-->
ইতালি নামটা শুনলেই একটা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সাহিত্য সব মেলানো মেশানো অনুভূতি হয়। তার সঙ্গে আবার এখন জুড়েছে ইতালিয়ান কুইজিন মানে রকমারি খাবারদাবার আর কী, ইতালিয়ান ফ্যাশান - আরও নিত্যনতুন কতকিছু। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। ঝকঝকে নীল সমুদ্র, সূর্যালোকিত দ্বীপের মেলা, গ্লেসিয়ার লেক, আগ্নেয়গিরি, আঙুরক্ষেত, গ্রামীণ জীবন। ইউনেস্কো হেরিটেজ তালিকায় সব চাইতে বেশি জায়গার নাম রয়েছে এই দেশের।
রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্স আর নেপলসের মতো ঐতিহ্যশালী এবং স্থাপত্যের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা শহরগুলিই পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। পৃথিবীর ম্যাপে এই দেশটি খুঁজে পেয়েছিলেন মার্কো পোলো। আর একে সমৃদ্ধ করেছেন গিয়োত্তো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলোর মতো চিত্রকর, ভাস্কর আর দান্তে, বোকাচ্চিওর মতো চিন্তাবিদেরা।
রোম (Rome) – ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্থাপত্য সবেরই পীঠস্থান ইতালির রাজধানী এবং সর্ববৃহৎ শহর রোম। তার ২৮০০ বছরের অস্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে সুগভীর প্রভাব ফেলেছে। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির অন্যতম রোমান সাম্রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস, সেভেন হিলস (Seven Hills), ভাটিকান সিটি (Vatican City), থ্রি কয়েন (Three Coins in the Fountain) – এইসবকিছুই রোমকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের (UNESCO World Heritage Site) মর্যাদা দিয়েছে। প্রাচীন ধ্বংসস্তুপ, অসাধারণ প্রাসাদ, শতাব্দী পুরনো চার্চ, সুন্দর সুন্দর ঝরনা – প্রাচীনত্ব এবং আধুনিকতার মেলবন্ধনে সারা পৃথিবীর ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে আকর্ষণীয় এই শহর। রোম শহরটি অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত।
পুরনো রোম (Old Rome) ছিল রেনেসাঁর (Renaissance) এক কেন্দ্রস্থল। মনোমুগ্ধকর সব চত্ত্বর, চার্চ এবং সর্বোপরি এখানকার সেরা আকর্ষণ প্যানথিয়ন (Pantheon)। খ্রীস্টপূর্ব ১২৬ সনে বর্তমান কাঠামোটি তৈরি হয়। বৃত্তাকার এই প্রাসাদের বারান্দায় গ্রানাইটে তৈরি করিন্থিয়ান শৈলীর অনেকগুলি বড় থাম আছে। কেন্দ্রীয় ডোমটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মাথার ওপর মাঝের অংশটি ফাঁকা প্রাকৃতিক আলো সরাসরি ঢোকার জন্য। অভ্যন্তরের নানা চিত্রকলা দর্শনীয়। ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে এখনও এই প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয়।
নয়শোরও বেশি চার্চ আছে এই শহরে তার মধ্যে অন্যতম ভাটিকান সিটি-র সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা(St. Peter's Basilica )। সেন্ট পল (St. Paul) চার্চ আর সেন্ট পিটার রোমের প্রথম দুটি চার্চ একসঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সান্তা মারিয়া মাজিওরে (Santa Maria Maggiore) এবং সান জিওভান্নি (San Giovanni) আরও দুটি প্রাচীন চার্চ। চার্চগুলির অভ্যন্তরের চিত্রশৈলী দর্শণীয়।
