম আসছিল না। তারপর কখন যে ট্রেনের দোলায় চোখটা লেগে গেছে কে জানে! হঠাৎ চটক ভেঙে গেল বেনারসে গঙ্গা পেরোনোর শব্দে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আবছা আলোয় গঙ্গার ঘাটগুলো দেখতে পেলাম। মনে মনে ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ’ বলে ডান হাত কপালে ঠেকালাম। এরপর লখনউ, শাহাজাহানপুর, মুরাদাবাদ পেরিয়ে জম্মু পৌঁছালাম ২৮ তারিখ সকালে।
স্টেশনে নেমে দেখি চরম অসহযোগিতা ও অব্যবস্থার ছবি। স্টেশনের বাইরে জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমের রিসেপশন সেন্টার থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল পরে দরকারের সময় বুঝেছিলাম সবই ভুল।
২৯ জুনঃ- একদফা সিকিউরিটি চেকিংয়ের পর পহেলগাঁও-এর দিকে রওনা দিলাম। এপথে বাসভাড়া পড়ে মাথাপিছু ২০০ টাকার মতন আর শেয়ারের গাড়িতে ভাড়া ৩৫০-৪০০ টাকা। যেন নাগরদোলায় ঘুরপাক খেতে খেতে পাহাড়ের মাথায় উঠছি আর নামছি। চারদিকটা সবুজ - নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে হাওয়া দিলে মনে হচ্ছে যেন গাছগুলো আকাশের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। সমস্ত রাস্তাতেই মাঝেমধ্যে লঙ্গরখানা আছে। উধ্মপুর, পত্নীটপ হয়ে আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ জওহর টানেল পেরিয়ে অনন্তনাগের ওপর দিয়ে অবশেষে পহেলগাঁও পৌঁছোলাম।
আরেকদফা সিকিউরিটি চেকিংয়ের পর বেসক্যাম্পে ঢোকার ছাড়পত্র মিলল। জম্মু থেকে আসার সময় দেখেছি একটু দূরে আধা সামরিক বাহিনী টহল দিচ্ছে, আর এখন বেসক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে মনে হল যেন কোনও সেনা ছাউনিতেই ঢুকে পড়েছি।
সারি সারি তাঁবু পড়েছে লিডার নদীর ধারে আর মূল রাস্তার দুপাশে। পছন্দমতো একটা টেন্ট ঠিক করে (মাথাপিছু ৭৫ টাকা) জিনিসপত্র রেখে পাশের লঙ্গরখানায় গেলাম খাবার জন্য। এ তো রাজকীয় আয়োজন। সবরকম খাবারই মিলবে নিখরচায়, তবে নিরামিষ। ‘আও ভোলে আও, খানা খাও’-লঙ্গরের লোকজনের কি আন্তরিক আহ্বান - এখনও যেন কানে বাজছে।
৩০ জুনঃ- যাত্রা শুরু আগামীকাল, পয়লা জুলাই। এদিনটা কাটল পহেলগাঁও ঘুরে বেড়িয়ে আর কেনাকাটায়। সমুদ্রতল থেকে ৭৫০০ ফুট ওপরে পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর, নিরিবিলি শহর পহেলগাঁও। তবে এখন অমরনাথ যাত্রী, সাধু-সন্ন্যাসী, কুলি, ঘোড়াওলা, দোকানদার, লঙ্গরখানার লোকজন, মিলিটারি - একেবারে জমজমাট অবস্থা।
বহুযুগ আগে এই রাস্তা দিয়েই আসত মধ্য এশিয়ার যাযাবর দস্যুর দল - এসেছে মিহিরগুল আর চেঙ্গিস খান। হাঁটতে হাঁটতে এইখানে এসেই প্রথম পেত খাদ্য আর পানীয়। জোজিলা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে লাদাখ থেকে কাশ্মীরের পথে প্রথম জনপদ। তাই নাম প্রথম গ্রাম বা পহেলগাঁও।
১ জুলাইঃ- সকালবেলায় বেসক্যাম্পের ক্লোকরুমে অতিরিক্ত জিনিসপত্র জমা দিয়ে চন্দনবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবার জন্য বেরোচ্ছি, দেখি সামনের পাহাড়ের মাথায় এক বিশাল রামধনু। মনে হল যেন স্বয়ং দেবতাত্মা হিমালয় অমরনাথ যাত্রীদের বরণ করার জন্য হাতে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বেসক্যাম্পের সামনে থেকেই শেয়ারের গাড়িতে চেপে (মাথাপিছু ৭৫ টাকা) ১৬ কিলোমিটার দূরে ৯,৫০০ ফুট উচ্চতার চির-পাইনে ছাওয়া চন্দনবাড়ি পৌঁছোলাম। এই চন্দনবাড়ি থেকেই অমরনাথ যাত্রার হাঁটাপথ শুরু। প্রথম দিনই হাঁটতে হবে সাড়ে ১২ কিলোমিটার। তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই পড়ল সেনা ছাউনি। আবার একদফা চেকিং-এর পর যাত্রার অনুমতি মিলল। অমরনাথের নাম স্মরণ করে যাত্রা শুরু করলাম। খানিক দূরে দূরে অতন্দ্র প্রহরীদের সঙ্গে দেখা হলেই চলছে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা। একটু চলার পরেই হাঁপ ধরছে, দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, সামনেই পিসুটপ, পেরোব কী করে?
