~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~

~ আগের পর্ব পড়ুন এখানে ~

~ শেষ পর্ব ~

৪.২.২০১৭ :

বেড়াতে এলে এই একটা মুশকিল, কোনওদিন সকালে জমিয়ে ঘুম হয়না। রোজই বেরোনোর তাড়া। ঘুম চোখে উঠে তড়িঘড়ি স্নান, গোগ্রাসে ব্রেকফাস্ট সারা এবং কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া। আজ আমাদের গন্তব্য নীল আইল্যান্ড। এবং আবারও Makruzz-এর ফেরি। নির্ধারিত সময়ের থেকে সে এল একটু দেরিতেই। তবে এবার আর অভিষেকের কোনও অসুবিধা হল না দেখলাম। নীল-এর জেটিতেও পুগালের পরিচিত একটি ছেলে, রাজার থাকার কথা। জাহাজ থেকে নেমে দেখি রঙের জাদুকরের ভেলকি এখানেও পিছু ছাড়েনি। ছাড়ার কথাও নয় অবশ্য। কিন্তু তাও, বারবার কিরকম অবাক বিস্ময় বোধ জাগছে মনে। এত রূপ যেন অবিশ্বাস্যই লাগছে কখনও কখনও। এখানে জলের নীল যেন আরও স্বচ্ছ, আরও উজ্জ্বল। হোটেলে নিয়ে যাওয়ার পথেই রাজা আমাদের নিয়ে গেল ন্যাচারাল ব্রিজ দেখাতে। এটি আসলে একটি বিশালাকৃতির মৃত কোরাল, তোরণের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটি খুব শান্ত ও মনোরম। রোদ প্রখর হলেও একটু ছায়া দেখে বসে থাকতে যে কী ভালো লাগছে! জলে রঙের এমনই মোহ, চোখ ফেরাতেই ইচ্ছে করে না। ঘন্টার পর ঘন্টা চোখের পলক না ফেলে তার রূপসুধা পান করা যায়। ঢেউ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলেও বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছি, জুতোর ভেতর জল ঢুকে ভিজে গেছে। ফিরে গিয়েই শুকোতে দিতে হবে।

নীল আইল্যান্ডটি বিস্তৃতিতে খুবই স্বল্প পরিসর। দ্বীপের প্রধান রাস্তাটি সর্বসাকুল্যে ৮ কি.মি. লম্বা। বাইক ভাড়া পাওয়া যায় এখানে, ঘোরার জন্যে যা অত্যন্ত সুবিধাজনক। এখনই ঠিক করে ফেলেছি, এর পরের বার যখন আসবো, নীলের জন্যে বরাদ্দ হবে অন্তত দু দিন এবং পায়ে হেঁটে দ্বীপটা চষে বেড়াব যতটা পারি। এখানেও বাঙালি আধিপত্য এত বেশি যে আমাদের হোটেলের নামটাও (অমূল্য রেসিডেন্সি) বাংলায় লেখা। রাজা নিজে তামিল হলেও সারাদিন আমাদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলে গেল সাবলীলভাবে। হোটেলের বাসিন্দারাও দেখলাম সবাই বাঙালি। তবে শুধু আমরাই কোনও ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে আসিনি। তাই বেশ নিশ্চিন্তমনে ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজেদের মত করে। কোনও নিয়ম বা সময়ের বাঁধাধরা গন্ডিতে বাধ্য নই।
বিকেলে গেলাম লক্ষ্মণপুর বিচ। নীল আইল্যান্ড-এর জায়গাগুলো রামায়ণের চরিত্রের নামে নামাঙ্কিত। রামনগর, সীতাপুর, লক্ষ্মণপুর ও ভরতপুর। আমি ভেবেছিলাম এখানেও বিদেশি পর্যটকদের রমরমা দেখব, হ্যাভলকের মত, কিন্তু দেখলাম বাঙালিদেরই আধিপত্য। আমরা যখন পৌঁছাই, বিচটি নির্জন। অর্থাৎ আবার একাত্ম হওয়ার সময়, আবার সমুদ্র, আকাশ, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সময়। অভিষেক তো যথারীতি ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, আমি শুধু আমার একলা মন ভাগ করে নিই জল-বালি-আকাশের সঙ্গেই।
আরও একবার সূর্যাস্তের পালা। আবারও সেই মায়াবী আলোয় জল আর আকাশের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার শুভক্ষণ এসে আপ্লুত করছে। এই সময় শুধু হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, নিজের থেকেও অনেক দূরে। সব মনখারাপ মিলিয়ে যায় ওই দিগন্ত রেখায়, যেখানে আকাশ হারিয়ে গেছে সমুদ্রের বুকে... নাকি সমুদ্র আকাশে?
অনেকখানি ভালোলাগা নিয়ে ফেরার পর ঠিক করলাম কাছাকাছি স্থানীয় বাজারে একটু ঘুরে দেখব। তা ঘুরতে এসে দেখি বাজার শুরু হওয়ার পর দু'পা হাঁটলেই বাজার শেষ! কী আর করা, আবার আমরা হোটেলমুখো। বলতে ভুলে গেছি, লক্ষ্মণপুর বিচ থেকে ফেরার পথে একজনের কাছে তন্দুরি কাঁকড়া অর্ডার করে এসেছি, সে হোটেলেই পৌঁছে দেবে বলেছে। প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ এলো সেটা। খুলে দেখি পরিমাণে প্রচুর! যদিও আমি কম করেই অর্ডার করেছিলাম, তাও যেটা দিয়েছে সেটা আমার একার জন্যে অনেক! অভিষেক তো চেখেও দেখবে না, সব আমাকেই গলাধ:করণ করতে হবে। খেতে কিন্তু দারুণ। প্রায় এক ঘন্টা ধরে কাঁকড়ার দাঁড়া-টাঁড়া নিয়ে কসরত করে যুদ্ধে জয় লাভ করলাম। আজও তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে, কাল ভোরে উঠে সানরাইজ দেখতে যাব।

