এক ভ্রমণে দুই দেশ
মঞ্জুশ্রী সিকদার
~ তথ্য - নিউজিল্যান্ড || নিউজিল্যান্ডের আরো ছবি ~
[ গত সংখ্যায় অস্ট্রেলিয়া-র পর ]
২৮ নভেম্বর
এবার নিউজিল্যান্ড। ২৮ তারিখ সকালে বিমানে অকল্যান্ড পৌঁছেছি। ইমিগ্রেশনের বিস্তর ঝামেলা পেরিয়ে গাড়ি করে পাড়ি দিলাম হ্যামিলটন শহরের পথে। সাজানোগোছানো শহর পেরিয়ে বিশাল চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে -দুপাশে উঁচু-নীচু টিলা -আগ্নেয়গিরির লাভা জমে তৈরি হয়েছে এই সব অঞ্চল -এখন সবুজে সবুজ -গরু, ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। গাড়ি দাঁড়ালো ওয়াইটোমো গ্লোওয়ার্ম কেভের (Waitomo Glowworm Cave) সামনে -এই গুহাটা দেখার অনুভূতি ভাষায় বোঝানো যাবে না। অন্ধকার গুহার মধ্যে বোট রাইডিং -ওপরে আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে অজস্র জোনাকি। এই গুহাটি বহুদিন পর্যন্ত অনাবিস্কৃত ছিল – স্থানীয় মাওরিরা এই কেভকে সর্বসমক্ষে আনতে চায় নি। ১৮৮৭ সালে মাওরি চিফ তানে তিনোরাউ একজন ইংরেজ জমি পর্যবেক্ষক ফ্রেড মার্ককে সঙ্গে নিয়ে এই কেভটি আবিস্কার করতে যায়। এই গুহায় ঢোকার একটাই রাস্তা এবং সেটা ওয়াইটোমো নদী দিয়ে। গাছের কাণ্ড দিয়ে ভেলা বানিয়ে তাতে চড়ে তারা গুহায় প্রবেশ করার চেষ্টা করে। অন্ধকার গুহায় ঢোকার পর একসময় হাতের মোমবাতিটাও নিভে গিয়েছিল – আর তখনই তারা দেখতে পেয়েছিল গুহার ভিতর পাহাড়ের গা অজস্র জোনাকির আলোয় রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আলো-আঁধারিতে তাদের চোখে পড়েছিল পাহাড়ের গায়ে অনেক লাইম স্টোনের ফরমেশন রয়েছে। ১৮৮৯ সালে পর্যটকদের জন্য গুহাটি খুলে দেওয়া হয়। এই গুহায় এখন যাঁরা কাজ করেন তারা তানে তিনোরাউ-এর পরবর্তী প্রজন্ম।
গুহা দেখা শেষ করে আমরা আবার বাসে করে চলেছি রোটরুয়ার পথে। যতদূর দৃষ্টি যায় কী অপূর্ব শোভা। পুরো নিউজিল্যান্ডটাই উঁচু নীচু সবুজ মাঠ আর খ্রীষ্টমাস ট্রি দিয়ে সাজানো। তাছাড়া আরও কত সুন্দর বড় বড় গাছ -মাঝে মাঝে ছোট একটা বাড়ি। মাওরি ভিলেজ দেখলাম - কাঠের শিল্পকলা দেখার মত - আলাস্কার টোটেম পোলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। রোটরুয়াতে অ্যাগ্রোডোম দেখলাম। ভেড়ার শরীর থেকে সমস্ত লোম কি ভাবে চেঁচে নেয় তা স্বচক্ষে দেখতে পেলাম। ভেড়াদের খেলাও দেখলাম। বেশ খানিকক্ষণের ধৈর্যের পুরস্কার হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত কিউই পাখির দর্শনও মিলল। এরা সব সময় ঝোপের আড়ালে থাকে। গাইড নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। খুবই অল্প সময়ের জন্য আমরা তার দেখা পেলাম। কিউয়ি জুতো পালিশ এখানেই তৈরি হয়। এরপর এলাম ফুটন্ত কাদা বা মাড ভলকানো দেখতে। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না কতটা জায়গা জুড়ে কাদা ফুটছে। আর কিছু কিছু জায়গায় জল ফুটছে -জল দেখা যাচ্ছে না - শুধুই ধোঁয়া। প্রকৃতির লীলা যে কত কে জানে!
