অমরনাথ দর্শন

নিবেদিতা কবিরাজ


~ অমরনাথ-এর তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~

মার্চে সুন্দরবন থেকে ফেরার পরই মান্টামামা বলছিল, "টুয়া আমাদের প্ল্যানটা খেয়াল আছে তো, এবছর কিন্তু যেতেই হবে।" বেশ কয়েকবছর ধরে শুধু আলোচনা আর যাব যাব-তেই থেমে আছে, তারপর আর কিছু এগোয়নি। সময়সীমা তো মোটে দেড় মাস, তার আগে-পরে একটা না একটা ট্যুর ঢুকে পরায় কিছুতেই প্ল্যানটা করা সম্ভব হচ্ছিল না। প্ল্যানটা খোলসা করে বলি এবারে, দুর্গম, দুরূহ পথে স্বপ্নের অমরনাথ যাত্রা। মান্টামামা অবশ্য দেখা হলেই বা ফোনে মাঝে মধ্যেই বলত, "তুই আর আমি বেরিয়ে যাব কেউ রাজি না হলেও।" কিন্তু কিছুতেই সেটা আর হয়ে উঠছিল না। আমাদের বেড়াতে বেরোনোর একটা টিম আছে দশ-বারো জনের,সেখানে ভাইও আছে। ওর মেয়ে ঋদ্ধি এখন পাঁচ বছরের; তাই ভাই,অর্পিতা যাবে না। এবছর গুগুলের টুয়েলভ হওয়ায় তুলুরা বেরোবে না, আর ক্রোমেরও সবে পাঁচ পূর্ণ হল, ওর পারমিশন পেতে এখনো দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে, তাই তুলু, অরুণ এই যাত্রার সঙ্গী কোনোভাবেই হবে না এখন। নোনোদা-রা এরকম ট্যুর করার পক্ষপাতী নয়, ওরা পাহাড়কে ভালোবাসলেও আয়েসি ট্যুর পছন্দ করে, গাড়িতে গাড়িতে; পায়ে হেঁটে নয়। দেবাশিস এতদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না, তাছাড়া তীর্থ করতে চায় না এখনই। মামাইও এখন কোথাও যেতে পারবে না, এম.এস.সি ফাইনাল, চাকরির চেষ্টায় অন্য দিকে মন দিচ্ছে না।
এপ্রিলের শুরুর দিকে মান্টামামাকে ফোন করলাম, বললাম, "মামাকে রাজি করাও, এবছর হলেও হতে পারে, রাজি হলে আমরা তিনজন বেরিয়ে যাব।" এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে। পয়লা বৈশাখের দুদিন আগে ধীমানের ডাকে ওর সখের বাড়ি মানে সুন্দরবন-এ গেছিলাম একটা অনুষ্ঠানে। সেখানে ওর ভাই মৃণালের সঙ্গে আলাপ হয়ে বেশ লাগল, মনেই হলনা প্রথম দেখা - খুব অল্প সময়েই এত আপন হয়ে গেলো। ওরাও নাকি এবার অমরনাথ যাবে। শুনে বেশ লাগল, ওর কাছ থেকে সমস্ত তথ্য নেওয়া শুরু করে দিলাম। হোয়াটস্যাপে অমরনাথ নাম দিয়ে মামা, মান্টামামা আর আমি এই তিনজনের একটা গ্রুপ খুলে সব তথ্য আমাদের মামা-ভাগ্নির ইউনিক গ্রুপের মাধ্যমে মৃণালদের দিতে লাগলাম। ওরাও ওদের পাওয়া তথ্য জানাতে লাগল। অমরনাথ যাত্রার পারমিশনের ফর্ম দেওয়া শুরু হয়েছে শুনেই মামারা জে এ্যাণ্ড কে ব্যাঙ্কে দৌড়ল, কিন্তু ওই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে গেলে আগের দিন রাত্তির থেকে দাঁড়াতে হবে। মৃণাল আগের বছর যাবে বলে পারমিশন করিয়েছিল তাই পদ্ধতিগুলো ওর অনেকটাই জানা। ওর পরামর্শমতো বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষাগুলো আগে করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বজবজ থেকে মামা, ইছাপুর থেকে মান্টামামা আর নৈহাটি থেকে আমি একদিন নীলরতন সরকার হাসপাতালে দৌড়োলাম ডাক্তারি সার্টিফিকেটের জন্য, কিন্তু ওখানে গিয়ে যা বুঝলাম, ব্যাপারটা মোটেই অতো সহজ নয়, ওরা আজ নয় কাল করে ঘোরাবে বেশ কদিন। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও হল যারা এই সার্টিফিকেটের জন্য দিন দশেক ধরে ঘুরছে। কিন্তু ডাক্তারি সার্টিফিকেট না পাওয়া পর্যন্ত ফর্ম তোলা যাবে না, ফর্ম তুলে ফর্ম ফিলাপ করে জমা দেওয়াও কমপক্ষে এক হপ্তার ধাক্কা। এতদিন নষ্ট হলে যা পারমিশনের চাপ, আমাদের পছন্দ মতো দিনে যাত্রা করা যাবে না। কিছু আটকালেই এখন মৃণাল, ওকেই ফোন লাগালাম। বলল,"দিদি, আমরা বারুইপুর হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছি। দুদিন যেতে হয়েছে, তোমরা একটু কষ্ট করে বারুইপুর চলে যাও, পেয়ে যাবে।" আমরাও বারুইপুরে দুদিন ধরে গিয়ে বেশিরভাগ টেস্ট ওখান থেকেই আর কিছু টেস্ট বাইরে থেকে করিয়ে ডাক্তারি সার্টিফিকেটটা শেষপর্যন্ত নিতে পারলাম।
এটুকু পেয়েই মনে হল, নাহ্, অমরনাথ যাত্রাটা তাহলে বোধহয় হবে আমাদের। কিন্তু এরপর পারমিশন পেতে হবে, ব্যাঙ্কে যেতে হবে, হয়তো আরও দুদিন লাগবে। পরের দিনই চন্দননগর পি.এন.বি.থেকে ফর্ম দিচ্ছে জানলাম এক ফেসবুক বন্ধুর থেকে, ওখানেই যাব ঠিক করলাম তিনজন মিলে। রাতেই মৃণালের ফোন, ও অনলাইনে পারমিশন অ্যাপ্লাই করতে পেরেছে। বলল, "দিদি, কাল ব্যাঙ্কে যেও না, আমরা পারমিশন পেলে তোমাদেরটাও আমি করে দেব।" শুনে মনে হলো এটা হলে তো ভালোই হয়, আর দৌড়োতে হয় না। কিন্তু মামাকে ফোনে বলায় মামা ঠিক রাজি হল না, বললো, "ব্যাঙ্কে চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এরপর আর ডেট পাবো না, ট্রেনের টিকিট পাওয়াও মুশকিল হয়ে যাবে।" আমি জোর করেই বললাম একটা দিন অপেক্ষা করো, তারপর যা বলবে করব। মামা কথা শুনল। পরের দিন শুনলাম মৃণালদের পারমিশন হয়ে গেছে, ওরা বারোই জুলাই যাত্রার ডেট পেয়েছে। মৃণালের কথা মতো আমাদেরও হয়ে যাবে এই আশায় সমস্ত ডকুমেণ্ট, ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট আর সার্টিফিকেট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিলাম মৃণালকে। ও অ্যাপ্লাই করে দিল রাতেই, পরের দিনই বেলার দিকে অবশেষে আমাদের পারমিট চলে এল অনলাইনে। মামা, মান্টামামা ভীষণ খুশি। আর দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না, মৃণাল যেন ম্যাজিক করে দিল। অমরনাথ যাত্রা ফাইনাল হল এক নিমেষে, একটা খুশির বন্যা বয়ে গেল যেন আমাদের মধ্যে, তিনজন মিলে ফোনে কনফারেন্স কল করে যাওয়ার তারিখ নিয়ে মেতে উঠলাম।
এই দ্যাখো, ডেটটাই তো বলিনি, আমাদের অমরনাথ যাত্রার দিন ঠিক হল বারোই জুলাই। মান্টামামা পরের দিনই সাতই জুলাইয়ের ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলল কলকাতা থেকে জম্মু যাওয়ার। দুই মামার সঙ্গে ভাগ্নি আমি, এ এক অনবদ্য টিম।
মাঝে দুটো মাস, মে আর জুন, টুকটুক করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতি বলতে কিছু কেনাকাটা, ডেকাথলন থেকে শীতের জিনিস আর ট্রেকিং শ্যু, ট্রেকিং ব্যাকপ্যাক। যত কম ভারী করা যায় ততো ভালো,নিজেকে বইতে হবে,অভ্যেস তো নেই। রেগুলার যোগব্যয়ামের সঙ্গে একটু করে হাঁটা শুরু করলাম মে মাসের শুরুর থেকেই। এখন যা-ই করি মামাদেরকে বলি, ওরাও যেভাবে প্রস্তুতি নেয় বলে, এভাবেই মে মাস কেটে জুন মাস এসে গেল। মৃণালের সঙ্গে ডেকাথলন গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনলাম, বাদ দিলাম ব্যাকপ্যাক, ওটা মৃণাল ধার দেবে বলল, টাকাটা বাঁচল। একটা এসএলআর ক্যামেরা কেনার ইচ্ছে বহুদিনের, কিন্তু দোকানে গিয়ে বুঝলাম কেনার ইচ্ছে থাকলেও ক্ষমতা নেই। এবারেও মৃণাল সাহস জোগাল,একটু কষ্ট করেই স্বপ্নটা পূরণ করে নিলাম। এসময়ে মৃণাল না থাকলে ইচ্ছেটা সত্যিই পূরণ হত না।
