এক ভ্রমণে দুই দেশ
মঞ্জুশ্রী সিকদার
~ তথ্য - অস্ট্রেলিয়া || অস্ট্রেলিয়ার আরো ছবি ~
১৮ নভেম্বর
গতকাল রাতে অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছেছি। আমার সাত মহাদেশ পরিক্রমার লক্ষ্যপূরণে এটা ছ’নম্বর - বেশ উত্তেজনাই লাগছে।
আজকের সফরসূচী ব্রিসবেন ঘুরে গোল্ড কোস্টে পৌঁছানো। আমরা আটজনে একটা মিডিবাসে করে গাইড ডেলমা-র কথা শুনতে শুনতে আর জানলা দিয়ে নতুন দেশ - অচেনা শহর দেখতে দেখতে চলেছি। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় বন্দর শহর ব্রিসবেন, জনসংখ্যা ১৩ লক্ষ, এখান থেকে ম্যাগনেসাইটের মত মূল্যবান খনিজ পদার্থ রপ্তানি হয়, মধুর জন্য কালো মৌমাছির চাষ করা হয়...। চলতে চলতে কখন ক্যাঙারু পয়েন্টে পৌঁছে গেছি। আগে নাকি এখানে অনেক ক্যাঙারু ঘুরে বেড়াত। এখন শুধু নদীর ধারে অনেকটা ওপরে ভিউ পয়েন্ট।
বাস চলেছে পুরোনো ব্রিসবেনের গা দিয়ে। বাড়িঘর, কয়েদিদের থাকার জায়গা এইসব চোখে পড়ল। মহিলা কয়েদিদের আলাদা বাসস্থান ছিল। এই রাস্তাটার নাম স্ট্যানলি স্ট্রিট। স্টোরি ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছালাম পার্লামেন্ট ভবনে। সিডনি হারবার ব্রিজের নির্মাতা জন ব্যাডফিল্ডেরই হাতেই তৈরি এই ব্রিজ। সানকর্প স্টেডিয়ামটা বেশ বড়, অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার দর্শক বসতে পারবে। এখানে নিয়মিত রাগবি খেলা হয়।
বিয়াল্লিশ একর জমিতে তৈরি করা হয়েছে ট্রপিকাল পার্ক। এখানে জাকারান্ডা আর রবার গাছ চিনতে পারলাম। লাল রঙের একরকমের ফুল অনেক ফুটে রয়েছে গাছ আলো করে।
ব্রিসবেন শহর ছেড়ে চলেছি গোল্ড কোস্টের পথে। ড্রাইভার লু-ই এবার আমাদের পথপ্রদর্শক। সোনালি বেলাভূমি আর নীল সাগর নিয়ে ‘গোল্ড কোস্ট’। সাগরতীরের এই শহরটাতে সবাই আসে ছুটি কাটাতে। সমুদ্রের ধারে তাই সারি সারি বিশাল বিশাল হোটেল আর রেস্তোঁরা। বিকেলবেলায় পৌঁছেছি। হোটেলের চোদ্দ তলার ব্যালকনিতে বসে উপভোগ করছি প্রকৃতিকে। সামনে অসীম সমুদ্র আর মাথার ওপর অনন্ত আকাশ। প্রশান্ত সাগরের বড় বড় ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। সৈকতে ভ্রমণ আর অবগাহনে ব্যস্ত অজস্র মানুষ।
সন্ধ্যেবেলা আধঘন্টা হাঁটার পর পৌঁছালাম ডিনারের জায়গায়। বড়দিন এসে গেছে – রাস্তার গাছগুলো রঙিন কাগজে আর আলোর মালায় সেজে উঠেছে। সমুদ্রের মৃদুমন্দ বাতাসে আলো ঝলমলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল।
২০ নভেম্বর
গতকাল সারাদিনটা কেটে গেছে ড্রিমওয়ার্ল্ডের নানারকম মজাদার রাইডে ঘুরে ঘুরে। আজ ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পরলাম সি-ওয়ার্ল্ড দেখতে। এখানে বরফ দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেরু অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করে পেঙ্গুইনদের রাখা হয়। নার্সারিতে ছোট ছোট পেঙ্গুইনদের যত্ন করে খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্যও উপভোগ করার মতো। কবে আন্টার্টিকা যেতে পারব জানি না, তবে এখানে এসে পেঙ্গুইন দেখে দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়েও বেশ আনন্দ হল। পোলার বিয়ারও দেখলাম। এছাড়া ডলফিন, শীল আর হাঙরের নানারকম শো, থ্রি ডি শো এসব দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে দিনটা কেটে গেল।
ফিরে এসে বিকেল-সন্ধ্যেটায় সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটা, জলে পা ভেজানো, নীল-কমলা আকাশে সি-গালের উড়ে যাওয়া – সন্ধ্যে নেমে আসা... মনে থাকবে অনেকদিন।