৫.২.২০১৭ :

অন্ধকার থাকতে থাকতেই উঠে পড়েছি। কোনরকমে ঘুমচোখে জামাটা পাল্টে নিয়েই বেরোব সূর্যোদয় দেখতে। দিল্লিতে তো এই সুবর্ণ সুযোগ বা সময় কোনটাই হয়না। তাই এখানে এসে একটি সুযোগও হাতছাড়া করতে চাই না। তৈরি হয়ে রাজাকে ফোন করে ডাকতেই ও চলে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। কাছেই বাড়ি ওর। সীতাপুর বিচে যখন পৌঁছলাম, বেশ অন্ধকার। আমরা ছাড়াও আরও দু-একজন এসেছে। আস্তে আস্তে আরও কয়েকজন এল। এই সৈকতটিও বেশ ছোট। ধীরে ধীরে পুব আকাশ রাঙাতে শুরু করছে, কেটে যাচ্ছে আঁধারের অন্তরাল। আকাশে অল্পবিস্তর মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাই পুরো পরিবেশটাই হয়ে উঠেছে আরও নাটকীয়। আমরা যেন এই রঙ্গমঞ্চের দর্শক। কোনও এক অদৃশ্য পরিচালক সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে রচনা করছেন তাঁর নাটকের প্রথম দৃশ্য। সারাদিন নানাভাবে আরও কত কিছুই লেখা হয়ে যাবে!
একটু একটু করে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বময়, মনটা ততোই কেমন যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। এ জগতে যেন কোনও দু:খ থাকতে পারে না, কষ্ট থাকতে পারে না; সকলের সব মনখারাপ মুছিয়ে দিতে পারে, এ এমনই মায়াবী আলো। কিন্তু নাটকের নায়ক, অর্থাৎ সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তার আলোর ছটায় সবাই ধুয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি এখনও লুকোচুরি খেলছেন মেঘের আড়ালে থেকে। সবাই যখন প্রায় হতাশ হয়ে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছে, ঠিক তখনই, তক্ষুনি হল সেই মিরাকল! একটুকরো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন তিনি। গ্রহণের পর রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে সূর্যের যে হিরের আংটির দ্যুতি ঠিকরে পড়ে, এও ঠিক সেই রকম। একখন্ড হীরক থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে সারা আকাশ জুড়ে। জল, মাটি, আকাশ – সবাই খেলছে তাদের প্রাত্যহিক হোলি, হলুদ, কমলা, লাল আবির নিয়ে। এই মুহূর্তগুলোতে বেঁচে থাকার জন্যে বারবার আসা যায় এই পৃথিবীতে, বারবার ভুলে যাওয়া যায় সকল ক্লেশ।

স্নান আর ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজকেই পোর্ট ব্লেয়ার ফেরার জাহাজ ধরব আমরা। তবে তার আগে কিছুক্ষণ ভরতপুর বিচে সময় কাটাব। ভরতপুর বিচটা একেবারেই জেটির ধারেই। কাল জেটিতে নেমেই যে ম্যানগ্রোভগুলোকে জলে অর্ধনিমজ্জিত দেখেছিলাম, দেখলাম সেগুলো আজ অনেকটাই উন্মুক্ত, নিশ্চয় ভাঁটা চলছে এখন। অলসভাবে হেঁটে ঘুরে, ছবি তুলে সময় কাটালাম। কিছু টুকটাক কেনাকাটিও করলাম বাড়ির সবার জন্য। জাহাজের সময় এগিয়ে আসছে। এই ছোট্ট দ্বীপটা এই অল্প সময়ের মধ্যে এমন মায়ায় বেঁধে ফেলেছে, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় তো নেই। আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি ছাড়া আমার তো আর কিছুই দেওয়ারও নেই তাকে। সে কিন্তু দু'হাত ভরে দিয়ে চলেছে। তার ঝাঁপিতে যত রং ছিল, সব সে যত্ন করে মাখিয়ে দিয়েছে আমার চোখে।
আবার Makruzz। এখানেও সেই হ্যাভলকে আলাপ হওয়া পরিবারটির সঙ্গে দেখা হল। নীলে এসে অনেক জায়গাতেই হয়েছে। আসলে দ্বীপটা অতি ছোট, এখানে দেখা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক হত। হয়ত আর কোনদিন এদের সঙ্গে দেখাই হবে না, তবু এই দু-তিন দিনের পরিচয়টাও কতদিন মনে থেকে যাবে। এও এক ধরণের আত্মীয়তা। আর ভ্রমণই পারে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তের মানুষদের এই অদৃশ্য আত্মীয়তার সুত্রে বাঁধতে।
পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে প্রায় আড়াইটে বেজে গেল। পুগাল অপেক্ষা করছিল জেটিতে। প্যাকড লাঞ্চ কিনে নিয়ে রওনা হলাম চিড়িয়াটাপুর দিকে। শুনেছি এখানে সূর্যাস্ত নাকি দেখার মতো। সানসেট পয়েন্টের থেকে একটু দূরে একটি পার্ক তৈরি করা আছে, সেই পার্কের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট ট্রেক রুট আছে মুন্ডা পাহাড়ের দিকে। স্থানীয় লোকজনের বেশ ভিড় দেখলাম এখানে, আজ রবিবার বলে বোধহয়। খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে ওই ট্রেক রুট ধরে হাঁটা শুরু করলাম। ঠিক কোন জায়গাটা মুন্ডা পয়েন্ট, সেটা আমি নিশ্চিত বলতে পারব না। তবে এক জায়গায় এসে বেশ খোলা একটা প্রান্তর, পাশে একটি সুইসাইড পয়েন্ট আছে (আজ অবধি আমি বোধয় এমন কোনও যায়গায় বেড়াতে যাইনি যেখানে এই নামে কোনও জায়গা নেই! কে আসে এত সুন্দর জায়গায় সুইসাইড করতে? এই সৌন্দর্যের মধ্যে কি মৃত্যুর কথা মনে আসে কারো?), সম্ভবতঃ সেটাই মুন্ডা পয়েন্ট। সেখানে এসেই বেশির ভাগ লোকজন থেমে যাচ্ছে, তবে আমরা এগোলাম আরও। আরও এক-দেড় কিলোমিটার এগিয়ে একটি লাইট হাউস আছে, তার পেছনে সমুদ্র দেখা যায়, এবং একজনের মুখে শুনলাম এটি দক্ষিণ আন্দামানের দক্ষিণতম প্রান্ত। জায়গাটি প্রকৃত অর্থেই খুব সুন্দর। এতটা হেঁটে আসা সার্থক মনে হয় এখানে এসে।