৩০ নভেম্বর
অন্তর্দেশীয় বিমানে বিকেলবেলা এসে পৌঁছলাম কুইন্স্ টাউন-এ। এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, ট্যুর গাইড ডারমট। গাড়ি করে হোটেলে যাচ্ছি - সাবার্ব এরিয়া দিয়ে গাড়ি চলছে - রাস্তার পাশে লেক - নীল জল -অন্যদিকে পাহাড় - পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট বাড়ি - ছবির মত সাজানো - কুইন্স্ টাউন - সত্যিই রানির মত।
১ ডিসেম্বর
সকাল ছ’টায় বেরিয়ে পড়লাম মিলফোর্ড সাউন্ডের উদ্দেশ্যে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। বাস ছাড়ার অল্প পরেই একটা বড় হ্রদের ধার দিয়ে চলতে শুরু করলো - এটা নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘতম হ্রদ -বিরাশি কিলোমিটার দীর্ঘ -নাম ওয়ানাকা। এখানে প্রচুর বড় বড় হ্রদ আছে। সবই পাহাড়ের বরফ গলা জল থেকে সৃষ্ট। এখানকার পাহাড়গুলো খুব বেশি উঁচু নয় - উচ্চতা যেমনই হোক পৃথিবীর কঠিনতম গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি আর বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। ড্রাইভারের কথা অনুযায়ী চোদ্দ-পনেরো হাজার বছর আগে শেষ তুষার আবহে বিশাল বিশাল হিমবাহের চাপে এই অঞ্চলের হ্রদ্গুলো তৈরি হয়েছে - সৃষ্টি হয়েছে উপত্যকা আর প্রান্তরের। হ্রদ, নদী, বন, পাহাড়, প্রান্তর আর নির্জনতা সব মিলিয়ে এ যেন সৌন্দর্যের এক সোনার খনি। ‘তে আনাউ’ শহরে একটা লেকের ধারে গাড়ি থামলো। এখানে আমরা ব্রেকফাস্ট করলাম। রাস্তার ধারে টেবিল-চেয়ারে বসে জলখাবার খাওয়া -সামনে লেকের জল - কী অপূর্ব অনুভূতি।
আবার চলা শুরু। যেতে যেতে দেখছি ন্যাশনাল পার্ক - লম্বা লম্বা পীচ গাছের সারি - সবুজে সবুজ। মসৃণ চওড়া রাস্তা - গাড়ি চলেছে দুরন্ত গতিতে। হঠাৎ দেখি কাশের গুচ্ছ - চেনা ছবি কী ভাল যে লাগলো কী বলবো! আবার উইন্ড স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে বরফাবৃত পাহাড় – বড় বড় গাছগুলো দূরে সরে গেছে - দুপাশে সবুজ ঘাসজমি - তৃণভোজীদের বিচরণ ক্ষেত্র। কোথাও দেখছি পাহাড়ের মাথায় বরফ - আবার কোথাও হিমবাহ। পৌঁছালাম মিরর লেক। খাড়া পাহাড়ের গায়ে পুকুরের মতো ছোট নিস্তরঙ্গ হ্রদ। জলে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা যায়। এখানকার জঙ্গলে কোন বাঁদর নেই, বন্য কুকুর, সাপ কিছুই নেই - রাতের বেলা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো যায়। আর তাই বোধহয় এখানে এত ভেড়া হরিণের চাষ হয়। ভেড়াদের এমনি কোন নির্দিষ্ট আস্তানা নেই - মাঠে মাঠেই জীবন কেটে যায়। গ্রীষ্মে ওদের লোম সব চেঁচে ফেলা হয় - শীতে আবার বেড়ে যায় - প্রকৃতি সব ব্যবস্থাই ঠিকঠাক করে রেখেছে। চলেছি পীচের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে - এই ধরনের জঙ্গল দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে দেখতে পাওয়া যায়। এবার পাহাড়ের মাথার ওপর থেকে নামছি - চলেছি ইষ্ট-কোষ্ট থেকে ওয়েষ্ট-কোষ্ট-এ। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় - তাই সৃষ্টি হয়েছে গভীর রেন ফরেস্টের - এত গভীর আর ঘন যে বহু প্লেন নিখোঁজ হয়ে গেছে। প্রথম প্লেনটি হারিয়ে যায় ১৯৩০ সালে। ১৯৬০ সালে তিনজন যাত্রীসহ আর একটি বিমান হারিয়ে যায় - বছর তিনেক পরে আরও একটি - এইভাবে আজপর্যন্ত তিরিশটা বিমানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকটা চলার পর গাড়ি থামালো একটা প্রপাতের সামনে - নাম ক্রীক। আবার চলা - এখানে দেখছি শুধুই গ্লেসিয়ার ভ্যালি - গ্লেসিয়ার আগেও অনেক দেখেছি -কিন্তু এ এক অন্যরকম সৌন্দর্য। এবার গাড়ি একটা টানেলে প্রবেশ করলো - হোমার টানেল। রাস্তাটার নাম মিলফোর্ড রোড। মিলফোর্ড সাউন্ডে যাওয়ার জন্য আগে কোন রাস্তা ছিল না। ১৯৩০ সালে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকে। আবার ১৯৩৫ সালে হোমার টানেলের কাজ শুরু হয়। কিন্তু নানারকম ঝড় ঝঞ্জা -অ্যাভালাঞ্চ গড়িয়ে পড়া, জলের স্রোত, নুড়ি পাথর তুষারপাত ইত্যাদি কারণে এই টানেল শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালে সম্পন্ন হয় এবং ১৯৫৪ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। টানেল পার হয়ে শুরু হ’ল নীচের দিকে নামা -এতক্ষণ আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে ছিলাম।
পাহাড়ের এই রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের কোলে গিয়ে মিশেছে। বাস থেকে নেমে প্রথমেই আমরা চললাম গর্জ দেখতে। এখানে আমরা একটা পাখি দেখতে পেলাম - কিয়া। টিয়া জাতীয় পাখি - খুব চালাক। একমাত্র সাদার্ন নিউজিল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। বনপথে অনেকটা হেঁটে তারপর একটু সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে এলাম গর্জ দেখতে - বেশ ভালই লাগলো এই গর্জটা দেখতে - একটু অন্যরকম। এরপর আমরা এলাম সমুদ্রের ধারে - দেখবো মিলফোর্ড সাউন্ড - সাউন্ড মানে ফিওর্ড। দুপাশে খাড়া পাহাড়ের গলি দিয়ে সমুদ্র দেশের ভূখণ্ডের ভেতর ঢুকে গেলে তাকে ফিওর্ড বলা হয়। নিউজিল্যান্ডের এই অঞ্চলে বহু ফিওর্ড আছে, সেইজন্য এই অঞ্চলকে ফিওর্ডল্যান্ডও বলা হয়। মিলফোর্ড ফিওর্ড দেখার জন্য আমরা ক্যাটাম্যারান-এ চড়লাম। পাহাড়ের ধার দিয়ে যেতে যেতে ঝরনা দেখলাম। ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঝরনার জল যাওয়ার দাপটে সবাইকে ভিজিয়ে দিল। যেতে যেতে পাথরের ওপর বিশ্রামরত শীল মাছ চোখে পড়ল। লঞ্চের ভেতরে বসে আমরা লাঞ্চ করলাম - এলাহি বন্দোবস্ত। তাসমান সি-এর ওপর দিয়ে ফিওর্ডের গা ঘেঁসে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুরে ফিরে এলাম নিজেদের গাড়িতে। ফিরব কুইন্স্ টাউনে।