২১ নভেম্বর
কেইর্নসের বিমান ধরলাম। বিমানবন্দরে নেমে দেখি আমাদের গাইড সুসান অপেক্ষা করছে। বাসে উঠে পড়লাম – যাব আদিবাসী গ্রাম দেখতে। জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার ফাঁকে সুসানের কথাগুলো কানে ভেসে আসছে। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক প্রথম কেইর্নস-এ আসেন। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। ট্যুরিজমই এখানকার প্রধান জীবিকা তবে চাষবাসেও এই অঞ্চল বেশ উন্নত। মূলত নানাধরণের ফল ও আখের চাষ হয়। মাছব্যবসাও রোজগারের আরেকটা বড় উপায়। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ব্যারন নদী।
বাস একজায়গায় থামলে আমরা নেমে পড়লাম। রেন ফরেস্টের মাথার ওপর দিয়ে কেবল কারে চলেছি। এর আগে আমাজনের রেনফরেস্ট ঘুরে এসেছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছিল। রোপওয়ে থেকে নামলাম জাপুকাইদের গ্রামে। এরাই এখানকার আদিবাসিন্দা। সেই প্রস্তর যুগ থেকে এদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের খুঁটিনাটি রয়েছে এখানকার মিউজিয়ামে। তবে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল যে এরা নাচ-গানের ভিতর দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে সুন্দর করে আমাদের সামনে তুলে ধরল। আর্ট গ্যালারি দেখে থিয়েটার হলে এলাম। এখানে স্থানীয় দুটি ছেলেমেয়ে কিছু অভিনয় করে দেখালো আর গাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি করা একটা ব্লো-পাইপে নানারকম আওয়াজ করে শোনাল। সবচেয়ে মজার লাগল মা ক্যাঙারুর পিছনে বাচ্চা ক্যাঙারু হাঁটছে সেই শব্দটা – দুটোই বেশ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল। এরপর মুক্তমঞ্চে আদিবাসী পোষাকে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা আদিম যুগে শিকার করা, কাঠে কাঠ ঘসে আগুন জ্বালানো এমন নানাকিছু আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরলো। খুবই আনন্দ পেলাম যখন আমাদের সবাইকেও মঞ্চে ডেকে একসঙ্গে নাচগান করা হল। এ যেন নিছক দর্শক হয়ে না থেকে ওদের সংস্কৃতির সঙ্গে সত্যিকারের মিশে যেতে পারলাম। এরপর একটা বিশাল সবুজ মাঠের মধ্যে আদিবাসী ছেলেরা আমাদের বুমেরাং ছোঁড়া দেখাল। আমরাও যে যার মত ছুঁড়ে দারুণ মজা পেলাম।
এখান থেকে বেরিয়ে বাসে কিছুদূর গিয়ে এবার রেলভ্রমণ। কুরান্ডা রেলে চড়ে জঙ্গল আর পাহাড়ের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলা। পথে পড়্ল ব্যারন নদীর ওপর ব্যারন ঝরনা এবং গর্জ। ব্যারন গর্জ ন্যাশনাল পার্ক ওয়ার্লড হেরিটেজ এরিয়া হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় চল্লিশ লক্ষ বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল ব্যারন নদী পরিবেষ্টিত এই অঞ্চল। ট্রেনের সব কম্পার্টমেন্টের দেওয়ালে ‘বুডাউজি’ নামে একটি সাপ কীভাবে গর্জটি খনন করেছিল সেই রূপকথা রেখায় রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
২২শে নভেম্বর