নেমে এসে গাড়িতেই গেলাম সানসেট পয়েন্টের দিকে। রাস্তার পাশে খাঁড়ির মত জল, উল্টো দিকে পাহাড়ের কোলেই সূর্য অস্ত যায় এখানে। জলের মধ্যে ইতস্ততঃ কয়েকটা গাছের গুঁড়ি, কয়েকটা পাথর এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে। আর তাতে জায়গাটার সৌন্দর্য একলাফে বেড়ে গেছে অনেকটা। সূর্য যখন আস্তে আস্তে পাহাড়ের কোলে নামল, জলের মধ্যে তখন যেন কেউ ছড়িয়ে দিল অসংখ্য সোনার কুচি। দূরে একটা দুটো উদাসী নৌকো ভেসে চলেছে। সূর্য যতই নেমে আসছে, জলে ততই লাগে সোহাগের ছোঁয়া। সূর্যোদয় মনে প্রশান্তির ছাপ রেখে গিয়েছিল বলেছিলাম, কিন্তু সূর্যাস্ত প্রতিবারই বয়ে আনে মনখারাপের বার্তা। যে হাত একদিন মুঠো ছেড়ে দিয়েছিল, তার স্পর্শের স্বাদ নতুন করে আচ্ছন্ন করে তোলে। শেষ বেলার পড়ন্ত আলোটা কেমন যেন বিবশ করে তোলে মনকে, যা নেই তাই পাওয়ার আশায়।

৬.২.২০১৭ :

ইংরাজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে এই দিনলিপি নতুন তারিখে লিখছি বটে, তবে বাংলামতে এখনও নতুন দিনের শুরু হয়নি। রাত সবে আড়াইটে। এই মাঝরাতে উঠে কী করছি তাই ভাবছেন? আজ আমরা উত্তর আন্দামানের দিগলিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। দূরত্ব প্রায় ৩৬০ কি.মি., সময় লাগে প্রায় দশ ঘন্টা। তার ওপর এই রাস্তায় পড়ে জারোয়া রিজার্ভ, যেটি পেরোতে কনভয়ের নির্ধারিত সময় মেনেই যেতে হবে। সারা দিনে চারবার কনভয় যায়, তিন ঘন্টা অন্তর। অত দূরের রাস্তা, তাই সকাল ছটার প্রথম কনভয় না ধরলে বেজায় মুশকিলে পড়তে হয়। মুশকিল অবশ্য আর কিছু নয়, শুধু দিগলিপুর পর্যন্ত পৌঁছনো যায় না এক দিনে, মাঝখানে রঙ্গত বা মায়াবন্দরে রাত্রিবাস করে পরদিন দিগলিপুর যেতে হয়। কিন্তু এতে একদিন সময় নষ্ট। তাই আজ আমরা সাড়ে তিনটের সময়ে বেরিয়ে কনভয়ের লাইনে দাঁড়াব। যথাসময় তৈরি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে দেখি পুগালও এসে গেছে। মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠা, তার ওপর গাড়িতে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। আমাকে আর পায় কে? গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল পাঁচটা নাগাদ, গাড়ি যখন জিরকাটাং চেকপোস্ট পৌঁছেছে। এখান থেকেই কনভয় ছাড়ে। সব গাড়ির নম্বর টুকে রেখে এক এক করে ছাড়া হয়। জারোয়া রিজার্ভের মধ্যে গাড়িগুলোকে কনভয়ের নিয়ম মেনেই যেতে হবে, ওভার টেক করা যাবে না এবং গতির সীমাও ঘন্টায় ৪০ কি.মি.। ছবি তোলাও মানা।
লাইনে আমাদের গাড়ি তিন নম্বরে। ছটার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। যথারীতি যাত্রীদের পঁচানব্বই শতাংশই বাঙালি। এবং তাদের অধিকাংশের মধ্যেই জারোয়া দেখার অত্যন্ত দৃষ্টিকটু অশ্লীল উৎসাহ। যেন জারোয়ারা মানুষ নয়, ভিনগ্রহ থেকে দিগভ্রান্ত হয়ে চলে আসা কিছু আজব জন্তু। প্রায় দেড় ঘন্টা পর রিজার্ভ থেকে বেরিয়ে যখন মিডল স্ট্রেইট পৌঁছলাম, তখন তো বেশির ভাগ লোকজন প্রচন্ড হতাশ, জারোয়া দেখতে না পাওয়ার জন্যে। তাতে নাকি তাদের এই জার্নিটাই মাটি! অথচ রিজার্ভের ভেতরটা কী সুন্দর! দুধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, জঙ্গল কোথাও ঘন, কোথাও বা হালকা হয়ে এসেছে। ঘন জায়গাগুলোতে গাছের এতটাই ভিড় করে আছে যে সূর্যের আলো প্রায় প্রবেশ করতে পারে না। আর যেখানে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, সেখানে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মিছটা এসে রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে আলতো আদরে। জঙ্গলের গাছগুলোতে, নতুন পাতায় লেগেছে আসন্ন বসন্তের প্রেমের রং, ঠিক যেন নববধূর সিঁথির সিঁদুরে লাজ। প্রকৃতি তো মুক্তহস্তে আমাদের জন্যে চারদিকে বিছিয়ে রেখেছে তার রূপের সম্ভার। শুধু দেখার চোখটাই দেয়নি সবাইকে। তাই বুঝি কেউ আড়ম্বর খোঁজে, বাহ্যিক বাহুল্যতায়, নকল সাজসজ্জায় রূপ খোঁজে। আর কেউ কেউ খুশি হয়ে বরণ করে নেয় নিরাড়ম্বর প্রেমটুকু, সেটাই হয়ে ওঠে তার অন্তরের ধন। আর জারোয়ারা, তারা তো আমাদের মতই মানুষ। তাদের দেখতে না পেলে আন্দামান আসাই বৃথা – এ তো সেই মানুষ জাতিকে অপমান করার সমতুল্য, মনুষ্যত্বকে অসম্মান করার মাফিক। হোক না তাদের গায়ের রং নিকষ কালো, হোক না মাথার চুল ছোট ছোট ও কোঁকড়ানো, তবু ওরা তো পারে ওদের নিজস্বতা বজায় রাখতে। আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা সেটা পেরেছি কই? এখন যদিও জারোয়ারাও খানিক বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে, অতটা শত্রুভাব পোষণ করেনা ঝকমকে জামাকাপড় পরা লোকেদের প্রতি। কিন্তু সেন্টিনেলিরা এখনও সভ্য জগতের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তারা এখনও তাদের মত করে বাঁচে, তাদের স্বতন্ত্রতাকে বাঁচিয়ে রেখে।
মিডল স্ট্রেইট পেরোতে হবে বোটে। যত গাড়ি, বাস যা কিছু যানবাহন ওপারে যাবে, সবই বোটে করেই পেরোবে। পেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে চাপা। এরপর আর একবার এরকম বোটে চড়তে হয় কদমতলায়। উত্তর আন্দামানের পথে জায়গাগুলোর নাম একেবারেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার নামের মত – কদমতলা, দুর্গাপুর, শিবপুর ইত্যাদি। শুনলাম এদিকে বাঙালিদেরই বসবাস। মাঝে মাঝে দু-একটি চেকপোস্ট, সেখানে নিয়মমাফিক কাজ সেরে আবার চলা। রঙ্গত পৌঁছে বেশ কয়েকটা বিচ ঘুরে নিলাম আবার। আমকুঞ্জ ও মরিচডেরা – দুটো বিচ। এরপর বেতাপুরে একটি ম্যানগ্রোভ ওয়াক। দুধারে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা আছে রাস্তা, মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্যে ছাউনি, তাদের আবার নামকরণও হয়েছে আন্দামানের বিভিন্ন পাখিদের নামে। ম্যানগ্রোভেরও কত রকমফের, আর কতই বা তাদের নামের বাহার - হাতিকান, কামান গোলা ইত্যাদি। এই হাঁটা রাস্তা নিয়ে যায় ধানি নাল্লা সৈকতে। এখানে একটি টার্টল হ্যাচারি আছে, কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড বা অন্য কর্মী না থাকায় এদিন আর সেখানে কচ্ছপ দেখা হল না। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, তাই বেশি সময় ব্যয় না করে ফিরে গিয়ে বসলাম গাড়িতে। আবার চলা শুরু। বিকেল চারটে নাগাদ দিগলিপুর পৌঁছলাম। তবে আমরা থাকব দিগলিপুর শহর থেকে আরও ২০ কি.মি. দুরে কালিপুরে। এখানে থাকার জায়গা বলতে দুটো। একটি সরকারি গেস্ট হাউস, আর একটি প্রাইভেট। আমাদের আগে থেকে বুকিং ছিল না কোথাওই। প্রথমে প্রাইভেট রিসর্টটিতেই ঢুকলাম। বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি রিসর্টটি। খুব পরিপাটি বাগান, পক্ষীপ্রেমীদের জন্যে জায়গাটি রীতিমত স্বর্গ। এসেই বুঝলাম এখানের জন্যে মাত্র একটি রাত বরাদ্দ রাখা খুব বোকামি হয়েছে। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। এখানে কটেজগুলোও খুব সুন্দর, ছিমছাম, সাজানো। এক অস্ট্রালিয়ান দম্পতির সঙ্গে আলাপ হল, এখানে আমাদের প্রতিবেশী। ভদ্রলোক কাঁধে একটা বিশাল লম্বা লেন্স সমেত ক্যামেরা আর হাতে একটা "বার্ডস ইন আন্দামান" বই। পাখি খুঁজে আর ছবি তুলে চলেছেন। কোনও একটা পাখি দেখলেই বই খুলে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে বার করছেন তার নাম। এদের জীবনটা কী ঈর্ষনীয় লাগে মাঝে মাঝে! কতভাবে জীবনটাকে উপভোগ করা যায় এরা জানে এবং সেই উপায়ও তাদের আছে। আমাদের দেশের লোকেদের হয় ইচ্ছেটাই নেই, ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য নেই অনেকের, আবার যাদের দুটিই আছে তাদের অনেকেরই সময় নেই। কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ছুটি পাওয়া যায় না এখানে, অথচ বিদেশে বহু লোক আছে যারা ছয় মাস কাজ করেন এবং বাকি ছয় মাস পৃথিবী ঘুরে কাটান।
যাই হোক, যা নেই সেই আলোচনা এখন মুলতুবি থাক। আপাতত যা আছে, সেখানে মনোনিবেশ করি। রিসর্টটিতে অসংখ্য গাছ্পালা আর আগেই বলেছি নাম জানা-না জানা অসংখ্য পাখি। মালিক ভদ্রলোকটিও খুব আলাপী। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত বাগানে হেঁটেই কাটিয়ে দিলাম। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর যাব কচ্ছপের ডিম পাড়া (টার্টল নেস্টিং) দেখতে, কালিপুর বিচে। অবশ্য দেখতে পাওয়াটা পুরোটাই ভাগ্যের হাতে। রোজ তারা আসে না। তাদের আসা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর। জোয়ারের সময় তারা আসবে, আবার খুব তীব্র জোয়ারে নয়। চাঁদের আলোও বেশি তীব্র হলে আসবেন না ওনারা। আহা, কচ্ছপ বলে কি ওদের কোনও প্রাইভেসি নেই নাকি? রাত্রে বারোটা নাগাদ গেলাম বটে, তবে আমাদের পোড়া কপালে শিকে ছিঁড়ল না। এখন নাকি ভাঁটা এসে গেছে, তার ওপর চাঁদও এখন বেশ জোরালো, অর্থাৎ, তারা এলেন না আজ। কী আর করা, ভগ্ন হৃদয়ের দু:খ নরম বিছানাতেই এলিয়ে দিলাম।