পৃথিবীর বেশ কয়েকটি সেরা মিউজিয়ামের ঠিকানা রোম। কাম্পো মার্জিও-র (Campo Marzio) ভিলা বোর্গিজ (Villa Borghese ) এলাকা জুড়ে অজস্র আর্ট মিউজিয়াম আছে। গ্যালেরিয়া বোর্গিজে (Galleria Borghese) রয়েছে বোর্গিজে পরিবারের নিজস্ব সংগ্রহ। ম্যুজিও নাশিওনাল দি ভিলা গিউলিয়া-য় (Museo Nazionale di Villa Giulia) পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এট্রুসকান আর্টের সংগ্রহ রয়েছে। ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মর্ডান আর্ট (Galleria Nazionale d'Arte Moderna) মিউজিয়ামে সেজান (Cézanne), মদিগ্লিয়ানি (Modigliani), দেগা (Degas), মনে (Monet ), ভ্যান গখ (Van Gogh) প্রভৃতি নানান বিখ্যাত শিল্পীর সৃষ্টি দেখা যায়। কলোসিও ডিস্ট্রিক্ট (Colosseo District)-এর কাপিতোলিন মিউজিয়ামে(Capitoline Museum) শহরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রোমান এবং গ্রীক আর্ট ও স্কাল্পচারের সংগ্রহ আছে। ইতালীয় রেনেঁসা এবং বারোক আর্ট (Baroque art) বুঝতে যেতে হবে মর্ডান সেন্টারের (Modern center) বারবেরিনি প্যালেসের (Barberini palace) অ্যান্টিক আর্টের গ্যালারিতে (Galleria d'Arte Antica )।
মর্ডান সেন্টারের বাথস অফ ডায়োক্লেসিয়ান (Baths of Diocletian) এবং পালাজো অলটেম্পসের (Palazzo Altemps) ন্যাশনাল মিউজিয়াম (National Museum) দুই-ই আর্কিওলজিকাল সংগ্রহের জন্য খ্যাত। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের নানান নিদর্শন দেখা যাবে ম্যুজিও দেল্লা সিভিলটা রোমানায় (Museo della Civiltà Romana) প্লাস্টার কাস্ট আর পাথরের নানা মূর্তি ও কাজে। হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে দেখে নেওয়া যায় মিউজিয়াম অফ দ্য ওয়ালস (Museum of the Walls), মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট মিউজিয়াম (Musical Instruments Museum) প্রভৃতি। কবিতাপ্রেমীদের জন্য আদর্শ ঠিকানা কিটস-শেলীর বাসাবাড়ি (Keats-Shelley House) – বর্তমানে এই মিউজিয়ামটি ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের জন্য উৎসর্গীকৃত। তবে এর পাশাপাশি ভাটিকান সিটির মিউজিয়মগুলি না দেখলে রোমের মিউজিয়াম ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
হেঁটে ঘুরে না দেখলে পুরোনো রোমের ঠিক ফ্লেভারটা পাওয়া যায় না। হাঁটতে হাঁটতে ট্যুরিস্ট-অধ্যুষিত জায়গার বাইরে বেরিয়ে এলেই মনে হবে যেন আধুনিক শহরে আর নেই, মধ্যযুগে পৌঁছে গেছি। মাথার ওপর খেয়াল রাখলে চোখে পড়বে রুফটপ গার্ডেন, বাড়ির দেওয়ালে অপূর্ব সব স্থাপত্য, চিত্রকলা। জানালা দিয়ে চোখে পড়ে সিলিং-এর ওক কাঠের বিম। বড় বড় পালাজোর আর্চের মতো গেটের দিকে তাকালে দৃষ্টি কেড়ে নেবে অপরূপ সব ভাস্কর্য, কৃত্রিম ঝরনা আর বাগানে সাজানো ভেতরের বিশাল চত্ত্বরের সৌন্দর্য।
শহরের অলিগলিগুলো এসে পড়েছে বড় বড় খোলা চত্ত্বরে। এই জায়গাগুলোতেই রয়েছে চার্চ আর কৃত্রিম ঝরনা। ট্রেভি ফাউন্টেন (Trevi Fountain ) এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। নর্থ সেন্টারের কাছে পিয়াজা দি স্প্যানাতে (piazza di Spagna) আরেকটি অসাধারণ কৃত্রিম জলপ্রপাত আছে। ১৯৫৩ সালে নির্মিত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র 'রোমান হলিডে' (Roman Holiday )-র শ্যুটিং হয়েছিল এখানেই।
কলোসিয়াম (Colosseum) – পুরোনো রোমের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ঐতিহাসিক অ্যাম্ফিথিয়েটার কলোসিয়াম। ডিম্বাকৃতি বিশালাকার এই স্থাপত্যটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি স্থাপত্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উদাহরণ। খ্রীঃপূঃ ৭২ থেকে ৮০ সালে এই স্থাপত্যটি গড়ে ওঠে। মধ্যযুগের প্রথম দিক থেকে রোমের মানুষের আমোদপ্রমোদের অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে এই কলোসিয়াম। ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ মানুষ ধরে এমনই বিশাল স্টেডিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই, পশুর লড়াই, ক্লাসিকাল মিথোলজি ভিত্তিক নাটক দেখতে নিয়মিতই জমায়েত হত লোকজন।
ভাটিকান সিটি (Vatican City) – রোম শহরের মধ্যেই প্রাকার দিয়ে আলাদা করা ক্যাথলিক খ্রীষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ শাসিত ভাটিকান সিটি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ। ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটটির উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য – সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা (St. Peter's Basilica), সিস্টিন চ্যাপেল (Sistine Chapel) এবং মিউজিয়ামগুলি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শনের অনেকগুলিই এখানে রয়েছে। সেন্ট পিটার্স চার্চের অভ্যন্তরে রাফায়েল (Raphael), ব্রামাঁতে (Bramante), মাইকেল এঞ্জেলো (Michelangelo), গিয়াকোমো দেল্লা পোর্তা (Giacomo della Porta), মাদেরনো (Maderno), বের্নিনি (Bernini) সহ রেনেঁসাযুগের বিভিন্ন নামী চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করের অপূর্ব সব সৃষ্টি দেখার সুযোগ মেলে। সিস্টিন চ্যাপেলের খ্যাতি অসাধারণ সব ফ্রেস্কোর জন্য। পেরুজিনো (Perugino), দোমেনিকো ঘিরলান্দিয়ো (Domenico Ghirlandaio), বতিচেল্লি( Botticelli), মাইকেল এঞ্জেলোর সৃষ্টি রয়েছে এখানে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাইকেল এঞ্জেলোর 'লাস্ট জাজমেন্ট' (Last Judgment)।
ভেনিস (Venice) - মায়াবী শহর ভেনিস জুড়ে ছড়িয়ে আছে অগণিত ছোটো ছোটো খাল – এগুলিই শহরের জলপথ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য রয়েছে ছোট ছোট নৌকা যার নাম গন্ডোলা। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এরকম নেই, তাই তো ভেনিস হল সব শহরের রানি। ইউনেস্কো এই পুরো শহরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর আখ্যায় ভূষিত করেছে।
শহর জুড়ে যেমন আছে ওয়াটার ক্যানাল তেমন আছে ছোট ছোট গলিপথ আর পুরনো সব বাড়ি, যার বেশিরভাগই এখন হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এইসব গলিপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে যেন মধ্যযুগীয় সময়ে শেক্সপিয়ারের কোনো নাটকের পটভূমিকায় পৌঁছে গেছি। ইতালির অন্যান্য শহরের মতো এখানেও এ-গলি সে-গলির ফাঁকে গীর্জা রয়েছে। অতি সাধারণ গীর্জারও ভেতরের সাজসজ্জা খুব সুন্দর।
দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সেন্ট মার্ক'স স্কোয়ার (Saint Mark's Square), বেল টাওয়ার (Bell Tower), সেন্ট মার্ক'স বাসিলিকা (Saint Mark's Basilica), ডোজে প্যালেস (Doge's Palace), রিয়্যালটো ব্রিজ (Rialto Bridge) এইসব। আর অবশ্যই গন্ডোলা চড়ে জলপথে ভেনিস ভ্রমণ এখানকার মূখ্য আকর্ষণ।
সবুজে ছাওয়া ছোট স্কোয়ার পিয়াজা সান মার্কো (Piazza San Marco) সেন্ট মার্ক'স ব্যাসিলিকার ঠিক সামনে অবস্থিত। ডোজে প্যালেস আর এর মাঝে আগে ছিল রিও বাতারিও (Rio Batario) ক্যানেল। ১১৭৪ সালে ক্যানেল বুজিয়ে চত্ত্বরটির আকারে বাড়ানো হয়। সরকারি অফিসগুলি মূলতঃ এই চত্ত্বরেই অবস্থিত। চত্ত্বরের মধ্যমণি নয়নকাড়া সেন্ট মার্ক'স ব্যসিলিকা। ডমিনিকো কন্টারিনি ১০৭১ সালে এই অপূর্ব চার্চটি নির্মাণ করেন। ভেনেশিয়ান এবং বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই চার্চটি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শিল্পের মেলবন্ধনের একটি অপরূপ নিদর্শন। 'চার্চ অফ গোল্ড' নামে খ্যাত ভেনিসের অন্যতম এই চার্চটি ১৮০৭ সাল থেকে রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপের অধীনে ছিল। ব্যাসিলিকার অন্যতম আকর্ষণ ৯৮.৬ মিটার উচ্চ বেল টাওয়ারটি। শহরের বিশেষ এই ল্যান্ডমার্ক স্থাপত্যটি নবম শতকে নির্মিত হলেও ১৯১২ সালে নতুন করে তৈরি করা হয়। ডোজে প্যালেস এই চত্ত্বরের আরেক আকর্ষণ। গথিক স্থাপত্যের এই প্রাসাদটি পনের শতকের প্রথমদিকে নির্মিত হয়েছিল। এক অগ্নিকান্ডের পর ১৫৭৪ সালে এর বেশ কিছু অংশ নতুন করে তৈরি করতে হয়।
সেন্ট মার্ক বেসিন (Saint Mark Basin) আর সান্তা লুসিয়া রেল স্টেশন (Santa Lucia rail station) লাগোয়া লেগুনকে জুড়েছে শহরের মাঝে ছড়িয়ে থাকা গ্র্যান্ড ক্যানেল(Grand Canal)। প্রাচীন এই জলপথটি ৩,৮০০ মিটার দীর্ঘ। ক্যানেলের দুপাশে প্রায় একশ সত্তরটি পুরোনো বড় বাড়ি রয়েছে। এখানে ভেনিসের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির বাসস্থান ছিল। প্রাইভেট বোট, ওয়াটার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি আর বিখ্যাত গন্ডোলা সবই চলে এই জলপথে। ক্যানালের ওপরে শহরের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে যে ব্রিজগুলি, তারমধ্যে অন্যতম রিয়ালটো ব্রিজ।
ভেনিস শহর বেশ জমজমাট - প্রচুর দোকানপাট – ট্যুরিস্টদের দৌলতে ঢালাও বিক্রি হয় ভেনেশিয়ান মাস্ক আর ছোট ছোট কাঠের বা প্লাস্টিকের তৈরি গন্ডোলা। রিয়্যালটো ব্রিজের আশেপাশে এরকমই সারি সারি দোকানের ভিড়। ভেনিস কাচের নানা রকম শৌখিন জিনিস তৈরির জন্যও বিখ্যাত। কাছেই মুরানো (Murano)দ্বীপে কিছু ভালো গ্লাস ফ্যাকট্রি আছে।
ভেনিস থেকে দু'ঘন্টার সফরে রেল অথবা সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যায় এক ছোট্ট সুন্দর বন্দর-শহর উত্তর ইতালির ত্রিয়েস্তে (Trieste)। ভেনিস থেকে খানিকটা উঁচুতে পাহাড়ের পাদদেশে, আদ্রিয়াতিক সমুদ্রের গা ঘেঁষা এই শহরের ইতালীয় পরিচয় বেশ নতুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত দীর্ঘদিন ত্রিয়েস্তে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের অংশ। এখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগই ছিল স্লাভ (Sloven)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখানে স্লাভদের আধিক্য নষ্ট করে ইতালীয়দের প্রভাব ও সংখ্যা বাড়তে থাকে। ব্ল্যাকশার্ট মিলিশিয়াদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এখন অবশ্য এটি পুরোদস্তুর ইতালীয় শহর।
মে মাসে ত্রিয়েস্তের আবহাওয়া চমৎকার। ঝকঝকে রোদ উঠলেই সমুদ্রসৈকতে রোদ পোহানোর ভিড়। ত্রিয়েস্তে ইতালির কফি-রাজধানী। অজস্র কাফে ছড়িয়ে রয়েছে সারা শহরে। একশো বছরের পুরনো কাফে সান মার্কোর খ্যাতি ছড়িয়েছে জেমস জয়েস ও সমসাময়িক বহু লেখক-শিল্পীর আড্ডাঘর হিসেবে। ইতালির যে কোনো শহরের মতোই ত্রিয়েস্তে সৌন্দর্যে ভরপুর, ইতিহাসে ভরপুর এবং অবশ্যই সুখাদ্যে ভরপুর। নোবেল পুরস্কারজয়ী পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ডঃ আবদুস সালাম ১৯৬৪ সালে এই শহরে International Centre For Theoretical Physics (ICTP) স্থাপন করেন। এই সংস্থাটি তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানচর্চায় খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। ত্রিয়েস্তেতে তাই এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নজরে পড়ে।
রিসিয়েরা দ্য সান সাব্বা (Risiera di San Sabba)– ইতালির একমাত্র নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি এখানেই রয়েছে। জায়গাটি এখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৮৯৮ সালে তৈরি এই চালকলকে (Risiera-Rice husking mill) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করে জার্মানরা, মুসোলিনির সাহায্যে ও আনুকূল্যে। যদিও এটিকে মূলতঃ ট্রানসিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হত ( বেশিরভাগ বন্দীকেই এখান থেকে Dachau বা Auschwitz–এর ক্যাম্পে পাঠানো হত) তা-ও অন্ততঃ চার হাজারেরও বেশি বন্দীকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে পালিয়ে যাওয়ার সময় নাৎসি বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিয়ে যায়, নিজেদের কুকর্মের প্রমাণ ধ্বংস করার জন্য। ক্যাম্প চত্ত্বরটা খুবই ছোট। অসম্ভব ছোট ছোট খুপরিতে চল্লিশ-পঞ্চাশজনকে ঠেসে ঢোকানো হত। এছাড়াও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের নানা পন্থাতো ছিলই। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বলতে আমরা মূলতঃ ইহুদি-নিধন বুঝি। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন ক্যাম্পে হাজার হাজার এথনিক স্লাভ, ক্রোয়েশিয়ান, পোলিশ ও রোমানিয় জিপসিদের হত্যা করা হয়েছে। রিসিয়েরার কয়েদীরা বেশিরভাগই ছিল স্লাভ ও ক্রোয়েশিয়ান; বিখ্যাত লেখক বরিস পাহর (এঁর বিখ্যাত উপন্যাস Necropolis) তাঁদের মধ্যে একজন। পরবর্তীকালে ইহুদিরা (বকলমে ইজরায়েল) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটির ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু স্লাভরা রিসিয়েরার অধিকার পুরোপুরি ছাড়তে রাজি হয়নি। মিউজিয়ামটি বর্তমানে ইতালি সরকারই দেখাশোনা করে। সমস্ত তথ্য ইতালীয়, ইংরাজি ও স্লাভ ভাষায় লেখা ( অন্যান্য ক্যাম্পে হিব্রুতে লেখাও আবশ্যিক)।
মিলান (Milan) – ফ্যাশন, স্বাচ্ছল্য আর ফুটবলের কেন্দ্রস্থল ইতালির মিলান শহর। ইন্টারনাশিওনাল (Internazionale) এবং মিলানো(Milano) – ইতালির দুটো বড় ফুটবল ক্লাবেরই ঠিকানা এই শহর। ঐতিহাসিক সান সিরো স্টেডিয়ামও(San Siro stadium) এই শহরেই। প্রতিবছর বসন্ত আর শরতে আয়োজিত ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় হাজির থাকেন দেশবিদেশের ডিজাইনার থেকে সুপারমডেলরা।
শহরের আনাচেকানাচে লুকিয়ে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস অগণিত চার্চ আর প্রাসাদের প্রকোষ্ঠে। শহরের কেন্দ্রস্থলে গথিকশৈলীর চার্চ দুয়োমো (Duomo), সান্তামারিয়া দেল্লে গ্রাজি চার্চে (Santa Maria delle Grazie Church) লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'দ্য লাস্ট সাপার' (Last Supper) ছবিটি রক্ষিত আছে। দুয়োমোর কাছেই রয়েছে অপেরা হাউস (Opera House), মধ্যযুগীয় দুর্গ স্ফোরজা ক্যাসেল (Sforza Castle)। সুপ্রাচীন কেনাকাটার জায়গা গালেরিয়া ভিত্তোরিও ইমানুয়েল-ও(Galleria Vittorio Emanuele) এই চত্ত্বরেই অবস্থিত।
আর এইসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শহর জুড়েই রয়েছে আকর্ষণীয় রেস্তোঁরা আর বার। সেসবও দর্শনীয়ও বৈকি।
লেক কোমো (Lake Como) - ইতালির মিলান শহর থেকে মাত্র ঘন্টা খানেকের দূরত্বে লেক কোমো। অদূরে তুষারাবৃত পর্বতমালা ও কাচের মতো স্বচ্ছ নীল হ্রদের ধারে ছোট ছোট গ্রামগুলিকে দেখলে মনে হয় পিকচার পোষ্টকার্ড।
লেক কোমোর ধারে সবথেকে নামকরা ভিলেজ হল বেলাজিও(Bellagio), যাকে নাকি নকল করে আমেরিকার লাসভেগাসে বেলাজিও তৈরি হয়। এখানে জর্জ ক্লুনি, ম্যাডোনা, ভারসাচি ও সিলভেষ্টার স্তালোনের প্রভৃতি হলিউডি তারকাদের বাড়ি আছে। পুরো এলাকাটা এতটাই নিখুঁত করে সাজানো যে রাস্তার ধারে বড় বড় টবে রংবেরং-এর ফুলগুলির মধ্যে কোথাও শুকনো ঝরা ফুল চোখে পড়ে না। পাথরের রাস্তার দুধারে সারি সারি বাড়ির বারান্দাগুলি ফুলে ফুলে ঢাকা আর তাদের তলায় তলায় দোকান। হীরে, মুক্তো, চোখধাঁধানো অস্ট্রিয়ান ক্রিস্টালের ঝাড়লন্ঠন থেকে গুচি-ফেন্ডির ব্যাগ, সবেরই আকাশছোঁয়া দাম। জায়গাটিকে অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। লেক থেকে পাহাড়ের দিকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে, আর তার দুধারে বাড়ি।
আরেকটি ভিলেজের নাম মিনাজিও (Menaggio)। এখানে পাথরের রাস্তাগুলি কিছু কিছু জায়গায় কাশীর গলির মতনই সরু, শুধু তফাৎ একটাই ফুলে ফুলে ঢাকা দুধারের বাড়িগুলি পড়ে যাওয়া কিছু ঝরা ফুল ছাড়া রাস্তাঘাটে একটা নোংরা কাগজও চোখে পড়ে না। এই মিনাজিওতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসোলিনি বহুদিন গোপনে ছিলেন।
লঞ্চে যেতে হবে লেনো (Leno) ভিলেজ। এটি রেনফরেস্টের এলাকায় পড়ে। পাহাড়ের ওপর ঘন জঙ্গল।
ট্রেমেজো (Tremezzo) ভিলেজে লেকের ধারেই বড় বড় স্ট্যাচু আর ফোয়ারা যার নাম 'শারলটা ভিলা'। আঠারোশো তিরানব্বই সালে প্রাশিয়ার রানি এই সতের একরে তৈরি বোটানিকাল গার্ডেন সমেত ভিলাটি তার মেয়েকে বিয়েতে যৌতুক দিয়েছিলেন। এখন এটি ইতালি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ভিলার সবথেকে বড় আকর্ষণ অসাধারণ বোটানিকাল গার্ডেন-এর সাথে অজস্র নাম জানা ফুলের সমারোহ।
ভেরেনা (Varenna) ভিলেজটিতে বেলাজিওর মতো অত দামি দোকান পাটের চাকচিক্য না থাকলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেলাজিওকেও ছাড়িয়ে যায়।
নেপলস (Naples) – রোমের থেকে মাত্র ঘন্টা দুয়েকের দূরত্বে থাকা ইতালির নেপলস শহর তৈরি হয়েছিল গ্রীকদের হাতে, পরে আরও সমৃদ্ধ করে রোমানরা। ইতালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাসের চিত্র খুব সুস্পষ্ট এই শহরে। দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে – ন্যাশনাল আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম (National Archaeological Museum), সান ফ্রান্সেস্কো দ্য পাওলা চার্চ (Church of San Francesco di Paola), রয়েল প্যালেস (Palazzo Reale), সান কার্লো থিয়েটার (San Carlo Theater), ক্যাথিড্রাল, তিনটি প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি। আর এসব ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে উষ্ণ কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ঢুঁ মারতে হবে শহরের প্রাচীনতম কাফে গ্র্যাম্বিনাস-এ (Café Gambrinus)।
পম্পেই( Pompei) - নেপলস থেকে ঘন্টাখানেক দূরে 'সোরেন্তো'(Sorrento)। যাওয়ার পথে পড়বে দু-হাজার বছরের পুরনো 'পম্পেই' নগরী। ভিসুভিয়াসের (Mt. Vesuvius) অগ্নুৎপাতে ঊনআশি খ্রীস্টাব্দে এই বিলাসবহুল নগরীটিতে প্রায় কুড়ি হাজার লোক প্রাণ হারায়। আর তার সতেরোশো বছর পরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে এটিকে উদ্ধার করেন। সুন্দর একটি একতলা ভিলা চোখে পড়ে যার সামনে ফোয়ারা, স্ট্যাচু এমনকী দরজার মুখে একটি চেনে বাঁধা মোজাইকের কুকুর। চব্বিশ অগষ্টের সেই দিনটি আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতনই শুরু হয়েছিল। লোকজন বাজার দোকান করছিল। একটি বাড়ির টেবিলে কিছু ডিম ও দুহাজার বছরের পুরনো কিছু রুটি রাখা আছে। এরা মরার কয়েক ঘন্টা আগেও পাহাড়ের গায়ে ধোঁয়া দেখে গ্রাহ্য করেনি কারণ ভলক্যানো শব্দটাই তারা জানতো না। ফুটন্ত ছাইগুলো মানুষের গায়ের ওপর জমা হয়ে ধীরে ধীরে শক্ত ইঁটের মত হয়ে যায়। বেশ কয়েকজন টাকার থলি নিয়ে পালাচ্ছিল, তারা সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে আজও তাদের মুখে চোখের আতঙ্ক পরিস্কার চোখে পড়ে।
লেডি অবলা বসুর ভ্রমণ কাহিনি 'লুপ্তনগরী' লেখাটিতে মৃত শহর পম্পেই-এর খুব সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। তাঁরা যেসময়ে সেখানে গিয়েছিলেন তখনও খননের কাজ চলছিল। তাঁর বর্ণনায় পড়ি - " রাত্রে নাট্যশালাতে গীতবাদ্য হইতেছে, - অতি প্রকাণ্ড অ্যাম্ফিথিয়েটারে সিংহ ও মানুষে লড়াই হইবে; দর্শকে আমোদভবন পূর্ণ, সকলেই আমোদে মত্ত! এমন সময়ে অকস্মাৎ বিসুবিয়াসের শিখর হইতে অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিল। মুহূর্তে আকাশ অগ্নিময় হইয়া গেল! বজ্রধ্বনিতে পৃথিবী পুনঃ পুনঃ কম্পিত হইতে লাগিল! বিসুবিয়সের গহ্বর হইতে অগণ্য জ্বলন্ত প্রস্তর চতুর্দ্দিকে নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল, তারপর উত্তপ্ত কর্দ্দমবৃষ্টি, তারপর ভষ্মবৃষ্টি!
নগরবাসীরা হঠাৎ বজ্রধ্বনি ও অগ্নিপাতে ভীত হইয়া যে যেখানে পারিল পলাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কোথায় পুত্র! কোথায় কন্যা! কোথায় স্ত্রী! সকলে ভীতস্বরে ডাকাডাকি করিতে লাগিল।বাহিরে অন্ধকার, তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালিয়া রাস্তায় বাহির হইল, কিন্তু হায়! যে আলোকের সাহায্যে তাহারা পলায়ন করিবে তাহারা পলায়ন করিবে ভাবিয়াছিল, সে আলোক ভস্মপাতে নিবিয়া গেল। তখন লোক-স্রোতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহারা পথ ভুলিয়া অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কেবল যখন বিসুবিয়াসের অগ্নিশিখায় মুহূর্তের জন্য দিক আলোকিত হইতেছিল, তখন সকলে পরস্পরকে দেখিতে পারিতেছিল, যাহাদের লইয়া একত্রে বাহির হইয়াছিল, তাহারা কোথায় হারাইয়া গিয়াছে! কাতর আহ্বানে কেহ আর প্রিয়জনের উত্তর পাইল না!" ইতিহাসের কাহিনির পরে আসে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা -"এই যে রাস্তা দিয়া চলিতেছি এই রাস্তায় সহস্রাধিক বৎসর পূর্ব্বের গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট রহিয়াছে। বৃষ্টি হইলে রাস্তায় জল জমিত, জুতা যাহাতে না ভিজিয়া যাইতে পারে, সেজন্য রাস্তার মাঝে মাঝে পাথর বসান ছিল, এখনও সেই পাথরগুলি যথাস্থানে রহিয়াছে। রাস্তার পাশ দিয়া জলের পাইপের নলগুলি এখনও দেখা যাইতেছে। পূর্ব্বে বলিয়াছি, ভষ্মচাপে অনেকে জীবন্তেই সমাহিত হইয়াছিল। তাহাদের দেহ ভষ্মে আবৃত হইয়া এতকাল অবিকৃত অবস্থায় রক্ষিত ছিল। একটী গৃহে অনেকগুলি মৃতদেহ দেখিলাম। তাহা দেখিয়া সেই দুর্দ্দিনের ঘটনা যেন চক্ষের সম্মুখে দেখিতে পাইলাম।...একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভষ্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল। সেই গৃহে একটী নারী দুহাতে তার শিশুটিকে উচ্চে ধরিয়া রহিয়াছিল। ভগ্নস্তূপ ক্রমে ক্রমে উন্নত হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল। কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভষ্মস্তূপ তিল তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই; কি যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল! মাতার হস্ত দুইটি মৃত্যু যন্ত্রণাতেও অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহস্র বৎসর পরে সেই উর্দ্ধোথ্থিত করপুটে সন্তানটি পাওয়া গিয়াছে। সেই মাতার স্নেহস্পর্শে যেন অতীত বর্ত্তমানের সহিত মিলিয়া গেল। একই দুঃখে, একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িল! তখন পম্পেইর মৃত রাজ্য সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল, এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজন পূর্ণ হইল!"
আমালফি (Amalfi) জায়গাটিতে রোমান সম্রাটরা ছুটি কাটাতে আসতেন। এখানেও সম্রাট টেবেরিয়াসের বিরাট ভিলা ছিল। কিছুটা দূরে রেভেল ভিলেজ যেখানে হামফ্রে বোগার্ট কয়েকটা ছবির স্যুটিং করতে এসেছিলেন। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশেছে মানুষের হাতে তৈরি সাজানো চাকচিক্য।
লাস্পেজিয়া (La Spezia) -কে কেন্দ্র করেই ঘুরে নেওয়া যায় 'পোর্তোফিনো' (Portofino)ও 'চিংকেটেরে'। চিংকে মানে পাঁচ আর টেরে হল গ্রাম। ভূমধ্যসাগরের ধারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ট্রেকিং করা যায়। ট্রেকিং পথ মানে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সরু সরু সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেবু ও আঙুরের ক্ষেত আর তার নীচেই গাঢ় নীল রঙের ভূমধ্যসাগর।
লাস্পেজিয়া থেকে লঞ্চে পোর্তোফিনো। এখানে গ্রেটা গার্বো, সফিয়া লরেন, লিজ টেলর ও রিচার্ড বার্টনের মতো সেলেব্রিটিরা ছুটি কাটাতে আসতেন, ম্যাডোনা তাঁর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালন করতে এসেছিলেন এখানেই। হোটেলগুলি পাহাড়ের ধাপে ধাপে ফুল দিয়ে সাজানো। ব্যুটিকের দোকানে জামাকাপড় থেকে জিনিসপত্র সবারই আকাশছোঁয়া দাম।
ফ্লোরেন্স (Florence) – রেনেসাঁর জন্মভূমি ইতালি, আর তার কেন্দ্র ছিল ফ্লোরেন্স। ১৩০০ থেকে ১৫০০ শতকের মধ্যে ইতালির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এই ফ্লোরেন্স। ইউরোপকে 'অন্ধকার যুগ' থেকে আলোয় ফিরিয়েছিল ফ্লোরেন্সবাসীর আবিষ্কৃত স্বর্ণমুদ্রা ফ্লোরিন। দান্তে (Dante), পেট্রার্ক (Petrarch) আর বোকাচ্চিওর (Boccaccio) হাত ধরে ইউরোপে লাতিন ভাষার একচ্ছত্র ক্ষমতার বদল ঘটল। দান্তে লিখলেন তাসকান ভাষায়। যা পরবর্তীকালে আধুনিক ইতালীয় ভাষার জন্মদাতা। বোকাচ্চিওর লেখার অনুপ্রেরণায় জিওফ্রে চসার (Geoffrey Chaucer) লিখলেন ইংরেজিতে। ফরাসী, স্প্যানিস এবং সর্বোপরি ইউরোপ জুড়ে চল হল লাতিন ভাষা ও সাহিত্যের।
ফিলিপ্পো ব্রুনেলেস্কি (Filippo Brunelleschi) এবং ব্যাতিস্ত আলবের্তি (Leon Batist'Alberti) সম্ভবত রেঁনেসা এবং নিওক্লাসিকাল আর্কিটেকচারের (Neoclassical Architecture) জন্ম দিলেন এই ফ্লোরেন্সেই। নতুন এই স্থাপত্যকলা প্রভাব ফেলেছিল সারা ইউরোপেই। আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানের সূচনা করলেন আর এক ফ্লোরেন্সবাসী গ্যালিলিও (Gallileo) এবং লিওনার্দো ব্রুনো (Leonardo Bruno)। ম্যাকাইভেলি (Machiavelli) প্রমূখের হাত ধরে জন্ম নিল আধুনিক রাজনৈতিক ধারণা এবং তত্ত্ব। আমেরিগো ভেসপুচ্চির (Amerigo Vespucci) মতো অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবী চিনতে। ফ্লোরেন্সবাসী তোসকানেল্লির(Paulo del Pozzo Toscanelli) আঁকা পৃথিবীর ম্যাপ একসময় পথ দেখিয়েছিল ভাস্কো দ্য গামাকেও। ফ্লোরেন্সেই জন্ম হয় অপেরার। গিয়েত্তো থেকে বতিচেল্লি, মাইকেলেঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি – ইতালির শিল্পকলার সম্রাটদের জন্ম এই শহরেই।
মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ভাস্কর্য 'ডেভিড'(David) থেকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির 'মোনালিসা' এই শহরের অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকায় থাকবে। এখানে বিশ্বের সেরা কিছু শিল্পকলা সমৃদ্ধ চার্চ রয়েছে। যেগুলির মধ্যে অন্যতম ব্রুনেস্কির ডোম, সান মিনিয়াতো আল মন্তে (San Miniato al Monte), সান লরেঞ্জো (San Lorenzo), সান্তা মারিয়া নভেল্লা (Santa Maria Novella), সান্তা ত্রিনিতা (Santa Trinita) ইত্যাদি। রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কয়েকটি আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়াম। আশিটিরও বেশি মিউজিয়ামের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সিটি হল, পালাজো দেল্লা সিনোরিয়া (the Palazzo della Signoria), আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম (Archeological Museum), মিউজিয়াম অফ দ্য হিস্ট্রি অফ সায়েন্স, পালাজো দাভানজাত্তি (the Palazzo Davanzatti), স্টিবার্ট মিউজিয়াম (the Stibbert Museum), মেদিসি চ্যাপেল (Medici Chapels) ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় – বিভিন্ন পর্যটন সংস্থাই আজকাল ইউরোপ প্যাকেজে ইতালির বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়। তবে নিজে কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে যাওয়া অবশ্যই ভালো। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইটেই ইতালি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তবে তার কোনোটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটাও একটা ব্যাপার। ইতালি ট্যুরিজমের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটটির ঠিকানা – http://www.italia.it/en/home.html
রোম ঘুরে দেখার জন্য সারাদিনের বা তিনদিনের টিকিট একবারে কাটা যায়। এতে বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশের টিকিট একসঙ্গেই হয়ে যায়।
খাবার-দাবার - ইতালির জনপ্রিয় খাবার পিত্জা, স্প্যাগেটি, পাস্তা, রিসোতো আর জিলাতো আইসক্রিম তো ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতেই। এছাড়াও পরখ করে দেখতে পারেন কাঁচা পাতলা করে কাটা হ্যাম আর মোজারেলা চিজ যার নাম 'প্রসুতা' আর বাইরেটা বেশ মুচমুচে আর ভেতরে মিষ্টি দেওয়া চিজ যার নাম 'স্কোলিয়া তেলে'। তাছাড়া ইতালির বিখ্যাত ওয়াইন 'চিয়াঁতি' তো আছেই।
ভ্রমণ কাহিনি – অন্য ইতালি || ভিন্ন স্বাদের ইতালি || ভেনিসে একদিন