এভাবে জুন কেটে গেল, আমাদের ট্রেনে ওঠার তারিখ ৭ই জুলাই এসে গেল।

কাঁধে একটা ইয়া বড়ো ব্যাকপ্যাক, বুকে একটা ছোটো ব্যাগ আর সঙ্গে চোরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেন জম্মু তাওয়াই, সময় সকাল এগারোটা পয়তাল্লিশ, ছাড়বে কলকাতা স্টেশন থেকে। স্টেশনে পৌঁছে মামাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম, আমার থেকেও একটা বড়ো ব্যাগ তাঁর কাঁধে, মাত্র তিয়াত্তর বছরের যুবক, বয়েস শুধুই সংখ্যা মাত্র। মান্টামামা পঞ্চান্ন হলেও জানি সে পঁয়ত্রিশকেও টেক্কা দিতে পারে, তার পিঠে মোটামুটি আকারের একটা ব্যাগ,বেশি কিছু লাগে না ওঁর। এক পেটি জলের বোতল তোলা হল ট্রেনে, স্টেশনে কফি খেয়ে ট্রেনে উঠে বসে বললাম, "শেষ পর্যন্ত তাহলে যাচ্ছি আমরা মামা-ভাগ্নি অমরনাথ দর্শনে।" ট্রেন ছেড়ে দিল, মামাদের এক-গাল হাসি, মামা তো বলেই ফেলল, "যদি শেষপর্যন্ত অমরনাথ দর্শন করতে পারি তাহলে সেটা তোর জন্য; ছোট থেকে স্বপ্ন দেখেছি অমরনাথ যাব। এতদিন শুধু ভেবেইছি, সঙ্গী পাইনি। অ্যাদ্দিনে হল।" চোখের কোণ ভিজে গেল আমার, মনে মনে বললাম তোমরা তো বিশ্বাস করবে না, এ যাত্রা আমার তোমার ওপর নির্ভর করে না, ডাক না এলে, তাঁর ইচ্ছে না হলে সম্ভব নয়। একটা অদ্ভুত মজার ব্যাপার দেখলাম, ট্রেনটায় যার সঙ্গেই কথা বলি সে-ই অমরনাথ যাত্রী। মনে বল যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বাড়ি থেকে তিনজনের ভাত, একটু মাছ আর একটু চিকেন করে এনেছি, একটা দিনের দুপুর-রাত্রি করে চলে যাবে আরেকদিন প্যান্ট্রিকারের খাবার নিতে হবে। আমাদের সামনে এক অবাঙালি পরিবার, আলাপ করে জানতে পারলাম বেলেঘাটার মানুষ, যাচ্ছেন অমরনাথেরই পথে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ আলাপ জমে উঠল। গল্প, আড্ডা, সঙ্গে ওঁদের তৈরি চা। ইলেকট্রিক কেটলি নিয়ে এসেছেন, চা কিছুতেই কিনে খেতে দেবেন না, একটু পুণ্যি করতে চান; বললেন, এই যাত্রা পথে এও নাকি এক সুযোগ! অবাক হচ্ছি মনে মনে, মনকে শুদ্ধ করে নিয়ে যাওয়া যেন।
এভাবেই প্রথম দিনটা কেটে গেল। পরের দিন অবাঙালি ভাবী সকাল সকাল উঠে চা করে ডাকাডাকি, এমন সহযাত্রী পাইনি কখনও। ওঁরা যা খাচ্ছেন আমাদের দিয়ে খাচ্ছেন, আমরাও যা খাচ্ছি ওঁদের দিয়ে, মজার যাত্রা। সকাল গড়িয়ে দুপুর, কেক, চা, বিস্কিট, মুড়িমাখা, তারপর, আগের দিনের ভাত একটু ছিল, এসিতে ভালোই আছে দেখে তাতে জল ঢেলে পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, নুন, আচার দিয়ে এক পেট খাওয়া হয়ে গেল। মামা খেতে খেতে বলল, "সঙ্গে একটা ওমলেট হলে আরও জমে যেত বা ডালের বড়া। কী শান্তি পেলাম রে, ট্রেনেও পান্তাভাতের মজা।" কী খাওয়ার ধুম আমাদের!
