বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই কিন্তু এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - amaderchhuti@gmail.com
কলকাতার কাছেই
প্রত্যূষ সেনগুপ্ত
|| তথ্য - অম্বিকা-কালনা ~ ছবি - অম্বিকা-কালনা ||
ডিসেম্বরের ছুটির দিনের সকাল ৷ কুয়াশার চাদর সরিয়ে আকাশে ঝলমলিয়ে রোদ উঠতে না উঠতেই ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে ৷ হাওড়া থেকে ঠিক সকাল দশটার কাটোয়া লোকালে রওনা দিলাম ৮২ কিলোমিটার দূরের অম্বিকা কালনা ৷ ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে বর্ধমান জেলার মহকুমা সদর কালনা হয়তো খুব একটা পরিচিত দ্রষ্টব্য স্হান নয়, তবে এই শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে গড়ে ওঠা অজস্র টেরাকোটার মন্দির৷সেইসব মন্দিরের কারুকার্যের ছবি তোলার ইচ্ছেতেই আমার এই কালনা ভ্রমণ ৷
ট্রেন ব্যান্ডেল ছাড়ার পর কাটোয়া লাইনে ঢুকতেই আস্তে আস্তে চারিদিকের পরিবেশ বদলে যেতে শুরু করল ৷ জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় চারদিকে বিভিন্ন মরসুমি ফসলের সমারোহ ৷ ফলন্ত শাকসব্জির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যস্হলে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অচেনা জায়গা ঘুরে দেখার জন্য একটি সাইকেল-রিক্সা ঠিক করে মিনিট পনেরোর মধ্যে এসে পড়লাম মন্দির চত্বরে ৷ একই এলাকায় এখানে রাস্তার দুপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির৷
প্রথমেই একশো আট শিবমন্দির ৷ ১৮০৯ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর ৷ মন্দিরগুলি দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তাকার সারিতে বিন্যস্ত ৷ বাইরের সারিতে রয়েছে ৭৪ টি এবং ভেতরের সারিতে ৩৪ টি শিবলিঙ্গ ৷ দুটি বৃত্তের মাঝখানে সাজানো বাগান আর বাঁধানো রাস্তা পুরো জায়গাটিকে এক অদ্ভুত সুন্দর রূপ দিয়েছে ৷ বিভিন্ন কোণ থেকে এই বৃত্তাকার গঠনশৈলীর ছবি তুলতে তুলতে মোহিত হয়ে গেলাম ৷ ঠিক বিপরীতে বিশাল চত্বরে একের পর এক মন্দির। ঊনবিংশ শতকের রেখদেউলের আদলে গড়ে ওঠা প্রতাপেশ্বর মন্দিরের চার দেওয়াল জুড়ে জমকালো টেরাকোটার নিখুঁত শিল্প এককথায় অসাধারণ ৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি তোলার সময় লক্ষ্য করলাম সে যুগের শিল্পীরা মূলতঃ তাঁদের সমকালীন সমাজচিত্র এবং আরাধ্য দেবদেবীর মূ্র্তি এই শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ প্রতাপেশ্বর মন্দির থেকে একটু এগিয়ে রাসমঞ্চ। খোলাছাদের এই সুবিশাল মঞ্চটির লাগোয়া এই এলাকার প্রাচীনতম পঞ্চবিংশতিরত্ন (২৫ টি চূড়া সম্বলিত) লালজী মন্দির৷১৭৩৯ সালে তৈরী এই প্রাসাদোপম স্হাপত্যের সামনে প্রশস্ত চাতালে রয়েছে চারচালা নাটমন্ডপ এবং গুহাকৃতি গিরিগোবর্দ্ধন মন্দির ৷পঞ্চবিশতিরত্নের আরও একটি নিদর্শন কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির৷১৭৫১-৫৫ তে নির্মিত এই ত্রিখিলান (৩ টি দরজা বিশিষ্ট) দেউলের বারান্দায় টেরাকোটার কাজগুলি বিশালাকৃতি ফলকের উপর গড়া৷ লালজী ও কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দিরের মাঝে একই সারিতে পাঁচটি ভিন্ন আকারের শিবমন্দির নিয়ে পঞ্চরত্নশিব মন্দির৷
রিক্সা করে এগিয়ে চললাম আমলীতলা হয়ে ভাদুড়ীপাড়া ৷ আমলীতলায় প্রকান্ড তেঁতুলগাছের নীচে শ্রীচৈতন্যদেবের চরণযুগলের স্পষ্টচিহ্নকে ঘিরে একটি ছোট মন্দির রয়েছে৷ ভাদুড়ীপাড়ার পঞ্চবিশতিরত্ন গোপালজী মন্দির দেখে অবশেষে পৌঁছলাম অতিপ্রাচীন শ্রী শ্রী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরে। চোদ্দটি অর্ধচন্দ্রাকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গর্ভগৃহে বামাকালীর অধিষ্ঠান ৷ পুণ্যার্থীদের ভিড়ে এখানে জমজমাট পরিবেশ৷দেবীদর্শন করার পর ফেরার পালা ৷ তিনঘন্টার সফর শেষে বিকেল ৩ ৩০ এর ডাউন কাটোয়া লোকাল ধরতে আবার স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম ৷
এতদিন ভেবেছি টেরাকোটার উৎকর্ষে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের শিল্পকর্মের বুঝি কোনো জুড়ি নেই, কিন্তু আজ অবশ্যই বলতে পারি সৌন্দর্য্ ও সূক্ষতার মাপকাঠিতে অম্বিকা কালনা বিষ্ণুপুরের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণে থাকা এই মন্দিরগুলিকে সঠিকভাবে প্রচার ও পরিচিতির আলোয় আনতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে এই শহরটিও এক জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র রূপে আত্মপ্রকাশ করবে ৷৷