২ ডিসেম্বর
কুইন্স্ টাউন হোটেল ছাড়লাম সকাল সাতটায়। চলেছি ফ্রান্স জোসেফের উদ্দেশ্যে। নিসর্গশোভা বর্ণনাতীত। তিনটে পাহাড়ের চূড়া একসঙ্গে ঠিক যেন রানির মুকুটের মত দেখাচ্ছে -এর নাম ক্রাউন রেঞ্জ। নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ পর্বত হল মাউন্ট কুক - উচ্চতা ৩৭৫৪মিটার। যদিও উচ্চতা বেশি নয় - কিন্তু এখানে হঠাৎই আবহাওয়ার ভীষণভাবে পরিবর্তন হয় - যার ফলে অভিযাত্রীদের মৃত্যুও হয়। নিউজিল্যান্ডে একদিনে নানা ঋতু অনুভব করা যায় -এই ঠান্ডা, এই গরম, আবার এই বৃষ্টি -এইজন্য ছাতা, গরম জামাকাপড় সবই সবসময় সঙ্গে রাখতে হয়। পাহাড়ের এক জায়গায় লেখা আছে - "Here at this altitude you are close to heaven and you can speak to God."
বেলা ৯টার সময় সাবওয়ে কাফেতে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হল। আবার চলা শুরু। এরপর নামলাম ওয়ানাকাতে - এখানে পাজ্ল্ ওয়ার্ল্ড দেখলাম - উল্টোপাল্টা ঘরবাড়ি -কোনটা হেলে আছে, কোনটা অর্দ্ধেক - আবার এমন একটা জায়গা যেখানে ঢুকলে গোলকধাঁধার মত রাস্তা হারিয়ে যায়, বেরনোই মুস্কিল -এইসব বাচ্চাদের মত একটু উপভোগ করলাম। আবার বাসে চলা শুরু। পথে একটা নদী পড়লো নাম ক্লুথা। হাওয়া নামে একটা গ্রাম পেরোলাম - এখানে লেকের জলে স্যামন এবং ট্রাউট দুটো মাছের সংমিশ্রণ করে চাষ করা হয় দেখলাম। চলতে চলতে ওয়ানাকা লেক পড়লো। এখন ইষ্ট-কোষ্ট থেকে ওয়েষ্ট-কোষ্ট যাচ্ছি। আবার একটা গ্রাম পড়লো নাম - মাকারোরা। দেখলাম ঝুরো পাহাড়। জার্মান আবিস্কারক হাস্ট আবিস্কৃত রাস্তা তাঁর নামানুসারে হয়েছে হাস্ট পাস। আগে কুইন্স্ টাউনে যেতে দুদিন লাগতো -এই রাস্তা আবিস্কারের ফলে মাত্র দু'ঘন্টা লাগে। আমরা চলেছি রেন ফরেষ্টের মধ্য দিয়ে - কোন কোন গাছ তিনশ-চারশ বছরের পুরোনো। একদিকে জঙ্গল আর একদিকে সমুদ্র -তাসমান সি -সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাসে গাছগুলো একদিকে হেলে আছে। ১৫০০ সালে পোর্তুগীজরা এসেছিল। ক্যাপ্টেন কুক তার লোকজন নিয়ে নিউজিল্যান্ড আবিস্কার করতে এসেছিলেন। প্রথমে তার লোকজন ডাঙায় নামে, কিন্তু তারা আর ফেরে না। মাওরি যোদ্ধারা তাদের মেরে ফেলে মাংসও খেয়ে ফেলে। কুক বুঝতে পেরে অন্য আইল্যান্ডে আশ্রয় নেন কিন্তু সেখানে মাওরিরা তাঁকেও সম্ভবত মেরে ফেলে - কারণ শেষ পর্যন্ত কুকের কোন কিছুই জানা যায়নি। তাসমান সমুদ্রে মাঝে মাঝে পাথরের চূড়া রয়েছে। একপাশে পাহাড়, পাহাড়ের কোলে সমুদ্রের জল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে শীল মাছ। সবমিলিয়ে যেন একটা ছবি।
লাঞ্চ ব্রেকের জন্য একটায় গাড়ি থামলো। স্যামন ফার্মে বসে খাওয়া হল। এখানে নদী থেকে মাওরিরা জেড্ পাথর সংগ্রহ করে। এখন যে পথে চলেছি এর দুপাশে ঘন জঙ্গল - বহু বছর আগে এটা ছিল ডায়নোসরের আস্তানা। একটা গাছের নাম টোটোরা। এই গাছ বহু পুরোনো এবং সব চেয়ে বড়। চলেছি সাগরের ধার দিয়ে - তীরে বড় বড় গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে - সাগরের জল বেড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাগরতো কিছুই নেয় না, ফিরিয়ে দেয়। তাই গাছগুলো পড়ে আছে সাগরের তীরে। পবিত্র টিয়া গাছ দেখলাম - এই গাছের কাঠ দিয়ে মাওরিদের দাহ করা হয়। ফক্স্ গ্লেসিয়ারে যাওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড়ালো। যারা ট্রেকিং করবে তারা যথাযথ পোষাক পরে ওখানকার গাইডের সঙ্গে রওনা দিল। অনেক সময় লাগবে। আমরা তিনজন যাইনি ট্রেকিং করতে। আমাদের গাইড ডরম্যাট আমাদের গাড়ি করে নিয়ে এল জঙ্গল ঘোরাতে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পায়ে হেঁটে জঙ্গল ঘুরতে চললাম। একটা নদীর ওপর ব্রীজ। সেই ব্রীজ পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম - গভীর জঙ্গল - কতরকমের গাছ -সূর্যের আলো খুব বেশি ঢুকতে পারে না। এই জঙ্গলটার নাম ওয়েস্টল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক। এখানে একটা গাছ দেখলাম খানিকটা আমাদের দেশের ঢেঁকি শাকের মত কিন্তু লম্বায় বেশ বড় - মাথাটা গোল করে পেঁচানো - আর চিত্রবিচিত্র করা – নাম কোরু (Koru) - এটা নিউজিল্যান্ডের বিমানের পিছনের সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৮৩৫ সালে গ্লেসিয়ার যেখানে ছিল সেই জায়গাটা দেখলাম - সেখান থেকে গ্লেসিয়ার অনেক সরে গেছে। ১৮৯৫ সালে যেখানে পিছিয়ে গেছে সেখানে হেঁটে যেতে ২ ঘন্টা সময় লাগে। ট্রেকিং করে সহযাত্রীরা ফিরে আসার পর সবাই চললাম রাতের আস্তানায় - হোটেল বেলা ভিস্টা, ফ্রান্স জোসেফ গ্লেসিয়ার।
৩রা ডিসেম্বর
ভোরবেলা হোটেলের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ভোরের রবিকিরণে ঝলমল করছে ফ্রান্স জোসেফ গ্লেসিয়ার - দেখে মনে হচ্ছে এত কাছে যেন এক ছুটেই পৌঁছে যাব। বেলা বাড়লেই মেঘে ঢেকে যাবে বরফ তাই সবার দরজায় নক করে ডেকে তুললাম এই দৃশ্য দেখার জন্য। ভাল জিনিস সবাই মিলে উপভোগ করলে বেশি ভাল লাগে।
সকাল ৯-৩০য় তল্পিতল্পাসহ উঠে পড়লাম গাড়িতে - যাব গ্রে-মাউথে। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা চলার পর আমরা গ্রে-মাউথ ষ্টেশনে এসে পৌঁছলাম। ওয়েষ্ট কোষ্টে গ্রে-মাউথই সবচেয়ে বড় টাউন। গ্রে-মাউথ ষ্টেশন থেকে ট্রাঞ্জ আলপাইন বা ট্রাঞ্জ সিনিক ট্রেনে চড়ে আমরা ক্রাইস্ট চার্চ শহরে পৌঁছব। চার ঘন্টা ধরে এই সফর শুধু প্রকৃতিকে দেখার জন্য - পাহাড় কেটে কেটে তৈরি হয়েছে রেলপথ -Tranz Alpine is one of the top six rail journeys in the World। আমাদের ড্রাইভার মালপত্রসহ গাড়ি নিয়ে ক্রাইস্ট চার্চ স্টেশনে অপেক্ষা করবে। দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়েই গাড়িতে উঠেছিলাম। খেতে খেতে বাইরের শোভা দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম। মাঝে ট্রেন বিশেষ বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ছে আর সবাই নেমে দেখছে, ছবি তুলছে। এইভাবে চারঘন্টা চলার পর বিকেল ৬-০৫ এসে পৌঁছলাম ক্রাইস্ট চার্চ শহরে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি চারটি জাহাজে চেপে ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা এখানে আসে। তাদের এখানে আসার বছর পাঁচেক পরে নিউজিল্যান্ডের প্রথম শহর হিসেবে ক্রাইস্ট চার্চের পত্তন ঘটে। স্টেশনে পৌঁছে ড্রাইভার আমাদের বাসে করে সোজা নিয়ে এল শহর ঘোরাতে। প্রথমে বাইরে থেকে ক্যাথিড্রাল দেখলাম। আর্ট গ্যালারীও দেখতে হল বাইরে থেকে। এরপর সোজা চলে এলাম বটানিক্যাল গার্ডেনে। গার্ডেনে ঢোকার মুখে একটা প্রাসাদের মতো বড় বাড়িতে এই শহরের মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের অনেকটা অংশ জুড়ে মাওরিদের জীবনধারা ও পুরোনো সংস্কৃতির পরিচয় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মিউজিয়ামের পর এলাম বাগানে। দেড় হাজার বিঘে জমি নিয়ে এই বাগান। সব ঘুরে দেখা সম্ভব নয় - নানারকম গাছ দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম গোলাপ বাগানে। অনেক জায়গায় গোলাপ বাগান দেখেছি। কিন্তু এ যেন কেমন অন্যরকম। ফেরার পথে মাত্র আট দশ হাত চওড়া নদী দেখলাম - নাম আইভন। ২০১১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী বিশাল ভূমিকম্পের ফলে ক্রাইষ্ট চার্চ শহর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরের একটা দিকে একবারে প্রবেশ নিষেধ - একদম ঘিরে রাখা রয়েছে। তাই আর বিশেষ কিছুই দেখা হয় নি। এরপর আমরা চলে এলাম সুদিমা এয়ারপোর্ট হোটেলে।
৪ ডিসেম্বর
কুইন্স্ টাউনে বেলুন রাইড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঝোড়ো বাতাসের কারণে সেটা বাতিল হয়ে যায়। আমাদের গাইড বলেছিল চেষ্টা করবে যাতে ক্রাইস্ট চার্চে বেলুন রাইড করাতে পারে। ৩ রা রাতে গাইড জানিয়ে দিল আমরা যেন ৪ তারিখ ভোর চারটের সময় প্রস্তুত থাকি। বেলুন চড়া হবে। ভোর ৪-২৫ মিনিটে গাড়ি এসে আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিল। আরও কয়েকটি হোটেল থেকেও যাত্রী তুললো। মোট কুড়ি জন চলেছি বেলুন রাইড করতে। মাঝপথে গাড়িতে আর একজন পাইলট উঠলো। আর আমাদের গাড়ির সঙ্গে আর একটা গাড়িকে জুড়ে দেওয়া হল। এই গাড়িটার মধ্যে বেলুনের সব সরঞ্জাম ছিল। এরপর একটা বিশাল ক্ষেতের মাঝখানে গাড়িটা থামলো। আমরাও নামলাম। একটা বিশাল বেতের বাসকেট, কাঁধ সমান উঁচু - নামানো হল। তারপর একটা মস্তবড় গোল বালিশের মত প্যারাশুটের তৈরি জিনিস নামানো হল। তাছাড়াও গ্যাস সিলিন্ডার, ওভেন, পাখা ইত্যাদি নামানো হল। আমাদের কুড়িজনকে সমান দুটো দলে ভাগ করে দুদিকে দাঁড় করানো হল। এবার বালিশটার দড়ি খুলে বের করা হল বেলুন। দু'দল দুদিকে টানতে টানতে প্রথমে চওড়া দিকটা খোলা হল - তারপর আবার নির্দিষ্টভাবে লম্বার দিকে টানা হল। এরপর দুদিকে দুটো পাখা লাগিয়ে বেলুন ফোলানো হল। বাস্কেটের অংশটার সঙ্গে বেলুনটাকে লাগানো হল। বাস্কেটের মধ্যে প্রধানতঃ চারটে খোপ - পাঁচজন করে এক একটা খোপে ঢুকে পড়লাম। আর মাঝখানটায় প্রধান চালক, গ্যাস ইত্যাদি সহ উঠে পড়লো। গ্যাস জ্বালিয়ে, আগুন জ্বেলে বেলুনের মধ্যে আস্তে আস্তে হাওয়া গরম করা হতে থাকলো - হাওয়া গরম হলে বেলুন ওপরে উঠতে শুরু করলো। নির্দিষ্ট সময়ের পর আগুন নিভিয়ে দেওয়া হল। বাস্কেটের মধ্যে আমরা একুশজন আকাশে বেলুনের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে চলেছি। এও এক বিরল অভিজ্ঞতা। ওপরে ওঠার পর পাইলট জানালেন এই বেলুনটাই নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বেলুন - ৪৩ মিটার লম্বা - যাত্রী ধরে ২৪ জন ও ১ জন পাইলট। খুব আস্তে আস্তে চলছিল বেলুনটা বোঝা যাচ্ছিল না যে চলছে। এক ঘন্টা চলার পর এবার নামতে লাগলো - কোথায় নামবে কেউ জানে না। গাড়ির পাইলটের সঙ্গে বেলুনের পাইলটের সারাক্ষণ ওয়াকিটকিতে কথা হচ্ছিল। অবশেষে অন্য একটা শস্যক্ষেতে এসে পৌঁছলো। এরপর আবার একইরকমভাবে বেলুনের হাওয়া বের করে সবাই মিলে তাকে কেসের মধ্যে পুরে ফেললো। শ্যাম্পেন খুলে সবাই মিলে বেলুন রাইডের সাকসেসকে সেলিব্রেট করা হল। আমরা যারা যাত্রী ছিলাম, তারাও সবাই যেহেতু বেলুন চালানোয় সাহায্য করেছে তাই সবাইকে প্রশংসাপত্র দেওয়া হল। এও এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতার স্মারক। জানিনা আমার এই পরিব্রাজকের জীবনে আরও কত কিছু পাওয়ার আছে...।
~ তথ্য - নিউজিল্যান্ড || নিউজিল্যান্ডের আরো ছবি ~
ভারত সরকারের মহাগাণনিক দপ্তর থেকে অবসর নেওয়া মঞ্জুশ্রীর পায়ের তলায় সর্ষে। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসেন এদেশ-ওদেশ। ছয় মহাদেশের মাটিতে পা রাখার পর এখন তাঁর স্বপ্ন আন্টার্টিকা ভ্রমণ।