চন্দনবাড়ি থেকে একটু এগিয়েই হিমবাহ। হিমবাহের গা বেয়ে, লিডার নদীর পাশে পাশে পথচলা। শ্যামল সবুজ উপত্যকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে চির, পাইন, দেবদারুর দল। চারপাশের এই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই এখন ক্লান্তি দূর করবার একমাত্র ওষুধ।
পিসুটপ পেরোলে এমন বড় বড় গাছ আর দেখা যাবে না। সাধারণত হিমালয়ে ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় বড় গাছ দেখা যায় না। বর্ষা বা শরতকাল ছাড়া এই জায়গাগুলোও তুষারাবৃত থাকে। হাঁটা থামিয়ে একেকসময়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। মনে হয় যেন আর পারছি না। তাকিয়ে দেখি ঘোড়া বা পিঠুর পিঠে করে উপরে লঙ্গরখানার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে জেনারেটর পর্যন্ত। সত্যিই কী অমানুষিক পরিশ্রম - ওদের দেখে মনে জোর পাই, শুরু করি আবার চড়াই ভাঙা।
কথিত, পুরাকালে দৈত্যদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। এইখানেই ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে অসুরদের পিষে হত্যা করেন। তাই এর নাম পেষণঘাঁটি বা পিসুটপ। অন্যমতে, কাশ্মিরী ভাষায় ‘পিসর’ শব্দের অর্থ পিছল, তাই থেকেই এই নামের উৎপত্তি। চূড়ান্ত কষ্টকর এই রাস্তা একেবারে ইংরেজির জেড অক্ষরকেও হার মানায়। প্রচণ্ড চড়াই আর বাঁক। চলার ছন্দ মাঝে মাঝেই নষ্ট করে দেয় ঘোড়ার দল। পথচলার ক্লান্তিতে আর প্রকৃতির শোভা বেশিক্ষণ মনে স্থায়ী হচ্ছে না। বড় বড় গাছ শেষ হয়ে এসেছে। এখন শুধু পাথর আর মাটির পাহাড়। বৃষ্টি হলে এই রাস্তা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। চারিদিকে ঝরনা আর নদীগুলো বরফের স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুএকটা তিরতির করে ঝরছে। একজন ভদ্রলোক তাঁর আট বছরের পঙ্গু ছেলেকে কাঁধে করে চলেছেন।
অবশেষে উঠে এলাম ১১,৫০০ ফুট উচ্চতায় পিসুটপে। ঘাসে ছাওয়া ছোট্ট উপত্যকা। মাঝখানে একটা লঙ্গরখানা আর অনেকগুলো ছোট ছোট দোকানপাট। পাঁচ টাকার জিনিস বিক্রি হচ্ছে পঁচিশ টাকায়। লঙ্গরখানার কাছে আসতেই আবার সেই একই আহ্বান-‘আও ভোলে খাও ভোলে’। দুপুর তখন প্রায় দুটো। তাই সামান্য কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম। এত ক্লান্তি কিন্তু একটু বিশ্রামেই কেটে গেল, বোধহয় হিমালয়ের স্নিগ্ধ বাতাসে।
আবার হাঁটা শুরু। হিমালয়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা চলেছে - বাঁদিকে হিমালয় আর ডানদিকে লিডার নদী গভীর খাদ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলেছে। পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে ছোট ছোট ফুলের গাছ – হাওয়ায় দুলছে। মনে হয় আমাদের দেখে ঠিক যেন মাথা নেড়ে হাসছে।
অনেকেই প্রথম রাতটা জোজিবালে কাটান। কিন্তু আমার গন্তব্য শেষনাগ, আরও অনেকটা পথ বাকি। এই পথে তুলনামূলকভাবে কষ্টটা অনেক কম। একটু পরেই দেখি একটা নদী পুরোটাই জমে স্থির হয়ে আছে আর বরফ নিয়ে সবাই ছোটদের মত খেলায় মেতেছেন। এই বিশাল হিমালয়ের কোলে সকলেই যেন ছোট হয়ে যায়। সামান্য চড়াই উতরাই ভেঙে একটা বাঁক ঘুরতেই শেষনাগের দেখা পেলাম, কী অপূর্ব সুন্দর!