বাসে করে চলেছি জাহাজঘাটার দিকে। উদ্দেশ্য গ্রেট বেরিয়ার রিফ দেখা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রবাল প্রাচীর। সাড়ে নটায় জাহাজ ছাড়লো - নব্বই মিনিটের সফর। ৬০ কিলোমিটার চলার পর জাহাজটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। এখানে একটা বড় বোট দাঁড়িয়ে আছে - রিফ পন্টুন (Reef Pontoon)। আমাদের জাহাজটা ঐ বোটের গা ঘেঁসে দাঁড়ালো। তারপর জাহাজ থেকে বোটে যাওয়ার জন্য একটা পাটাতন পেতে দিল - বেশ স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করা যাচ্ছিল। দূরে দূরে বেশ কয়েকটি এরকম বোট দেখা যাচ্ছিল। গ্লাস বোটে করে চললাম কোরাল দেখতে। তারপর আবার সেমি সাবমেরিন ট্রিপ। এই ট্রিপটা খুবই ভাল লাগলো। আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপে গ্লাস বোটে করে কোরাল দেখেছি। কিন্তু সেমি-সাবমেরিন এই প্রথম। বোটের যে অংশটা জলের তলায় সেইখানে আমরা বসেছিলাম। ভিতরে বসে কাঁচের মধ্য দিয়ে নীল জলরাশি দেখতে দেখতে চলেছি - হঠাৎ দেখি পাহাড়ের উঁচু উঁচু মাথা - এটাই ত’ প্রবাল প্রাচীর। কত বিচিত্র আকারের, রঙবেরঙের দেওয়াল - লাল, নীল, হলদে, চক্র কাটা। প্রাচীরের গায়ের কাছে আবার ছোট বড় অসংখ্য রঙিন রঙিন মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। এই রীফটার আয়তন ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার। এটা ন্যাশনাল পার্ক হেরিটেজ সাইট ঘোষিত হয়েছে। এর আবিস্কর্তা ক্যাপ্টেন কুক। এই বোট থেকে আবার সবাই স্নর্কেলিং-এর জন্য সমুদ্রে নামছিল। জলে নামার পোষাকও নিচ্ছিল যাদের দরকার -লাইফ জ্যাকেট, চশমা - সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। আমিও সালোয়ার স্যুট পরে, চশমা পরে লাইফ জ্যাকেট সহ জলে নেমে পড়লাম। প্রশান্ত মহাসাগরের এই আকর্ষণ কি ছাড়া যায়। এরপর বোটেই ব্যুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা। এলাহি ব্যাপার। সমুদ্রস্নানের পর এত রকমারি খাবার - ভালই উপভোগ করলাম।
২৪ নভেম্বর
গতকাল রাতে মেলবোর্নে পৌঁছেছি। এখানে দেখলাম সরকারি ট্রাম ফ্রিতে সিটি ট্যুর করায়। সকালে নিজেরাই বেরিয়ে পড়লাম ট্রামে করে শহর ঘুরতে। নদীর নামে ট্রামের নাম ইয়ারা। প্রত্যেক স্টপেজে ট্রাম থামিয়ে সেখানকার বৃতান্ত শোনাচ্ছে। হারবার টাউনে নেমে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফেরার ট্রাম ধরলাম।
লাঞ্চের শেষে বাসে বেরিয়ে পড়লাম ফিলিপ আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। প্রথমে আমরা নামলাম চার্চিল আইল্যান্ড ভিজিটর সেন্টারে। এটা একটা পশুখামার। এত সুন্দর ভাবে পশুরা রয়েছে মনে হচ্ছে যেন এরা মুক্ত – হাঁস, মুরগী, ময়ূর কী সুন্দর চরে বেড়াচ্ছে। ল্যাভেন্ডারের বাগানও দেখলাম। এখান থেকে আমরা এলাম ফিলিপ আইল্যান্ডে। ১৯৯১ সালে এখানে বন্য কোয়ালা সংরক্ষণ সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। কোয়ালা অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশেষ পশু। এখানে অনেক ক্যাঙারুও দেখলাম আর দেখলাম প্রচুর পাখি। আশি রকম প্রজাতির পাখি এখানে আছে। এখানকার ক্যাঙারুগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট, এদের ওয়ালাবাই বলা হয়। তবে ফিলিপ আইল্যান্ডে সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য হল পেঙ্গুইন প্যারেড। জীবনে অনেক আশ্চর্যজনক জিনিস দেখেছি, সবকিছুকে হার মানায় এই প্যারেড। এরা ভোরবেলা বেরিয়ে যায় সাগরের উদ্দেশ্যে। কোথায় ভেসে বেড়ায় কে জানে! কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগে ফিরে আসে নিজেদের ডেরায়। এদের প্যারেড দেখার জন্য সমুদ্রের তীরে নির্দিষ্ট জায়গায় গ্যালারি করা আছে। আমরা সময়মত এসে সবাই মিলে সেখানে বসে পড়লাম। অপেক্ষায় আছি কখন দেখবো। তারপর হঠাৎ দেখলাম একঝাঁক পেঙ্গুইন তীরে এসে উঠলো - ক্রমশঃ ঝাঁকে ঝাঁকে পেঙ্গুইন এসে জড়ো হতে লাগল। ওমা! তারপর দেখি ওরা লাইন করে এগিয়ে আসছে ডাঙার দিকে। আমরা দেখছি হাজার পেঙ্গুইন লেফট্ রাইট্ করতে করতে ক্রমশ উপরে আসছে - ওদের যেখানে থাকার জায়গা সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে -শেষ আর হয় না...। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। মুগ্ধ বিস্ময়ে শুধু চেয়ে দেখা।
২৫ নভেম্বর
ব্যাগপত্র নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। মেলবোর্ন শহর দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব বিমানবন্দরে। আজকের গন্তব্য সিডনি। বাসে যেতে যেতে গাইডের কাছে জানতে পারলাম এখানকার লোকবসতি ৪০ লক্ষ। পনের বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। মেলবোর্নের সংস্কৃতির কেন্দ্র ফেডারেশন স্কোয়ার। হেরিটেজ পার্কে রয়েছে ক্যাপ্টেন কুকের কলেজ। ১৮৫০ সালে নির্মিত ক্যাথিড্রালটিও দেখার মত। শহিদদের স্মরণে রয়েছে স্রাইন অব রিমেমব্রেনস। শহরের মাঝে অবস্থিত ইউরেকা স্কাই ডেক-এর অষ্টাশিতলা ওপর থেকে পুরো মেলবোর্ন শহরটাকে ছবির মত লাগল। টাওয়ারটি অবশ্য বিরানব্বই তলা। এছাড়াও রয়েছে রয়েল বোটানিক গার্ডেন, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড এমন অনেক দ্রষ্টব্য। তবে এত কম সময়ে প্রায় কিছুই ভালো করে দেখা সম্ভব নয়।
২৬ নভেম্বর
ছবিতে দেখা সিডনি হারবার ব্রিজ ও সিডনি অপেরা হাউসের চেনা চেহারাটা দেখে খুব ভালো লাগল। পাহাড় কেটে তৈরি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে মনোরেল। পাহাড়ি এলাকা বলে বেশ উঁচুনীচু। রাস্তাঘাট বা অনেক জায়গাই বিভিন্ন ব্রিটিশ গভর্নরদের নামানুসারে। প্রধান রাস্তা জর্জ স্ট্রিট। পুরনো সিডনি পোর্ট অঞ্চল।
বিকেলে সমুদ্রের ধারে খানিকক্ষণ ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে আর্ট গ্যালারিতে এলাম। গ্যালারির পাশে হাইড পার্ক। এখান থেকে চলে গেলাম অপরূপ সুন্দর বন্দী সৈকতে। দেখি অনেক লোকজন নিশ্চিন্তে জলে নেমে মজা করছে, ওরই মধ্যে আবার সাইরেন বেজে উঠল – হাঙর আসছে – হুড়মুড়িয়ে সবাই তীরে উঠে পড়তে লাগল – লাইফ বোটগুলোও বেশ সজাগ। ওখান থেকে হাডসন বে ঘুরে চলে এলাম বিখ্যাত অপেরা হাউস দেখতে। এই বাড়িটার ছাদ এমনভাবে তৈরি যে সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টির জলে আপনা থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। মেন হল দুটো – একটায় পনেরশো লোক ধরে আর একটায় ছাব্বিশশো। এই হলদুটোতে কনসার্ট আর অপেরা হয়। ছোট ছোট আরও কয়েকটা হল আছে। সবশেষে ডারলিং হারবারে এসে জাহাজে উঠলাম। সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে নৈশাহার সেরে নেওয়া।
২৭ নভেম্বর
চলেছি ব্লু-মাউন্টেনের পথে। ব্লু-মাউন্টেনের এরিয়া বেলজিয়ামের অর্দ্ধেক - ঠিকমত ঘুরতে চাইলে অন্ততঃ সাত দিন সময় লাগবে পুরোটা দেখতে। এটা জাতীয় উদ্যান। চারদিকে ইউক্যালিপ্টাসের সমারোহ। সাতশোর বেশি প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস আছে এখানে। ইউক্যালিপ্টাসের তেল যখন বাতাসে ভাসে তখন সূর্যের আলোয় নীল দেখায় - তাই এর নাম ব্লু-মাউন্টেন। এর উচ্চতা ২০০ মিটার -এটা স্যান্ড স্টোন এবং লাইম স্টোনের পাহাড়। এখানে ইউরেনিয়াম