-->
অকল্যান্ড (Auckland) - নানান আদিবাসীদের বাসভূমি অকল্যান্ডের পরিচয় স্থানীয় মাওরিদের ভাষায় ‘তামাকি-মাকাউ-রাউ’। যার অর্থ - ‘The maiden with a hundred suitors’।
বন্দর শহর অকল্যান্ড। ওয়াইটেমাটা এবং অকল্যান্ড বন্দরের মাঝে সাজানোগোছানো শহরটিতে প্রথমেই চোখে পড়ে ৩২৮ মিটার উঁচু স্কাই টাওয়ার। অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম, অকল্যান্ড ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, উইন্টার গার্ডেন, অকল্যান্ড চিড়িয়াখানা ইত্যাদি। অকল্যান্ডের সৈকতগুলিও অপূর্ব। উল্লেখযোগ্য সৈকত পিহা এবং মুরিওয়াই। এখানে দুটি আগ্নেয়গিরি আছে – আইল্যান্ড অব রঙ্গিটোটো, ওয়ান ট্রি হিল। হাতে সময় থাকলে ফেরিতে ঘুরে আসা যায় শান্ত গ্রাম ডেভেনপোর্ট আর ওয়াইহেকে দ্বীপ থেকে। ওয়াইহেকে দ্বীপে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি দুর্গ।
অকল্যান্ড থেকে একদিনের বেড়ানোয় ওয়াইটোমো গ্লোওয়ার্ম কেভ(Waitomo Gloworm Cave), ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ সিনেমার সেট – বিবো ব্যাগিনসের গ্রাম আর রোটরুয়া (Rotorua) ঘুরে নেওয়া যায়। অকল্যান্ড থেকে ওয়াইটোমো যাওয়ার পথে পড়বে সাজানোগোছানো হ্যামিলটন (Hamilton) শহর। শহর পেরিয়ে দুপাশে উঁচু-নীচু টিলা, সবুজ ফার্মল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ ওয়াইটোমো গ্লোওয়ার্ম কেভের মজা অন্ধকার গুহার মধ্যে বোট রাইডিং। চোখে পড়ে স্ট্যলাগটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের পাহাড়ের গায়ে অজস্র জোনাকি অন্ধকারে ঝলমল করছে। ওয়াইটোমো মানে - water entering a hole in the ground। ১৮৮৭ সালে মাওরি চিফ তানে তিনোরাউ (Tane Tinorau) একজন ইংরেজ জমি পর্যবেক্ষক ফ্রেড মেসকে সঙ্গে নিয়ে এই কেভটি আবিস্কার করেন। এই গুহায় ঢোকার একটাই রাস্তা এবং সেটা ওয়াইটোমো নদী দিয়ে। ১৮৮৯ সালে পর্যটকদের জন্য গুহাটি খুলে দেওয়া হয়।
রোটরুয়ার পথ উঁচু নীচু সবুজ মাঠ আর খ্রীষ্টমাস ট্রি আর সুন্দর বড় বড় গাছ দিয়ে সাজানো। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাড়ি। এই অঞ্চলে মোট সতেরোটি হ্রদ আছে। রোটরুয়ার প্রধান আকর্ষণ অ্যাগ্রোডোম (agrodome)। শীপ সো - ভেড়ার শরীর থেকে সমস্ত লোম কি ভাবে চেঁচে নেয় তা সামনাসামনি দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে অর্গানিক ফার্ম ট্যুর। এখানে নানান জন্তুজানোয়ার দেখা যায়। দেখা মেলে নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত পাখি কিউই-এর (Kiwi)। উলেন মিল ঘুরে দেখে নেওয়া যায় কেমন করে চেঁচে নেওয়া ভেড়ার লোম থেকে নানান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উলের জামাকাপড়-চাদর ইত্যাদি তৈরি করা হয়। রোটরুয়ার আরেক দ্রষ্টব্য ফুটন্ত কাদা(Mud Volcano)। কিছু কিছু জায়গায় জলও ফুটছে – তবে চোখে পড়ে শুধুই ধোঁয়া। ১৮৮৬ সালে মাউন্ট তারাওয়েরার অগ্নুৎপাতে তে ওয়াইরোয়া গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে এই ফুটন্ত কাদার সৃষ্টি হয়েছিল। রোটরুয়ার ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে হুইরিনাকি ফরেস্ট পার্কে কয়েকশো বছরের প্রাচীন মহীরুহ দেখতে পাওয়া যায়।
কুইনস টাউন (Queenstown)- নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ অংশে কুইনস টাউন। নীল জলের লেক আর পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট বাড়ি নিয়ে ছবির মত সাজানো শহর। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল হিসেবে খ্যাত কুইনস টাউনে স্কিইং-এর মতো স্নো স্পোর্টসে অংশ নিতে হাজির হন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা। এছাড়াও বাঙ্গি জাম্পিং, মাউন্টেন বাইকিং, স্কেটবোর্ডিং, ট্র্যম্পিং, প্যারাপেন্টিং, স্কাই ডাইভিং, ফ্লাই ফিসিং বেশ জনপ্রিয়।
কুইনস টাউন থেকে ৩০৭ কিলোমিটার দূরে নিউজিল্যান্ডের আরেক আকর্ষণ মিলফোর্ড সাউন্ড (Milford Sound)। সাউন্ড মানে ফিওর্ড (Fjord বা Fiord)। দুপাশে খাড়া পাহাড়ের গলি দিয়ে সমুদ্র দেশের ভূখণ্ডের ভেতর ঢুকে গেলে তাকে ফিওর্ড বলা হয়। নিউজিল্যান্ডের এই অঞ্চলে বহু ফিওর্ড আছে, সেইজন্য এই অঞ্চলকে ফিওর্ডল্যান্ডও বলা হয়।
এখানকার পাহাড়গুলো খুব বেশি উঁচু নয় - কঠিনতম গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি আর বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। এখানে প্রচুর বড় বড় হ্রদ আছে। সবই পাহাড়ের বরফ গলা জল থেকে সৃষ্ট। হ্রদ, নদী, বন, পাহাড়, প্রান্তর আর নির্জনতা সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এক সোনার খনি।
পথে পড়বে নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘতম হ্রদ -বিরাশি কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়ানাকা (Wanaka)। মসৃন চওড়া রাস্তার পাশে লম্বা লম্বা পীচ গাছের সারি। সবুজের মাঝে সাদা কাশের গুচ্ছ। বরফাবৃত পাহাড় – দুপাশে সবুজ তৃণভূমি। কোথাও পাহাড়ের মাথায় বরফ - আবার কোথাও হিমবাহ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এরপর মিরর লেক। খাড়া পাহাড়ের গায়ে পুকুরের মতো ছোট নিস্তরঙ্গ হ্রদ। জলে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় - সৃষ্টি হয়েছে গভীর রেন ফরেষ্টের। পথে পড়বে ক্রীক জলপ্রপাত - গ্লেসিয়ার ভ্যালি - হোমার টানেল। রাস্তাটার নাম মিলফোর্ড রোড। মিলফোর্ড সাউন্ডে যাওয়ার জন্য আগে কোন রাস্তা ছিল না। ১৯৩০ সালে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকে। আবার ১৯৩৫ সালে হোমার টানেলের কাজ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালে টানেলের কাজ শেষ হলে পরের বছর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। টানেল পার হয়ে নীচের দিকে নামা - পাহাড়ের এই রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের কোলে গিয়ে মিশেছে। এখানে টিয়া জাতীয় কিয়া (Kea) পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এই পাখি একমাত্র সাদার্ন নিউজিল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলেই দেখা যায়। ক্যাটাম্যারান-এ চড়ে মিলফোর্ড ফিওর্ড দেখার আনন্দ নেওয়া যায়। যাওয়ার পথে ঝরনার জল এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় শরীর।
নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের পশ্চিম তীরে ছোট শহর ফ্রান্স জোসেফের থেকে ফ্রান্স জোসেফ গ্লেসিয়ারের (Franz Joseph Glacier) দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। এখানকার নিসর্গশোভা অসাধারণ। তিনটে পাহাড়ের চূড়া একসঙ্গে দেখা যায় - নাম ক্রাউন রেঞ্জ। ট্রেকিং করে বা হেলিকপ্টারে এই গ্লেসিয়ার দেখে নেওয়া যায়।
ওয়ানাকা হ্রদের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ওয়ানাকা-র (Wanaka) আকর্ষণ পাজ্ল্ ওয়ার্ল্ড - উল্টোপাল্টা ঘরবাড়ি -কোনটা হেলে আছে, কোনটা অর্দ্ধেক - আবার কোথাওবা গোলকধাঁধার মত রাস্তা হারিয়ে যায়। ওয়েষ্ট-কোষ্ট ধরে আরও এগোলে পথে একটা নদী পড়বে নাম ক্লুথা (Clutha)। তারপরে হাওয়া (Hawa) গ্রাম - এখানে লেকের জলে স্যামন (Salmon) এবং ট্রাউট (Trout) দুটো মাছেরই চাষ করা হয় । ওয়ানাকা লেকের ধারে ঝুরো পাহাড় (Scree Sloap)। জার্মান আবিস্কারক হাস্ট আবিস্কৃত রাস্তা তাঁর নামানুসারে হয়েছে হাস্ট পাস। আগে কুইন্স্ টাউনে যেতে দুদিন লাগতো -এই রাস্তা আবিস্কারের ফলে মাত্র দু’ঘন্টা লাগে। ফক্স্ গ্লেসিয়ারে (Fox glacier) যাওয়ার পথে পড়ল রেন ফরেষ্ট- কোন কোন গাছ তিনশ-চারশ বছরের পুরোনো। একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে সমুদ্র -তাসমান সি -সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাসে গাছগুলো একদিকে হেলে আছে। দুপাশে ঘন জঙ্গল - বহু বছর আগে এখানে ডায়নোসরাস ছিল। সব চেয়ে বড় অতি প্রাচীন গাছের নাম টোটোরা (Totora)। পবিত্র টিয়া (Tiya) গাছের কাঠ দিয়ে মাওরিদের দাহ করা হয়। এই জঙ্গলের নাম ওয়েস্টল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক (Westland National Park)। এখানে একটা গাছ রয়েছ যেটা খানিকটা আমাদের দেশের ঢেঁকি শাকের মত কিন্তু লম্বায় বেশ বড় - মাথাটা গোল করে পেঁচানো - আর চিত্রবিচিত্র করা – নাম কোরু (Koru) - এটা নিউজিল্যান্ডের বিমানের পিছনের সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখান থেকেই ফক্স গ্লেসিয়ার ট্রেকিং শুরু হয়।
ওয়েষ্ট কোষ্টে গ্রে-মাউথ (Greymouth)-ই সবচেয়ে বড় শহর। গ্রে-মাউথ ষ্টেশন থেকে Tranz Alpine বা Tranz Scinic ট্রেনে চড়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যাওয়া যায় ক্রাইস্ট চার্চ শহরে। চার ঘন্টা ধরে এই সফর শুধুই প্রকৃতিকে দেখার জন্য - পাহাড় কেটে কেটে তৈরি হয়েছে রেলপথ।
ক্রাইস্ট চার্চ (Chirstchurch) - উনিশ শতকের মাঝামাঝি জাহাজে করে ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা ক্রাইস্ট চার্চ আসে। তাদের এখানে আসার বছর পাঁচেক পরে নিউজিল্যান্ডের প্রথম শহর হিসেবে ক্রাইস্ট চার্চের পত্তন ঘটে। শহরের বুকে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে আইভন (Ivon) নদী। দ্রষ্টব্য ক্যাথিড্রাল, আর্ট গ্যালারি, বটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি। গার্ডেনে ঢোকার মুখে প্রাসাদের মতো বড় বাড়িটি মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের অনেকটা অংশ জুড়ে মাওরিদের জীবনধারা ও পুরোনো সংস্কৃতির পরিচয় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেড় হাজার বিঘে জমি নিয়ে মিউজিয়ামের বাগান। ২০১১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী বিশাল ভূমিকম্পের ফলে ক্রাইস্ট চার্চ শহর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কুক ক্রাইস্ট চার্চের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। উচ্চতা ৩৭৫৪মিটার। যদিও উচ্চতা বেশি নয় - কিন্তু এখানে হঠাৎই আবহাওয়ার ভীষণভাবে পরিবর্তন হয়।
যাওয়াঃ অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন এবং ক্রাইস্ট চার্চে নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে।
অন্যান্যঃ জি.এম.টি. থেকে নিউজিল্যান্ডের সময় ১২ ঘন্টা এগিয়ে আছে। নিউজিল্যান্ডে একইদিনে নানা ঋতু অনুভব করা যায় - এই ঠান্ডা, এই গরম, আবার এই বৃষ্টি - এইজন্য ছাতা, গরম জামাকাপড় সবই সবসময় সঙ্গে রাখা ভালো।
থাকা, বেড়ানো ইত্যাদি নানান তথ্যের জন্য এই ওয়েবসাইটগুলি দেখা যেতে পারে - http://www.newzealand.com/int/
http://www.tourism.org.nz/
তথ্য সহায়তাঃ মঞ্জুশ্রী সিকদার
~ নিউজিল্যান্ডের ছবি ~ ভ্রমণ কাহিনি - এক ভ্রমণে দুই দেশ ~