ভাতঘুম দিয়ে বিকালে ওঠার পর চা খেতে খেতে ভাবীদের সঙ্গে জোর আড্ডা চলছিল, ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে ছটা, হঠাৎ একজনের মুখে শুনলাম অমরনাথ গুহার কাছে মেঘভাঙা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, প্রচুর দর্শনার্থী সেখানে, মিলিটারি নেমেছে, অবস্থা নাকি খুবই সাংঘাতিক। সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ট্রেনের প্রায় সবাই খবরটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি জটিলের দিকে, বৃষ্টির জলের তোড়ে মানুষ ভেসে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে টেন্ট, ভেসে যাচ্ছে ভান্ডারা। অমরনাথ যাত্রা আপাতত বন্ধ। ইতিমধ্যে খবরটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানোয় বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ, আত্মীয় স্বজনদের থেকে ফোন আসা শুরু হয়ে গেছে ট্রেনের যাত্রীদের। 'অমরনাথ যাত্রা বন্ধ হয়ে গেছে, ফিরে এসো, ফিরে এসো' ডাক আমাদের সবার মোবাইলে। যেন একটা ঘন কালো মেঘের অন্ধকারে আমরা। যাত্রা বন্ধ থাকলে, রাস্তা বন্ধ থাকলে কেউই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারব না, চিন্তা করার কিছু নেই। যেতে না পারলে কাশ্মীর ঘুরব, ফেরার টিকিট তো ১৮ জুলাই, এই-ই সিদ্ধান্ত হল আমাদের তিনজনের। আগে তো কাল সকালে ট্রেন থেকে নামা হোক। বাড়ি থেকে অহরহ ফোন আসছে, মা, ভাই, দেবাশিসের, এদিকে মামারবাড়ি থেকে, ইছাপুর থেকে। সবাইকে বলে দিলাম, "কাল সকালে আমাদের কাউকে ফোনে পাবে না, একদম চিন্তা করবে না, জম্মু ঢুকে গেলে আমাদের সিমগুলো আর কাজ করবে না ওখানে। জম্মু নেমে পোস্টপেইড সিম নিয়ে তোমাদের নম্বরটা জানিয়ে দেব।"
পরদিন একদম সময়মতো সকাল নটায় ট্রেন জম্মুতে ঢুকে গেল। স্টেশনের বাইরে বেরিয়েই দেখলাম অমরনাথ যাত্রীদের জন্য একটা অফিস, ওখানে সমস্ত ডকুমেণ্ট আর পারমিট দেখে একটা যাত্রা-কার্ড দিচ্ছে, যেটা গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে, ওটা দেখেই বোঝা যাবে আমরা অমরনাথ যাত্রী। চটপট নিয়ে নিলাম যাত্রা-কার্ড, তারপর দেখলাম রাস্তার উল্টোদিকের দোকানগুলো পোস্টপেইড সিম নিয়ে বসে, ট্যুরিস্টদের জন্য। আমরা একটা জিও, একটা বিএসএনএল পোস্টপেইড সিম নিলাম। তিনজনেই বাড়িতে নম্বরদুটো জানিয়ে দিলাম।
জম্মু স্টেশন থেকে একটু দূরে ভগবতীনগর, যেতে সময় লাগে অটোতে আধঘন্টামতো। ওখানেই বিশাল জায়গা নিয়ে অমরনাথ যাত্রীদের থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা বিনা খরচে। মামাদের আগেই বলে রেখেছিলাম আমরা ওখানে উঠব না, টেন্টে তিন থেকে চার দিন থাকতেই হবে, পাবলিক টয়লেট তখন ব্যবহার করতেই হবে, বাকি দিনগুলো আমরা হোটেলে থাকলেই ভালো হয়। তাই আর ওদিকে না গিয়ে স্টেশনের কাছে বৈষ্ণোদেবী লজে রুমের আশায় গেলাম, কিন্তু দেখলাম ফাঁকা নেই। পর পর বেশ কটা এরকম ভালো ভালো লজ আছে, পরেরটা কালিকা লজ, ওটাতে ফাঁকা আছে দেখলাম, দেখে আসার সময় ঢালে নামতে গিয়ে পিঠের আর বুকের ব্যাগ সমেত ধপাস করে পড়ে গেলাম পা পিছলে। মামারা হাত ধরে তুলে নিল, কোথাও লাগেনি অবশ্য।
ঢুকে দেখলাম লজটা বেশ সুন্দর, বড় হোটেলের সমতুল্য; লিফটে তিনতলায় উঠে রুম দেখে বেশ খুশি হলাম, ১৮০০ টাকায় এসি রুম তিনজন থাকার জন্য বেশ ভালো। ডাবল বেড সঙ্গে এক্সট্রা বেড, বাথরুমও পছন্দের মতো, যদিও একটা রাতই থাকব, কাল সকালে পাহেলগাঁও বেরিয়ে যাব, তবুও একটা সুন্দর রুমে থাকলে ট্রেনের দু'রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