৭.২.২০১৭ :

আজ সকালে বেরোনোর খুব বেশি তাড়া নেই। এখান থেকে আজ চলে যাব যদিও, কিন্তু মাঝে রঙ্গতে রাত কাটাব, তাই একদিনে অতটা বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার টেনশন নেই। এদিকে কাল টার্টল নেস্টিং দেখতে না পাওয়ার আফশোস এখনও যায়নি। যাওয়ার পথে রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ড দেখে সে দু:খ অবশ্য কিছুটা ঘুচলো। এই যমজ দ্বীপ মাঝে একটি বালির চর দিয়ে জোড়া। জোয়ারের সময়ে সেই চর জলের নিচে ডুবে যায়, তখন দেখে মনে হবে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা দ্বীপ। ভাঁটার সময় জল নেমে গেলে দেখা যায় এদের মাঝের যোগসূত্রখানা। উত্তর আন্দামানে খুব বেশি পর্যটক আসেন না, তাই ভিড় নেই তেমন। দিগলিপুর থেকে নৌকা করে আসতে হয় এখানে।এখান থেকে ফিরে এসে আমরা রঙ্গতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

পথে মায়াবন্দরে কারমাটাং সৈকতে কাটালাম বেশ অনেকটা সময়। বেশ লম্বা একটি সৈকত। এবং আমরা ছাড়া আর কেউই নেই সেখানে। বেশ প্রাইভেট বিচে সময় কাটাচ্ছি এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। যেমন ইচ্ছে, যেদিকে ইচ্ছে হাঁটছি, ছবি তুলছি। কেউ দেখারও নেই। এখান থেকে বেরোনোর সময় একজনের কাছে একটি আশার কথা শুনলাম। ধানি নাল্লা বিচ, যেটা আমরা কাল যাওয়ার পথে দেখেছি, সেখানে নাকি এখন কচ্ছপেরা ডিম পাড়তে আসছে। সুতরাং আমরা রাত্রে ওখানে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। কাল থেকে হতাশ হয়ে পড়া উদ্যমে আবার একটা নতুন জোর পাওয়া গেল। অতএব আবার এগিয়ে চললাম আমরা। প্রথমে ঠিক ছিল আমরা রঙ্গতে গিয়ে থাকব, কিন্তু ধানি নাল্লা আসতে গেলে রঙ্গত থেকে সেটা কিছুটা দূরে হবে। তাই কাছে যে সরকারি গেস্ট হাউস আছে, সেখানে গেলাম। ফাঁকাও পাওয়া গেল ভাগ্যক্রমে। এবার আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা।