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর - তিন পাহাড় দিয়ে ঘেরা পান্নাসবুজ শান্ত টলটলে হ্রদের জলে পড়েছে পাহাড় আর নদীর ছায়া। সমুদ্রতল থেকে ১১,৭৫০ ফুট ওপরে রয়েছি। এখান থেকেই লিডার নদীর পথচলা শুরু। ভাবি, প্রকৃতির এ কী অদ্ভুত খামখেয়াল -চারদিক থেকে বয়ে আসা যে নদীগুলো শেষনাগকে ছুঁয়েছে তারা সবাই জমে স্থির হয়ে আছে, অথচ, শেষনাগের জলে তার কোনও প্রভাবই পড়েনি। কাশ্মীরি ভাষায় ‘নাগ’ শব্দের অর্থ সরোবর। অমরনাথের পথে এটাই শেষ জলাশয়। হয়তো তাই নাম হয়েছে শেষনাগ। আবার প্রচলিত গল্পকথা বলে বহু অতীতে সুশ্রবসনাগ এই সরোবর খনন করান, তাই এই নাম। শেষনাগকে ডানদিকে ফেলে মিনিটদশেক হাঁটার পর টেন্ট এলাকায় পৌঁছোলাম। পথের দুপাশে সারি সারি তাঁবু। সারাদিনের পরিশ্রমের পর কিছু খেতেও প্রায় ইচ্ছে করছে না। দেখেশুনে একটা টেন্টে (মাথাপিছু ১৬০ টাকা) রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। এইসব টেন্ট মালিকদের ওপর প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। খুবই নিচুমানের ব্যবস্থা, না আছে আলো এমনকি ভালো বিছানাও। অমরনাথের কাছে যাচ্ছি, তাই এই অসুবিধার কথা মনে ঠাঁই দিলাম না। এখানে সন্ধ্যা হয় প্রায় ৭টার সময়। আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে লঙ্গরখানায় খেয়ে তাঁবুতে ফিরলাম। প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে পরেরদিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
২ জুলাইঃ- ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখি চারদিকে সাজো সাজো রব - যাবার জন্য সবাই তৈরি হচ্ছে। আমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে টেন্ট থেকে বেরোলাম। লঙ্গরখানা থেকে সামান্য চা ও টিফিন খেয়ে বাবা অমরনাথের নাম স্মরণ করে পঞ্চতরণীর উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। একটু ঢালুতে নেমে পৌঁছালাম গ্লেসিয়ারের ওপর। একটা ছোট্ট ঝরনা পেরিয়ে আবার চড়াই আরম্ভ হল। বরফ আর বরফ -হাঁটু পর্যন্ত মাঝে মাঝে তুষারে ডুবে যাচ্ছে। অনেকে দেখি বরফের ওপর বসে স্কি করে উতরাইয়ে নামছেন। একটু হাঁটছি আর জিরোচ্ছি। মহাগুনাস পাস ১৪,৫০০ ফুট উচ্চতায়, এখানে অক্সিজেনের পরিমাণ এতই কম যে তাড়াতাড়ি হাঁপ ধরে যাচ্ছে। কিন্তু কী অপূর্ব চারপাশ -বরফেরই কত রূপ!