চটপট চান করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, পেটে বেশ টান দিয়েছে। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি এক কাপ চা ছাড়া, আসার সময় দেখে নিয়েছিলাম রাস্তার উল্টোদিকে অমরনাথ যাত্রীদের ভাণ্ডারা, ওখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম ভাত আর কুমড়োর ডাল দিয়ে - ওটা নাকি জম্মুর স্পেশাল খাবার। যাই হোক, খিদের মুখে যা পড়ছে তা-ই অমৃত লাগছে। খাওয়ার পর কাল পাহেলগাঁও যাবার গাড়ির খোঁজে আমি আর মামা স্ট্যাণ্ডের দিকে হাঁটা লাগালাম,মান্টামামার দুপুরের ভাতঘুম চাই - তাই হোটেলে চলে গেল। আমি আর মামা স্ট্যাণ্ডে গিয়ে কোনও গাড়ি পেলাম না,অগত্যা একটা অটো বুক করে ভগবতীনগর চলে গেলাম বাসের আশায়। ওখানে গিয়ে শুনলাম ভোর তিনটের মধ্যে ওখানে পৌঁছতে হবে আমাদের, তবেই মিলিটারিদের এসকর্ট করা বাসগুলোতে যেতে পারব। প্রাইভেট বাস যেগুলো যায় তারাও যাবে এসকর্ট গাড়ির পিছনে পিছনে,অতএব ওই ভোরেই আসতে হবে, যা বুঝলাম। আমাদের ভগবতীনগরে হোটেল নিলে সুবিধে হত, ভোর তিনটের মধ্যে আসতে গেলে আজ রাতেই লজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। দুটো রাত্রি ট্রেন জার্নির পর আজ তিনজনেরই একটু রেস্ট, একটু ঘুম দরকার - লজের দিকে রওনা দিলাম। ট্রেনে আসার সময় এক এজেন্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, নাম মোনাদা। ওঁর ফোন নম্বরটা নিয়ে নিয়েছিলাম কখন কী কাজে লাগে ভেবে। উনি ইছাপুরের বাসিন্দা, গ্রুপ নিয়ে আসেন - ফোন করলাম ওঁর কোনও গাড়ি কাল পাহেলগাঁও যাচ্ছে কিনা জানতে, ফাঁকা থাকলে যদি আমাদের নিয়ে যান। উনি বললেন, হ্যাঁ, গাড়ি যাবে তো। আমরা কজন জেনে নিয়ে বললেন, রাতে জানাব। তখনকার মতো লজে ফিরে আসা ছাড়া আর কাজ নেই, শরীরও আর যেন দিচ্ছে না। ফিরতে ফিরতে প্রায় ছটা বেজে গেল, তখনও বেশ চড়া রোদ্দুর আছে, আমি রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লাম, মামারা একটু বসে আবার বেরিয়ে পড়ল বাইরে, আমার ইচ্ছে করল না, ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
রাতেও আর বেরোতে ইচ্ছে করল না খেতে যেতে, মামাদের বললাম,"ভালো করে মুড়ি মাখি, খাও দেখবে ভালো লাগবে।" মুড়ি খেতে খেতেই মোনাদার ফোন, কাল ওঁর একটা গাড়ি যাবে, আমাদের নেবেন, দশটায় ছাড়বে; রেডি থাকতে বললেন। মাথাপিছু ১৫০০ টাকা নেবে। মান্টামামা নিজের এলাকার মানুষ পেয়ে বেশ দর কষাকষি করে তিনজনের টাকাটা ৩৮০০-তে নামাল। রাতে খুব প্রয়োজনীয় ঘুমটাও হল সবার।
পরদিন ১০ জুলাই আমরা সকাল সকাল তৈরি হয়ে মোনাদাকে ফোন করে জানালাম। উনি বললেন, "তাহলে আপনারা নটাতেই বেরিয়ে যান, এসকর্ট করা গাড়িগুলো বেরিয়ে গেছে।" মোনাদা ট্যাভেরা পাঠিয়েছে, গাড়িতে উঠে দেখলাম দুজন ভদ্রমহিলা ছাড়া আর কেউ নেই; কারণ জিজ্ঞাসা করায় জানলাম আজ সব ট্রেন লেট, তাই ওঁদের দুজনকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন মোনাদা। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না, গাড়ি তো পেলামই, এতো ভালো পাব আশা করিনি। মনে মনে বললাম হে প্রভু এভাবেই সঙ্গে থেকো। সহযাত্রী দুজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে জানলাম ওঁদেরও ইছাপুরেই বাড়ি।