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর রওনা হলাম। আবার সেই ম্যানগ্রোভ ওয়াকের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম সৈকতে। যে হ্যাচারিটা কাল দেখেছিলাম, তার পাশেই সিকিউরিটি গার্ডের থাকার জন্যে একটি একচালা ঘর রয়েছে। ডাকতে দুজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বেশ সহৃদয় ওঁরা। এখানেও আজ কচ্ছপদের আসার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ ওই একই, পূর্ণিমা আসন্ন, তাই চাঁদের আলো বেশ প্রকট। আর এত আলোতে নাকি তারা ডিম পাড়তে আসে না। তবে আমাদের হ্যাচারি দেখাতে নিয়ে গেলেন টর্চ নিয়ে। আর গিয়েই দেখি কি কান্ড! এক রাশ বাচ্চা কচ্ছপ, সদ্য ডিম ফুটে বেরিয়েছে, হ্যাচারির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কচ্ছপেরা যখন সমুদ্র তীরে বালিতে ডিম পেড়ে রেখে সমুদ্রে ফিরে যায়, সেই ডিম সংগ্রহ করে এই হ্যাচারিতে এনে বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়। একটি একটি গর্তে কতগুলো ডিম কবে রাখা হয়েছে, সেসব লিখে রাখা হয়। মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। তারপর সেগুলো সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসা হয়। আমাদের প্রতি ভাগ্যদেবী কিছুটা হলেও সদয় হয়েছেন, আজই একটি হ্যাচ থেকে বাচ্চা বের করার দিন। ওই দুই ভদ্রলোক মিলে একটি বালতিতে তুলে রাখলেন এক এক করে বাচ্চাগুলো। সংখ্যায় মোট ছিয়াশিটা। তারপর সবাই মিলে গেলাম তাদের সমুদ্রে ছাড়তে। বেশ মজার অভিজ্ঞতা। ছবি তোলার জন্য আলো ফেললেই তারা জলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসছে আমাদের দিকে। তারপর আলো নেভালে আবার জলের শব্দে মুখ ঘোরাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ আশায় আশায় ঘুরলাম বিচে, যদি ভুল করেও একটা চলে আসে আজ! কিন্তু না, সেই অসম্ভব আর সম্ভব হলো না। এ তো আর বলিউড সিনেমা নয়, আর আমিও কোনও নায়িকা নই, যে সব আনহোনি কো হোনি করে দিতে পারব! চাঁদের আলোয় ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতাও বেশ অনেকদিন মনে থাকবে। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু কিছু পোকামাকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। এতক্ষণে চাঁদের আলোতে চোখও সয়ে গেছে, আলাদা করে আলো লাগছে না পথ দেখতে। সব মিলিয়ে নেস্টিং না দেখতে পাওয়ার দু:খ এখন আর একেবারেই হচ্ছে না দেখলাম।

৮.২.২০১৭ :

বেড়ানোর শেষের মুখে এসে বাড়ির জন্যে একটু হলেও মনখারাপ করে। হয়তো এই বাড়ির প্রতি টানটা আছে বলেই প্রতিবার ঘর ছাড়ার নেশাটা এত মধুর হয়। সবকিছুর শেষে ঘরে ফেরার আশ্বাসটা যেন নোঙ্গর দেয় একটা, আর তাতেই ফের ভেসে যাওয়ার সাহস যোগায় মনে। ন'দিনের বেড়ানোর পর ঘরে ফেরার ইচ্ছেটা একটু একটু করে মনখারাপ করে দিচ্ছে আমাদেরও। তবু চলা তো থামে না, থামালে চলে না। সুতরাং, আবার মাঝরাত থেকে উঠে, ধরাচূড়া পরে ভোর চারটের মধ্যে তৈরি। আজ এখান থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরব, পথে বারাটাং আইল্যান্ড ঘুরে। আবার ফিরতি কনভয় ধরতে হবে বলে তাড়াতাড়ি বেরোনো।
উত্তর আন্দামানে এসে একটা জিনিস খুব ভালো লাগল আমার। খুব ছোট জনপদেও শিক্ষাকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলও আছে দেখলাম। কদমতলা পৌঁছে দেখি কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশ। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, তাই বোটও ছাড়ছে না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যখন সূর্যের আলো কুয়াশার সঙ্গে তরবারি খেলায় জয়লাভ করল, আমাদের বোটও নোঙ্গর তুলল।

বারাটাং-এ একটি মাড ভলকানো আছে। এটি সম্ভবতঃ ভারতের একমাত্র মাড ভলকানো। মাটির ভেতর থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্রমাগত কাদা নি:সৃত হয়ে চলেছে লাভার মত। ওখান থেকে ফিরে জলখাবারের পর্বটা মিটিয়ে নিলাম। তারপর আবার নৌকো করে গেলাম লাইমস্টোন কেভ দেখতে। এই বারাটাং-এ অনেক পর্যটক আসেন পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। যারা নর্থ আন্দামান অবধি যায় না, তারা এখান পর্যন্ত এসে এই মাড ভলকানো আর লাইমস্টোন কেভ দেখে আবার ফিরে যান পরের কনভয়ে। লাইমস্টোন কেভ যাওয়ার পথটি ভারী মনোরম। ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। তারপর বেশ কিছুটা হেঁটে পৌঁছনো হয় গুহামুখে। স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের অপূর্ব কারুকার্য এখানে। এখানেও সেই বিভিন্ন পরিচিত আকৃতি খোঁজার খেলা চলল কিছুক্ষণ, কোনটা পদ্মফুল, আবার কোনটা হাতির মাথা। যদিও গাইড বেশিরভাগই কোন দেব-দেবীর আকৃতি দিয়ে বর্ণনা করে, কিন্তু নিজের মত করে নিজের মনের ভাবনাকে ডানা মেলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তো আমার নিজের হাতেই, থুড়ি, নিজের চোখেই।
ফিরে এসে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা পরবর্তী কনভয়ের জন্যে। পুগাল গাড়ি লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সময়মত। নিশ্চিন্ত মনে ছাউনিতে বসে বিশ্রাম করতে করতে, এবং বেশিরভাগ যাত্রীদের মুখে অত্যন্ত অশোভনভাবে জারোয়া না দেখতে পাওয়ার আফশোস শুনতে শুনতে সময়টা কেটে গেল। কেউ কেউ তো আবার পথে যে দ্বীপবাসীকেই দেখেছে, তাদের গাত্রবর্ণের গাঢ়ত্বের সঙ্গে জারোয়া হওয়া বা না হওয়ার সম্ভাবনা যাচাই করতে বেশ মাথা ঘামাচ্ছে দেখলাম। সৌভাগ্যবশত: বিরক্তি চরমসীমায় পৌঁছনোর আগেই কনভয়ের টাইম হল।
জারোয়া রিজার্ভের রাস্তাটা এই ভরদুপুরেও অত্যন্ত মনোরম রয়েছে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলোর লুকোচুরি খেলা এখনও অব্যাহত রয়েছে, যাওয়ার দিন যেমন দেখেছিলাম। নতুন পাতাগুলোতে বসন্তের রং কি আজ আর একটু বেশি করে লেগেছে? গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে মনটা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। পেট্রল-ডিজেলের গন্ধে অভ্যস্ত নাকে এই গন্ধই যেন সঞ্জীবনী সুধার মত কাজ করে।
ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পেটে তখন ছুঁচোদের ডন-বৈঠক চলছে। হোটেলে ফিরে কিছু খাবার পেটে দিতে তবে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সন্ধ্যেবেলা আজ আর বিশেষ কিছু করার নেই, অত:পর বিছানার নরম গদিতেই সঁপে দিলাম নিজেকে।

৯.২.২০১৭ :

আজ আমাদের আন্দামান ভ্রমণের শেষ পর্ব। পোর্ট ব্লেয়ারের স্থানীয় জায়গাগুলো কিছু কিছু ঘুরব আজ। সকালে প্রথমেই গেলাম চ্যাথাম শ মিল। ১৮৮৩ সালে স্থাপিত এই করাত কল আজ রীতিমত ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ কেটে তাকে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হয়। আন্দামানের বিখ্যাত প্যাডক কাঠের জন্যে এই কারখানায় একটি সম্পূর্ণ আলাদা সেকশন আছে। পুরো কারখানাটা ঘুরে দেখতে মন্দ লাগে না। একটি প্রদর্শনী তথা বিক্রয়কক্ষও আছে, রীতিমত নজরকাড়া বেশ কিছু কাজ দেখা যায় সেখানে।

এখান থেকে কাছেই চ্যাথাম হোয়ার্ফ জেটি। এই জেটি থেকে বোটে করে যাব বাম্বুফ্ল্যাট। মাউন্ট হ্যারিয়েট, আন্দামানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থান। প্রথম স্থানাধিকারী স্যাডেল পিক রয়েছে দিগলিপুরে। সেখানেও ট্রেক হয়, কিন্তু বেশ সময়সাপেক্ষ, তাই করতে পারিনি। মাউন্ট হ্যারিয়েটে একটি ন্যাশনাল পার্ক আছে আন্দামান প্রশাসনের। জায়গাটা অত্যন্ত শান্ত, খুব বেশি লোকজনও নেই দেখলাম। জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় কত রকমের পাখির ডাক-ই যে শোনা যায়! ভেতরে একটি রেস্ট হাউসও আছে দেখলাম। এত লোভনীয় যে অনায়াসে সেটা যে কারোর bucket list-এ চলে আসবে। দুটি ভিউ পয়েন্ট তৈরি করা আছে ভেতরে, যেখান থেকে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন দ্বীপ দেখা যায়। কোনও দিকে নীল, কোনও দিকে নর্থ বে। আমরা ভারতীয় কুড়ি টাকার নোটে নর্থ বে লাইট হাউসের যে ছবিটা দেখি, সেটি এখান থেকে তোলা। কালাপাত্থর ট্রেক বলে একটি ট্রেক রুট আছে এর ভেতর দিয়ে। সেই সুযোগ কি ছাড়া যায় নাকি? প্রায় ২ কি.মি. লম্বা রাস্তা। যদিও কালাপাত্থরের বিশেষত্বটা যে ঠিক কি, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি সেদিন। পরে ফিরে এসে উইকিপিডিয়াতে পড়লাম, ওখান থেকে বন্দীদের গিরিখাতে ঠেলে মেরে ফেলা হত। পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখস শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া অন্য আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। পক্ষীপ্রেমীদের এবং বিশাল বিশাল লেন্স সহ DSLR-ধারীদের জন্যে এই জায়গা রীতিমত স্বর্গ।
মাউন্ট হ্যারিয়েট থেকে ফিরে এসে মেরিন মিউজিয়াম আর অ্যান্থ্রোপোলজিকাল মিউজিয়াম দেখা হল। দুটিই অত্যন্ত আকর্ষনীয় সম্ভারে সমৃদ্ধ। মেরিন মিউজিয়ামে বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক প্রাণীদের আলাদা আলাদা কক্ষে প্রদর্শন করা রয়েছে। এর মধ্যে শঙ্খ ও প্রবালের সংগ্রহ আমার খুব ভাল লাগল। অ্যান্থ্রোপোলজিকাল মিউজিয়ামে আন্দামানের আদিবাসী, যেমন ওঙ্গে, গ্রেট আন্দামানিজ, সেন্টিনেলিজ, জারোয়া প্রমুখের জীবনযাপন পদ্ধতি, ব্যবহার্য সামগ্রী ইত্যাদির নমুনা দেখা যায়।
ফেরার পথে পুগাল আমাদের নিয়ে গেল জগার্স পার্ক। এখান থেকে এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। জায়গাটা অপ্রত্যাশিরভাবে সুন্দর। ঠিক বিকেল ফুরিয়ে আসার মুখে, আকাশে হালকা মেঘের মায়াজাল ছিঁড়ে সূর্যের শেষ রশ্মিচ্ছটা ঠিকরে পড়ছে আর সারা আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অলীক রং। এখানে দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয়ে এলো। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপর ছেড়ে চলে যাব এই শহর, এই দ্বীপ। এখানে বিভিন্ন আইল্যান্ডে দেখেছি বোর্ড টাঙানো আছে – "don't take anything except memories"। অন্য কিছু নিয়ে যাওয়ার তো সুযোগই নেই আমার কাছে, স্মৃতিতেই ভরে গেছে প্রাণ। মনের একটা আলাদা প্রকোষ্ঠে যত্ন করে জমানো আছে সব।