জাতীয় খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ -দু-মুখো রাস্তা -অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে -অনেক গাড়ি সবই চলেছে ব্লু মাউন্টেনের পথে। রাস্তার দুপাশে মাটিতে শুধুই হলদে ফুলের ঝোপ। রাস্তা এত চওড়া যে পাহাড়ে উঠছি বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে পাহাড়ের কাটা অংশ দেখে ঠাওর হচ্ছে। ১০১৭ মিটার ওঠার পর দেখি লেখা আছে কাটুমবা - জায়গাটার নাম। এখানে নেমে পাহাড়ি রাস্তায় ঝোপের মধ্যে দিয়ে সবাই হাঁটতে লাগলাম। পথে একটা ঝরনা পড়ল - এরও নাম কাটুমবা। আগে পাহাড়ের ওপর কয়লা খনি ছিল। এখনও সবই সাজানো রয়েছে - ছোট রেলপথ, তার ওপর কয়লাশুদ্ধ গাড়ি - গুহার মধ্যে সুড়ঙ্গপথে আলোর রেখায় দেখলাম খনিতে কর্মরত মানুষের মূর্তি - যেতে যেতে চোখে পড়ল দাবানলে পুড়ে যাওয়া সারিসারি কালো কালো পোড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। এখানে স্কাইরেল চড়ে পাহাড়ের মাথায় খানিকটা ঘুরলাম। নেমে আবার জিগ্জাগ্ রাস্তা ধরে পাহাড়ি জঙ্গলে হাঁটা। দেখলাম ইকো পয়েন্ট আর থ্রি সিস্টারস্ রক।
এই তিন বোনকে নিয়ে একটা রূপকথার গল্প প্রচলিত আছে। আদিবাসী তিন বোন - মিনহি, বিমলা, গুনেডু তাদের বাবার সঙ্গে এই পাহাড়ে থাকতো। বাবা একজন উইচ ডাক্তার (ওঝা)। নাম তায়াওয়ান। আর পাহাড়েরই গভীর এক গুহায় থাকতো একটা রাক্ষস। নাম বুনউইপ। বাবা প্রতিদিন মেয়েদের নিয়ে বেরোতেন। গভীর গর্তের কাছে আসার আগে তিন মেয়েকে পাহাড়ের পাথরের দেয়ালের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে কাজে চলে যেতেন। একদিন বাবা চলে যাচ্ছেন ঠিক এমন সময় মেয়েরা তাদের সামনে একটা বিষাক্ত বিছে দেখতে পেল। মিনহি ভয় পেয়ে একটা পাথর দিয়ে বিছেটাকে মারতেই পাথরটা পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে ভ্যালিতে আছড়ে পড়লো। সেই মুহূর্তে যত পশু পাখি ছিল সব দাঁড়িয়ে গেল - আর সঙ্গে সঙ্গে তিনবোনের পিছনে যে পাথরের দেওয়াল ছিল সেটা খুলে পড়ে গেল। রাক্ষসটা ভীত সন্ত্রস্ত ওই তিন বোনের দিকে এগোতে লাগল - নীচের ভ্যালিতে ওদের বাবা যখন দেখলেন রাক্ষসটা এগিয়ে যাচ্ছে ওদের একেবারে কাছে তখন তিনি তার যাদুদণ্ডটি (magic bone) মেয়েদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন আর তখনই তিনবোন পাথর হয়ে গেল। এদিকে মেয়েদের ধরতে না পেরে রাক্ষসটা বাবার দিকে তেড়ে গেল - বাবা যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি রাক্ষসের জালে আটকে গেছেন তখন তিনি নিজেকে একটি পাখিতে (Lyre) রূপান্তরিত করে ফেললেন এবং রাক্ষসের কবল থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর ম্যাজিক বোনটা গেল হারিয়ে। বুনউইপ) চলে যাওয়ার পর তায়াওয়ান ম্যাজিক বোনটা খুঁজতে লাগলেন। আজও তিনি তাঁর যাদুদণ্ডটা খুঁজে চলেছেন - মেয়েরাও আশায় আছে বাবা তাঁর দণ্ডটা পেলেই তারা আবার মানুষ হতে পারবে। আজও বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় লিয়র পাখিটি তার মেয়েদের ডেকে ডেকে বলছেন যাদুদণ্ডের খোঁজ তিনি করেই চলেছেন...।
[আগামী সংখ্যায় নিউজিল্যান্ড পর্ব]
~ তথ্য - অস্ট্রেলিয়া || অস্ট্রেলিয়ার আরো ছবি ~
ভারত সরকারের মহাগাণনিক দপ্তর থেকে অবসর নেওয়া মঞ্জুশ্রীর পায়ের তলায় সর্ষে। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসেন এদেশ-ওদেশ। ছয় মহাদেশের মাটিতে পা রাখার পর এখন তাঁর স্বপ্ন আন্টার্টিকা ভ্রমণ।