চললাম পাহেলগাঁও-র পথে। আমরা তিনজন আর রীনাদি, কৃষ্ণাদি গল্প করতে করতে – কবে যাত্রার তারিখ, কোথায় থাকবেন, যেতে না পারলে কোথায় কোথায় ঘুরবেন। তারপর ড্রাইভারকে বললাম, "ভাই ব্রেকফাস্ট করব, ভালো ধাবা দেখে দাঁড়িও।" ড্রাইভার ঘন্টাখানেক পরে একটা ধাবায় দাঁড় করাল। সেখানে গিয়ে যা শুনলাম তাতে মোনাদার ওপর সবাই রেগে গেল। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। অমরনাথ যাত্রা বন্ধ থাকায় যাত্রীদের গাড়িগুলোকে আটকে দিচ্ছে, ভাণ্ডারাগুলোতে হাজার হাজার লোকের ভিড়। রাস্তার এই অবস্থা জেনে আমাদের গাড়িতে কেন তুললেন? থাকতাম নাহয় আমরা জম্মুতেই। যাই হোক, এখন মাঝপথে এসে মাথা গরম করা ঠিক নয়, কেউ আলুর পরোটা কেউ রাজমা-চাউল খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম, মাথাও ঠান্ডা হল সবার। ড্রাইভারের ওপর মান্টামামা একটু চোটপাট করায় সে বলল, "চিন্তা করবেন না, আমার বাড়ি পাহেলগাঁওতেই, দেরি হলেও আপনাদের পৌঁছে দেব অন্য পথে।" তখনও বুঝিনি মোনাদার সিদ্ধান্তটাই শাপে বর হতে চলেছে আমাদের জন্য। ড্রাইভার ছেলেটা গাড়ি ঘোরাল হাইওয়ে থেকে, অন্য পথে চলল গাড়ি, রাস্তায় দু'পা অন্তর মিলিটারি। বার বার গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি, ড্রাইভার বলে বাড়ি, আমরা ওর বাড়ির লোক। আমাদের আগেই শিখিয়ে রেখেছিল বলবেন না অমরনাথ যাত্রী, আমরাও গলা থেকে যাত্রী কার্ড খুলে রেখেছিলাম। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা।
এভাবেই ঘন্টাছয়েকে পৌঁছে গেলাম পাহেলগাঁও, ঘড়িতে তখন বাজে দুপুর সাড়ে তিনটে। সোজা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। মৃণাল কলকাতা থেকে হোটেল বুক করে রেখেছিল,ওদের জন্য দুটো আর আমাদের একটা রুম। হোটেলের ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছিল আমায়,তাই সরাসরি যোগাযোগ করে নিতে অসুবিধে হয়নি। মৃণালরা অবশ্য কাল ঢুকবে। হোটেলে চেক-ইন করে ব্যাগ রুমে রেখেই বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের কোলে এসে কি হোটেলের ঘরে আটকে থাকা যায়, বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে। পাহাড়ি পথে কিছুটা নিচে নেমে লিডার নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চললাম ভুস্বর্গ-এর শোভা দেখতে দেখতে। চারিদিক সবুজ পাহাড়ে পাহাড়ে হাতে হাত ধরাধরি করে লিডার নদীকে ঘিরে রেখেছে,আর প্রশ্রয়-পাওয়া আদুরে চঞ্চল শিশুকন্যার মতো নদী এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে আপন খেয়ালে। আমাদের মনগুলো ফুরফুরে পালকের মতো খুশি খুশি হয়ে গেল,একনিমেষে বয়েস গেল কমে। মান্টামামা নাচতে শুরু করেছে, মামা আর আমি তা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম,নিজেদের হাসিগুলোও লিডার নদীর বয়ে চলা স্রোতের সঙ্গে তালমেলানো মনে হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে সন্ধে হয়ে এল, মামা ঘড়ি দেখে বলে উঠল, "চল এবার ফিরি,আটটা বাজে রে"। ফেরার পথে বেশ কয়েকজন মিলিটারির সঙ্গে দেখা, একটু কথা বলতেই বুঝতে পারলাম তাদের মধ্যে দুজন বাঙালি। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গল্প,ওঁদের থেকে জানতে চাইলাম অমরনাথ যাত্রার পরিস্থিতি। বললেন, "হয়তো ১১ জুলাই থেকে চালু হবে, কিন্তু পরিস্থিতি ভালো নয়, রাস্তা খুব খারাপ হয়ে গেছে বৃষ্টিতে। আপনারা আরও দুদিন পাহেলগাঁওতে থেকে যাত্রা শুরু করুন"। গল্পে গল্পে কখন ৯টা বেজে গেছে, শুভরাত্রি জানিয়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলাম হোটেলে। ফিরে রাতের খাবার খেয়ে গল্প করতে বেশ রাত হয়ে গেল।
১১ জুলাই সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম বৈসরণের পথে, পাহেলগাঁও থেকে ঘোড়ায় বা হেঁটে যাওয়া যায় ৬ কিলোমিটার। পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ চড়াই পথ, একপাশে গভীর খাদ। কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না, প্রকৃতির রূপ যেন ফেটে পড়ছে। দূরে কখনও বরফের চূড়া দেখা যায়, কখনও বা ঘন সবুজ পাহাড়ে আড়াল হয়ে যায়। নিচের দিকে তাকালে কখনও গভীর খাদ কখনও বা দূরে কিছু ঘরবাড়ির প্রেক্ষাপট, কখনও কখনও আবার তির তির করে বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী ঝরণা। ঘন্টা চারেকের মধ্যেই টুকটুক করে ফটো তুলতে তুলতে,গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই সাম্রাজ্যে। কচি কলাপাতারঙের সবুজ ঘাসের গালিচার মত বিশাল উপত্যকা এদিকে ওদিকে ঢেউ খেলে আছে, চারদিকে গাঢ় সবুজরঙা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। কী অপূর্ব মনোমুগ্ধকর শোভা, দেহ-মন জুড়িয়ে গেল। সত্যিই ভারতবর্ষে কী নেই, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, মরুভুমি, পাহাড়, পর্বত - পৃথিবীর এক সংক্ষিপ্ত রূপ যেন আমাদের দেশ। জঙ্গল আর পর্বতের আলোছায়ায় বৈসরণ উপত্যকায় বসে দূরে তাকিয়ে এই পরম সত্যকে অনুধাবন করলাম।
এবার একটা মজার ঘটনা বলি। সবুজ ঘাসে বসে বসে দেখলাম জিপলাইনিং হচ্ছে, দেখে খুব ইচ্ছে হল। মামাদের বলেও ফেললাম। মামারাও হৈ হৈ ক'রে বলে উঠল, "কর, কর।" এদিকে আসার সময় ক্যামেরা ছাড়া কিছুই আনিনি, না ব্যাগ না মানি ব্যাগ। জিজ্ঞাসা করে জানলাম সাড়ে তিনশো টাকা লাগবে। মামারা ওদের মানিব্যাগ খুলে দেখে ওরাও টাকা নিয়ে বেরোয়নি, দুজনের ব্যাগে খুব বেশি হলে চারশো টাকা আছে, আমি তো তাই দেখে কিছুতেই রাইডে যাবনা, মামারাও নাছোড়বান্দা, "মেয়ের একটা ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগ পেয়েছি, তোকে করতেই হবে"; এ আরেক আবদার, করতেই হল। মামাদের পকেট ফাঁকা করে দিয়েও কী যে মজা,কী যে তৃপ্তি; ছোট্টবেলার আনন্দের স্বাদ পেলাম যেন। তারপর এক বোতল জল আর দুটো চা-ও হয়ে গেল মামাদের পকেট রাজ্য থেকে, মান্টামামা চা খায় না ভাগ্যিস! চা পানের পর শর্টকার্ট পথে নেমে এলাম ঘন্টা আড়াই-এর মধ্যে,আজ বারো কিলোমিটার দিয়ে শুরু হল আমাদের ট্রেকিং পর্ব। ফেরার পথে পাহেলগাঁওতে এসে দেখি দুই ভদ্রমহিলা বাংলায় কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছেন, শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে আলাপ করলাম। কবে এসেছেন,কবে অমরনাথ যাত্রা করছেন জানতে চাওয়ায় অনেক উত্তরও পেয়ে গেলাম। ওঁরা আজই ফিরেছেন, দর্শন হয়নি বরফের শিবলিঙ্গ, দেখেছেন প্রকৃতির রূদ্ররূপ। মেঘভাঙা বৃষ্টির সময় সবে পৌঁছেছিলেন ওখানে, পরের দিন সকালে বাবা বরফিনাথ দর্শন করবেন, তাই পছন্দমতো তাঁবুতে ঢুকেছেন। হঠাৎই শুনতে পেলেন "ভাগো, ভাগো, সব ভাগো"; সেই শুনে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে দেখেন দূর থেকে জলস্রোত নেমে আসছে তাঁবুর দিকে, তিনজনে লাফ দিয়ে বেরিয়ে একটু দূরে সরে যেতে পেরেছিলেন, পেছন ফিরে দেখলেন চোখের নিমেষে ভেসে গেলো তাঁদের তাঁবু, যেখানে একটু আগেই ছিলেন। প্রাণভয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে থাকেন, শুধু ওঁরাই নয়, তখন ওখানে জনস্রোত, বাঁচার লড়াই, হয়তো তিনিই রক্ষা করেছেন, তারপর মাঝরাতে পৌঁছেছেন পঞ্চতরণী। সেখান থেকে আজ নামতে পেরেছেন পাহেলগাঁও, দুদিন পেটে কিছু পড়েনি,একটু আধটু জল ছাড়া। এগুলো বলছেন আর থরথর করে কাঁপছেন দুজনে, কেন জানিনা ওঁদের কাঁপুনি দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, বললাম, "শান্ত হন।´-"সাবধানে যাবেন, বড়ো খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি তো, ভয় হয়।" আরও বললেন, "একদিন দুদিন পরে যান, রাস্তার অবস্থা বড়ই খারাপ।"