১০.২.২০১৭ :

অবশেষে শেষের দিন সমাগত। বাড়ির জন্যে টান অনুভব করছিলাম দুদিন আগে, অথচ আজই আবার এই জায়গাটার জন্যে মনটা ভারী হয়ে উঠছে। এই কদিনে জায়গাটা দু'হাত ভরে দিয়েছে শুধু। কত রকমের অভিজ্ঞতা যে হয়েছে এই কদিনে! সমুদ্রের নিচে ডুবেছি, প্রচুর হেঁটেছি, এমনকি ট্রেকও করেছি এখানে এসে। কত রকমের রং যে দেখেছি তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই জানি, তাই চেষ্টাও করছি না। হেসেছি, কেঁদেছি, নস্টালজিয়ায় ভুগেছি, এককথায় জীবনটাকে প্রাণভরে বেঁচেছি এই কদিনে। অনেকগুলো মুহূর্ত বন্দী করে নিয়েছি আমার মুঠোফোনে, কিন্তু চোখ যা দেখেছে তার কাছে সেগুলো অতিশয় নগণ্য। আকাশ এবং সমুদ্রকে মিলেমিশে একাকার করে দেওয়া এমন রঙের খেলা আর কি কোথাও হয়? আর কি কোথাও দিগন্তকে এভাবে ধুয়ে দিতে পারে অস্তরাগের ছোঁয়া? মানুষ কি এত সরল হয় আর কোথাও? আন্দামানই প্রথম জায়গা যেখানে এসে, সেখানে থাকাকালীনই আমি দ্বিতীয়বার আসার প্ল্যান করে নিয়ে ফিরছি। আকাশ থেকে যতক্ষণ সম্ভব দেখা যায়, চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি এই দ্বীপরাজিকে, মেখে নিচ্ছি তার সবুজ, জড়িয়ে নিচ্ছি তার নীল। ভালো থেকো আন্দামান, উজাড় করে দাও তোমার সব রূপ, আরও আরও মুগ্ধ কর তোমার কাছে ছুটে আসা সকল পর্যটকদের। তারা যে বড়ই পিপাসার্ত, তোমার সৌন্দর্যের অমৃতসুধা পান করিও তাদের। এই লেখা সেই অর্থে ঠিক ভ্রমণকাহিনি নয়। এতে আন্দামানের ইতিহাস বা ভূগোল সম্পর্কে প্রায় কোনও তথ্যই নেই। জায়গাগুলোর বিবরণে আমার আবেগই বোধহয় বেশি প্রকাশ পেয়েছে। আমি তো আসলে ভ্রমণকাহিনির লেখক নই। বা বলা ভালো, লেখকই নই আমি। এটা আমার চোখে দেখা আন্দামান, আমার ভাবনার রঙে রাঙানো আন্দামান। আমার কল্পনার সাজেই সাজিয়েছি তাকে। আমার স্বপ্নই তার অলংকার, আমার অনুভবই তার কপালের আলপনা। আমার ভালবাসার বসনে সে সেজে উঠেছে নববধূর বেশে। বড় যত্নে লালন করব তাকে, বহুদিন... বহু বছর...

~ সমাপ্ত ~


~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~

পছন্দের বই আর গান পেলে বাকী পৃথিবীকে আলাদা করে দিতে সময় লাগে না পর্ণা সাহানার। প্রিয় অবসর বিনোদন নানারকম রান্না আর হস্তশিল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রালয়ে কর্মরতা। নিজের হাতে সংসার গোছানোয় বিশেষ যত্নশীল। মাঝে মাঝেই মুক্তির আনন্দে বেরিয়ে পড়া কারণ ছোটবেলা থেকেই পায়ের তলায় সর্ষে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher