প্যারিস (Paris): বহু ইতিহাসের আখ্যানের ধারক শহর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। এখানে দ্রষ্টব্য স্থানও অনেক। তাই শহরে পা দিয়ে পর্যটকদের আগে বেছে নিতে হবে তাঁদের পছন্দের জায়গাগুলো। কেউ যদি মনে করেন যে তিনি শুধু ইতিহাসের মাধ্যমে প্যারিস নগরীকে খুঁজে পেতে চান তবে তাঁর উচিত ল্যুভর মিউজিয়াম, মঁমার্ত, তুলেরি গার্ডেন, রয়াল প্যালেস, বাস্তিল দুর্গ, প্লেস দ্য লা কনকর্ড, কার্তিয়ের দ্য লাতিন ইত্যাদি স্থানগুলিতে ঘোরাফেরা করা।
ল্যুভর মিউজিয়াম (Louvre Museum) দেখতে হাতে কম করে তিন চারদিন সময় রাখা ভালো। যদিও তাও এই কদিনে ল্যুভর প্রায় অদেখাই থেকে যায়। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে ল্যুভরে তিনমাস সময় লাগে। ১২০০ শতকে প্রাসাদপম এই বাড়িটি গড়ে ওঠে। ১৮০০ শতকে ফরাসী বিপ্লবের সময় এটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়। ল্যুভরের প্রায় ৩৫০০০ শিল্প সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে ইজিপ্সিয়ান, গ্রীক, রোমান অ্যান্টিক দ্রব্যাদি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, দে লা ক্রয়েক্স, ভারমীর, রুবেন প্রমূখ খ্যাতনামা ইউরোপীয়ান চিত্রকরদের আঁকা ছবি প্রভৃতি অজস্র দ্রষ্টব্য। বিখ্যাত ‘মোনালিসা’ ছবিটিও এখানেই আছে। নতর দাম চার্চ, মঁমার্ত এগুলি একদিনেই দেখা যায়। নতর দাম চার্চে(Notre Dame )-র ঘন্টাটি দেখে বিষ্ময়ে অবাক হয়ে যান বেশিরভাগ পর্যটকই। মনে পড়ে যায় ভিক্তর হুগো-র সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নতরদাম’। ইনভ্যালিড মিউজিয়ামে (Les Invalides ) নেপোলিয়নের সমাধিটি রয়েছে। এখানে বহু ফরাসী সৈনিকদেরও মৃতদেহ সজ্জিত আছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসন দখল করে আছে আইফেল টাওয়ার(Eiffel Tower)। গুস্তাভ এইফেল সাহেবের নামে টাওয়ারটি পর্যটকদের ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে মনে হবে কি বিশালাকার স্তম্ভগুলি - তার তলায় তস্য ক্ষুদ্র জনগণের ঢেউ। আর ওপরে লিফ্ট দিয়ে উঠলে আরেক চমক -নীচে কুয়াশার চাদরে মোড়া স্বপ্ননগরী -পাখির চোখের দৃষ্টি দিয়ে এক ঝলক দেখে নিতে হবে।
তুলেরি গার্ডেন(Tuileries Garden ) বা ফরাসিতে যাকে বলে জারদাঁ দে তুলেরি আগে রয়াল প্যালেস হিসাবে বিখ্যাত ছিল। এখন ইতিহাসের কালচক্রের প্রবর্তনের ফলে শুধুই পর্যটকদের ভ্রমণের স্থান হিসাবে খ্যাত। এর পূর্বদিকে ল্যুভর মিউজিয়াম, দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে সিন নদী, উত্তরে রু দ্য রিভোলি ও পশ্চিমে প্লেস দ্য লা কনকর্ড(Place de la Concorde )। এই প্লেস দ্য লা কনকর্ডে রাখা ছিল ফরাসি বিপ্লবে ব্যবহৃত কুখ্যাত “গিলোটিন”। ৩২০০ বছরের প্রাচীন ২৩ মিটার উঁচু ওবেলিক্সটিও এখানে আছে। এটি ক্লিওপেট্রার নিডল নামেও পরিচিত।
কারতিয়ের লাতিন(Latin Quarter ) হচ্ছে প্যারিসের প্রাচীন শিক্ষা কেন্দ্র। বর্তমানে এখানে আরো দু-একটি শিক্ষাকেন্দ্র গঠিত হওয়ার ফলে এই স্থানটিকে শহরের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
প্লেস দ্য লা বাস্তিল(Place de la Bastille) অবশ্যই দেখা প্রয়োজন। বাস্তিল দুর্গ ফরাসি বিপ্লবের প্রধান উৎপত্তিস্থল। ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে স্মরণ রেখে বর্তমানে এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশ হয়ে থাকে।
কেই যদি প্রমোদসাগরে তরী ভাসাতে চান তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে রংবাহারি ডিজনিল্যান্ড, শঁজ-এ-লিজে, বিভিন্ন নাইট ক্লাব ও লিডোর সুবিখ্যাত ক্যাবারে শো।
ডিজনিল্যান্ড(Disneyland) ও ডিজনিপার্কে পুরোপুরি ঘুরে বেড়াতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। এখানে হাজার রকমের রাইডস্ আছে, বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন প্যারেড ও ডান্স শো। ডিজনিল্যান্ড ও ডিজনিপার্কে ঘোরাফেরা করে এবং কাল্পনিক শিশুচরিত্রগুলির সঙ্গে ভাব-বিনিময় করে দুতিন দিন কেটে যাবে। অর্ধেকের ওপর রাইড প্রথমদিনে ওঠাও হবে না। প্যারিসের ডিজনিল্যান্ড শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। গোড়ার দিকে “ইউরো ডিজনিল্যান্ড” নামকরণ হলেও এখন “প্যারিস ডিজনিল্যান্ড” নামেই খ্যাত। এই বিনোদন ক্ষেত্রে রয়েছে দুটি থিম্ পার্ক, একটি সুবিশাল সুভেন্যির, খাবার ও ঘুরে বেড়ানোর জায়গা এবং সাতটি ডিজনি পরিচালিত হোটেল। ১৯৯২ সালে ডিজনিল্যান্ডের উদ্বোধন হয় প্যারিসের মাটিতে। ডিজনিল্যান্ডের গড়ে ওঠার ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়।এটি নির্মান হওয়ার সময়ে সমগ্র দেশ জুড়ে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথা সকলেরই জানা যে প্যারিসকে “কালচারাল ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” বলা হয়ে থাকে। প্যারিসবাসীর গর্ব তার সমৃদ্ধশালী সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প ও স্থাপত্য। সেই প্যারিসের বুকে ডিজনিল্যান্ড খোলা হলে পরে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “কনজিউমার কালচার” বা “ভোগবাদী কৃষ্টি”-কে সানন্দে ডেকে আনা হবে এটা প্রথমে মেনে নিতে পারেননি ফরাসিরা। তাই গোড়ার দিকে বেশ কিছুদিন আন্দোলন ও প্রতিবাদের জন্য ডিজনিল্যান্ড গঠনের কাজ স্থগিত থাকে। পরে কিছু নির্দিষ্ট লেবার আইন মেনে ও বৃহত্তর স্বার্থে শিশুদের বিনোদনের কথা ভেবে বুদ্ধিজীবি মানুষ নেতিবাচক মনোভাব দূর করে ডিজনিল্যান্ড গড়ে তোলার কাজে সম্মতি দেন। বর্তমানে আইফেল টাওয়ারকে পিছনে ফেলে ডিজনিল্যান্ড হয়ে উঠেছে পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্যস্থলের মধ্যে অন্যতম।
কোন দুপুর বিকেলে হেঁটে বেড়ানো যেতে পারে শঁজ-এ-লিজের (Champs-e-lyse) মধ্যে দিয়ে। দুধারে সারি সারি দোকান প্রধানতঃ কফির, বিয়ারের আর পাঁউরুটি-কেকের। নাম করা বেকারি, পেস্ট্রি শপ আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। মাঝে চওড়া প্যারিসের রাস্তা -চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে হুশ্ করে চলে যাবে ফরাসি গাড়িগুলি। প্রিয়জনের হাতে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্মৃতি রোমন্থন আর ক্লান্ত হলে বসা যায় মধ্যবর্তী পার্কের অন্তরালে নিরিবিলিতে। খুব ক্লান্ত হলে ঠোঁট রাখা যায় নাম করা কফি শপের ফুটন্ত কফির কাপে। শঁজ-এ-লিজের আভেনিউ ঘুরে উঠে পড়া যায় বাসে। এই বাসে করে বিভিন্ন টানেলের মধ্যে দিয়ে শহরের অলিতে গলিতে ভ্রমণ করা যায়। দুর্দান্ত গতি আর অপূর্ব সুন্দর শহরের রাস্তার দৃশ্য। টানেলের মধ্যে দিয়ে যেতে বেশ রোমহর্ষক লাগে আর মনে পড়ে যায় ডায়না-ডোডি জুড়ি এরকমই এক টানেলে ধাক্কা খেয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ঠিক সন্ধ্যার মুখে উঠে পড়া যায় সিন নদীর বুকে বাঁধা নৌকাগুলির একটিতে। প্যারিস শহরের বুকে ছলছলিয়ে বয়ে চলেছে সিন নদী। সিন নদীতে রিভার ক্রুজ একটি অভাবনীয় প্রাপ্তি পর্যটকদের কাছে। কাঁচে ঢাকা নৌকায় চেপে মন্থর গতিতে প্যারিসের বক্ষদেশ চিরে এক ঘন্টার যাত্রা। অনেকগুলি সেতু আছে প্যারিস নগরীতে। তাদের তলা দিয়ে নৌকাগুলি পার হবে আর দুধারে সরে সরে যাবে নতর দাম, আইফেল, প্লেস দ্য লা কনকর্ড, তুলেরি গার্ডেন ইত্যাদি। একবার নদীবক্ষে ভ্রমণের সময়ে এই বিশিষ্ট স্থানগুলি চোখে পড়বে আর কানে ধারাভাষ্যের মাধ্যমে জেনে নিতে হবে স্থানগুলির মাহাত্ম্যকথা। পরে অবশ্য ট্যুরিস্ট গাইডের সাহায্য নিয়ে এই সবগুলি স্থান পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা যাবে।
রাতে প্যারিস আরেক বিষ্ময়কর রূপে ধারণ করে। কলকাতায় পুজোর পাঁচদিন যেমন আলোর মালায় সজ্জিত হয় রাস্তাঘাট-প্যারিস শহরে সারা বছরই সেই আলোর মালা দেখা যায়। তাই এই শহরের আরেক নাম “সিটি অফ লাইট্স”। আলো ঝলমলে শহরে রাত যত গভীর হয় তার আকর্ষণ ততই বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন নাইটক্লাব -প্যারিসের নাইটলাইফের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে মেতে থাকেন প্যারিসবাসীরা -সঙ্গে থাকে ঢালাও পানীয় ও অপর্যাপ্ত ভোজন।
যাওয়া – শহরের উত্তর-পূর্বে চার্লস দ্য গলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দক্ষিণ-পশ্চিমে ওরলি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এছাড়াও শহরের উত্তরে রয়েছে স্থানীয় বিউভেইস এয়ারপোর্ট। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে প্যারিসের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ ভালো। এছাড়া ইউরোলাইনের বাসতো রয়েইছে।
শহরের দ্রষ্টব্যগুলি দেখার ভালো উপায় পায়ে হেঁটে বা মেট্রোয় চড়ে ঘোরা। চালাতে পারলে স্কুটার বা মোটোরবাইকও ভাড়া করা যায়। গাড়ি ভাড়া করলে কিন্তু ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার সমূহ সম্ভাবনা।
খাওয়া-দাওয়া -ফরাসি রেস্তোঁরাগুলির কথা ভুলে গেলে চলবে না। বিভিন্ন জিভে জল আনা খাবারের কেন্দ্রস্থল শহর প্যারিস। যেকদিন শহরে থাকতে হবে সেকদিন সমান তালে চালিয়ে যেতে হবে ভোজনপর্ব। নানান রকমের চিজ, স্যালাড, মাংস, কেক, পেস্ট্রি, চকলেট ও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফরাসি পানীয় সবকিছুরই আস্বাদন নিয়ে ভালোবাসতে হবে প্যারিস নগরীকে।
(তথ্য সহায়তাঃ মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়)
~ প্যারিসের ছবি- শুভ্রাংশু বিশ্বাস ~ তমালি ভৌমিক ~ ভ্রমণ কাহিনি -স্বপ্নের দেশে একদিন~