অমরনাথ দর্শন
নিবেদিতা কবিরাজ
~ অমরনাথ-এর তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~
একটু এগোতেই পিট্টুদের সঙ্গে দেখা, একজনকে আমার আর মামার বড়ো ব্যাগ দুটো দিয়ে হালকা হলাম, ছোট ব্যাগটা পিঠে নিয়ে চললাম। আজকের বারো কিলোমিটারের প্রথম তিন কিলোমিটার খুব চড়াই পথ, উঠতে পারলেই পিসু টপ। ওটা পেরোতে পারলে বাকিটা কঠিন নয়, চড়াই উৎরাই দিয়ে সাজানো। যাত্রা শুরু করার একটু পরই একটা ভাণ্ডারা পেলাম, মান্টামামা হালকা খাবার খেল ; মৃণাল বলল, "দিদি খেও না, পিসু টপ পেরোই, তারপর ভাণ্ডারা পাবো তখন খাবো।" এগিয়ে চললাম। খাড়াই মানে ভীষণ খাড়াই, তার মধ্যে কাদা, দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না, সবাই নিজের মতো এগোচ্ছে, আমি আর মামা একসঙ্গে উঠছি, পাশ দিয়ে ঘোড়ার লাইন উঠছে। দু পা এগোচ্ছি আর একটু দাঁড়াচ্ছি, নিজেকে বোঝাচ্ছি কোনও তাড়া নেই, কচ্ছপের মতো ওঠো, উঠতে তোমায় হবেই। ঘন্টা তিনেক এভাবে হাঁটার পর ভাবছি এখনও তিন কিলোমিটার হয়নি? কতটা হল? আর কত বাকি? এক ঘোড়াওলাকে জিজ্ঞেস করায় বলল আর এক কিলোমিটার, দূরে হাত দেখিয়ে বলল, "ওই যে পিসু টপ দেখা যাচ্ছে, হয়ে যাবে দিদি, ধীরে ধীরে আসুন।" বেলা এগারোটার দিকে আর আমি দুর্গম, দুরূহ পিসু টপ পৌঁছলাম। মৃণালরা আর মান্টামামা আগেই পৌঁছে গেছে, মান্টামামা তো হিরো, সবার আগে পৌঁছেছে। সবাই ভাণ্ডারার সামনে আমাদের জন্যই অপেক্ষায় ছিল, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করলাম যে যার পছন্দ অনুযায়ী; কেউ রুটি, কেউ ইডলি, কেউ পোহা। একটা রুটি আর একটু সবজি নিলাম, শেষে একটু চা। "বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাবে না, নিলে শরীর ছেড়ে দেবে, এখনও ন'-দশ কিলোমিটার, চলো বেরিয়ে পড়ি দিদি", মৃণাল তাড়া লাগাল।
এরপর জোজিবাল, নাগাকোটি পেরোলাম। চড়াই উৎরাই পথে হাঁটতে হাঁটতে কোথাও দু'দণ্ড দাঁড়াচ্ছি, কখনও পাথরের ওপর একটু বসছি, কখনও দুটো খেজুর, কখনও বা এক ঢোক জল খেয়ে আবার হাঁটছি। রুক্ষতাও এমন সুন্দর, গাছপালাহীন মাটি নুড়ি পাথর দিয়ে সাজানোগোছানো - পর্বতের সৌন্দর্য যেন সেই পরমাত্মার হাতের রঙতুলির কারুকার্য, কোনও এক মুহূর্তের খামখেয়ালিপনা। এসব দেখতে দেখতে কত রাস্তা হেঁটে চলেছি, কিন্তু একটুও কষ্ট নেই, যেন এক পরম আনন্দ।
এভাবে চলতে চলতে হঠাৎই প্রচন্ড গর্জন করে পাশ দিয়ে বয়ে যেতে দেখলাম শেষনাগ থেকে নির্গত জলরাশিকে। বুঝলাম আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। শুনেছি বাবা মহাদেব এখানেই নাকি শেষনাগকে রেখে উঠেছিলেন। জয় মহাদেবের জয়। আবার বেশ খাড়াই শেষ দিকটা, নাকি পথের ক্লান্তিতে খাড়াই লাগছিল জানিনা, মিলিটারি ড্রেস পরা দুই অল্পবয়সী মহিলা ওপর থেকে নেমে আসছেন সাহায্য লাগবে কিনা জানতে, হাসলাম, হাতটা ধরলেন। ওঁদের একজনের হাত ধরে বাকি দশ পা মতন তরতর করে উঠে শেষনাগ পৌঁছে গেলাম। আসার সময় বলেছিলাম আমার হাত ধরে তুলতে, উনি শুনেছেন। অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা, আর এক বোধোদয় একই সঙ্গে ঘিরে ধরল আমায় ; উপলব্ধি করলাম তিনি শুধু মন্দিরে মসজিদে নয়, সর্বত্র বিরাজমান।
শেষনাগে একটা টেন্টে মৃণালরা পাঁচজন আর আমরা তিনজন - এই আটজন থাকব আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, সেইমতো ঢুকে পড়লাম টেন্টে। একটা প্লাস্টিক ফোম পাতা, তার ওপর কম্বল দেওয়া; তাতেই শুতে হবে, আর গায়ে দেওয়ার একটা করে কম্বল। বেশ ঠান্ডা এখানে, ঠিক হল ভাণ্ডারা থেকে যে যা খাবো খেয়ে চটপট কম্বলের তলায় ঢুকে যাব। রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপছি, একই হাল সবার। ওরকম কাঁপতে কাঁপতেই খেয়ে এসে জ্যাকেট, টুপি যে যা পরে ছিলাম ওই পরেই শুয়ে পড়লাম।
১৩ জুলাই, ভোর সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম শেষনাগ থেকে পঞ্চতরণীর পথে। রাস্তায় ভাণ্ডারা থেকে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম শুধু। শেষনাগ থেকে পঞ্চতরণী প্রায় পনেরো কিলোমিটার, প্রথম সাড়ে চার কিলোমিটার শুধু চড়াই আর রুক্ষতা, অক্সিজেনের অভাব।
আজ হেঁটে উঠতে মামার একটু কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি, মামার সঙ্গে সঙ্গে আছে মানস। বারবার দাঁড়িয়ে দম নিতে হচ্ছে। মামাকে কোকা-৩০ দিলাম, বলল, "ঠিক আছি চল।" অনেক দূরে মহাগুনাস টপ দেখা যাচ্ছে, বলেই ফেললাম, "অত ওপরে এখনও উঠতে হবে?" মামা বলল, "ওদিকে দেখিস না, নিচের দিকে তাকা, কত মানুষ উঠে আসছে, তুই ওই পথ পেরিয়ে এসেছিস।" অবাক হয়ে গেলাম, পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে মানুষগুলোকে, ওই পথেই এসেছি? তিয়াত্তর বছরের মামার মনের জোর দেখে অবাক হলাম। বেড়ে গেল মনের জোর, মনে হল, হ্যাঁ পারব, ঠিক পারব, পারলামও। মহাগুনাস টপে পৌঁছনোর একটু আগে থেকে বৃষ্টি শুরু হল, হাঁটার গতিও কমে গেছে। কথিত আছে, এখানেই মহাদেব পুত্র গণেশকে রেখে মাতা পার্বতীকে নিয়ে ওপরে উঠেছিলেন।
টুক টুক করে হেঁটে পৌষপত্রীর ভাণ্ডারাতে দাঁড়ালাম সবাই। এই ভাণ্ডারাটায় দেখলাম দারুণ দারুণ সব খাবার ; আমরা টুকটাক খেয়ে, একটু বসে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার উৎরাই বেশি, চড়াই কম। কিন্তু বৃষ্টিতে রাস্তা কাদা হওয়ায় নামাও যেন শক্ত হয়ে গেল। এবারে মৃণাল আমার হাত ধরল, তাতে যেন নামাটা সহজ হল। শুধু হাঁটা না, মৃণাল আমায় পাহাড়ি পথে নামতে শেখালো। মনে মনে বুঝলাম তিনিই এসে ঠিক হাত ধরলেন। যখনই অসুবিধে হয় মৃণাল ঠিক হাতটা ধরে নামিয়ে দিচ্ছে। আবার উপলব্ধি করলাম তিনি মানুষের মধ্যেই আছেন; জানি না কতটা পাথরের বা ধাতুর মূর্তিতে আছেন, তবে জীবের মধ্যে যে আছেন তা তো নিজের চোখেই দেখলাম। বইয়ে পড়েছি, শুনেছি কিন্তু প্রত্যক্ষ অনুভব এই যাত্রায় হল।
পঞ্চতরণীতে পৌঁছতে বেশ দেরি হল, সন্ধে নামে নামে, মানে আটটা বেজে গেছে। আজ পূর্ণিমা, জ্যোৎস্নার আলোয় দুধসাদা বরফের পাহাড় যেন সোনায় মাখামাখি। এক মায়াবী রাতে আমরা তোমার অপার্থিব স্বর্গরাজ্যে।
ভাণ্ডারাতে একটা রুটি, ডাল আর সিমুই খেলাম। টেন্টে ফেরার পর মৃণালের বন্ধু সন্দীপ বলল, "দিদি, কাল আমরা অমরনাথ দর্শন করে নিচে নেমে যাব, তাই শুরুতেই ঘোড়া নেব। আপনারা কী করবেন?"
আমরা তিনজন হেঁটেই উঠব ঠিক করলাম, ঘোড়া নিতে হলে অমরনাথ গুহা থেকে বেরিয়ে মানে বরফিনাথ দর্শনের পর নেব।
১৪ জুলাই ভোর চারটে, আবার বেরিয়ে পড়লাম, পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ গুহার উদ্দেশ্যে।
পঞ্চতরণী থেকে গুহার দূরত্ব ৬ কিলোমিটার, কিন্তু দুর্গম রাস্তা। ক'দিন আগের মেঘভাঙা বৃষ্টির পর আরও খারাপ হয়েছে। দর্শন করেই বালতাল নেমে যাওয়ার ইচ্ছা, অমরনাথ গুহা থেকে বালতাল চৌদ্দ কিলোমিটার, অনেকটা রাস্তা। খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লেও পঞ্চতরণীর গেট খুলল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। হাঁটা শুরু করলাম মনের আনন্দে, আজই দর্শন করব প্রভু তোমার ওই অভূতপূর্ব রূপ।
আজ আকাশ বড়ই মুখ ভার করে রেখেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হ'ল, রেনকোট পরে হেঁটে চলেছি। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে, মামাও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেঁটে চলেছে; বারবার মামার দিকে দেখছি, বৃষ্টিতে ভিজছে এভাবে, কী হবে কে জানে! আজ যেন একটু ভয় ভয় করছে, রাস্তারও ভয়ানক অবস্থা, মানুষের সংখ্যাও প্রচুর, খাড়াই সরু পথে তিন চারটে লাইন, তার মধ্যে ঘোড়া, পালকি যাতায়াত করছে, পা টিপে টিপে যেতে হচ্ছে।
আমার ভেতরে তুমি আছো তো, সেই তুমি শক্তি দাও, তুমি সঙ্গে থাকলে ঠিক পারব, তাঁকে ডাকতে ডাকতে চলেছি। মাঝে মাঝে এত উঁচু উঁচু পাথর যে একা উঠতেই পারছি না, পাশ থেকে একজন হিন্দিতে বলল, "হাতটা দিন"। হাত ধরতেই টপ করে উঠে পড়লাম, হেসে বললাম, "ভাগ্যি ছিলেন।" উনি বললেন, "আছি, চলুন ভয় নেই।" বার বার উনি হাত ধরছেন আমি না বললেও, অবাক হচ্ছি খুব, পিছন থেকে একজন বললেন, "মাতাজী ভয় নেই, হাত ধরুন, বরফে পা পিছলে যাবে।" কে বলছেন? আমার ঈশ্বর? সত্যিই পা ভীষণ পিছলে যাচ্ছে, শক্ত করে মানুষটার হাত ধরলাম, বুঝলাম তিনিই নিয়ে যাচ্ছেন। যাত্রীদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে লাঠি, লাঠি ছাড়া আগে কাউকে দেখিনি বা হয়তো লক্ষ্য করিনি। এই মানুষটার হাতে লাঠি নেই, আমাকে বেশ কিছুক্ষণ শক্ত করে ধরে অনেকটা পথ পার করলেন, মামাকেও অনেক জায়গায় টেনে তুলে দিলেন, কখন কখনও মান্টামামাকে হাত বাড়িয়ে পিছলে যাওয়া থেকে রক্ষা করলেন। হ্যাঁ ইনিই আমার ঈশ্বর, আমার শ্রীকৃষ্ণ, আমার মহাদেব। এভাবে সঙ্গম পেরোলাম, আরও ৩ কিলোমিটার যেতে হবে। বালতাল আর চন্দনওয়াড়ির রাস্তা সঙ্গমে এসে এক হয়েছে, তাই যাত্রী সংখ্যা এবার আরও বেশি। বৃষ্টি মাথায় এক হাতে লাঠি আর একটা হাতে তাঁকে ধরে এগোচ্ছি আর মনে মনে তাঁকে বলছি, "আমি কিন্তু তোমায় টের পাচ্ছি, তুমি ঠিক রক্ষা করলে। আমার, সবার চারিদিকে তুমি আছো, ঘিরে আছো। তুমি গুহাতে যতই থাকো তার থেকে বহুগুণ বেশি মানুষের মধ্যে আছো। ঈশ্বর দর্শন হয়ে গেছে আমার, প্রতি মুহূর্তেই ঈশ্বর দর্শন করি তো, কিন্তু বুঝি না বলো। গুহা পর্যন্ত যদি পৌঁছতে না পারি আমার একটুও দুঃখ হবে না, তোমার ওই রূপ যদি দেখতে না পাই তবুও একবারও কোনো অভিযোগ করব না তোমায়, আমি তোমায় অনুভব করতে পেরেছি এতেই অপার আনন্দ আজ আমার বুকে।" এভাবেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন পৌঁছে গেছি গুহার কাছাকাছি, কিন্তু মামাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন কে জানে! অপেক্ষায় এক ধারে দাঁড়িয়ে পড়লাম, একজন মিলিটারি এসে জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে?" বললাম মামাদের দেখতে পাচ্ছি না, উনি হাত ধরে একটু উঁচু পাথরে দাঁড় করালেন, বললেন কিছুক্ষণ দেখুন, না পেলে মাইকে নাম ধরে ডাকবেন। মিনিট দশেক পরে দেখলাম মামা আর মান্টামামা উঠে আসছে, আমি মিলিটারি মানুষটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঁচু পাথর থেকে নেমে এলাম আর বুঝলাম আবার তিনিই এসে রক্ষা করলেন।
যাত্রাপথে বহু মানুষ পাশের জনকে এভাবেই হাত ধরে রক্ষা করছেন, দেখেছি আর উপলব্ধি করেছি মানুষের মধ্যে তিনি যতটা আছেন আর কোথাও তিনি এভাবে নেই।
প্রায় তিনশো সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছলাম গুহার সামনে, মনে হলো যেন অসাধ্য সাধন করলাম। অবশ্য আমি নয়, এ আমার ভেতরের তিনিই করেছেন, ঝরঝর করে আনন্দাশ্রু আমার গাল বেয়ে। বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, চারিদিক বেশ ঝকঝক করছে, গুহার ওপরের দিকে তাকাতেই নজরে এলো সেই পায়রা, যারা নাকি অমর হয়ে রয়েছে মহাদেবের গল্প শুনে। গেট পেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে একদম সামনের সারিতে চলে এলাম, কী করে এলাম জানি না, চোখের সামনে সেই বিস্ময়কর বরফের শিবলিঙ্গ। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ, টের পেলাম মনের ভেতরটা খুব শান্ত হচ্ছে, ওই বরফের মতোই, আজ খুব পরিতৃপ্ত আমি। এক গভীর ভালোলাগায় ডুবে আছি।
দর্শনার্থীদের ভিড়েই বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে, আমি না বেরোলে আরেকজন ঢুকবে কী করে? শান্তমনে নেমে এলাম সিঁড়ি বেয়ে।
এবার ফেরার পালা, তার আগে পেটে কিছু দিতে হবে, ভাণ্ডারাতে রুটি সবজি খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গমে নেমে এলাম, ওখানেই পিট্টু অপেক্ষা করছে আমাদের ব্যাগ নিয়ে।
এরপর আমি আর মামা ঘোড়া নিলাম বালতাল যাওয়ার জন্য, মান্টামামা হেঁটে নামতে শুরু করল, ঘোড়া নেবে না।
বালতালের রাস্তা দিয়ে হেঁটে নামা ভালো ঘোড়ায় চড়ে নামার থেকে, কিন্তু শরীর আর দিচ্ছে না, অনেকটা পথ চৌদ্দ কিলোমিটার, হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। হয়তো রাতটা গুহার কাছে টেন্টে থাকতে পারতাম, কিন্তু মনে হয়েছিল যত কষ্টই হোক আজ নেমে যাব বালতাল। ঘোড়ায় যেতে যেতে মান্টামামার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, একা একা নামবে বড়ো ব্যাগটা নিয়ে, বড্ড জেদি মানুষটা। কতবার বলেছি, "জানি তুমি পারবে, তাও ঘোড়া নিয়ে নাও।" নিলো না, বলল, "তোদের আগে নেমে যাবো।" ঘোড়ায় যেতে যেতে একবার আমি আর একবার মামা পড়ে গেলাম, নেহাত খাদের দিকে নয়, তাই প্রাণে বাঁচলাম। এক চুল এদিক ওদিক হ'লেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। আবারও তাঁকে অনুভব করলাম, এবারেও তিনিই রক্ষা করলেন।
ঘোড়া পৌঁছে দিল সাড়ে সাতটার দিকে, সময় নষ্ট না করে চটপট একটা টেন্ট নিয়ে ঢুকে পড়লাম। মান্টামামা নটায়, মৃণালরা প্রায় দশটায় বালতাল পৌঁছেছে। কিন্তু মৃণাল ফোন করায় বুঝতে পারলাম আমি আর মামা বালতাল বেসক্যাম্প-এর আগের ক্যাম্পে ঢুকেছি। মান্টামামা আর মৃণালরা বালতাল বেসক্যাম্পে আর আমরা দুজন অন্য ক্যাম্পে রাত কাটালাম।
ভোর হতেই ক্যাম্পের গাড়িতে মামা আর আমি পৌঁছে গেলাম বালতাল বেসক্যাম্প, ওখানে একটা ভাণ্ডারাতে চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে মান্টামামাকে নিয়ে তিনজন চললাম বাসস্ট্যাণ্ডে। খোঁজাখুঁজি করে একটা শেয়ার গাড়ি পেয়ে গেলাম, দুপুরেই পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর।
শ্রীনগরে হোটেলে ঢুকে আগে স্নান সারলাম, গত তিনদিন স্নান করা তো দূরের কথা, এক জামাকাপড়েই ছিলাম। তারপর তিনজনে একটা বাঙালি হোটেলে ভালো করে খেয়ে লম্বা ঘুম। একটা গোটা দিন কোথাও না বেরিয়ে রেস্ট নিলাম, রাতে মোনাদার ফোন। খোঁজখবর নিলেন, শরীর ঠিক আছে কিনা, কেমন দর্শন হল, পুরোটা হেঁটে গেছি, নাকি ঘোড়ায়। আমি কৃষ্ণাদি, রীনাদির খবর নিলাম, ওঁদের সঙ্গে পঞ্চতরণীতে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিল, তারপর আর যোগাযোগ করতে পারিনি। অবশ্য ফোনে পাবই বা কী করে, ফোনগুলো তো তিনদিন চার্জ দিতেই পারিনি, ওঁরাও তাই, ওইজন্য স্যুইচড অফ ছিল। মোনাদাকে আবার গাড়ির জন্য বললাম, যদি দিতে পারেন তাহলে কাল যুসমার্গটা ঘুরে আসতাম। বললেন, "দেখছি, কাল সকালে জানাবো।"
১৭ জুলাই, সকাল সকাল তৈরি হয়ে গেছি, কিন্তু মোনাদা কিছুই জানাননি। ঠিক করলাম নিজেরাই বেরিয়ে পড়ব, বাইরে ব্রেকফাস্ট করে স্ট্যাণ্ড থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাব। ব্রেকফাস্ট করতে করতে মোনাদার ফোন, বললেন "গাড়ি নিয়ে আসছি, সঙ্গে রীনাদি, কৃষ্ণাদিকে নিয়ে, ওঁদেরকে নিয়ে আপনারা ঘুরে আসুন।" বাহ্, বেশ খবর! আমরা খুব খুশি। দিদিদের নিয়ে হইহই করে আমরা সারাদিন ধরে যুসমার্গটা ঘুরে নিলাম, সন্ধেতে ফিরে দিদিদের নিয়ে ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণও হল।
১৮ জুলাই আমাদের ফেরার ট্রেন। কাশ্মীর, পাহাড়, জঙ্গল, ঝরনা, দুর্গম পথ, অমরনাথ দর্শন, কত অচেনা মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত অজানাকে জানা, বোঝা এভাবেই সমৃদ্ধ হলাম আর সেই রেশ নিয়ে ফিরতি পথে হিমগিরিতে উঠলাম, কী করে যেন কেটে গেল দিনগুলো।
~ অমরনাথ-এর তথ্য || অমরনাথের ছবি || অমরনাথ ট্রেকরুট ম্যাপ ~
নৈহাটিতে, পরিবারের সঙ্গে গাছ, মাছ, পাখি ও কুকুর নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন নিবেদিতা কবিরাজ। প্রিয় একটি বুটিক আছে। প্রকৃতির টানে জঙ্গলের গভীরতায়, পাহাড়ের প্রাচুর্য আর উদারতার হাতছানিতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়েন এদিক সেদিক।