আই.বি.এম.-এ কর্মরত সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যূষ ভালোবাসেন বেড়াতে আর ক্যামেরায় ধরে রাখতে সেইসব মুহূর্তগুলো।
ছোট্ট ছুটির পুরী
জয়ব্রত মুখার্জি
|| তথ্য - পুরী ~ পুরীর আরো ছবি ||
সপ্তাহের মাঝে দু'দিন ছুটি পেয়ে আমবাঙালির চিরপ্রিয় পুরী যাওয়াই ঠিক করলাম। পুরীর এটাই মজা যে বারবার গেলেও কখনো পুরনো হয়না। পুরী এক্সপ্রেসে ভোরবেলায় পৌঁছে সোজা হোটেল ভিক্টোরিয়ায়।
জগন্নাথের মন্দিরের সঙ্গে কেমন একটা প্রাচীন শব্দ -গন্ধ জড়িয়ে আছে। শুধু ভিড় আর পাণ্ডাদের উৎপাতটাই খুব বিরক্তিকর। মন্দিরের ভেতরের ভাস্কর্যও অতুলনীয়। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতেই অনেক সময় লেগে গেল। শোনা যায়, সূর্যবংশীয় রাজা অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পেয়ে সমুদ্র থেকে পাওয়া কাঠ দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তিটি ও পরে মন্দিরটি তৈরি করান। মন্দিরের বেদিতে বলরাম, জগন্নাথ ও সুভদ্রার মূর্তির সঙ্গে রয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও নীলমাধবের মূর্তিও। তবে বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণকাজ অনেক পরে রাজা অনন্তবর্মন শুরু করলেও তাঁর পৌত্র রাজা অনঙ্গ ভীমদেবের আমলে শেষ হয়।
মন্দির থেকে ফিরে শুধু সমুদ্র। পুরীতে সমুদ্রের ধারেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। অনেকক্ষণ ধরে স্নানপর্ব সেরে হোটেলে খেয়ে এসে আবার সাগরে ফেরা। দুপুর-বিকেল কাটানো বালুকাবেলায়।
পরদিন একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে বেরোলাম। হোটেল থেকেই সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। আমাদের গন্তব্য ধৌলাগিরি, উদয়গিরি-খণ্ডগিরি আর কোণারক। ভুবনেশ্বর থেকে কোণারকের পথে পুরী রোডে ধৌলিচক থেকে ডানদিকে আরও কিছুটা দূরে ধৌলি বা ধৌলাগিরি। এখানেই ঐতিহাসিক কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়েছিল কলিঙ্গরাজ ও সম্রাট অশোকের মধ্যে।যুদ্ধজয়ের পর অসংখ্য মানুষের মৃত্যুতে অনুতপ্ত হয়ে অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। ধৌলিতে অশোক পাহাড়ের গায়ে খোদিত রয়েছে রাজা অশোকের কাহিনি।এখানে একটি শায়িত বুদ্ধমূর্তি আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ভূবনেশ্বর শহরের দৃশ্যও খুবই সুন্দর।
পূর্বঘাট পর্বতমালার এপারে খণ্ডগিরি, ওপারে উদয়গিরি। পাহাড় কুঁদে তৈরি হয়েছিল এই গুহাগুলি। উদয়গিরিকে বৌদ্ধদের গুহাও বলা হয়। উদয়গিরিতে মোট ৪৪টি গুহা আছে। গুহাগুলি দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাওয়া যাবে খণ্ডগিরিতে। খণ্ডগিরি জৈন তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। এখানে ১৯টি গুহা আছে। উদয়গিরি - খণ্ডগিরির অনেকগুলো গুহাতেই অপরূপ ভাস্কর্য মুগ্ধ করে। সবকটি গুহা দেখতে অনেক সময় লেগে যায়।আমরা ১৫০ টাকা দিয়ে একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। এতে বেশ সুবিধেই হয়েছিল।
দুপুরের খাওয়া সেরে পৌঁছালাম কোণারকে। ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নিঃসন্দেহে কোণারকের সূর্যমন্দির। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতেও রয়েছে এর নাম। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল আর কেইবা করেছিলেন তা নিয়ে নানান কাহিনি আছে। তবে রাজা নরসিংহদেব ১৩ শতকে বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ করেন।মোট ২৪টা চাকা এবং ১৪টি ঘোড়ার মূর্তি দিয়ে রথের আকারে তৈরি এই মন্দিরটি ভারতবর্ষের স্থাপত্য ও কারুশিল্পের একটি অনবদ্য নিদর্শন। মন্দির জুড়ে নর্তকী, নর-নারীর মিলন দৃশ্য, বাজনা-বাদক, যুদ্ধ – একের পর এক অপরূপ ভাস্কর্য বারবার দেখেও পুরোনো হয়না।
কোণারকের কাছেই চন্দ্রভাগা সৈকতে অপরূপ এক সূর্যাস্ত দেখে পুরীর হোটেলে ফিরে এলাম – রাতেই ঘরে ফেরার ট্রেন ধরা – ফিরে যাওয়া আবার রোজের ধরাবাঁধা রুটিন জীবনে।
ফটোগ্রাফিটাই জয়ব্রত-র নেশা, ভালোবাসেন বেড়াতেও। চাকরি আর দৈনন্দিন জীবন থেকে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন ক্যামেরা হাতে।