-->
সিঙ্গাপুরের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক গল্পকথা। ১৩ শতকে সুমাত্রার এক রাজকুমার পরমেশ্বর জাহাজডুবি হয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছোন এক নির্জন দ্বীপে। এখানে তিনি এক রহস্যময় সিংহের ন্যায় প্রাণীর দেখা পান। সিংহরাজের আশীর্বাদ নিয়েই এই দ্বীপে তাঁর রাজ্যপাট প্রতিষ্ঠা করেন পরমেশ্বর। শহরের নাম রাখেন সিংহপুরা বা সিংহের শহর।
স্ট্রেট অফ মেলাক্কায় এই ছোট্ট দ্বীপের অবস্থান চিরকালই ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই দ্বীপভূমির বাড়তি সুবিধা। তবে ১৮১৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠার পর থেকেই সিঙ্গাপুরের ইতিহাস বদলে যেতে শুরু করে। জেলেদের ছোট্ট গ্রাম ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে চিনা, মালয়, ভারতীয়, আরব, আর্মেনিয়ান প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের ভাগ্যান্বেষী মানুষদের বাণিজ্য আর কর্মসংস্থানের অন্যতম এক কেন্দ্র। জন্ম হয় এক মিশ্র সংস্কৃতির। বছরদুয়েক মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকার পর ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হয় সিঙ্গাপুর।
আকারে-আয়তনে ছোট্টখাট্টো এই দ্বীপটি কিন্তু আর্ন্তজাতিক স্টেটাস বেশ বড়ো। শহর, রাজধানী, রাজ্য এবং দেশ-সবকটি তকমা নিয়েই ‘ইউনিকলি সিঙ্গাপুর’- সিঙ্গাপুর ট্যুরিজমের আইডিয়াল ট্যাগলাইন।
সিঙ্গাপুরে প্রতি বছর যত মানুষ বেড়াতে আসেন তার সংখ্যা মোটামুটি এখানে যত মানুষ বাস করেন তার দ্বিগুণ। অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি, অজস্র মন্দির, মসজিদ, মিউজিয়াম, জু, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বার্ড পার্ক -এমন হরেক সব দ্রষ্টব্য আর আকাশ্চুম্বী ঝকমকে আধুনিক মলে কেনাকাটার নানান পশরা -সিঙ্গাপুরের চিরন্তন আকর্ষণ।
স্যার স্ট্যামফোর্ড র্যাফেলের কল্পনায় আধুনিক সিঙ্গাপুরের গড়ে ওঠা শুরু হয়। র্যাফেলের পর এই দায়িত্ব নেন লি কুয়ান ইউ। ক্রমে ক্রমে শিপিং, অ্যাভিয়েশন, ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ছোট্ট এই দেশ। নানা দেশ-জাতি-ধর্মের মানুষ ডেরা বেঁধেছেন এখানে। গড়ে উঠেছে মিশ্র সংস্কৃতির পরিবেশ। জমজমাট শহরের বুকের ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সিঙ্গাপুর নদী। মাথার উপর নীল আকাশ, নীল জলেতে মিশে একাকার। নদীর বুকে বোটের মালা। লঞ্চঘাট ঘিরে হোটেলের সারি। বোটভ্রমণেই বেড়িয়ে নেওয়া যায় মারিনা বে পর্যন্ত। লঞ্চঘাট পেরিয়ে ডানহাতে পড়বে ফুলারটন হোটেল। আগে এটি একটি দুর্গ ছিল। ছবির মতো কেভেন ব্রিজ পেরিয়ে আরও এগোলে নজরে পড়বে অর্ধসিংহ-অর্ধমৎস্যকন্যা সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত স্মারক মার লায়ন (Mer lion)।
এশীয় সভ্যতার মিউজিয়াম (Asian Civilisations Museum) - শুধু সিঙ্গাপুর নয়, সমগ্র এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইতিহাস আর সংস্কৃতির পরিচয় মিলবে এখানে। এমন মিউজিয়াম সারা এশিয়াতেই আর নেই। পুরো একটা তলাই রয়েছে ভারতকে নিয়ে। সিঙ্গাপুরের শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল এসপ্ল্যানেড থিয়েটার মারিনা বে-তে (Marina Bay)। ১,৬০০ আসনের কনসার্ট হল, ২,০০০ আসনের থিয়েটার, একাধিক স্টুডিয়ো, ৪,৮৮৯ রকমের বাজনা, অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল এলাকা, রেস্টুরেন্ট, বার, শপিং-এর জায়গা-আরও কত কী। প্রতিবছর জুন মাসে এখানেই সিঙ্গাপুর আর্ট ফেস্টিভ্যাল উদ্যাপন হয়। এম.র.টি স্টেশনের কাছেই চায়নাটাউন (Chiana Town)। শহরের অন্যতম সেরা মিউজিয়াম চায়নাটাউন হেরিটেজ সেন্টারটি এখানকার প্রধান আকর্ষণ। শপিং করতে করতে পৌঁছোনো যাবে হেরিটেজ সেন্টারে। সিঙ্গাপুরে চিনা অভিবাসনের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করার এক বিষ্ময়কর অভিজ্ঞতা। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সিল্ক, ক্র্যাফট, ইলেকট্রনিক্স হরেক দোকানে শপিং সারতে সারতে পৌঁছে যাওয়া যাবে মসজিদ জামে আর শ্রীমারিয়াম্মান মন্দির (Sri Mariamman Temple)। চায়নাটাউনের কেন্দ্রস্থলে এই হিন্দুমন্দিরটি। মুঘল স্থাপত্যের আদলে তৈরি প্রাচীন মসজিদটিও নজর কাড়ে। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে প্রাচীন চিনামন্দির থিয়ান হক কেন বা স্বর্গীয় আনন্দের মন্দির। মন্দিরে সমুদ্রের দেবী মা জু পো আর ক্ষমার দেবী কোয়ান ইন পূজিত হন। এম. আর. টি থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাবেল লেনে চেনা চেনা দৃশ্য গন্ধ নিয়ে লিটল ইন্ডিয়া (Little India)।
প্রায় ৬০০ প্রজাতির চেনা অচেনা পাখির ঠিকানা ২০০ বর্গমিটার ব্যাপী জুরং বার্ড পার্ক (Jurong Bird Park)। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো কৃত্রিম পাখিরালয়। গোলাপিরঙা ফ্লেমিংগো, রংচঙে ম্যাকাও, কাকাতুয়া আর নানা প্রজাতির টিয়া পাখি, পেঙ্গুইনের মিছিল -আন্টার্কটিকা থেকে আফ্রিকা -সারা বিশ্বের নানান পাখির দেখা মিলবে এখানে। ‘নাইট সাফারি’তে রাতের বেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে পশুপাখি দেখার মজাই আলাদা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পার্ক খোলা থাকে। ৫২০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন। হার্বেরিয়াম সেকশনে বিভিন্ন প্রজাতির ৬,০০,০০০ গাছপালা রয়েছে। জাতীয় অর্কিড উদ্যানে দেখা মিলবে নানান প্রজাতির ৬০,০০০ অর্কিড। এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি চিড়িয়াখানাও সিঙ্গাপুরে। প্রকৃতির মাঝে স্বাভাবিক পরিবেশে দেড়শোরও বেশি প্রজাতির স্তন্যপায়ী, পাখি আর সরীসৃপের বাসভূমি এই জু। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো কৃত্রিম জলপ্রপাতটি দেখেও মুগ্ধ হতে হয়।
সিঙ্গাপুরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে আবদুল গফফর মসজিদ, শ্রী ভিরামা কালিয়াম্মান মন্দির, লিয়ং সান বৌদ্ধমন্দির, আর্মেনিয়ান চার্চ, কেন্দ্রীয় শিখমন্দির, ফোট ক্যানিং পার্ক আর ঔপনিবেশিক ইতিহাসের স্মৃতিমাখা কলোনিয়াল ডিস্ট্রিক্ট।
সিঙ্গাপুরের আরেক আকর্ষণ উপকূল থেকে সামান্য দূরে স্যান্টোসা আইল্যান্ড (Santosa Island)। ফ্রেশার হিল থেকে কেবলকারে স্যান্টোসা যাওয়া যায়, ফেরার সময় জলপথে আসুন। স্যান্টোসায় গিয়ে মনোরেলে চড়ে ঘুরে নেওয়া যায় দ্বীপটা। দেখে নিন ওয়ার মেমোরিয়াল, বাটারফ্লাই পার্ক, ডলফিন লেগুন। স্যান্টোসা থেকে কেবলকারে জুয়েলবক্স, মাউন্ট ফেবারের শৃঙ্গচূড়ায় চলে যাওয়া যায়।
আর একসঙ্গে পুরো সিঙ্গাপুরকে দেখতে উঠতে হবে ৫৪০ ফুট উঁচু সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার (Singapore Flyer)। মেরিনা বে থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর রিভার, র্যাফেলস প্লেস, মার্লায়ন পার্ক -চোখের সামনে খুলে যাবে একের পর এক দৃশ্যপট। এই হুইল যখন ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায় তখন মনে হয় যেন পৃথিবীটাই উলটে গিয়েছে -সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
যাওয়াঃ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়ান, এয়ারলাইন্স ও থাই এয়ারওয়েজের বিমানে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বড়ো শহর থেকে সিঙ্গাপুর পৌঁছনো যাবে। বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে, বাসে বা ট্যাক্সিতে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
খাওয়াদাওয়াঃ সিঙ্গাপুরের স্থানীয় খাবারদাবারের স্বাদ নিতে চোখে দেখতে হবে মুর্তাবাক। এটা কিমার পুর দেওয়া মোগলাই পরোটা গোছের আইটেম। নারকেল দুধ, নানা ধরনের সামুদ্রিক উপাদান আর মশলাদার সস দিয়ে তৈরি লাক্সা। গরমাগরম ফায়েড ফ্ল্যাট নুডলসের সঙ্গে নানারকম সি-ফুডের জমাটি রেসিপি চার কোয়ে তেও। আরও রয়েছে পাক চোয় ইন অয়েস্টার সস, পেপার ক্র্যাব বা প্রন, ফিশ হেড সুপ, ফিশবল সুপ, চিকেন রাইস, গ্লেজড ডাক-এমন হাজারো সব লোভনীয় পদ। ডেসার্ট হিসেবে চলতে পারে বরফ গুঁড়ো আর নানারকম ফলের কুচি ভরা আইস কাসাং কিংবা গাজরের কেক। অর্চার্ড রোডের উইসামা আত্রিয়া, লাকি প্লাজা, শপিং মলের ফুড কোর্ট, স্কটস রোডের স্কটস, নিউটন সার্কাস, চায়নাটাউন হল, ইস্ট কোস্ট পার্কওয়ের মেরিন প্যারেড-পেটপুজোর লোভনীয় সব ঠিকানা।
কেনাকাটাঃ শপার্স প্যারাডাইস সিঙ্গাপুর। শহরের বুকে দীর্ঘ অর্চার্ড রোডের দুপাশে বহু শপিংম্যল আর একের পর এক দোকান। সিঙ্গাপুর ম্যারিয়ট হোটেলের ঠিক নীচেই তাং-এ নানারকম ক্রিস্টালের মূর্তি সাজানো, দেখলেই কিনতে ইচ্ছা করবে। লাগোয়া লাকি প্লাজায় মিলবে খানিক সস্তায় ব্র্যান্ডেড পোশাক, জুতো, ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট আর হস্তশিল্পের নানান আইটেম। বিশাল এইচ এম ভি স্টোরে সিডি-ডিভিডি আর হরেকরকম মিউজিক সিস্টেম দেখতে দেখতেই কেটে যাবে সময়। নি আন সিটি ম্যলটি আরও বড়ো আর ঝকঝকে। আরেকটি জনপ্রিয় ম্যল সেন্টারপ্যেন্ট। কমদামে কেনাকাটার জন্য ভালো দোকান রবিনসন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স।
নামী ব্র্যান্ডের দামি জিনিস কিনতে না চাইলে ঢুঁ মারুন লিটল ইন্ডিয়ার মহম্মদ মুস্তাফা শামসুদ্দিনের দোকানে। কী নেই? জুয়েলারি, ঘড়ি, মোবাইল, ভিডিয়ো ক্যামেরা-হরেক জিনিস।
আরব স্ট্রিটে জামাল খাজুর অ্যারোম্যাটিক্স আতরের জন্য বিখ্যাত। কমদামে ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের সন্ধান মিলবে সিম লিম জংশন ও সিম লিম স্কোয়ারে। নর্থ বিজ রোডের ফু নান সেন্টারও ভালো।
বাণিজ্যিক এলাকার প্রাণকেন্দ্র সানটেক সিটি - সব পেয়েছির দেশ। এখানে আপনার কেনাকাটার তালিকায় পছন্দের সবকিছুই পেয়ে যাবেন। একটু অন্যরকম কেনাকাটা করতে চলে যাওয়া যায় চায়নাটাউনে। সংগ্রহ করতে পারেব চিনা লন্ঠন, ফেংশুই সিংহ কিংবা কাঠের তৈরি হস্তশিল্প। চলে যাতে পারেন ভিড় থেকে দূরে হল্যান্ড ভিলেজ শপিং সফরে।
জরুরিঃ সিঙ্গাপুরের আই এস ডি কোড ৬৫। খুব গরম বা ঠান্ডা নয় আবহাওয়া। হালকা পোশাকেই দিব্যি চলে যায়। দেওয়ালি আর থাইপুসাম জাতীয় ছুটির দিন। স্থানীয় মুদ্রা সিঙ্গাপুর ডলার।
অন্যান্য আকর্ষণঃ হরেকরকমের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস সিঙ্গাপুরের আরেক মজা। ৫০০ ফুট উঁচু বুকিট তিমা পাহাড়ে হাইকিং, সমুদ্রের তীর ধরে সাইক্লিং, ডাইভিং, উইন্ডসার্ফিং, ওয়াটারস্কিয়িং, বোটিং, মাউন্টেনিয়ারিং, কায়াকিং আরও কত কী! আর গলফ খেলতে ভালোবাসলে ঢুঁ মারতে হবে সিঙ্গাপুর আইল্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, স্যান্টোসা গলফ ক্লাব, তানামেরা কান্ট্রি ক্লাব, র্যাফলস কান্ট্রি ক্লাব এসবে।
থাকাঃ রকমারি প্যাকেজট্যুরে সিঙ্গাপুর বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন ট্যুর অপারেটররা। নিজস্ব ব্যবস্থায় বেড়াতে চাইলে সিঙ্গাপুর ট্যুরিজমের ওয়েবসাইট www.singaporetourism.org.in থেকে হোটেল ও নানা প্যাকেজের খোঁজ পাওয়া যাবে। এছাড়া হোটেলের খোঁজ মিলবে www.agoda.com, www.yoursingapore.com ও www.booking.com/singapore এইসব ওয়েবসাইটে।
~ সিঙ্গাপুরের ছবি ~ ভ্রমণ কাহিনি - ঝটিকা সফরে সিঙ্গাপুর ~