ভক্তদের বিশ্বাস, অমরনাথ দর্শন করব বলে যদি কেউ এই পথে বের হন, স্বয়ং ভোলানাথই তাঁর সব দায়িত্ব তুলে নেন। যেন এরই প্রমাণ পেলাম হাতেনাতে -এক বৃদ্ধা এক হাঁটু বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ কাঁদছেন আর বলছেন, ‘অমরনাথ হি হামকো লে যায়গি’ - পরের মুহূর্তেই দেখি কর্তব্যরত দুই জওয়ান তাঁর দুই হাত ধরে প্রায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। ভাবি, স্বয়ং ভোলানাথই কি এইভাবে এঁদের বেশে এখানে আসেন?
মাথা নিচু করে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি, এক বিশাল বরফে মোড়া সাদা পাহাড় যেন রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে নীল আকাশের পটে এক অসাধারণ ছবি।
মহাগুনাস পাসে পৌঁছোতেই জওয়ান ভাইয়েরা যত্ন করে গরম জলের গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। গরম জলটা খেয়ে যেন ধড়ে প্রাণ এল। এখানে বেশিক্ষণ থাকতে দেয় না, তাই আবার হাঁটা শুরু করলাম, এবার উতরাই। জওয়ান ভাইয়েরা সবাইকে সাবধান করে বলছেন, চোখে সানগ্লাস, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস পড়ুন। প্রথমে এটা একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল, পথে নেমে বুঝলাম কারণটা কি, উতরাইয়ে কিছুটা নামতেই মনে হল চারপাশে সাদা বরফে মোড়া পাহাড়ের মাঝখানে আমি যেন আটকে গেছি। সূর্য একেবারে মাথার ওপর - বরফের ওপর রোদ পড়ে চোখ একেবারে ঝলসে দিচ্ছে। অথচ এই বরফের রাজ্যেই দেখি দুটো বাচ্চা মেয়ে কেমন অবলীলাক্রমে একপাল ছাগল-ভেড়া চড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। একটা খরস্রোতা নাম না জানা নদীর ওপরে পাটাতন দেওয়া কাঠের অস্থায়ী পুল পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে নজরে পড়ল এক যাযাবর পরিবারকে। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে গড়ে তোলা তাঁদের ছোট্ট ঘরের সামনে বসে দৈনন্দিন কাজকর্ম সারছেন। সামনের একফালি খোলা জায়গাটায় তাঁদের পোষা ঘোড়া আর তার বাচ্চা চড়ছে। একটা বাঁক ঘুরে কিছুটা নীচে নেমে এসে আবার একটা কাঠের পুল পেরিয়ে বেশ অনেকটা সমতল।
পঞ্চতরণী পৌঁছেছি - সমুদ্রতল থেকে ১১,২০০ ফুট উচ্চতায় ভীমা, ভগবতী, সরস্বতী, ঢাকা, বর্গশিলা - এই পাঁচ নদীর মিলনক্ষেত্র। তীর্থের নিয়মমতো, প্রত্যেক যাত্রীকে এখানে পরপর পাঁচটি নদীতে স্নান করতে হয়। কিন্তু এই ঘোর ঠান্ডায় আমার সেই সাহস নেই। চারদিকে উঁচু উঁচু বরফে মোড়া পাহাড়। সেই অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যেই ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে লঙ্গরখানা পেরিয়ে টেন্টগুলোর দিকে এগোই। অনেক টেন্ট, সুবিধামতো একটা ঠিক করে নিলেই হল। জনপ্রতি খরচ পড়বে মোটামুটি ২০০ টাকা। যাঁরা হেলিকপ্টারে এসেছেন তাঁদেরও এখানে নেমেই হেঁটে, ঘোড়ায় বা পালকিতে অমরনাথ দর্শনে যেতে হয়। প্রায় ২ কিলোমিটার সমতল। মাটি-ঘাস-পাথর ছড়ানো রাস্তা। বাঁদিকে নদী আর ডানদিকে যেন হাত বাড়ালেই রুক্ষ তিনটি পাহাড়। তাদের গায়ে মাঝে মাঝে বরফ জমে আছে। পথচলার ক্লান্তিতে আর কোনওদিকে তাকাতেই যেন ইচ্ছে করছে না। তার ওপর হিমেল বাতাস শরীরে দাঁত বসাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি টেন্টে ঢুকে লেপ ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
একটু বিশ্রাম করে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে নিয়ে আরও এক প্রস্থ গরম জামাকাপড় গলিয়ে বেরোলাম। এখানে রাত আটটা পর্যন্ত দিনের মতো ভালো আলো থাকে। তাঁবুগুলো পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলাম কাল যে পথে যেতে হবে সেইদিকে। দেখি অমরাবতী নদীর জল জমে বরফ হয়ে রয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া যেন শরীরের সব রক্তকে জমিয়ে দেবে। ঠান্ডার চোটে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল না। লঙ্গরখানায় রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি তাঁবুতে এসে শুয়ে পড়লাম।
৩ জুলাইঃ- ভোর তিনটের সময় ঘুম ভেঙে দেখি তাঁবুর বাকী সবাই যাওয়ার জন্য তৈরি। যাঁরা ঘোড়ায় চড়ে যাবেন তাঁরা ঘোড়াওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি করছেন। আমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। পঞ্চতরণী থেকে রওনা হয়ে প্রথমেই পড়ল ভৈরবঘাটির দুরন্ত চড়াই। একটু হাঁটার পরেই মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে ফুসফুসটা যেন বেরিয়ে আসছে। যাঁরা ফিরছেন (বেশিরভাগই ঘোড়ায়) তাঁদের জিজ্ঞাসা করছি, কেমন দেখলেন কিম্বা আর কতদূর? তাঁরাও আশ্বাস দেন, এইতো এসে গেছে, আর একটু। গরম জামাকাপড় সব খুলে ফেলেছি। গোটা গা ঘামে ভিজে গেছে। লাঠিতে ভর দিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। বেশিক্ষণ বিশ্রামও নেওয়া যাবে না, তাহলেই পা জড়িয়ে যাবে। প্রায় দু’ঘন্টা এভাবে চড়াই ভাঙার পর উতরাই পেলাম। মাটি আর পাথরের রাস্তা - চারদিক ধুলোয় ধুলোময়। ভালো করে নিশ্বাস পর্যন্ত নেওয়া যাচ্ছে না।
যাঁরা দর্শন করে ফিরছেন তাঁদের মুখে অনাবিল একটা প্রশান্তি মাখা। আমার করুণ অবস্থা দেখে বলছেন, আর বেশিদূর নয়, অমরনাথের নাম করে এগিয়ে যান। লাঠিতে ভর দিয়ে খুব সাবধানে অমরনাথ উপত্যকার গ্লেসিয়ার পেরোচ্ছি। দূর থেকে গুহার মুখ দেখতে পেয়ে মনে মনে বাবা অমরনাথকে প্রণাম জানালাম। দেখে মনে হচ্ছে যেন খুব কাছে এসে গেছি, কিন্তু যতই এগোই গুহা ততই দূরে সরে যাচ্ছে। ডানদিকে অমরগঙ্গা জমে বরফ হয়ে আছে। এখানে অনেক টেন্ট আছে, তাতে রাত্রিবাসও করা যায়। পুজোর জিনিসপত্র কিনে এগোতে লাগলাম। আবার চেকিং। গ্লেসিয়ারের পর থেকে সিঁড়ি শুরু হয়েছে। নামেই সিঁড়ি - মাপের কোন ঠিকঠিকানা নেই - কোনওটা পাঁচফুট চওড়া তো দু’ফুট উঁচু। দু’তিনটে সিঁড়ি উঠি, আর বিশ্রাম করি। এখান থেকেই বারা অমরনাথের জয়ধ্বনি আর ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি উঠে জুতো রাখার ব্যবস্থা। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। জওয়ান ভাইরা বেলচা দিয়ে প্রায় চার-পাঁচ ফুট বরফ কেটে রাস্তা করছে। জুতো খোলার পর মনে হচ্ছে পা দুটো যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। আবার ক’টা সিঁড়ি। এখান থেকে সিকিউরিটির লোকজন গুনে গুনে লোক ছাড়ছেন যাতে ওপরে একসঙ্গে বেশি ভিড় না হয়। এরকম দুটো বাধা পেরিয়ে ১৩,৫০০ ফুট উচ্চতায় গুহামুখে পৌঁছে পেলাম তুষারলিঙ্গ অমরনাথ দর্শন। কী অপূর্ব! সব কষ্ট যেন নিমেষেই ভুলে গেলাম- মন ভরে গেল আনন্দে- চোখ থেকে আপনা-আপনিই জল বেরিয়ে আসছে। এত আনন্দ যেন সারা জীবনেও ফুরোবে না।
এখন আর কাউকে তুষারলিঙ্গের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। সামনে লোহার রেলিং দেওয়া। দুচোখ ভরে দেখছি আর মনে মনে বলছি বহুজন্মের পুণ্যের ফলে এ দর্শন। এক জওয়ান ভাইয়ের স্পর্শে জ্ঞান ফিরল - এগোতে হবে। পুজোর জিনিসপত্র পুরোহিতের হাতে দিলাম। তিনি বেদিতে ঠেকিয়ে তা ফেরত দিলেন। বেশিক্ষণ তুষারলিঙ্গের সামনে থাকতে দিচ্ছে না। অগত্যা মূল বেদি থেকে একটু নিচে নেমে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখি দুটো সাদা পায়রা উড়ে এসে গুহার গায়ে পাথরের ওপর বসল। শোনা যায়, সেই পুরাণের সময় থেকেই একজোড়া কপোত-কপোতী অমরনাথে বাসা বাঁধে, এরা নাকি অমর! সত্যি-মিথ্যে জানিনা, শুধু মনে হল বাবা অমরনাথের দয়ায় এই যাত্রাতেই সেই পুণ্যদর্শনও হয়ে গেল।
পুরাণে আছে, নারদমুনির প্ররোচনায় পার্বতী শিবের কাছে ত্রিভুবনের সৃষ্টিরহস্য জানতে চান। পার্বতীকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে রাজি হন শিব। অথচ সৃষ্টিরহস্য বলতে হবে অতি সঙ্গোপনে যাতে কেউ না শুনতে পায়। অনেক খুঁজে শেষে তিনি হিমালয়ের বুকে এই গুহা আবিস্কার করেন। দেবাদিদেব শুরু করলেন অমরকথা বা সৃষ্টিরহস্য। কত দিন, কত যুগ পার হল তার কোনও হিসেব নেই। একদিন শেষ হল অমরকথা। শিব চোখ খুলে দেখেন পার্বতী ঘুমিয়ে পড়েছেন কবেই, আর এতদিন ধরে সৃষ্টিরহস্য কথা শুনেছে এক শুকপাখি। পার্বতীর বদলে সেই এতদিন সাড়া দিয়ে এসেছে। দেবাদিদেবের ক্রোধের ভয়ে শুক উড়তে উড়তে গিয়ে ব্যাসদেবের পত্নীর উদরে প্রবেশ করে। ব্যাসদেবের পত্নীর কাছে হার মেনে শিব আশীর্বাদ করেন তাঁর পুত্ররূপে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে জন্ম নেবে এই শুক। আর যে গুহায় বসে সে অমরকথা শুনেছে তা অমরতীর্থে পরিণত হবে। মহাদেব সেখানে স্বয়ং অধিষ্ঠান করবেন অমরনাথ রূপে। মতান্তরে, এই লীলাশুকই কপোত-কপোতীর রূপ ধরে অমর হয়ে রয়েছেন অমরনাথে।
এইসব কথা-কাহিনির কোনও শেষ নেই। যত শুনি, ততই আরও শুনতে ইচ্ছে করে। এবার ফেরার পালা - মন চায়না, তবু ফিরতে হবে। একটু করে নামি আর ঘুরে দাঁড়াই, দেখি। প্রণাম করে মনে মনে বলি, তুমি চাইলে আবার আসব তোমাকে দর্শন করতে।
~ তথ্য- অমরনাথ || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেক রুট ম্যাপ ~
চিত্র সাংবাদিক অপূর্ব যুক্ত রয়েছেন একটি বাংলা সংবাদপত্রের সঙ্গে।