হোটেলে ফিরতে তিনটে বেজে গেল, খিদেও পেয়েছে। পাশেই একটা বাঙালি হোটেল, ওখানে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে নিলাম। খবর নিলাম, মৃণালরা হোটেলে ঢুকেছে কিছুক্ষণ আগে। ওরা পাঁচ জন, তাই দুটো রুম নিয়েছে। ওর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হল, বেশ লাগল। ওদের বললাম, "তোমরা রেস্ট নাও, কাল তো যাত্রা শুরু, সেই নিয়ে কথা আছে।"
রাতে দূরের এক ভাণ্ডারাতে খেয়ে হোটেলে মৃণালদের রুমে ঢুকলাম। ওরা পাঁচজন,আমরা তিনজন এই আটজনের একটা গাড়ি ঠিক হল পরের দিন চন্দনওয়াড়ি যাওয়ার,ওখান থেকেই যাত্রা শুরু। সবাই সবার ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম ঠিক করে। মামা আর আমি পিট্টুকে বড়ো ব্যাগ দিয়ে দেব, ছোট ব্যাগে রেইনকোট, জ্যাকেট,এক্সট্রা মোজা আর ড্রাইফ্রুট, জল নিলাম। গাড়ি আসবে ভোর চারটের মধ্যে, সঙ্গেসঙ্গেই বেরিয়ে যেতে হবে।

১২ জুলাই, অ্যালার্ম দেওয়াই ছিল ভোর সাড়ে তিনটেয়। ঘুম ভেঙে গেছিল অবশ্য আগেই, একে একে ব্রাশ করে তিনজনে রেডি হয়ে নিলাম। পৌনে চারটে নাগাদ মৃণালের ফোন, দিদি গাড়ি এসে গেছে। ভোর চারটে বাজার পাঁচ মিনিট আগেই রুম থেকে বেরিয়ে নিচে এলাম, গাড়ি ছাড়ল সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল, অমরনাথযাত্রীদের গাড়ির লম্বা লাইন। ৮ জুলাই বন্ধ হয়ে গেছিল অমরনাথ যাত্রা, তখন থেকেই বহু যাত্রী আটকে পাহেলগাঁওতে, আজ তাঁদের অনেকেই যাত্রা শুরু করবেন। শেষ পর্যন্ত আমাদের গাড়ি চন্দনওয়াড়ি পৌঁছল যখন, তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে ছটা। গাড়ি থেকে নেমে সবাই একটা করে লাঠি কিনে অমরনাথ যাত্রার গেটে লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। মৃণাল মামাকে প্রণাম করল, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই মামাকে প্রণাম করে নিলাম।
গেট পেরিয়ে পিঠের বোঝা নিয়ে যাত্রা শুরু করার আগে একটু দাঁড়ালাম, চোখ বন্ধ আমার। ভেসে উঠল এক বীরসন্ন্যাসী গেরুয়াধারী, মাথা ন্যাড়া, হাতে লাঠি, খালি পায়ে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, স্বামীজীকেই স্মরণ করলাম,স্বামী বিবেকানন্দ অমরনাথের কঠিন দুর্গম রাস্তা খালি পায়েই পার হয়েছিলেন। জয় স্বামীজির জয়। মনে মনে তাঁকে ডাকছি, তোমার ইচ্ছে পূরণ হোক, তুমি নিয়ে গেলে তবেই পারব যেতে, তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম প্রভু। আমার আসল আমি জাগ্রত হোক। চোখ খুলতেই কেন যেন এক বাঁধভাঙা জল চোখে, সম্বিৎ ফিরে পেয়েই হাসতে হাসতে আপনমনে বললাম তোমার নাছোড়বান্দা সন্তান আমি, কিচ্ছু জানি না, হাত ধরে নিয়ে উঠলে তবেই উঠব।

~ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য ~


~ অমরনাথ-এর তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~

নৈহাটিতে, পরিবারের সঙ্গে গাছ, মাছ, পাখি ও কুকুর নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন নিবেদিতা কবিরাজ। প্রিয় একটি বুটিক আছে। প্রকৃতির টানে জঙ্গলের গভীরতায়, পাহাড়ের প্রাচুর্য আর উদারতার হাতছানিতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়েন এদিক সেদিক।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher